চার জেলায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে, বাড়ছে সীমান্তে

সাতক্ষীরায় ঢিলেঢালা লকডাউন

ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে দৈনিক নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে করোনা শনাক্তের হার ৫ থেকে ৭ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে। দেশে প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় সংক্রমণ যখন পিকে (চূড়ায়) ছিল তখন এই চার জেলায় শনাক্তের হার ছিল সবচেয়ে বেশি। গত ঈদের (১৪ মে) পর থেকে সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ কয়েকটি জেলায় সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে ১৫টির বেশি সীমান্ত জেলায় ‘উচ্চ’ সংক্রমণ হচ্ছে।

সারাদেশে গতকাল গড় শনাক্তের হার ছিল ১১ শতাংশের বেশি। আর সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সংক্রমণের হার ২০ শতাংশের বেশি। সীমান্ত জেলায় ‘উচ্চ সংক্রমণ’ এবং করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট (ধরন) আশপাশের জেলাও ছড়িয়ে পড়ছে। এতে অন্যান্য জেলায় সংক্রমণ পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা।

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, সংক্রমণ পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার আগেই নমুনা পরীক্ষার আওতা বাড়িয়ে সব রোগী দ্রুত শনাক্ত করতে হবে। এরপর তাদের চিকিৎসা, আইসোলেশন এবং তাদের সংস্পর্শে আসা লোকজনের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে হবে। উচ্চ সংক্রমিত জেলাগুলোতে মানুষের চলাচল, যানবাহন ও হাটবাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলোতে এখন সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. নাসিমা সুলতানা গতকাল সংবাদকে জানান, সীমান্তবর্তী কয়েকটি জেলায় সংক্রমণ হার বেশি। এ কারণে জাতীয়ভাবে শনাক্তের হার একটি বেশি দেখাচ্ছে।

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্যবিদ প্রফেসর ডা. বেনজির আহমেদ সংবাদকে বলেন, ‘সীমন্তবর্তী জেলাগুলোতে প্রথম সংক্রমণ শনাক্তের পরপরই প্রশাসনের আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল, কঠোর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আমরা দেখেছি, যখন সংক্রমণ আশপাশের জেলায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, তখনও যথাযথ ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এ কারণে স্থানীয়ভাবে সংক্রমণ অনেক বেড়ে গেছে, একই সঙ্গে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টও ছড়িয়ে পড়ছে।’

এই মুহূর্তে সংক্রমণ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কী, জানতে চাইলে আইইডিসিআর’র সাবেক এই প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, ‘এখন যদি কেইস টু কেইস অর্থাৎ প্রত্যেক রোগীকে দ্রুত শনাক্ত করে আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসা দেয়া যায়, ভারত থেকে যারা আসছেন তাদের কোয়ারেন্টিন এবং আক্রান্তদের সংস্পর্শে যারা আসছেন তাদের সবার কোয়ারেন্টিন করা যায় তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। তবে এই মুহূর্তে সীমান্ত জেলাগুলোতে যা পরিস্থিতি তাতে মনে হয়, আমাদের আরও মৃত্যুর জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গত ৮ মে প্রথম জানায়, ভারত থেকে আসা তিন বাংলাদেশির দেহে করোনার ভারতীয় ধরন (বি.১.৬.৭) শনাক্ত হয়েছে। এ পর্যন্ত ঠিক কতজনের দেহে করোনার ভারতীয় ধরন সংক্রমণ ঘটিয়েছে সে সর্ম্পকে পূর্ণাঙ্গ কোন গবেষণা হয়নি।

ঢাকার সিভিল সার্জন ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘ঢাকায় এখন সংক্রমণের হার ৫ থেকে ৬ শতাংশের নিচে রয়েছে। এখানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে বলা যায়।’

নারায়ণগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইমতিয়াজ গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘জেলায় করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আজ (গতকাল) মাত্র চারজন রোগী শনাক্ত হয়েছে। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে এখানে করোনা শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে রয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরেই শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে রয়েছে।’

সংবাদের গাজীপুর প্রতিনিধি গতকাল জানিয়েছেন, গত একদিনে জেলায় ১৯৮ জনের নমুনা পরীক্ষায় ১৫ জনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ। আর এ পর্যন্ত জেলায় মোট ১১ হাজার ৩৬৩ জনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এ হিসাবে মোট শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ। গাজীপুরে করোনায় এ পর্যন্ত ২১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।

সংবাদের চট্টগ্রাম ব্যুরো অভিস জানিয়েছে, চট্টগ্রামে গত ৪০ দিনে করোনায় মারা গেছেন ১১৯ জন। এ নিয়ে করোনা আক্রান্ত চট্টগ্রামে মৃতের সংখ্যা ৬শ’র ওপরে ছাড়িয়েছে।

গত তিনদিনে করোনায় কেউ মৃত্যুবরণ না করলেও শুধুমাত্র গত ৯ দিনে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে চট্টগ্রামে। গত ২৬ এপ্রিলের প্রতিবেদনে আগের ২৪ ঘণ্টায় মোট ৫০৪ জনের মত্যুর তথ্য দিয়েছিল জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়। এর মধ্য দিয়ে মৃতের সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়ে যায়, এর সঙ্গে একমাস ১০ দিনের মাথায় এসে যুক্ত হয়েছেন আরও ১১৯ জন। করোনায় সর্বমোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬১৯ জনের মতো।

অন্যদিকে করোনা আক্রান্ত হয়ে শুধুমাত্র গত ৯ দিনে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে গত ২ জুন ৩ জন, ৩১ মে ৪ জন, ৩০ মে ৫ জন, ২৯ মে ১ জন, ২৮মে ৪ জন, ২৬ মে ২ জন।

চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত মোট আক্রান্ত ৫৩ হাজার ৯৪২ জন। গতকাল করোনায় মত্যুবরণ করেনি কেউ। জেলা সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি জানান, ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে ৯৯১টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এতে আক্রান্ত হয়েছেন ৯৭ জন। নতুন আক্রান্তদের মধ্যে নগরে ৪৫ জন এবং উপজেলায় ৫২ জন।

সীমান্ত জেলায় এখনও বাড়ছে সংক্রমণ

ভারত সীমান্তবর্র্তী ২৯টি জেলা রয়েছে। এর মধ্যে ২২টি জেলায় সংক্রমণ বাড়ছে। তবে ১৫টি জেলায় ‘দ্রুতগতিতে’ বাড়ছে করোনা সংক্রমণ।

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, এখনই সতর্ক হয়ে কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়া হলে পরিস্থিতি আবার খারাপের দিকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

খুলনায় গত ৩০ মে থেকে গতকাল পর্যন্ত এক হাজার ৯৩৪টি নমুনা পরীক্ষায় ৪৭৫ জনের করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার প্রায় ২৫ শতাংশ। এর আগের সপ্তাহে শনাক্তের হার ছিল ২০ শতাংশ। খুলনায় গতকাল পর্যন্ত ৯৬ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন।

রাজশাহী জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের গতকালের তথ্য অনুযায়ী, গত একদিনে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসাপাতালে ২৬৫ জনের নমুনা পরীক্ষায় ১৩১ জনের সংক্রমণ পাওয়া গেছে। নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ৪৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ।

এদিকে নওগাঁ জেলায় সংক্রমণ কিছুটা কমেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় মাত্র দু’জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে। তারা নওগাঁ পৌরসভার হাট-নওগাঁ এলাকার বাসিন্দা।

নওগাঁ সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় গত ২০ মে থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ৪৯৫টি নমুনা পরীক্ষায় ১৫৯ জনের করোনা শনাক্ত হয়। শনাক্তের হার ৩২ দশমিক ১২ শতাংশ। গত মঙ্গলবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তিনদিনে ১৭৯টি নমুনা পরীক্ষায় ৪৭ জনের করোনা পাওয়া গেছে। শনাক্তের হার ২৬ দশমিক ২৫ শতাংশ।

এছাড়া সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, যশোর, নাটোর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, সিলেটসহ অন্যান্য সীমান্ত জেলায় করোনা ছড়িয়ে পড়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু ও শনাক্তের হার বেড়েছে

গতকাল বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় ৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই সময়ে এক হাজার ৪৪৭ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে।

এ নিয়ে দেশে মোট করোনা শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়ালো আট লাখ ৯ হাজার ৩১৪। আর মোট মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ১২ হাজার ৮০১ জনে।

গত একদিনে ১৩ হাজার ১১৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ১১ দশমিক ০৩ শতাংশ। এর আগের দিন শনাক্তের হার ছিল ১০ দশমিক ৪০। গত ৩৯ দিনের মধ্যে গতকাল শনাক্তের হার সবচেয়ে বেশি ছিল।

গত একদিনে সুস্থ হয়েছেন এক হাজার ৬৬৭ জন। এ পর্যন্ত মোট করোনা থেকে সুস্থ হয়েছেন সাত লাখ ৪৯ হাজার ৪২৫ জন। মোট সুস্থতার হার ৯২ দশমিক ৬০ শতাংশ।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী, কোন দেশে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে কিনা, সে সর্ম্পকে ধারণা পাওয়ার একটি নির্দেশক হলো নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে রোগী শনাক্তের হার। কোন দেশে টানা দুই থেকে তিন সপ্তাহ নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে ধরা যায়।

সাতক্ষীরায় ঢিলেঢালা লকডাউন

সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরায় বিধিনিষেধের মধ্যে ও কিছু কিছু দোকানপাট খুলতে দেখা গেছে। অবাধে চলাচল করতে দেখা গেছে নসিমন-করিমন-ভটভটি-ইজিবাইকসহ সব বৈধ-অবৈধ যানবাহন। কাঁচা বাজারগুলোতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না অধিকাংশ ক্রেতা বিক্রেতা। জেলায় করোনা সংক্রমণ কমাতে প্রশাসনকে আরও তৎপর হওয়ার তাগিদ স্থানীয়দের।

শহরের হাসপাতাল মোড়, শহীদ আলাউদ্দীন চত্বরসহ প্রধান-প্রধান এলাকাগুলোতে সকাল থেকেই অবাধে চলছে ইজিবাই-মাহেন্দ্র-নসিমনসহ বিভিন্ন প্রকার বৈধ-অবৈধ যানবাহন। এমনকি সাতক্ষীরা-খুলনা মহাসড়কে বাস চলাচল করতে দেখা গেছে। সুলতানপুর বড় বাজার-মিলবাজার-টাউন বাজারসহ বিভিন্ন কাচাবাজারে উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। সামাজিক দূরত্ব মানার বালাই ছিল না অধিকাংশ ক্রেতা-বিক্রেতার।

বাগের হাটে

আরও ২ জনের মৃত্যু

বাগেরহাট : বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ ও শরণখোলায় করোনা আক্রান্ত হয়ে দুই বৃদ্ধ মারা গেছেন। গতকাল বেলা ১১টায় মোড়েলগঞ্জ উপজেলার ভাষান্দল গ্রামে করোনায় আক্রান্ত আবদুল ওহাব শেখ (৬৫) নিজ বাড়িতে মারা যান। আর শরণখোলা উপজেলার উত্তর রাজাপুর গ্রামের নুর ইসলাম হাওলাদার (৭০) নামের এক বৃদ্ধ শুক্রবার রাতে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। এ নিয়ে জেলায় গতকাল পর্যন্ত করোনা সংক্রমণে মোট মারা গেছেন ৪৮ জন।

দিনাজপুরে টিকার মজুদ শেষ

দিনাজপুর : দিনাজপুর জেলায় কোভিড-১৯ টিকার মজুদ শেষ হওয়ায় পরবর্র্তী ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত কোভিড-১৯ টিকাদান কার্যক্রম বন্ধ থাকবে বলে জানান সিভিল সার্জন।

দিনাজপুরে কোভিড-১৯ সংক্রমণ সংক্রান্ত নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সিভিল সার্জন ডা. আবদুল কুদ্দুছ জানান, গতকাল করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন আরও ৩ জন। এদের মধ্যে ১ জন সদর উপজেলার, ১ জন বিরল উপজেলার ও ১ জন বিরামপুর উপজেলার বাসিন্দা। এ নিয়ে জেলায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ১৩৪ জনে।

রবিবার, ০৬ জুন ২০২১ , ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২৪ শাওয়াল ১৪৪২

চার জেলায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে, বাড়ছে সীমান্তে

সাতক্ষীরায় ঢিলেঢালা লকডাউন

image

ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে দৈনিক নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে করোনা শনাক্তের হার ৫ থেকে ৭ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে। দেশে প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় সংক্রমণ যখন পিকে (চূড়ায়) ছিল তখন এই চার জেলায় শনাক্তের হার ছিল সবচেয়ে বেশি। গত ঈদের (১৪ মে) পর থেকে সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ কয়েকটি জেলায় সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে ১৫টির বেশি সীমান্ত জেলায় ‘উচ্চ’ সংক্রমণ হচ্ছে।

সারাদেশে গতকাল গড় শনাক্তের হার ছিল ১১ শতাংশের বেশি। আর সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সংক্রমণের হার ২০ শতাংশের বেশি। সীমান্ত জেলায় ‘উচ্চ সংক্রমণ’ এবং করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট (ধরন) আশপাশের জেলাও ছড়িয়ে পড়ছে। এতে অন্যান্য জেলায় সংক্রমণ পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা।

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, সংক্রমণ পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার আগেই নমুনা পরীক্ষার আওতা বাড়িয়ে সব রোগী দ্রুত শনাক্ত করতে হবে। এরপর তাদের চিকিৎসা, আইসোলেশন এবং তাদের সংস্পর্শে আসা লোকজনের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে হবে। উচ্চ সংক্রমিত জেলাগুলোতে মানুষের চলাচল, যানবাহন ও হাটবাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলোতে এখন সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. নাসিমা সুলতানা গতকাল সংবাদকে জানান, সীমান্তবর্তী কয়েকটি জেলায় সংক্রমণ হার বেশি। এ কারণে জাতীয়ভাবে শনাক্তের হার একটি বেশি দেখাচ্ছে।

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্যবিদ প্রফেসর ডা. বেনজির আহমেদ সংবাদকে বলেন, ‘সীমন্তবর্তী জেলাগুলোতে প্রথম সংক্রমণ শনাক্তের পরপরই প্রশাসনের আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল, কঠোর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আমরা দেখেছি, যখন সংক্রমণ আশপাশের জেলায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, তখনও যথাযথ ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এ কারণে স্থানীয়ভাবে সংক্রমণ অনেক বেড়ে গেছে, একই সঙ্গে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টও ছড়িয়ে পড়ছে।’

এই মুহূর্তে সংক্রমণ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কী, জানতে চাইলে আইইডিসিআর’র সাবেক এই প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, ‘এখন যদি কেইস টু কেইস অর্থাৎ প্রত্যেক রোগীকে দ্রুত শনাক্ত করে আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসা দেয়া যায়, ভারত থেকে যারা আসছেন তাদের কোয়ারেন্টিন এবং আক্রান্তদের সংস্পর্শে যারা আসছেন তাদের সবার কোয়ারেন্টিন করা যায় তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। তবে এই মুহূর্তে সীমান্ত জেলাগুলোতে যা পরিস্থিতি তাতে মনে হয়, আমাদের আরও মৃত্যুর জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গত ৮ মে প্রথম জানায়, ভারত থেকে আসা তিন বাংলাদেশির দেহে করোনার ভারতীয় ধরন (বি.১.৬.৭) শনাক্ত হয়েছে। এ পর্যন্ত ঠিক কতজনের দেহে করোনার ভারতীয় ধরন সংক্রমণ ঘটিয়েছে সে সর্ম্পকে পূর্ণাঙ্গ কোন গবেষণা হয়নি।

ঢাকার সিভিল সার্জন ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘ঢাকায় এখন সংক্রমণের হার ৫ থেকে ৬ শতাংশের নিচে রয়েছে। এখানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে বলা যায়।’

নারায়ণগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইমতিয়াজ গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘জেলায় করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আজ (গতকাল) মাত্র চারজন রোগী শনাক্ত হয়েছে। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে এখানে করোনা শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে রয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরেই শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে রয়েছে।’

সংবাদের গাজীপুর প্রতিনিধি গতকাল জানিয়েছেন, গত একদিনে জেলায় ১৯৮ জনের নমুনা পরীক্ষায় ১৫ জনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ। আর এ পর্যন্ত জেলায় মোট ১১ হাজার ৩৬৩ জনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এ হিসাবে মোট শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ। গাজীপুরে করোনায় এ পর্যন্ত ২১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।

সংবাদের চট্টগ্রাম ব্যুরো অভিস জানিয়েছে, চট্টগ্রামে গত ৪০ দিনে করোনায় মারা গেছেন ১১৯ জন। এ নিয়ে করোনা আক্রান্ত চট্টগ্রামে মৃতের সংখ্যা ৬শ’র ওপরে ছাড়িয়েছে।

গত তিনদিনে করোনায় কেউ মৃত্যুবরণ না করলেও শুধুমাত্র গত ৯ দিনে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে চট্টগ্রামে। গত ২৬ এপ্রিলের প্রতিবেদনে আগের ২৪ ঘণ্টায় মোট ৫০৪ জনের মত্যুর তথ্য দিয়েছিল জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়। এর মধ্য দিয়ে মৃতের সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়ে যায়, এর সঙ্গে একমাস ১০ দিনের মাথায় এসে যুক্ত হয়েছেন আরও ১১৯ জন। করোনায় সর্বমোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬১৯ জনের মতো।

অন্যদিকে করোনা আক্রান্ত হয়ে শুধুমাত্র গত ৯ দিনে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে গত ২ জুন ৩ জন, ৩১ মে ৪ জন, ৩০ মে ৫ জন, ২৯ মে ১ জন, ২৮মে ৪ জন, ২৬ মে ২ জন।

চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত মোট আক্রান্ত ৫৩ হাজার ৯৪২ জন। গতকাল করোনায় মত্যুবরণ করেনি কেউ। জেলা সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি জানান, ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে ৯৯১টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এতে আক্রান্ত হয়েছেন ৯৭ জন। নতুন আক্রান্তদের মধ্যে নগরে ৪৫ জন এবং উপজেলায় ৫২ জন।

সীমান্ত জেলায় এখনও বাড়ছে সংক্রমণ

ভারত সীমান্তবর্র্তী ২৯টি জেলা রয়েছে। এর মধ্যে ২২টি জেলায় সংক্রমণ বাড়ছে। তবে ১৫টি জেলায় ‘দ্রুতগতিতে’ বাড়ছে করোনা সংক্রমণ।

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, এখনই সতর্ক হয়ে কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়া হলে পরিস্থিতি আবার খারাপের দিকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

খুলনায় গত ৩০ মে থেকে গতকাল পর্যন্ত এক হাজার ৯৩৪টি নমুনা পরীক্ষায় ৪৭৫ জনের করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার প্রায় ২৫ শতাংশ। এর আগের সপ্তাহে শনাক্তের হার ছিল ২০ শতাংশ। খুলনায় গতকাল পর্যন্ত ৯৬ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন।

রাজশাহী জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের গতকালের তথ্য অনুযায়ী, গত একদিনে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসাপাতালে ২৬৫ জনের নমুনা পরীক্ষায় ১৩১ জনের সংক্রমণ পাওয়া গেছে। নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ৪৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ।

এদিকে নওগাঁ জেলায় সংক্রমণ কিছুটা কমেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় মাত্র দু’জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে। তারা নওগাঁ পৌরসভার হাট-নওগাঁ এলাকার বাসিন্দা।

নওগাঁ সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় গত ২০ মে থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ৪৯৫টি নমুনা পরীক্ষায় ১৫৯ জনের করোনা শনাক্ত হয়। শনাক্তের হার ৩২ দশমিক ১২ শতাংশ। গত মঙ্গলবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তিনদিনে ১৭৯টি নমুনা পরীক্ষায় ৪৭ জনের করোনা পাওয়া গেছে। শনাক্তের হার ২৬ দশমিক ২৫ শতাংশ।

এছাড়া সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, যশোর, নাটোর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, সিলেটসহ অন্যান্য সীমান্ত জেলায় করোনা ছড়িয়ে পড়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু ও শনাক্তের হার বেড়েছে

গতকাল বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় ৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই সময়ে এক হাজার ৪৪৭ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে।

এ নিয়ে দেশে মোট করোনা শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়ালো আট লাখ ৯ হাজার ৩১৪। আর মোট মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ১২ হাজার ৮০১ জনে।

গত একদিনে ১৩ হাজার ১১৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ১১ দশমিক ০৩ শতাংশ। এর আগের দিন শনাক্তের হার ছিল ১০ দশমিক ৪০। গত ৩৯ দিনের মধ্যে গতকাল শনাক্তের হার সবচেয়ে বেশি ছিল।

গত একদিনে সুস্থ হয়েছেন এক হাজার ৬৬৭ জন। এ পর্যন্ত মোট করোনা থেকে সুস্থ হয়েছেন সাত লাখ ৪৯ হাজার ৪২৫ জন। মোট সুস্থতার হার ৯২ দশমিক ৬০ শতাংশ।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী, কোন দেশে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে কিনা, সে সর্ম্পকে ধারণা পাওয়ার একটি নির্দেশক হলো নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে রোগী শনাক্তের হার। কোন দেশে টানা দুই থেকে তিন সপ্তাহ নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে ধরা যায়।

সাতক্ষীরায় ঢিলেঢালা লকডাউন

সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরায় বিধিনিষেধের মধ্যে ও কিছু কিছু দোকানপাট খুলতে দেখা গেছে। অবাধে চলাচল করতে দেখা গেছে নসিমন-করিমন-ভটভটি-ইজিবাইকসহ সব বৈধ-অবৈধ যানবাহন। কাঁচা বাজারগুলোতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না অধিকাংশ ক্রেতা বিক্রেতা। জেলায় করোনা সংক্রমণ কমাতে প্রশাসনকে আরও তৎপর হওয়ার তাগিদ স্থানীয়দের।

শহরের হাসপাতাল মোড়, শহীদ আলাউদ্দীন চত্বরসহ প্রধান-প্রধান এলাকাগুলোতে সকাল থেকেই অবাধে চলছে ইজিবাই-মাহেন্দ্র-নসিমনসহ বিভিন্ন প্রকার বৈধ-অবৈধ যানবাহন। এমনকি সাতক্ষীরা-খুলনা মহাসড়কে বাস চলাচল করতে দেখা গেছে। সুলতানপুর বড় বাজার-মিলবাজার-টাউন বাজারসহ বিভিন্ন কাচাবাজারে উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। সামাজিক দূরত্ব মানার বালাই ছিল না অধিকাংশ ক্রেতা-বিক্রেতার।

বাগের হাটে

আরও ২ জনের মৃত্যু

বাগেরহাট : বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ ও শরণখোলায় করোনা আক্রান্ত হয়ে দুই বৃদ্ধ মারা গেছেন। গতকাল বেলা ১১টায় মোড়েলগঞ্জ উপজেলার ভাষান্দল গ্রামে করোনায় আক্রান্ত আবদুল ওহাব শেখ (৬৫) নিজ বাড়িতে মারা যান। আর শরণখোলা উপজেলার উত্তর রাজাপুর গ্রামের নুর ইসলাম হাওলাদার (৭০) নামের এক বৃদ্ধ শুক্রবার রাতে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। এ নিয়ে জেলায় গতকাল পর্যন্ত করোনা সংক্রমণে মোট মারা গেছেন ৪৮ জন।

দিনাজপুরে টিকার মজুদ শেষ

দিনাজপুর : দিনাজপুর জেলায় কোভিড-১৯ টিকার মজুদ শেষ হওয়ায় পরবর্র্তী ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত কোভিড-১৯ টিকাদান কার্যক্রম বন্ধ থাকবে বলে জানান সিভিল সার্জন।

দিনাজপুরে কোভিড-১৯ সংক্রমণ সংক্রান্ত নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সিভিল সার্জন ডা. আবদুল কুদ্দুছ জানান, গতকাল করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন আরও ৩ জন। এদের মধ্যে ১ জন সদর উপজেলার, ১ জন বিরল উপজেলার ও ১ জন বিরামপুর উপজেলার বাসিন্দা। এ নিয়ে জেলায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ১৩৪ জনে।