জাতীয় পরিচয়পত্রের দায়িত্ব পাচ্ছে স্বরাষ্ট্র, ইসির বিরোধিতা

জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) কাজ (নতুন প্রদান এবং সংশোধনী) এখন থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় করবে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত দিয়েছেন বলে জাতিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভাপতি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।

মন্ত্রী বলছেন, জাতীয় পরিচয়পত্রে কাজের কোন ক্যাপাসিটি নেই নির্বাচন কমিশনের। পৃথিবীর কোন দেশেই এ কাজ নির্বাচন কমিশনের কাছে থাকে না। এটি থাকে সাধারণত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতায়। জাতীয় পরিচয়পত্রের কাজ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আসায় মানুষের ভোগান্তি কমবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ এর দায়িত্বে থাকবে। গতকাল আইনশৃঙ্খলা সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভায় এ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে কিছু দিকনির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।

গত কয়েকদিন ধরেই জাতীয় পরিচয়পত্রের দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে দেয়া নিয়ে বিতর্ক চলছিল। অনেকেই জাতীয় পরিচয়পত্রের দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তরের বিরোধিতা করে আসছিল। তাদের ভাষ্য, এটি নির্বাচন কমিশনের কাছেই থাকা দরকার। নির্বাচন কমিশনার এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। তাদের একজন মাহবুব তালুকদার বলছেন নির্বাচন কমিশন থেকে এ কাজ (এনআইডি) সরিয়ে নিলে তা হবে সংবিধানবিরোধী।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইনশৃঙ্খলা সভা শেষে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জানিয়েছেন, আপনারা জানেন এনআইডি আগে নির্বাচন কমিশন করত। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন এটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় করবে। আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কিছু নির্দেশনা দিয়েছি। ওনাদের ক্যাপাসিটি আছে দৈনিক ৫শ’ করার কিন্তু আমরা বলেছি এটি আনলিমিটেড থাকবে। এনআইডি করার কোন সীমারেখা থাকবে না। ক্যাপাসিটি বাড়াতে হবে। কারণ অনেক মানুষের দীর্ঘদিনের পেন্ডিং আছে। আমার নিজেরও অভিজ্ঞতা আছে, আমার অনেক বন্ধু-বান্ধব আমাকে বলেছে তাদের কাজ দীর্ঘদিন ধরে হচ্ছে না।

২০০৭ সালে ছবিযুক্ত ভোটার কার্ড হিসেবে এনআইডির কার্যক্রম শুরু হয়। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটি প্রকল্পে নির্বাচন কমিশনের আওতায় কাজটি শুরু করেছিল সেনাবাহিনী। জালভোট ঠেকাতে ছবিসহ তখন এই কার্ড করা হয়েছিল ভোটার কার্ড হিসেবে। পরে এটিকে জাতীয় পরিচয়পত্র হিসেবে যুক্ত করা হয়। এ কার্ডের সব তথ্য নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে আছে। এখান থেকে ইচ্ছে করলে একজন নাগরিকের পূর্ণ ঠিকানা বের করা সম্ভব। এখন জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, ব্যবসা, চাকরি, পাসপোর্ট ও ভিসাসহ সব ধরনের কাজে দেয়া বাধ্যতামূলক। এমনকি ব্যাংক থেকে টাকা তুলতেও জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রয়োজন হয়। নির্বাচন কমিশন বর্তমানে দেশের ১১ কোটি ১৭ লাখের বেশি নাগরিক ভোটার তালিকাভুক্ত রয়েছে।

ভোটার তালিকার সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়ার কাজটিও হয় ইসির মাধ্যমে। ২০১০ সালে ইসির অধীনে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ একটি আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পায়। এনআইডি কার্যক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে দেয়ার বিষয়ে গত ১৮ মে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের এক চিঠি নির্বাচন কমিশনে পাঠায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। তা নিয়ে আপত্তি ওঠে ইসিতে। তা আগের মতোই ইসির অধীনে রাখার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানোর নির্দেশনাও দেন সিইসি কে এম নূরুল হুদা

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেনের কাছে এনআইডির কাজ স্বরাষ্ট্রে দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সংবাদকে বলেন, এ পরিস্থিতি হ-য-ব-র-ল তৈরি করবে। অবকাঠামো, জনবল ঠিক না করে কীভাবে এনআইডির কাজ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দেয়া হলো তা বোধগম্য নয়। কাজ করবে নির্বাচন কমিশনের লোকজন আর সিল থাকবে সরকারের এটি কীভাবে সম্ভব। হ্যাঁ, এটি নিয়ে আগে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কথা বলা দরকার ছিল। একটি চিঠি দিয়ে এনআইডির কাজ নিয়ে যাওয়া বাস্তবসম্মত নয়। নির্বাচন কমিশন একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। এখন কমিশনের লোক কার কথা শুনবে কমিশনের না সরকারের। তিনি বলেন, এ সিদ্ধান্ত তেলেসমাতি কা- ঘটাবে। কারণ এনআইডির সঙ্গে ভোটার তালিকা যুক্ত।

এনআইডি স্বরাষ্ট্রে গেলে মানুষ দ্রুত সেবা পাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটি তো আমারা পাসপোর্টের ক্ষেত্রেই দেখতে পাচ্ছি। পাসপোর্ট পেতে পুলিশ ভেরিফিকেশন, তদন্ত কত কি। আমার নিজের পাসপোর্ট পেতে ৩ মাস সময় লেগেছে। হ্যাঁ জনবল, অবকাঠামো ঠিক করে এ কাজ তাদের নেয়া উচিত ছিল। আর পৃথিবীর যেসব দেশে এনআইডি আছে তা নির্বাচন কমিশনের কাছেই থাকে।

জাতীয় পরিচয়পত্রের কাজ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তরের বিষয়ে গতকাল নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, জাতীয় পরিচয়পত্র বা এনআইডি অনুবিভাগ জনবলসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্থানান্তরের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ যে নির্দেশ জারি করেছে, তা হচ্ছে নির্বাচনের কফিনে সর্বশেষ পেরেক। ‘কী উদ্দেশ্যে এই আত্মঘাতী ও অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তা আমার বোধগম্য নয়।’ লিখিত বক্তব্যে মাহবুব তালুকদার আরও বলেন, ‘এ সিদ্ধান্ত সংবিধানের ১১৯ ধারার পরিপন্থী। এরইমধ্যে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ এতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আমি তাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করছি।’ তিনি বলেন, ‘মন্ত্রিপরিষদের যুগ্মসচিব স্বাক্ষরিত গত ২৪ মে ২০২১ তারিখের পত্রে এনআইডি হন্তান্তরের প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনের ‘বদলে’ ‘সরকার’ শব্দটি প্রতিস্থাপনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে, এনআইডির বিদ্যমান অবকাঠামো ও জনবল সুরক্ষা সেবা বিভাগে হস্তান্তর করার ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে এ ধরনের নির্দেশ প্রদান কতটা যৌক্তিক তা বিবেচ্য। ভোটার তালিকা ও জাতীয় পরিচয়পত্র অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এর ফলে নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও জাতীয় পরিচয়পত্রের ডাটাবেজনির্ভর ইভিএম পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণে জটিলতার সৃষ্টি হবে। এছাড়া এতে নির্বাচন ব্যবস্থা ও কাক্সিক্ষত গণতন্ত্র ভুলুণ্ঠিত হবে। এটি করা হলে সংবিধানের ১১৯ ধারা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালন সম্ভব হবে না বলে মনে করি। নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে এনআইডি স্থানান্তরের নির্দেশ কমিশনের অঙ্গচ্ছেদের নামান্তর।’

এক প্রশ্নের জবাবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বলেন, পত্র-পত্রিকায়ই দেখেছি ভুল জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের আবেদন জানিয়ে ৩ বছরেও পাননি। আর নির্বাচন কমিশনের সেই ক্যাপাসিটিও নেই। কারণ তারা শুধু ভোটার তালিকা প্রণয়নের কাজ করে থাকেন। তাই মানুষের ভোগান্তি কমাতে এখন থেকে কাজটি করবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। মন্ত্রী বলেন, ‘কোন নাগরিক জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য কিংবা সংশোধনের আবেদন করলে তাকে এক মাসের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানাতে হবে। দেয়া সম্ভব না হলে, কেন দেয়া যাবে না, সেই বিষয়টিও লিখিতভাবে সংশ্লিষ্ট নাগরিককে জানাতে হবে। আমরা একটি জবাবদিহি সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চাই।’ মন্ত্রী বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব ভোটার তালিকা তৈরি করা। জাতীয় পরিচয়পত্র করার মতো সক্ষমতাও তাদের নেই। পৃথিবীর কোন দেশে এমন নিয়মও নেই’ জাতীয় পরিচয়পত্র নির্বাচন কমিশনের হাতে থাকে। পৃথিবীর সব দেশেই জাতীয় পরিচয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে থাকে।

এনআইডি কাজের দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পেলে মানুষের কী লাভ প্রশ্ন করলে মন্ত্রী বলেন, যাতে তারা প্রতিকার পায় বা সময়মতো এনআইডি পায়। আমরা দেখেছি ৩ বছর আগে আবেদন করেও এনআইডি পায়নি। সেটি আর থাকবে না। রোহিঙ্গাদের অনেকেই জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে পাসপোর্ট করে ভিসা নিয়ে বাংলাদেশি পরিচয়ে বিদেশে গেছেন সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে মন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গাদের আর জাতীয় পরিচয়পত্র নেয়ার সুযোগ থাকবে না। আইনিভাবে তাদের সুযোগ কমে গেল। প্রতারণা হবে না এটি বলা যাবে না। ইতোমধ্যে যেসব রোহিঙ্গা জাতীয় পরিচয়পত্র করেছে সেটির সঙ্গে কারা জড়িত সেটি খতিয়ে দেখা হবে।

বৃহস্পতিবার, ০৩ জুন ২০২১ , ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২১ শাওয়াল ১৪৪২

জাতীয় পরিচয়পত্রের দায়িত্ব পাচ্ছে স্বরাষ্ট্র, ইসির বিরোধিতা

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

image

জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) কাজ (নতুন প্রদান এবং সংশোধনী) এখন থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় করবে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত দিয়েছেন বলে জাতিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভাপতি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।

মন্ত্রী বলছেন, জাতীয় পরিচয়পত্রে কাজের কোন ক্যাপাসিটি নেই নির্বাচন কমিশনের। পৃথিবীর কোন দেশেই এ কাজ নির্বাচন কমিশনের কাছে থাকে না। এটি থাকে সাধারণত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতায়। জাতীয় পরিচয়পত্রের কাজ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আসায় মানুষের ভোগান্তি কমবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ এর দায়িত্বে থাকবে। গতকাল আইনশৃঙ্খলা সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভায় এ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে কিছু দিকনির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।

গত কয়েকদিন ধরেই জাতীয় পরিচয়পত্রের দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে দেয়া নিয়ে বিতর্ক চলছিল। অনেকেই জাতীয় পরিচয়পত্রের দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তরের বিরোধিতা করে আসছিল। তাদের ভাষ্য, এটি নির্বাচন কমিশনের কাছেই থাকা দরকার। নির্বাচন কমিশনার এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। তাদের একজন মাহবুব তালুকদার বলছেন নির্বাচন কমিশন থেকে এ কাজ (এনআইডি) সরিয়ে নিলে তা হবে সংবিধানবিরোধী।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইনশৃঙ্খলা সভা শেষে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জানিয়েছেন, আপনারা জানেন এনআইডি আগে নির্বাচন কমিশন করত। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন এটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় করবে। আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কিছু নির্দেশনা দিয়েছি। ওনাদের ক্যাপাসিটি আছে দৈনিক ৫শ’ করার কিন্তু আমরা বলেছি এটি আনলিমিটেড থাকবে। এনআইডি করার কোন সীমারেখা থাকবে না। ক্যাপাসিটি বাড়াতে হবে। কারণ অনেক মানুষের দীর্ঘদিনের পেন্ডিং আছে। আমার নিজেরও অভিজ্ঞতা আছে, আমার অনেক বন্ধু-বান্ধব আমাকে বলেছে তাদের কাজ দীর্ঘদিন ধরে হচ্ছে না।

২০০৭ সালে ছবিযুক্ত ভোটার কার্ড হিসেবে এনআইডির কার্যক্রম শুরু হয়। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটি প্রকল্পে নির্বাচন কমিশনের আওতায় কাজটি শুরু করেছিল সেনাবাহিনী। জালভোট ঠেকাতে ছবিসহ তখন এই কার্ড করা হয়েছিল ভোটার কার্ড হিসেবে। পরে এটিকে জাতীয় পরিচয়পত্র হিসেবে যুক্ত করা হয়। এ কার্ডের সব তথ্য নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে আছে। এখান থেকে ইচ্ছে করলে একজন নাগরিকের পূর্ণ ঠিকানা বের করা সম্ভব। এখন জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, ব্যবসা, চাকরি, পাসপোর্ট ও ভিসাসহ সব ধরনের কাজে দেয়া বাধ্যতামূলক। এমনকি ব্যাংক থেকে টাকা তুলতেও জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রয়োজন হয়। নির্বাচন কমিশন বর্তমানে দেশের ১১ কোটি ১৭ লাখের বেশি নাগরিক ভোটার তালিকাভুক্ত রয়েছে।

ভোটার তালিকার সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়ার কাজটিও হয় ইসির মাধ্যমে। ২০১০ সালে ইসির অধীনে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ একটি আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পায়। এনআইডি কার্যক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে দেয়ার বিষয়ে গত ১৮ মে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের এক চিঠি নির্বাচন কমিশনে পাঠায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। তা নিয়ে আপত্তি ওঠে ইসিতে। তা আগের মতোই ইসির অধীনে রাখার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানোর নির্দেশনাও দেন সিইসি কে এম নূরুল হুদা

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেনের কাছে এনআইডির কাজ স্বরাষ্ট্রে দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সংবাদকে বলেন, এ পরিস্থিতি হ-য-ব-র-ল তৈরি করবে। অবকাঠামো, জনবল ঠিক না করে কীভাবে এনআইডির কাজ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দেয়া হলো তা বোধগম্য নয়। কাজ করবে নির্বাচন কমিশনের লোকজন আর সিল থাকবে সরকারের এটি কীভাবে সম্ভব। হ্যাঁ, এটি নিয়ে আগে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কথা বলা দরকার ছিল। একটি চিঠি দিয়ে এনআইডির কাজ নিয়ে যাওয়া বাস্তবসম্মত নয়। নির্বাচন কমিশন একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। এখন কমিশনের লোক কার কথা শুনবে কমিশনের না সরকারের। তিনি বলেন, এ সিদ্ধান্ত তেলেসমাতি কা- ঘটাবে। কারণ এনআইডির সঙ্গে ভোটার তালিকা যুক্ত।

এনআইডি স্বরাষ্ট্রে গেলে মানুষ দ্রুত সেবা পাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটি তো আমারা পাসপোর্টের ক্ষেত্রেই দেখতে পাচ্ছি। পাসপোর্ট পেতে পুলিশ ভেরিফিকেশন, তদন্ত কত কি। আমার নিজের পাসপোর্ট পেতে ৩ মাস সময় লেগেছে। হ্যাঁ জনবল, অবকাঠামো ঠিক করে এ কাজ তাদের নেয়া উচিত ছিল। আর পৃথিবীর যেসব দেশে এনআইডি আছে তা নির্বাচন কমিশনের কাছেই থাকে।

জাতীয় পরিচয়পত্রের কাজ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তরের বিষয়ে গতকাল নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, জাতীয় পরিচয়পত্র বা এনআইডি অনুবিভাগ জনবলসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্থানান্তরের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ যে নির্দেশ জারি করেছে, তা হচ্ছে নির্বাচনের কফিনে সর্বশেষ পেরেক। ‘কী উদ্দেশ্যে এই আত্মঘাতী ও অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তা আমার বোধগম্য নয়।’ লিখিত বক্তব্যে মাহবুব তালুকদার আরও বলেন, ‘এ সিদ্ধান্ত সংবিধানের ১১৯ ধারার পরিপন্থী। এরইমধ্যে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ এতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আমি তাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করছি।’ তিনি বলেন, ‘মন্ত্রিপরিষদের যুগ্মসচিব স্বাক্ষরিত গত ২৪ মে ২০২১ তারিখের পত্রে এনআইডি হন্তান্তরের প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনের ‘বদলে’ ‘সরকার’ শব্দটি প্রতিস্থাপনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে, এনআইডির বিদ্যমান অবকাঠামো ও জনবল সুরক্ষা সেবা বিভাগে হস্তান্তর করার ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে এ ধরনের নির্দেশ প্রদান কতটা যৌক্তিক তা বিবেচ্য। ভোটার তালিকা ও জাতীয় পরিচয়পত্র অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এর ফলে নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও জাতীয় পরিচয়পত্রের ডাটাবেজনির্ভর ইভিএম পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণে জটিলতার সৃষ্টি হবে। এছাড়া এতে নির্বাচন ব্যবস্থা ও কাক্সিক্ষত গণতন্ত্র ভুলুণ্ঠিত হবে। এটি করা হলে সংবিধানের ১১৯ ধারা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালন সম্ভব হবে না বলে মনে করি। নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে এনআইডি স্থানান্তরের নির্দেশ কমিশনের অঙ্গচ্ছেদের নামান্তর।’

এক প্রশ্নের জবাবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বলেন, পত্র-পত্রিকায়ই দেখেছি ভুল জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের আবেদন জানিয়ে ৩ বছরেও পাননি। আর নির্বাচন কমিশনের সেই ক্যাপাসিটিও নেই। কারণ তারা শুধু ভোটার তালিকা প্রণয়নের কাজ করে থাকেন। তাই মানুষের ভোগান্তি কমাতে এখন থেকে কাজটি করবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। মন্ত্রী বলেন, ‘কোন নাগরিক জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য কিংবা সংশোধনের আবেদন করলে তাকে এক মাসের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানাতে হবে। দেয়া সম্ভব না হলে, কেন দেয়া যাবে না, সেই বিষয়টিও লিখিতভাবে সংশ্লিষ্ট নাগরিককে জানাতে হবে। আমরা একটি জবাবদিহি সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চাই।’ মন্ত্রী বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব ভোটার তালিকা তৈরি করা। জাতীয় পরিচয়পত্র করার মতো সক্ষমতাও তাদের নেই। পৃথিবীর কোন দেশে এমন নিয়মও নেই’ জাতীয় পরিচয়পত্র নির্বাচন কমিশনের হাতে থাকে। পৃথিবীর সব দেশেই জাতীয় পরিচয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে থাকে।

এনআইডি কাজের দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পেলে মানুষের কী লাভ প্রশ্ন করলে মন্ত্রী বলেন, যাতে তারা প্রতিকার পায় বা সময়মতো এনআইডি পায়। আমরা দেখেছি ৩ বছর আগে আবেদন করেও এনআইডি পায়নি। সেটি আর থাকবে না। রোহিঙ্গাদের অনেকেই জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে পাসপোর্ট করে ভিসা নিয়ে বাংলাদেশি পরিচয়ে বিদেশে গেছেন সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে মন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গাদের আর জাতীয় পরিচয়পত্র নেয়ার সুযোগ থাকবে না। আইনিভাবে তাদের সুযোগ কমে গেল। প্রতারণা হবে না এটি বলা যাবে না। ইতোমধ্যে যেসব রোহিঙ্গা জাতীয় পরিচয়পত্র করেছে সেটির সঙ্গে কারা জড়িত সেটি খতিয়ে দেখা হবে।