করোনা উদ্ভূত দারিদ্র্য মোকাবিলায় ক্ষুদ্রঋণের ভূমিকা

মতিউর রহমান ও শিশির রেজা

কভিড-১৯ আমাদের চিরচেনা জগৎটাকে সবদিক দিয়ে অপরিচিত করে দিয়েছে। মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতিতেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এই রোগের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, স্বাস্থ্যগত ও মনস্তাত্ত্বিক অভিঘাত নিয়ে ইতোমধ্যে অনেক গবেষণা হয়েছে। শুধু আর্থিক দিক থেকেই বিবেচনা করলে বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে এই রোগের অভিঘাত ব্যাপকতর। বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ এই ১৫ মাসে নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন। প্রকৃত সংখ্যা হয়ত আরও বেশি।

নবসৃষ্ট এই বিপুল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য মোকাবিলায় ক্ষুদ্রঋণ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষ করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) পরিচালিত ক্ষুদ্রঋণ এক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম নিয়ে সমালোচনা থাকলেও এটি যে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে দেশি-বিদেশি একাধিক গবেষণায় তা প্রমাণিত হয়েছে।

দেশের সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে প্রয়োজনীয় আর্থিক ও সামাজিক উদ্যোগ সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের জীবনমানের উন্নয়ন অর্জন করা সম্ভব। গ্রামাঞ্চলে নারীর উন্নয়ন ও অধিকার আদায়, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগে অর্থায়ন, প্রয়োজনীয় ঋণ প্রদানের মাধ্যমে বিদেশ গমনে সহায়তা প্রদানে এনজিও এবং ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর তাই স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রযাত্রায় যে সেক্টরটি দেশ-বিদেশে রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত তা হলো এদেশের এনজিও এবং ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানসমূহ।

অবশ্য সাধারণ মানুষের কাছে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম এবং জবাবদিহিতা নিয়ে কিছু অস্পষ্টতা রয়েই গেছে। বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনাকারী এনজিওগুলো একটি সরকারি নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি বা এমআরএ) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এমআরএ’র পাশাপাশি আরেকটি সরকারি প্রতিষ্ঠান পিকেএসএফ (পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন) দ্বারাও আংশিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। সুতরাং তাদের একটি জবাবদিহিতা রয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন দাতা সংস্থার সাহায্যে পরিচালিত বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন এনজিওবিষয়ক ব্যুরোতেও নিয়মিত প্রতিবেদন দাখিল ও ছাড়পত্র গ্রহণ করতে হয় কোন কোন সংস্থাকে। সব ক্ষেত্রেই সংস্থাগুলোকে বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন দাখিল করতে হয়। আয়কর অফিসেও সংস্থাগুলোকে নিয়মিত প্রতিবেদন দাখিল করতে হয়। এই নানামুখী ও কঠোর জবাবদিহিতা কাঠামোর মধ্যে আসলে খেয়াল খুশি মতো ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনা করার কোন সুযোগ নেই। সুতরাং ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের খেয়াল খুশিমতো ঋণ প্রদান ও সার্ভিস চার্জ গ্রহণ করছে- এ ধরনের যে একটি ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে তা পুরোপুরি ভিত্তিহীন। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো এখন অনেক বেশি জবাবদিহিতা ও সরকারি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। তবে রেজিস্ট্রেশনবিহীন কিছু অসাধু প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের প্রতারিত করে এ খবরও আমরা জানি, তবে তার সংখ্যা খুবই কম এবং বর্তমানে কঠোর নজরদারির কারণে তা প্রায় কমে এসেছে।

বিগত প্রায় দেড় দশকের আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন নজির নেই। কয়েকটি ব্যতিক্রম উদাহরণ হয়ত আছে। বরং ঋণের টাকা আয়-বর্ধণমূলক কাজে বিনিয়োগ করে লাভবান হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের তদারকি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। ঋণগ্রহীতাদের অনেকেই তাদের দারিদ্রাবস্থা কাটিয়ে উঠে স্বাবলম্বী হয়েছে। যেসব পরিবারে আগে তিনবেলা খাবারের যোগান ছিল না তারা এখন তিনবেলা পেটভরে খেতে পায়। সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারে, অসুস্থ হলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসেবা নিতে পারে, অনেকেই তাদের ঋণের টাকা যথার্থ ব্যবহারের মাধ্যমে লাভবান হয়ে বাড়ি ঘরের উন্নয়ন করেছে, স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের মালিকও হয়েছে। অধিকাংশ পরিবারে বিদ্যুৎ সংযোগ আছে। বিনোদনের জন্য টেলিভিশন আছে এমনকি অনেক পরিবারে ফ্রিজ ব্যবহার করতেও দেখা গেছে। সুতরাং এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, ক্ষুদ্রঋণের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠী তাদের দারিদ্র্য অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন সঠিক কর্মপরিকল্পনা ও ঋণ প্রদানের প্রবাহ ঠিক রাখা।

মহামারী করোনার আঘাতে দরিদ্র ও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দারিদ্র্যের হার আবারও বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় ক্ষুদ্রঋণের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে এবং নবসৃষ্ট দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্রঋণের আওতায় এনে দারিদ্র্য অবস্থা মোকাবিলা করা ও উত্তরণ সম্ভব বলে আমরা মনে করি। বাংলাদেশ সরকার ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ বরাদ্দ দিয়েছে। ফলে, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো করোনার কারণে সৃষ্ট দরিদ্রদের মাঝে নতুন করে স্বল্প সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেছে। ঋণ প্রদানের পাশাপাশি তারা গ্রাহকদের করোনাভাইরাস রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রমও চালিয়ে যাচ্ছে।

তবে এসব সত্ত্বেও ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। অনেক কর্মীই করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন এবং নিয়মিত সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। ফলে অনেক সদস্যের ঋণের টাকা বকেয়া পড়ে যাচ্ছে। অনেক সদস্য ঋণের টাকা নিয়ে স্থানান্তর করছেন ফলে বকেয়া পড়ে যাচ্ছে। কারো কারো আয়-বর্ধণমূলক কর্মকান্ড ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় কিস্তির টাকা নিয়মিত পরিশোধ করতে পারছেন না। এসব কারণে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় কমে যাচ্ছে এবং তারা ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতা প্রদান ও পরিচালন ব্যয় মেটাতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন। সুতরাং এই অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজস্ব কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে হবে এবং সেসঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো আরও নমনীয় হলে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী সংস্থাগুলোর জন্য সুবিধা হবে বলেই প্রতীয়মান হয়।

বাংলাদেশের মোট শ্রমজীবী মানুষের ৮৫ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা ও দক্ষতা সবই আছে। কিন্তু করোনার কারণে তাদের আর্থিক মেরুদন্ড ভেঙে গেছে। এই পরিস্থিতিতে কৃষি ও অকৃষি খাতে যুক্ত এই বিশাল জনশক্তির উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বিনিয়োগ ও জীবনযাপনের জন্য ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম জোরদার করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। সুতরাং কভিড-১৯ উদ্ভূত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য অবস্থা কাটিয়ে উঠতে ক্ষুদ্রঋণ কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। এক্ষেত্রে প্রয়োজন সরকারের উপযুক্ত নীতিগত সহায়তা ও আর্থিক প্রণোদনা।

[লেখক : মতিউর রহমান, গবেষণা পরামর্শক, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এইচডিআরসি);

শিশির রেজা, সহযোগী সদস্য, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি]

রবিবার, ৩০ মে ২০২১ , ১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১৭ শাওয়াল ১৪৪২

করোনা উদ্ভূত দারিদ্র্য মোকাবিলায় ক্ষুদ্রঋণের ভূমিকা

মতিউর রহমান ও শিশির রেজা

কভিড-১৯ আমাদের চিরচেনা জগৎটাকে সবদিক দিয়ে অপরিচিত করে দিয়েছে। মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতিতেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এই রোগের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, স্বাস্থ্যগত ও মনস্তাত্ত্বিক অভিঘাত নিয়ে ইতোমধ্যে অনেক গবেষণা হয়েছে। শুধু আর্থিক দিক থেকেই বিবেচনা করলে বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে এই রোগের অভিঘাত ব্যাপকতর। বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ এই ১৫ মাসে নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন। প্রকৃত সংখ্যা হয়ত আরও বেশি।

নবসৃষ্ট এই বিপুল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য মোকাবিলায় ক্ষুদ্রঋণ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষ করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) পরিচালিত ক্ষুদ্রঋণ এক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম নিয়ে সমালোচনা থাকলেও এটি যে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে দেশি-বিদেশি একাধিক গবেষণায় তা প্রমাণিত হয়েছে।

দেশের সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে প্রয়োজনীয় আর্থিক ও সামাজিক উদ্যোগ সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের জীবনমানের উন্নয়ন অর্জন করা সম্ভব। গ্রামাঞ্চলে নারীর উন্নয়ন ও অধিকার আদায়, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগে অর্থায়ন, প্রয়োজনীয় ঋণ প্রদানের মাধ্যমে বিদেশ গমনে সহায়তা প্রদানে এনজিও এবং ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর তাই স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রযাত্রায় যে সেক্টরটি দেশ-বিদেশে রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত তা হলো এদেশের এনজিও এবং ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানসমূহ।

অবশ্য সাধারণ মানুষের কাছে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম এবং জবাবদিহিতা নিয়ে কিছু অস্পষ্টতা রয়েই গেছে। বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনাকারী এনজিওগুলো একটি সরকারি নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি বা এমআরএ) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এমআরএ’র পাশাপাশি আরেকটি সরকারি প্রতিষ্ঠান পিকেএসএফ (পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন) দ্বারাও আংশিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। সুতরাং তাদের একটি জবাবদিহিতা রয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন দাতা সংস্থার সাহায্যে পরিচালিত বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন এনজিওবিষয়ক ব্যুরোতেও নিয়মিত প্রতিবেদন দাখিল ও ছাড়পত্র গ্রহণ করতে হয় কোন কোন সংস্থাকে। সব ক্ষেত্রেই সংস্থাগুলোকে বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন দাখিল করতে হয়। আয়কর অফিসেও সংস্থাগুলোকে নিয়মিত প্রতিবেদন দাখিল করতে হয়। এই নানামুখী ও কঠোর জবাবদিহিতা কাঠামোর মধ্যে আসলে খেয়াল খুশি মতো ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনা করার কোন সুযোগ নেই। সুতরাং ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের খেয়াল খুশিমতো ঋণ প্রদান ও সার্ভিস চার্জ গ্রহণ করছে- এ ধরনের যে একটি ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে তা পুরোপুরি ভিত্তিহীন। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো এখন অনেক বেশি জবাবদিহিতা ও সরকারি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। তবে রেজিস্ট্রেশনবিহীন কিছু অসাধু প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের প্রতারিত করে এ খবরও আমরা জানি, তবে তার সংখ্যা খুবই কম এবং বর্তমানে কঠোর নজরদারির কারণে তা প্রায় কমে এসেছে।

বিগত প্রায় দেড় দশকের আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন নজির নেই। কয়েকটি ব্যতিক্রম উদাহরণ হয়ত আছে। বরং ঋণের টাকা আয়-বর্ধণমূলক কাজে বিনিয়োগ করে লাভবান হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের তদারকি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। ঋণগ্রহীতাদের অনেকেই তাদের দারিদ্রাবস্থা কাটিয়ে উঠে স্বাবলম্বী হয়েছে। যেসব পরিবারে আগে তিনবেলা খাবারের যোগান ছিল না তারা এখন তিনবেলা পেটভরে খেতে পায়। সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারে, অসুস্থ হলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসেবা নিতে পারে, অনেকেই তাদের ঋণের টাকা যথার্থ ব্যবহারের মাধ্যমে লাভবান হয়ে বাড়ি ঘরের উন্নয়ন করেছে, স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের মালিকও হয়েছে। অধিকাংশ পরিবারে বিদ্যুৎ সংযোগ আছে। বিনোদনের জন্য টেলিভিশন আছে এমনকি অনেক পরিবারে ফ্রিজ ব্যবহার করতেও দেখা গেছে। সুতরাং এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, ক্ষুদ্রঋণের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠী তাদের দারিদ্র্য অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন সঠিক কর্মপরিকল্পনা ও ঋণ প্রদানের প্রবাহ ঠিক রাখা।

মহামারী করোনার আঘাতে দরিদ্র ও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দারিদ্র্যের হার আবারও বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় ক্ষুদ্রঋণের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে এবং নবসৃষ্ট দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্রঋণের আওতায় এনে দারিদ্র্য অবস্থা মোকাবিলা করা ও উত্তরণ সম্ভব বলে আমরা মনে করি। বাংলাদেশ সরকার ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ বরাদ্দ দিয়েছে। ফলে, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো করোনার কারণে সৃষ্ট দরিদ্রদের মাঝে নতুন করে স্বল্প সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেছে। ঋণ প্রদানের পাশাপাশি তারা গ্রাহকদের করোনাভাইরাস রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রমও চালিয়ে যাচ্ছে।

তবে এসব সত্ত্বেও ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। অনেক কর্মীই করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন এবং নিয়মিত সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। ফলে অনেক সদস্যের ঋণের টাকা বকেয়া পড়ে যাচ্ছে। অনেক সদস্য ঋণের টাকা নিয়ে স্থানান্তর করছেন ফলে বকেয়া পড়ে যাচ্ছে। কারো কারো আয়-বর্ধণমূলক কর্মকান্ড ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় কিস্তির টাকা নিয়মিত পরিশোধ করতে পারছেন না। এসব কারণে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় কমে যাচ্ছে এবং তারা ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতা প্রদান ও পরিচালন ব্যয় মেটাতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন। সুতরাং এই অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজস্ব কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে হবে এবং সেসঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো আরও নমনীয় হলে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী সংস্থাগুলোর জন্য সুবিধা হবে বলেই প্রতীয়মান হয়।

বাংলাদেশের মোট শ্রমজীবী মানুষের ৮৫ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা ও দক্ষতা সবই আছে। কিন্তু করোনার কারণে তাদের আর্থিক মেরুদন্ড ভেঙে গেছে। এই পরিস্থিতিতে কৃষি ও অকৃষি খাতে যুক্ত এই বিশাল জনশক্তির উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বিনিয়োগ ও জীবনযাপনের জন্য ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম জোরদার করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। সুতরাং কভিড-১৯ উদ্ভূত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য অবস্থা কাটিয়ে উঠতে ক্ষুদ্রঋণ কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। এক্ষেত্রে প্রয়োজন সরকারের উপযুক্ত নীতিগত সহায়তা ও আর্থিক প্রণোদনা।

[লেখক : মতিউর রহমান, গবেষণা পরামর্শক, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এইচডিআরসি);

শিশির রেজা, সহযোগী সদস্য, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি]