তিস্তার ভাঙনে গৃহহীন হচ্ছে শত শত মানুষ

প্রতিকারের কোন নজর নেই

‘আপনাদের সাংবাদিকদের এখানে আসার দরকার নাই। আমাদের মহব্বত করার দরকার নাই। আপনারা চলে যান, মন্ত্রী, এমপি থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আমরা পাও ধরেছি, তারা কোন সাড়া দেয় নাই। এখন আপনারা আসছেন দুঃখ-দুর্দশা তুলে ধরতে। তার দরকার নাই। তুলে ধরে কী হবে। আমরা তো ভাঙনে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছি। আপনারা চলে যান।’ এভাবে ক্ষোভ ব্যক্ত করলেন কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বজরা ও গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের কাসিমবাজার লকিয়ারপাড় এলাকার ভাঙনকবলিতরা।

গত সোমবার দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কাসিমবাজার এলাকার তিস্তা নদীর ভাঙনের লাইভ চিত্র ছড়িয়ে পড়ার পর সাংবাদিকরা ওই এলাকায় দুর্দশার চিত্র তুলে ধরতে গেলে এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয় গণমাধ্যম কর্মীদের।

স্থানীয় আব্বাস মিয়া (৪৫), হারু মিস্ত্রি (৫২) ও দুলাল দোকানদার জানান, গত তিন বছর থেকে এখানে নদী ভাঙছে। এখন পর্যন্ত সহ¯্রাধিক মানুষ এই নদীর ভাঙনে গৃহহীন হয়েছে। এছাড়াও গত ৪/৫ দিনে প্রায় ৬০টির মতো বাড়ি ভেঙে গেছে। এখনও লোকজন নদীর পাড় থেকে গাছপালা, বাড়িঘর সরাচ্ছে।

কিন্তু কর্তৃপক্ষের কেউই এখানে দুর্দশার চিত্র দেখতে আসেনি। মোবাইল করেও তাদের সাড়া পাওয়া যায়নি। ফলে গৃহহীন মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। গতকাল সকালে সরেজমিনে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ১৫/১৬টি ভাঙনকবলিত পরিবার খোলা আকাশে ছাপড়া তুলে অবস্থান নেয়ার চেষ্টা করছে। রাতে বৃষ্টিতে লেজেগোবরে অবস্থা অন্যদের। প্রশাসন থেকে এখনও কেউ খোঁজ নিতে আসেনি।

কাসিমবাজার নাজিমাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আলতাফ হোসেন রিটায়ার্ডমেন্টের প্রায় ১৫/১৬ লাখ টাকা দিয়ে মনোরম বিল্ডিং বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন, শেষ বয়সে একটু ভালোভাবে থাকার জন্য। সেই বিল্ডিং ঘর এখন তিস্তা নদীর পেটে। ভিটেহারা হয়ে এখন তিনি উলিপুরের তবকপুর ইউনিয়নে মেয়ে জামাইয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।

ওই বাজারের একমাত্র মুচি পরিবার হরিদাস বসতবাড়ি হারিয়ে রাস্তার স্লোপে আশ্রয় নিয়েছেন। একই অবস্থা আব্দুল আউয়াল মাস্টারের বড় ভাই আব্দুর রাজ্জাক ও ছোট ভাই রফিকের। তারা এখন নিঃস্ব হয়ে খোলা আকাশে অবস্থান নিয়েছেন। তাদের বসতবাড়ি, গাছপালা, আবাদি জমিন সব এখন তিস্তা নদীতে মিশে গেছে।

কাসিমবাজার এলাকার গণমাধ্যম কর্মী ফরহাদ হোসেন জানান, গতরাতে বাড়ি ভেঙে রঞ্জুকারি, সাজু বেকারি এখনও জায়গা পাননি। একই অবস্থা ৩৫/৪০টি পরিবারের।

তারা বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে গবাদিপশু ও জিনিসপত্র রেখে এসে এখন আশ্রয়ের জায়গা খুঁজছেন। কেউ কেউ করোনার কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া হাইস্কুল ও মাদ্রাসার ঘরে আশ্রয়ের জন্য দেন-দরবার করছেন। ভিটেমাটি, গাছপালা, জায়গা-জমি হারিয়ে এরা দিশেহারা হয়ে গেছে। মেগা প্রকল্পের নামে এখানে স্বল্পমেয়াদে কাজ করায় তিস্তার তীব্র ভাঙন রোধ করা যাচ্ছে না। ফলে প্রতিবছর শত শত পরিবার নতুনভাবে গৃহহীন হচ্ছে। প্রশাসনের লোকজন আশ^াস দিলেও কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না।

এই মুহূর্তে তিস্তা নদী ভাঙনে হুমকির মুখে রয়েছে কাসিমবাজার হাট, নাজিমাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কাসিমবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, কাসিমবাজার আলিয়া কামিল মাদ্রাসাসহ সহ¯্রাধিক বাড়িঘর।

বিষয়টি নিয়ে বজরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাবুল আমিন জানান, আমার ইউনিয়ন এবং গাইবান্ধার হরিপুর ইউনিয়নের সীমানায় তিস্তা নদী প্রবলভাবে ভাঙছে। দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া না হলে এলাকাবাসী ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে।

এ ব্যাপারে কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম জানান, বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে পানি প্রবাহের ফলে তিস্তা নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারে আমরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে ভাঙন ঠেকাতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

বুধবার, ০২ জুন ২০২১ , ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২০ শাওয়াল ১৪৪২

তিস্তার ভাঙনে গৃহহীন হচ্ছে শত শত মানুষ

প্রতিকারের কোন নজর নেই

জেলা বার্তা পরিবেশক, কুড়িগ্রাম

‘আপনাদের সাংবাদিকদের এখানে আসার দরকার নাই। আমাদের মহব্বত করার দরকার নাই। আপনারা চলে যান, মন্ত্রী, এমপি থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আমরা পাও ধরেছি, তারা কোন সাড়া দেয় নাই। এখন আপনারা আসছেন দুঃখ-দুর্দশা তুলে ধরতে। তার দরকার নাই। তুলে ধরে কী হবে। আমরা তো ভাঙনে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছি। আপনারা চলে যান।’ এভাবে ক্ষোভ ব্যক্ত করলেন কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বজরা ও গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের কাসিমবাজার লকিয়ারপাড় এলাকার ভাঙনকবলিতরা।

গত সোমবার দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কাসিমবাজার এলাকার তিস্তা নদীর ভাঙনের লাইভ চিত্র ছড়িয়ে পড়ার পর সাংবাদিকরা ওই এলাকায় দুর্দশার চিত্র তুলে ধরতে গেলে এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয় গণমাধ্যম কর্মীদের।

স্থানীয় আব্বাস মিয়া (৪৫), হারু মিস্ত্রি (৫২) ও দুলাল দোকানদার জানান, গত তিন বছর থেকে এখানে নদী ভাঙছে। এখন পর্যন্ত সহ¯্রাধিক মানুষ এই নদীর ভাঙনে গৃহহীন হয়েছে। এছাড়াও গত ৪/৫ দিনে প্রায় ৬০টির মতো বাড়ি ভেঙে গেছে। এখনও লোকজন নদীর পাড় থেকে গাছপালা, বাড়িঘর সরাচ্ছে।

কিন্তু কর্তৃপক্ষের কেউই এখানে দুর্দশার চিত্র দেখতে আসেনি। মোবাইল করেও তাদের সাড়া পাওয়া যায়নি। ফলে গৃহহীন মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। গতকাল সকালে সরেজমিনে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ১৫/১৬টি ভাঙনকবলিত পরিবার খোলা আকাশে ছাপড়া তুলে অবস্থান নেয়ার চেষ্টা করছে। রাতে বৃষ্টিতে লেজেগোবরে অবস্থা অন্যদের। প্রশাসন থেকে এখনও কেউ খোঁজ নিতে আসেনি।

কাসিমবাজার নাজিমাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আলতাফ হোসেন রিটায়ার্ডমেন্টের প্রায় ১৫/১৬ লাখ টাকা দিয়ে মনোরম বিল্ডিং বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন, শেষ বয়সে একটু ভালোভাবে থাকার জন্য। সেই বিল্ডিং ঘর এখন তিস্তা নদীর পেটে। ভিটেহারা হয়ে এখন তিনি উলিপুরের তবকপুর ইউনিয়নে মেয়ে জামাইয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।

ওই বাজারের একমাত্র মুচি পরিবার হরিদাস বসতবাড়ি হারিয়ে রাস্তার স্লোপে আশ্রয় নিয়েছেন। একই অবস্থা আব্দুল আউয়াল মাস্টারের বড় ভাই আব্দুর রাজ্জাক ও ছোট ভাই রফিকের। তারা এখন নিঃস্ব হয়ে খোলা আকাশে অবস্থান নিয়েছেন। তাদের বসতবাড়ি, গাছপালা, আবাদি জমিন সব এখন তিস্তা নদীতে মিশে গেছে।

কাসিমবাজার এলাকার গণমাধ্যম কর্মী ফরহাদ হোসেন জানান, গতরাতে বাড়ি ভেঙে রঞ্জুকারি, সাজু বেকারি এখনও জায়গা পাননি। একই অবস্থা ৩৫/৪০টি পরিবারের।

তারা বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে গবাদিপশু ও জিনিসপত্র রেখে এসে এখন আশ্রয়ের জায়গা খুঁজছেন। কেউ কেউ করোনার কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া হাইস্কুল ও মাদ্রাসার ঘরে আশ্রয়ের জন্য দেন-দরবার করছেন। ভিটেমাটি, গাছপালা, জায়গা-জমি হারিয়ে এরা দিশেহারা হয়ে গেছে। মেগা প্রকল্পের নামে এখানে স্বল্পমেয়াদে কাজ করায় তিস্তার তীব্র ভাঙন রোধ করা যাচ্ছে না। ফলে প্রতিবছর শত শত পরিবার নতুনভাবে গৃহহীন হচ্ছে। প্রশাসনের লোকজন আশ^াস দিলেও কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না।

এই মুহূর্তে তিস্তা নদী ভাঙনে হুমকির মুখে রয়েছে কাসিমবাজার হাট, নাজিমাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কাসিমবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, কাসিমবাজার আলিয়া কামিল মাদ্রাসাসহ সহ¯্রাধিক বাড়িঘর।

বিষয়টি নিয়ে বজরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাবুল আমিন জানান, আমার ইউনিয়ন এবং গাইবান্ধার হরিপুর ইউনিয়নের সীমানায় তিস্তা নদী প্রবলভাবে ভাঙছে। দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া না হলে এলাকাবাসী ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে।

এ ব্যাপারে কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম জানান, বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে পানি প্রবাহের ফলে তিস্তা নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারে আমরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে ভাঙন ঠেকাতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।