৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট

চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম হবে কি

করোনায় বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে জীবন-জীবিকার সমীকরণ মেলানোর চ্যালেঞ্জ নিয়ে নতুন অর্থবছরের বাজেট জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এবারের বাজেটের আকার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার যা বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১২ শতাংশ বেশি এবং জিডিপির ১৭.৯ শতাংশের সমান।

গতকাল বিকেলে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের এই বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। তার আগে মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর ওই প্রস্তাবে সই করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।

চলমান করোনা পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে সৃষ্ট ক্ষত পুনরুদ্ধারের কৌশল বিবেচনায় নিয়ে এবং করোনা মোকাবিলার নীতি কৌশল মাথায় নিয়ে বাজেট প্রস্তুত করা অর্থমন্ত্রীর জন্য বেশ চ্যালেঞ্জের ছিল। তারপরও সব শ্রেণীর নাগরিকের মন রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন তিনি। উন্নয়ন ব্যয় বৃদ্ধি করেছেন, অনেক জায়গায় কর ছাড় দিয়েছেন, সামাজিক সুরক্ষার আওতা বৃদ্ধি করেছেন, করোনায় চলমান প্রণোদনা অব্যাহত রেখেছেন, বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির কথা উল্লেখ করেছেন।

‘জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’ শীর্ষক বাজেট উপস্থাপনায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘সমাজের সব শ্রেণীর মানুষকে মাথায় রেখে বাজেট করা হয়েছে। এটা হবে মানুষের জীবন রক্ষার বাজেট। মানুষের জীবিকার রক্ষারও বাজেট এটা। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী থেকে ব্যবসায়ী-শিল্পপতি সবার বাজেট।’

তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থমন্ত্রী এই বাজেটকে জীবন-জীবিকা রক্ষার বাজেট বললেও এটি খুবই গতানুগতিক বাজেট। তার ‘জীবন- জীবিকা’র বাজেটে জীবন রক্ষাকারী করোনা টিকা কীভাবে, কতদিনের মধ্যে সব জনগণ পাবে এবং মানুষের জীবন বাঁচবে, তা উল্লেখ্য নেই আর এই বাজেট তিনি কীভাবে বাস্তবায়ন করবেন এটাই বড় চ্যালেঞ্জ।

করোনা মোকাবিলার জন্য এই গতানুগতিক বাজেট তারা প্রত্যাশা করেননি। আয়-ব্যয়ের মধ্যে নেই সামঞ্জস্য। বাস্তবায়ন নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সব অর্থনীতিবিদই।

অর্থমন্ত্রীর বাজেটকে একেবারে গতানুগতিক মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মইনুল ইসলাম। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘বাজেটে অর্থমন্ত্রীকে খুঁজেই পাওয়া যায়নি। এই পরিস্থিতিতে অর্থনীতি এগিয়ে নিতে কিছু কৌশল অর্থমন্ত্রী গ্রহণ করতে পারতেন কিন্তু এমন কৌশলের ছিটেফোঁটাও নেই।’

একই কথা বলেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি সংবাদকে বলেছেন, ‘মোটা দাগে বললে, এই বাজেট একেবারেই গতানুগতিক। করোনা সংকটের সময় এই বাজেট তেমন কাজে আসবে বলে আমার মনে হয় না। বিশেষ করে, দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা চাঙ্গা করতে প্রতিটি জনগণকে ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে কিন্তু কীভাবে এবং কতদিনের মধ্যে ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসা হবে তার কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। এটা খুবই প্রয়োজন ছিল।’

গতবারের মতো এবারও অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামালকে বাজেট দিতে হয়েছে করোনাভাইরাস মহামারীর সংকটে টিকে থাকার পাশাপাশি অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়ার কঠিন চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে।

বাজেট উপস্থাপনের সময় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, করোনার পরিস্থিতিতে চারটি মূলনীতি অনুসরণ করে বাজেট প্রস্তুত করা হয়েছে। এগুলো হলো, অর্থনীতি চাঙ্গা করতে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি, ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি টেনে তুলতে প্রণোদনা ঘোষণা, সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বৃদ্ধি, বাজারে মুদ্রা সরবরাহ ঠিক রাখা।

এই কৌশল অনুযায়ী, প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতও তৈরি পোশাক খাতের জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা রাখাসহ সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।

এবারের ৬ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকার বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় ১৪ শতাংশ বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। এরই মধ্যে এডিপি অনুমোদন করা হয়েছে। এবার পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা, যা বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত অনুন্নয়ন বাজেটের চেয়ে ১২ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে ৬৯ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধেই যাবে, যা মোট অনুন্নয়ন ব্যয়ের ১৯ শতাংশের বেশি।

এবারের বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয়েছে। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এবারের বাজেট সম্প্রসারণমূলক হওয়ারই প্রয়োজন। হয়েছেও তাই।

‘অর্থের প্রবাহ ঠিক না থাকলে অর্থনীতি চাঙ্গা হবে না। তাই উন্নয়ন ব্যয় বৃদ্ধি করাটা যৌক্তিক।’ বলছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম।

মহামারীর প্রথম ধাক্কা সামলে অর্থনীতির চাকা সচল হতে শুরু করেছিল এ বছর শুরুর দিকে কিন্তু সংক্রমণ সামাল দিতে আবারও সরকারকে লকডাউনের পথে যেতে হয়েছে।

দুই বছর ধরে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাভাবিক গতি না থাকায় রাজস্ব আহরণে লক্ষ্যের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে এনবিআর। অর্থমন্ত্রী আশা করছেন, নতুন অর্থবছরের সম্ভাব্য ব্যয়ের ৬৪ শতাংশ রাজস্ব খাত থেকে আসবে।

প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। এই অংক বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত রাজস্ব আয়ের ১১ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে কর হিসেবে ৩ লাখ ৩০ হাজার ৭৮ কোটি টাকা আদায় করা যাবে বলে আশা করছেন অর্থমন্ত্রী। তাই এনবিআরের কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। টাকার ওই অংক মোট বাজেটের ৫৫ শতাংশের মতো।

তবে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ঘাটতি সমস্যা না। তবে প্রতিবছর রাজস্ব আহরণে এনবিআরের ব্যর্থতা দেশের জন্য ভালো ইঙ্গিত বহন করে না। এক বছর যখন দেখা যাচ্ছে, এনবিআর রাজস্ব আহরণ করতে পারছে না তখন পরের বছরই কেন সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ তৈরি করা হচ্ছে না? বিষয়টি নিয়ে নীতি-নির্ধারকদের ভাবতে হবে।’

গতবারের মতো এবারও সবচেয়ে বেশি কর আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট থেকে, ১ লাখ ২৭ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। এই অংক বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১১ শতাংশের মতো বেশি। বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে ভ্যাট থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা।

লক্ষ্য পূরণ না হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে তা ১ লাখ ১৫ হাজার ২১৭ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। আয়কর ও মুনাফার উপর কর থেকে ১ লাখ ৪ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা রাজস্ব পাওয়ার আশা করা হয়েছে এবারের বাজেটে। বিদায়ী সংশোধিত বাজেটে এর পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা।

নতুন বাজেটে আমদানি শুল্ক থেকে ৩৭ হাজার ৯০৭ কোটি টাকা, সম্পূরক শুল্ক থেকে ৫৪ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা, রপ্তানি শুল্ক থেকে ৫৬ কোটি টাকা, আবগারি শুল্ক থেকে ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা এবং অন্যান্য কর ও শুল্ক থেকে ১ হাজার ৫০ কোটি টাকা আদায়ের পরিকল্পনা করেছেন অর্থমন্ত্রী। এছাড়া বৈদেশিক অনুদান থেকে ৩ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা পাওয়া যাবে বলে বাজেট প্রস্তাবে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন।

বিদায়ী অর্থবছরের মূল বাজেটে মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা, আদায় সন্তোষজনক না হওয়ায় তা সংশোধন করে ৩ লাখ ৫২ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ছিল পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। সংশোধনে তা ৫ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছে।

নতুন অর্থবছরের জন্য অর্থমন্ত্রী যে বাজেট প্রস্তাব সংসদের সামনে তুলে ধরেছেন, তাতে আয় ও ব্যয়ের সামগ্রিক ঘাটতি থাকছে রেকর্ড ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকার মতো, যা মোট জিডিপির ৬.২ শতাংশ।

অবশ্য এই ঘাটতিকে খুবই স্বাভাবিক মনে করছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা পরিচালক বিনায়ক সেন। তিনি বলছেন, ‘মহামারীর সময়ে এই ঘাটতি বেশি নয়। অর্থমন্ত্রী যে বাজেট দিয়েছে তাতে ঘাটতি মোট জিডিপির ৬.২ শতাংশ। সম্প্রতি ভারতের ঘাটতি ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। স্বয়ং আইএমএফ প্রধান বলেছেন, সংকটের সময়ে বাজেট ঘাটতি ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেলেও সমস্যা নাই।’

সাধারণত ঘাটতির পরিমাণ ৫ শতাংশের মধ্যে রেখে বাজেট প্রণয়নের চেষ্টা হয়। তবে মহামারীর সংকটে প্রণোদনার টাকা জোগানোর চাপ থাকায় গতবারের মতো এবারও তা সম্ভব হয়নি। বরাবরের মতোই বাজেট ঘাটতি পূরণে অর্থমন্ত্রীকে নির্ভর করতে হবে অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক ঋণের ওপর।

তিনি আশা করছেন, বিদেশ থেকে ১ লাখ ১ হাজার ২২৮ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা ঋণ করে ওই ঘাটতি তিনি মেটাবেন। অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে ৭৬ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে আরও ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে বাজেটে।

মহামারীর মধ্যেই বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। পরে তা দুই দফা সংশোধন করে ৬ দশমিক ১ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। অর্থমন্ত্রী আশা করছেন, তার নতুন বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারলে মূল্যস্ফীতি ৫.৩ শতাংশের মধ্যে আটকে রেখেই ৭.২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি পাওয়া সম্ভব হবে।

বাজেটে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ ৩৫ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদায়ী বাজেটেও সোয়া লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা রাখা হয়েছিল। এই প্রণোদনার মাধ্যমেই দেশের অর্থনীতিকে বড় ধসের হাত থেকে রক্ষা করেছে।

বাজেটে কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ২০২১ সালের মধ্যে আরও ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। তবে কীভাবে এই কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে তার সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নেই। এমন কর্মসংস্থান সৃষ্টির কথা আগেও অনেক বলা হয়েছে। তবে সেসব প্রকল্প তেমন কাজে এসেছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

এবারের বাজেটে বলা হয়েছে, দেশের জনসংখ্যার ৫০ শতাংশের অধিক তরুণ। এই হার উন্নত বিশ্বে ২০-২৫ শতাংশের বেশি নয়। এ ছাড়া প্রতি বছর ২০ লক্ষাধিক মানুষ আমাদের শ্রম বাজারে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। এছাড়াও আরও কিছু প্রকল্পের কথা উল্লেখ করা হয়।

শুক্রবার, ০৪ জুন ২০২১ , ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২২ শাওয়াল ১৪৪২

৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট

চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম হবে কি

রেজাউল করিম

image

করোনায় বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে জীবন-জীবিকার সমীকরণ মেলানোর চ্যালেঞ্জ নিয়ে নতুন অর্থবছরের বাজেট জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এবারের বাজেটের আকার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার যা বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১২ শতাংশ বেশি এবং জিডিপির ১৭.৯ শতাংশের সমান।

গতকাল বিকেলে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের এই বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। তার আগে মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর ওই প্রস্তাবে সই করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।

চলমান করোনা পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে সৃষ্ট ক্ষত পুনরুদ্ধারের কৌশল বিবেচনায় নিয়ে এবং করোনা মোকাবিলার নীতি কৌশল মাথায় নিয়ে বাজেট প্রস্তুত করা অর্থমন্ত্রীর জন্য বেশ চ্যালেঞ্জের ছিল। তারপরও সব শ্রেণীর নাগরিকের মন রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন তিনি। উন্নয়ন ব্যয় বৃদ্ধি করেছেন, অনেক জায়গায় কর ছাড় দিয়েছেন, সামাজিক সুরক্ষার আওতা বৃদ্ধি করেছেন, করোনায় চলমান প্রণোদনা অব্যাহত রেখেছেন, বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির কথা উল্লেখ করেছেন।

‘জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’ শীর্ষক বাজেট উপস্থাপনায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘সমাজের সব শ্রেণীর মানুষকে মাথায় রেখে বাজেট করা হয়েছে। এটা হবে মানুষের জীবন রক্ষার বাজেট। মানুষের জীবিকার রক্ষারও বাজেট এটা। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী থেকে ব্যবসায়ী-শিল্পপতি সবার বাজেট।’

তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থমন্ত্রী এই বাজেটকে জীবন-জীবিকা রক্ষার বাজেট বললেও এটি খুবই গতানুগতিক বাজেট। তার ‘জীবন- জীবিকা’র বাজেটে জীবন রক্ষাকারী করোনা টিকা কীভাবে, কতদিনের মধ্যে সব জনগণ পাবে এবং মানুষের জীবন বাঁচবে, তা উল্লেখ্য নেই আর এই বাজেট তিনি কীভাবে বাস্তবায়ন করবেন এটাই বড় চ্যালেঞ্জ।

করোনা মোকাবিলার জন্য এই গতানুগতিক বাজেট তারা প্রত্যাশা করেননি। আয়-ব্যয়ের মধ্যে নেই সামঞ্জস্য। বাস্তবায়ন নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সব অর্থনীতিবিদই।

অর্থমন্ত্রীর বাজেটকে একেবারে গতানুগতিক মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মইনুল ইসলাম। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘বাজেটে অর্থমন্ত্রীকে খুঁজেই পাওয়া যায়নি। এই পরিস্থিতিতে অর্থনীতি এগিয়ে নিতে কিছু কৌশল অর্থমন্ত্রী গ্রহণ করতে পারতেন কিন্তু এমন কৌশলের ছিটেফোঁটাও নেই।’

একই কথা বলেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি সংবাদকে বলেছেন, ‘মোটা দাগে বললে, এই বাজেট একেবারেই গতানুগতিক। করোনা সংকটের সময় এই বাজেট তেমন কাজে আসবে বলে আমার মনে হয় না। বিশেষ করে, দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা চাঙ্গা করতে প্রতিটি জনগণকে ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে কিন্তু কীভাবে এবং কতদিনের মধ্যে ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসা হবে তার কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। এটা খুবই প্রয়োজন ছিল।’

গতবারের মতো এবারও অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামালকে বাজেট দিতে হয়েছে করোনাভাইরাস মহামারীর সংকটে টিকে থাকার পাশাপাশি অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়ার কঠিন চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে।

বাজেট উপস্থাপনের সময় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, করোনার পরিস্থিতিতে চারটি মূলনীতি অনুসরণ করে বাজেট প্রস্তুত করা হয়েছে। এগুলো হলো, অর্থনীতি চাঙ্গা করতে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি, ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি টেনে তুলতে প্রণোদনা ঘোষণা, সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বৃদ্ধি, বাজারে মুদ্রা সরবরাহ ঠিক রাখা।

এই কৌশল অনুযায়ী, প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতও তৈরি পোশাক খাতের জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা রাখাসহ সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।

এবারের ৬ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকার বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় ১৪ শতাংশ বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। এরই মধ্যে এডিপি অনুমোদন করা হয়েছে। এবার পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা, যা বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত অনুন্নয়ন বাজেটের চেয়ে ১২ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে ৬৯ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধেই যাবে, যা মোট অনুন্নয়ন ব্যয়ের ১৯ শতাংশের বেশি।

এবারের বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয়েছে। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এবারের বাজেট সম্প্রসারণমূলক হওয়ারই প্রয়োজন। হয়েছেও তাই।

‘অর্থের প্রবাহ ঠিক না থাকলে অর্থনীতি চাঙ্গা হবে না। তাই উন্নয়ন ব্যয় বৃদ্ধি করাটা যৌক্তিক।’ বলছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম।

মহামারীর প্রথম ধাক্কা সামলে অর্থনীতির চাকা সচল হতে শুরু করেছিল এ বছর শুরুর দিকে কিন্তু সংক্রমণ সামাল দিতে আবারও সরকারকে লকডাউনের পথে যেতে হয়েছে।

দুই বছর ধরে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাভাবিক গতি না থাকায় রাজস্ব আহরণে লক্ষ্যের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে এনবিআর। অর্থমন্ত্রী আশা করছেন, নতুন অর্থবছরের সম্ভাব্য ব্যয়ের ৬৪ শতাংশ রাজস্ব খাত থেকে আসবে।

প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। এই অংক বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত রাজস্ব আয়ের ১১ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে কর হিসেবে ৩ লাখ ৩০ হাজার ৭৮ কোটি টাকা আদায় করা যাবে বলে আশা করছেন অর্থমন্ত্রী। তাই এনবিআরের কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। টাকার ওই অংক মোট বাজেটের ৫৫ শতাংশের মতো।

তবে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ঘাটতি সমস্যা না। তবে প্রতিবছর রাজস্ব আহরণে এনবিআরের ব্যর্থতা দেশের জন্য ভালো ইঙ্গিত বহন করে না। এক বছর যখন দেখা যাচ্ছে, এনবিআর রাজস্ব আহরণ করতে পারছে না তখন পরের বছরই কেন সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ তৈরি করা হচ্ছে না? বিষয়টি নিয়ে নীতি-নির্ধারকদের ভাবতে হবে।’

গতবারের মতো এবারও সবচেয়ে বেশি কর আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট থেকে, ১ লাখ ২৭ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। এই অংক বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১১ শতাংশের মতো বেশি। বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে ভ্যাট থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা।

লক্ষ্য পূরণ না হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে তা ১ লাখ ১৫ হাজার ২১৭ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। আয়কর ও মুনাফার উপর কর থেকে ১ লাখ ৪ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা রাজস্ব পাওয়ার আশা করা হয়েছে এবারের বাজেটে। বিদায়ী সংশোধিত বাজেটে এর পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা।

নতুন বাজেটে আমদানি শুল্ক থেকে ৩৭ হাজার ৯০৭ কোটি টাকা, সম্পূরক শুল্ক থেকে ৫৪ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা, রপ্তানি শুল্ক থেকে ৫৬ কোটি টাকা, আবগারি শুল্ক থেকে ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা এবং অন্যান্য কর ও শুল্ক থেকে ১ হাজার ৫০ কোটি টাকা আদায়ের পরিকল্পনা করেছেন অর্থমন্ত্রী। এছাড়া বৈদেশিক অনুদান থেকে ৩ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা পাওয়া যাবে বলে বাজেট প্রস্তাবে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন।

বিদায়ী অর্থবছরের মূল বাজেটে মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা, আদায় সন্তোষজনক না হওয়ায় তা সংশোধন করে ৩ লাখ ৫২ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ছিল পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। সংশোধনে তা ৫ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছে।

নতুন অর্থবছরের জন্য অর্থমন্ত্রী যে বাজেট প্রস্তাব সংসদের সামনে তুলে ধরেছেন, তাতে আয় ও ব্যয়ের সামগ্রিক ঘাটতি থাকছে রেকর্ড ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকার মতো, যা মোট জিডিপির ৬.২ শতাংশ।

অবশ্য এই ঘাটতিকে খুবই স্বাভাবিক মনে করছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা পরিচালক বিনায়ক সেন। তিনি বলছেন, ‘মহামারীর সময়ে এই ঘাটতি বেশি নয়। অর্থমন্ত্রী যে বাজেট দিয়েছে তাতে ঘাটতি মোট জিডিপির ৬.২ শতাংশ। সম্প্রতি ভারতের ঘাটতি ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। স্বয়ং আইএমএফ প্রধান বলেছেন, সংকটের সময়ে বাজেট ঘাটতি ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেলেও সমস্যা নাই।’

সাধারণত ঘাটতির পরিমাণ ৫ শতাংশের মধ্যে রেখে বাজেট প্রণয়নের চেষ্টা হয়। তবে মহামারীর সংকটে প্রণোদনার টাকা জোগানোর চাপ থাকায় গতবারের মতো এবারও তা সম্ভব হয়নি। বরাবরের মতোই বাজেট ঘাটতি পূরণে অর্থমন্ত্রীকে নির্ভর করতে হবে অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক ঋণের ওপর।

তিনি আশা করছেন, বিদেশ থেকে ১ লাখ ১ হাজার ২২৮ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা ঋণ করে ওই ঘাটতি তিনি মেটাবেন। অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে ৭৬ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে আরও ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে বাজেটে।

মহামারীর মধ্যেই বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। পরে তা দুই দফা সংশোধন করে ৬ দশমিক ১ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। অর্থমন্ত্রী আশা করছেন, তার নতুন বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারলে মূল্যস্ফীতি ৫.৩ শতাংশের মধ্যে আটকে রেখেই ৭.২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি পাওয়া সম্ভব হবে।

বাজেটে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ ৩৫ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদায়ী বাজেটেও সোয়া লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা রাখা হয়েছিল। এই প্রণোদনার মাধ্যমেই দেশের অর্থনীতিকে বড় ধসের হাত থেকে রক্ষা করেছে।

বাজেটে কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ২০২১ সালের মধ্যে আরও ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। তবে কীভাবে এই কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে তার সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নেই। এমন কর্মসংস্থান সৃষ্টির কথা আগেও অনেক বলা হয়েছে। তবে সেসব প্রকল্প তেমন কাজে এসেছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

এবারের বাজেটে বলা হয়েছে, দেশের জনসংখ্যার ৫০ শতাংশের অধিক তরুণ। এই হার উন্নত বিশ্বে ২০-২৫ শতাংশের বেশি নয়। এ ছাড়া প্রতি বছর ২০ লক্ষাধিক মানুষ আমাদের শ্রম বাজারে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। এছাড়াও আরও কিছু প্রকল্পের কথা উল্লেখ করা হয়।