শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব

এসএসসি ও এইচএসসির জন্য সীমিত পরিসরে খোলার পক্ষে

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েছে শিক্ষা প্রশাসন। কারণ শিক্ষাবিদ, জনস্বাস্থ্যবিদ ও শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এই মুহূর্তে শুধু ‘এসএসসি ও এইচএসসি’ পরীক্ষার্থীদের জন্য সীমিত পরিসরে স্কুল-কলেজ খুলে দেয়ার পক্ষে কিন্তু শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গত ২৬ মে এক সংবাদ সম্মেলনে ১৩ জুন থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়। তবে শিক্ষামন্ত্রী তার অবস্থান কিছুটা পরিবর্তন করে গতকাল জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে তার কাছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার ‘মেসেজ বেশি আছে’। তিনি জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার চাপ নেই।

শিক্ষা প্রশাসনের কয়েক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা এখনই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুরোপুরি খুলে দেয়ার পক্ষে নয়। এজন্য তারা সীমিত পরিসরে ‘এসএসসি ও সমমান এবং এইচএসসি ও সমমান’ পরীক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার প্রস্তাব করেছিলেন কিন্তু শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় একসঙ্গে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পরিকল্পনা প্রকাশ করেন। এতে বিভিন্ন মহল ও অংশীজনের মধ্যে নানা রকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।

বর্তমানে দেশে করোনা সংক্রমণের যে পরিস্থিতি তাতে সীমিত পরিসরে ‘এসএসসি এবং এইচএসসি’ পরীক্ষার্থীদের জন্য স্কুল-কলেজ খুলে দেয়া যায় বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা। তারা বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় ‘জেনারেশন গ্যাপ’ তৈরি হয়ে যাচ্ছে; ‘কিশোর গ্যাং’ তৈরি হচ্ছে; হতাশায় ভোগে পরীক্ষার্থীরা নানা অপরাধে জড়াতে পারে। জানতে চাইলে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব ও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক প্রফেসর শেখ ইকরামুল কবির সংবাদকে বলেন, ‘এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের দু’তিনটি ভাগে ভাগ করে স্কুল-কলেজ খুলে দেয়া উচিত। একটি গ্রুপ আজ স্কুলে এলে, আরেকটি গ্রুপ পরদিন স্কুলে আসবে; এভাবে জরুরিভিত্তিতে পরীক্ষাদের পাঠদান শুরু করা দরকার।’

এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের বয়সও একটু বেশি উল্লেখ করে শেখ ইকরামুল কবির বলেন, ‘এই পরীক্ষার্থীরা নিজে থেকেই স্কুল-কলেজে যাতায়াত করতে পারবে; অভিভাবকদের সঙ্গে আসার প্রয়োজন হবে না কিন্তু কিন্ডারগার্টেন বা প্রাক-প্রাথমিক ও নিম্নমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য এখন পুরোপুরি স্কুল খুলে দিলে ঝুঁকি থেকে যায়। কারণ এদের সঙ্গে অভিভাবকরা যাতায়াত করে থাকেন...স্কুলে ভিড় জমান।’

দেশে গত বছরের ৮ মার্চ প্রথম করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এরপর ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এই করোনা সংক্রমণ কমে আসায় বেশ কয়েকবারই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পরিকল্পনা প্রকাশ করেছেন শিক্ষামন্ত্রী। তবে চলতি বছরের প্রথম দিকে যখন নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় সংক্রমণের হার ৩-৪ শতাংশে নেমেছিল তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

কিন্তু ২৬ মে শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পরিকল্পনা প্রকাশের দিন দেশে করোনা সংক্রমণের হার ছিল ৯ দশমিক ১১ শতাংশ। ওইদিন শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের মধ্যে এলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন।’ গতকালও দেশে করোনা শনাক্তের হার ছিল ৭ দশমিক ৯১ শতাংশ।

সরকারের রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন সংবাদকে বলেন, ‘সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে নামলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া যাবে কিন্তু এর প্রস্তুতি এখনই শুরু করতে হবে। আগাম প্রস্তুতি না থাকলে ৫ শতাংশের নিচে নামার পর আবার সংক্রমণ বেড়ে গেলে তখনও বসে থাকতে হবে। এতে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

একসঙ্গে নয়, পর্যায়ক্রমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পরামর্শ দিয়ে খ্যাতিমান এই জনস্বাস্থ্যবিদ বলেন, ‘একসঙ্গে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যাবে না। বড়দের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আগে খুলতে হবে; সবার শেষে ছোটদের স্কুল খুলতে হবে। কোন কারণে সংক্রমণ বাড়লে তখন পর্যায়ক্রমে প্রতিষ্ঠান বন্ধও করা যাবে।’

ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘এখন ঢাকায় সংক্রমণ কম; এখানে আস্তে আস্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া যায় কিন্তু চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ কয়েকটি জেলায় সংক্রমণ বেশি... সেখানে আরও কিছুদিন বন্ধ থাকুক কিন্তু কয়েকটি জেলায় সংক্রমণের জন্য সবকিছু বন্ধ রাখার প্রয়োজন নেই।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি শিক্ষা বোর্ডের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, ‘বোর্ডের পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়ে ইতোমধ্যে বলা হয়েছে, এই মুহূর্তে এসএসসি ও সমমান এবং এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের পাঠদান ছাড়া অন্যান্য শ্রেণীর পাঠদান নিয়ে ভাবার প্রয়োজন নেই। তারা পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে; অথচ পরীক্ষা সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণাই পাচ্ছে না। সীমিত পরিসরে হলেও এদের ক্লাস নিতে হবে কিন্তু মন্ত্রণালয় সবকিছু একবারে খুলে দিতে চায়; এতে সময় নষ্ট হচ্ছে।’

শিক্ষামন্ত্রীর গতকালের অবস্থান ও শিক্ষক নেতার বক্তব্য

করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া থেকে বন্ধ রাখার ‘মেসেজ’ বেশি আছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি।

তিনি গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে আইনমন্ত্রী প্রয়াত অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরুর স্মরণসভায় অংশ নিয়ে এ কথা জানান।

শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার সব প্রচেষ্টা আছে। যে কোন সময় চাইলে খুলে দেয়া যায়। তবে যারা আন্দোলন করে যাচ্ছেন খুলে দেয়ার জন্য, তাদের মধ্যে সবার মতামত প্রতিফলন হয় না। অনেক অভিভাবক সেখানে কথা বলতে পারেন না। আমার কাছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার থেকে বন্ধ থাকার মেসেজ বেশি আছে।’

দীপু মনি বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার বিষয়ে আমরা যে তারিখই নির্দিষ্ট করি না কেন, অবস্থা অনুকূলে না এলে মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে আমরা ঝুঁকি নেব না।’

সরকারের কাছে শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং অভিভাবক সবার স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘গুরুত্ব দিয়েই আমরা এক বছর দুই মাসের বেশি সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রেখেছি কিন্তু জাতীয় শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ নেই।’

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, বিশেষজ্ঞরা বলেছেন সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে না নামলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া উচিত নয়। ঈদযাত্রার কারণে সংক্রমণের হার আবারও কিছুটা ঊর্ধ্বগামী। ‘আমরা বলেছি ১৩ জুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিতে চাই। আমরা চেষ্টা করব। অনেক জায়গা থেকে চাপ আছে, অনেক আন্দোলনের ডাক আছে। তবে সেটি বৃহত্তর ছাত্র সমাজ বা অভিভাবক যারা আছেন, তাদের মতামত প্রতিফলিত করে না।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’র সভাপতি ও রাজধানীর মিরপুরের ‘সিদ্ধান্ত হাই স্কুলে’র প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম রনি সংবাদকে বলেন, ‘সবকিছু খুলে দিয়ে শুধু স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখা হয়েছে। এটা অযৌক্তিক; এর মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হচ্ছে; শিক্ষার্থীদের অন্ধকারে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।’

এই শিক্ষক নেতা আরও বলেন, ‘বলা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের ঘরে রাখতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। এর কোন যুক্তি নেই। কোন শিক্ষার্থীই ঘরে বসে নেই; এরা রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, হাটবাজারে যাচ্ছে, গ্রামের বাড়িতে ছুটি ভোগ করতে যাচ্ছে-আসছে। যাদের বয়স একটু বেশি তারা নানা রকম অপরাধে জড়াচ্ছে; হতাশায় ভুগছে অথচ শিক্ষকরা নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছেন।’

নজরুল ইসলাম রনি বলেন, ‘আমরা এখনই সবকিছু পুরোপুরি খুলে দেয়ার পক্ষে নয় কিন্তু যারা এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী- এদের পাঠদান থেকে বিরত রাখার মানে কী? এদের শিক্ষাজীবন ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে কেন?’

অনলাইন পাঠদান নিয়ে প্রশ্ন

শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি গতকাল বলেছেন, ‘আমরা অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রেখেছি। যদিও তার সীমাবদ্ধতা আছে, প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। এখন আমরা একটা যুদ্ধের মধ্যে আছি। অনলাইনে পড়াশোনা চলছে। প্রতিদিনের অনলাইন পড়াশোনার মান এবং পরিসর বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আমরা সবাই এতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। সারা পৃথিবীও অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে।’

অনলাইনে পাঠদানের বিষয়ে শিক্ষাবিদ প্রফেসর শেখ ইকরামুল কবির বলেন, ‘জোড়াতালির শিক্ষা দিয়ে পাবলিক পরীক্ষার্থীদের মেধা যাচাই করা যাবে না। এটি শহরকেন্দ্রিক পাঠদান ব্যবস্থা, এই পাঠদানের মাধ্যমে শহর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যে জেনারেশন গ্যাপ তৈরি হচ্ছে। মেধা বিকাশেও বৈষম্য বাড়ছে। গ্রামের শিক্ষার্থীরা দূরের কথা, শিক্ষকরাও এই অনলাইন পাঠের সুবিধা পাচ্ছেন না। কারণ তাদের হাতে স্মার্টফোন সেট নেই; ইন্টারনেট সংযোগও অনেকের নেই।’

রবিবার, ৩০ মে ২০২১ , ১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১৭ শাওয়াল ১৪৪২

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব

এসএসসি ও এইচএসসির জন্য সীমিত পরিসরে খোলার পক্ষে

রাকিব উদ্দিন

image

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে ও শিক্ষার্থীদের টিকার আওতায় আনার দাবিতে গতকাল ঢাবি ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন -সংবাদ

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েছে শিক্ষা প্রশাসন। কারণ শিক্ষাবিদ, জনস্বাস্থ্যবিদ ও শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এই মুহূর্তে শুধু ‘এসএসসি ও এইচএসসি’ পরীক্ষার্থীদের জন্য সীমিত পরিসরে স্কুল-কলেজ খুলে দেয়ার পক্ষে কিন্তু শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গত ২৬ মে এক সংবাদ সম্মেলনে ১৩ জুন থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়। তবে শিক্ষামন্ত্রী তার অবস্থান কিছুটা পরিবর্তন করে গতকাল জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে তার কাছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার ‘মেসেজ বেশি আছে’। তিনি জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার চাপ নেই।

শিক্ষা প্রশাসনের কয়েক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা এখনই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুরোপুরি খুলে দেয়ার পক্ষে নয়। এজন্য তারা সীমিত পরিসরে ‘এসএসসি ও সমমান এবং এইচএসসি ও সমমান’ পরীক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার প্রস্তাব করেছিলেন কিন্তু শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় একসঙ্গে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পরিকল্পনা প্রকাশ করেন। এতে বিভিন্ন মহল ও অংশীজনের মধ্যে নানা রকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।

বর্তমানে দেশে করোনা সংক্রমণের যে পরিস্থিতি তাতে সীমিত পরিসরে ‘এসএসসি এবং এইচএসসি’ পরীক্ষার্থীদের জন্য স্কুল-কলেজ খুলে দেয়া যায় বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা। তারা বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় ‘জেনারেশন গ্যাপ’ তৈরি হয়ে যাচ্ছে; ‘কিশোর গ্যাং’ তৈরি হচ্ছে; হতাশায় ভোগে পরীক্ষার্থীরা নানা অপরাধে জড়াতে পারে। জানতে চাইলে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব ও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক প্রফেসর শেখ ইকরামুল কবির সংবাদকে বলেন, ‘এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের দু’তিনটি ভাগে ভাগ করে স্কুল-কলেজ খুলে দেয়া উচিত। একটি গ্রুপ আজ স্কুলে এলে, আরেকটি গ্রুপ পরদিন স্কুলে আসবে; এভাবে জরুরিভিত্তিতে পরীক্ষাদের পাঠদান শুরু করা দরকার।’

এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের বয়সও একটু বেশি উল্লেখ করে শেখ ইকরামুল কবির বলেন, ‘এই পরীক্ষার্থীরা নিজে থেকেই স্কুল-কলেজে যাতায়াত করতে পারবে; অভিভাবকদের সঙ্গে আসার প্রয়োজন হবে না কিন্তু কিন্ডারগার্টেন বা প্রাক-প্রাথমিক ও নিম্নমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য এখন পুরোপুরি স্কুল খুলে দিলে ঝুঁকি থেকে যায়। কারণ এদের সঙ্গে অভিভাবকরা যাতায়াত করে থাকেন...স্কুলে ভিড় জমান।’

দেশে গত বছরের ৮ মার্চ প্রথম করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এরপর ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এই করোনা সংক্রমণ কমে আসায় বেশ কয়েকবারই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পরিকল্পনা প্রকাশ করেছেন শিক্ষামন্ত্রী। তবে চলতি বছরের প্রথম দিকে যখন নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় সংক্রমণের হার ৩-৪ শতাংশে নেমেছিল তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

কিন্তু ২৬ মে শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পরিকল্পনা প্রকাশের দিন দেশে করোনা সংক্রমণের হার ছিল ৯ দশমিক ১১ শতাংশ। ওইদিন শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের মধ্যে এলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন।’ গতকালও দেশে করোনা শনাক্তের হার ছিল ৭ দশমিক ৯১ শতাংশ।

সরকারের রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন সংবাদকে বলেন, ‘সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে নামলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া যাবে কিন্তু এর প্রস্তুতি এখনই শুরু করতে হবে। আগাম প্রস্তুতি না থাকলে ৫ শতাংশের নিচে নামার পর আবার সংক্রমণ বেড়ে গেলে তখনও বসে থাকতে হবে। এতে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

একসঙ্গে নয়, পর্যায়ক্রমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পরামর্শ দিয়ে খ্যাতিমান এই জনস্বাস্থ্যবিদ বলেন, ‘একসঙ্গে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যাবে না। বড়দের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আগে খুলতে হবে; সবার শেষে ছোটদের স্কুল খুলতে হবে। কোন কারণে সংক্রমণ বাড়লে তখন পর্যায়ক্রমে প্রতিষ্ঠান বন্ধও করা যাবে।’

ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘এখন ঢাকায় সংক্রমণ কম; এখানে আস্তে আস্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া যায় কিন্তু চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ কয়েকটি জেলায় সংক্রমণ বেশি... সেখানে আরও কিছুদিন বন্ধ থাকুক কিন্তু কয়েকটি জেলায় সংক্রমণের জন্য সবকিছু বন্ধ রাখার প্রয়োজন নেই।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি শিক্ষা বোর্ডের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, ‘বোর্ডের পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়ে ইতোমধ্যে বলা হয়েছে, এই মুহূর্তে এসএসসি ও সমমান এবং এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের পাঠদান ছাড়া অন্যান্য শ্রেণীর পাঠদান নিয়ে ভাবার প্রয়োজন নেই। তারা পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে; অথচ পরীক্ষা সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণাই পাচ্ছে না। সীমিত পরিসরে হলেও এদের ক্লাস নিতে হবে কিন্তু মন্ত্রণালয় সবকিছু একবারে খুলে দিতে চায়; এতে সময় নষ্ট হচ্ছে।’

শিক্ষামন্ত্রীর গতকালের অবস্থান ও শিক্ষক নেতার বক্তব্য

করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া থেকে বন্ধ রাখার ‘মেসেজ’ বেশি আছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি।

তিনি গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে আইনমন্ত্রী প্রয়াত অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরুর স্মরণসভায় অংশ নিয়ে এ কথা জানান।

শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার সব প্রচেষ্টা আছে। যে কোন সময় চাইলে খুলে দেয়া যায়। তবে যারা আন্দোলন করে যাচ্ছেন খুলে দেয়ার জন্য, তাদের মধ্যে সবার মতামত প্রতিফলন হয় না। অনেক অভিভাবক সেখানে কথা বলতে পারেন না। আমার কাছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার থেকে বন্ধ থাকার মেসেজ বেশি আছে।’

দীপু মনি বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার বিষয়ে আমরা যে তারিখই নির্দিষ্ট করি না কেন, অবস্থা অনুকূলে না এলে মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে আমরা ঝুঁকি নেব না।’

সরকারের কাছে শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং অভিভাবক সবার স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘গুরুত্ব দিয়েই আমরা এক বছর দুই মাসের বেশি সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রেখেছি কিন্তু জাতীয় শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ নেই।’

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, বিশেষজ্ঞরা বলেছেন সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে না নামলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া উচিত নয়। ঈদযাত্রার কারণে সংক্রমণের হার আবারও কিছুটা ঊর্ধ্বগামী। ‘আমরা বলেছি ১৩ জুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিতে চাই। আমরা চেষ্টা করব। অনেক জায়গা থেকে চাপ আছে, অনেক আন্দোলনের ডাক আছে। তবে সেটি বৃহত্তর ছাত্র সমাজ বা অভিভাবক যারা আছেন, তাদের মতামত প্রতিফলিত করে না।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’র সভাপতি ও রাজধানীর মিরপুরের ‘সিদ্ধান্ত হাই স্কুলে’র প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম রনি সংবাদকে বলেন, ‘সবকিছু খুলে দিয়ে শুধু স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখা হয়েছে। এটা অযৌক্তিক; এর মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হচ্ছে; শিক্ষার্থীদের অন্ধকারে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।’

এই শিক্ষক নেতা আরও বলেন, ‘বলা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের ঘরে রাখতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। এর কোন যুক্তি নেই। কোন শিক্ষার্থীই ঘরে বসে নেই; এরা রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, হাটবাজারে যাচ্ছে, গ্রামের বাড়িতে ছুটি ভোগ করতে যাচ্ছে-আসছে। যাদের বয়স একটু বেশি তারা নানা রকম অপরাধে জড়াচ্ছে; হতাশায় ভুগছে অথচ শিক্ষকরা নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছেন।’

নজরুল ইসলাম রনি বলেন, ‘আমরা এখনই সবকিছু পুরোপুরি খুলে দেয়ার পক্ষে নয় কিন্তু যারা এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী- এদের পাঠদান থেকে বিরত রাখার মানে কী? এদের শিক্ষাজীবন ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে কেন?’

অনলাইন পাঠদান নিয়ে প্রশ্ন

শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি গতকাল বলেছেন, ‘আমরা অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রেখেছি। যদিও তার সীমাবদ্ধতা আছে, প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। এখন আমরা একটা যুদ্ধের মধ্যে আছি। অনলাইনে পড়াশোনা চলছে। প্রতিদিনের অনলাইন পড়াশোনার মান এবং পরিসর বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আমরা সবাই এতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। সারা পৃথিবীও অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে।’

অনলাইনে পাঠদানের বিষয়ে শিক্ষাবিদ প্রফেসর শেখ ইকরামুল কবির বলেন, ‘জোড়াতালির শিক্ষা দিয়ে পাবলিক পরীক্ষার্থীদের মেধা যাচাই করা যাবে না। এটি শহরকেন্দ্রিক পাঠদান ব্যবস্থা, এই পাঠদানের মাধ্যমে শহর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যে জেনারেশন গ্যাপ তৈরি হচ্ছে। মেধা বিকাশেও বৈষম্য বাড়ছে। গ্রামের শিক্ষার্থীরা দূরের কথা, শিক্ষকরাও এই অনলাইন পাঠের সুবিধা পাচ্ছেন না। কারণ তাদের হাতে স্মার্টফোন সেট নেই; ইন্টারনেট সংযোগও অনেকের নেই।’