অন্যের সাজাভোগকারী মিনুর মুক্তির নির্দেশ

চট্টগ্রামে হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কুলসুম আক্তার ওরফে কুলসুমী সেজে প্রায় তিন বছর ধরে স্বেচ্ছায় ‘সাজাভোগ’ করা মিনু আক্তারকে মুক্তির নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে প্রকৃত আসামি কুলসুম আক্তার কুলসুমীকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীমের ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন।

এছাড়া বিচারিক আদালতে কুলসুমীর পরিবর্তে মিনু আক্তারের আত্মসমর্পণ এবং পরে ওই আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল দায়েরের প্রক্রিয়ায় প্রতারণার আশ্রয় নেয়া হয়েছে কিনা, সেটির ব্যাখ্যা চেয়েছে উচ্চ আদালত। সংশ্লিষ্ট তিন আইনজীবী ও এক আইনজীবীর সহকারীকে আগামী ২৮ জুন আদালতে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। তিন আইনজীবী হলেন চট্টগ্রাম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট এমএ নাসের, অ্যাডভোকেট নুরুল আনোয়ার ও অ্যাডভোকেট বিবেকানন্দ চৌধুরী।

আদালতে মিনুর পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী শিশির মুনির ও ইকবাল হোসেন। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন। এর আগে হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কুলসুম আক্তারের হয়ে জেল খাটা মিনুর বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন আইনজীবী শিশির মনির।

মামলার আদেশ প্রদানের পর হাইকোর্ট মন্তব্য করেন, আমরা এ ধরনের ঘটনার রুট খুঁজে বের করতে চাই। আমরা মনে করি এসব ঘটনা মিডিয়াতে আসা উচিত। মানুষ যেন এসব কাজ করতে না পারে। তখন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ড. মো. বশির উল্লাহ আদালতকে বলেন, এই ঘটনার সর্বোচ্চ প্রচার হবে। আমাদের কোর্টেও মিডিয়াকর্মীরা আছেন। এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনার মতো ফলোআপ পাবে।

জানা যায়, কারাগারের একটি বালাম বই দেখতে গিয়ে মিনুর সাজা খাটার বিষয়টি উঠে আসে। সেখানে দেখা যায়, একজনের পরিবর্তে যাবজ্জীবন সাজা খাটছেন এই নারী। পরবর্তীতে বিষয়টি আদালতের নজরে আনা হলে এ মামলার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হাইকোর্টে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। হত্যা মামলায় চট্টগ্রামের একটি আদালত যাবজ্জীবনসহ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন কুলসুম আক্তার কুলসুমীকে। কিন্তু তার পরিবর্তে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জেল খাটছিলেন এই মিনু। নামের মিল না থাকার পরও কুলসুম আক্তার কুলসুমীর বদলে মিনু চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন দুই বছর ৯ মাসের বেশি সময়।

আলোচিত এই ঘটনার বর্ণনায় আইনজীবী শিশির মনির জানান, ২০০৬ সালের জুলাই মাসে চট্টগ্রামের রহমতগঞ্জ বাংলা কলেজ এলাকায় কোহিনুর আক্তার ওরফে বেবী নামের এক নারী খুন হন। ওই ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা হয়। একপর্যায়ে এই হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্তার অভিযোগে কুলসুম আক্তার ওরফে কুলসুমীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর ২০০৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কুলসুমীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ২০০৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কুলসুমী জামিনে মুক্ত হন। তবে ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত রায়ে কুলসুমীকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। রায়ের দিন অনুপস্থিত থাকায় আদালত তার বিরুদ্ধে সাজাসহ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।

পরে ২০১৮ সালের ১২ জুন মিনু নামের এক মহিলাকে সাজাপ্রাপ্ত আসামি কুলসুম আক্তার ওরফে কুলসুমী সাজিয়ে আত্মসমর্পণ পর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর ২০১৯ সালের ২৩ এপ্রিল কুলসুমী হাইকোর্টে আপিল করেন।

২০২১ সালের ২১ মার্চ চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে চিঠি দিয়ে জানান যে, ২০১৮ সালের ১২ জুন তারিখে কারাগারে পাঠানো আসামি প্রকৃত সাজাপ্রাপ্ত আসামি কুলসুম আক্তার নয়। এরপর কারাগারে থাকা আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। আসামি আদালতে জবানবন্দিতে জানায়, তার নাম মিনু। মর্জিনা নামের এক মহিলা তাকে চাল-ডাল দেবে বলে জেলে ঢোকায়। প্রকৃত আসাসি কুলসুম আক্তারকে সে চিনে না। এরপর আদালত কারাগারের রেজিস্ট্রার দেখে হাজতি আসামি কুলসুমী এবং সাজাভোগকারী আসামির চেহারায় অমিল খুঁজে পান। এরপর চট্টগ্রামের আদালত কারাগারের রেজিস্ট্রারসহ মামলার যাবতীয় নথি গত ২৩ মার্চ হাইকোর্টে পাঠায়।

মঙ্গলবার, ০৮ জুন ২০২১ , ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২৬ শাওয়াল ১৪৪২

অন্যের সাজাভোগকারী মিনুর মুক্তির নির্দেশ

আদালত বার্তা পরিবেশক

চট্টগ্রামে হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কুলসুম আক্তার ওরফে কুলসুমী সেজে প্রায় তিন বছর ধরে স্বেচ্ছায় ‘সাজাভোগ’ করা মিনু আক্তারকে মুক্তির নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে প্রকৃত আসামি কুলসুম আক্তার কুলসুমীকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীমের ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন।

এছাড়া বিচারিক আদালতে কুলসুমীর পরিবর্তে মিনু আক্তারের আত্মসমর্পণ এবং পরে ওই আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল দায়েরের প্রক্রিয়ায় প্রতারণার আশ্রয় নেয়া হয়েছে কিনা, সেটির ব্যাখ্যা চেয়েছে উচ্চ আদালত। সংশ্লিষ্ট তিন আইনজীবী ও এক আইনজীবীর সহকারীকে আগামী ২৮ জুন আদালতে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। তিন আইনজীবী হলেন চট্টগ্রাম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট এমএ নাসের, অ্যাডভোকেট নুরুল আনোয়ার ও অ্যাডভোকেট বিবেকানন্দ চৌধুরী।

আদালতে মিনুর পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী শিশির মুনির ও ইকবাল হোসেন। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন। এর আগে হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কুলসুম আক্তারের হয়ে জেল খাটা মিনুর বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন আইনজীবী শিশির মনির।

মামলার আদেশ প্রদানের পর হাইকোর্ট মন্তব্য করেন, আমরা এ ধরনের ঘটনার রুট খুঁজে বের করতে চাই। আমরা মনে করি এসব ঘটনা মিডিয়াতে আসা উচিত। মানুষ যেন এসব কাজ করতে না পারে। তখন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ড. মো. বশির উল্লাহ আদালতকে বলেন, এই ঘটনার সর্বোচ্চ প্রচার হবে। আমাদের কোর্টেও মিডিয়াকর্মীরা আছেন। এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনার মতো ফলোআপ পাবে।

জানা যায়, কারাগারের একটি বালাম বই দেখতে গিয়ে মিনুর সাজা খাটার বিষয়টি উঠে আসে। সেখানে দেখা যায়, একজনের পরিবর্তে যাবজ্জীবন সাজা খাটছেন এই নারী। পরবর্তীতে বিষয়টি আদালতের নজরে আনা হলে এ মামলার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হাইকোর্টে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। হত্যা মামলায় চট্টগ্রামের একটি আদালত যাবজ্জীবনসহ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন কুলসুম আক্তার কুলসুমীকে। কিন্তু তার পরিবর্তে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জেল খাটছিলেন এই মিনু। নামের মিল না থাকার পরও কুলসুম আক্তার কুলসুমীর বদলে মিনু চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন দুই বছর ৯ মাসের বেশি সময়।

আলোচিত এই ঘটনার বর্ণনায় আইনজীবী শিশির মনির জানান, ২০০৬ সালের জুলাই মাসে চট্টগ্রামের রহমতগঞ্জ বাংলা কলেজ এলাকায় কোহিনুর আক্তার ওরফে বেবী নামের এক নারী খুন হন। ওই ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা হয়। একপর্যায়ে এই হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্তার অভিযোগে কুলসুম আক্তার ওরফে কুলসুমীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর ২০০৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কুলসুমীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ২০০৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কুলসুমী জামিনে মুক্ত হন। তবে ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত রায়ে কুলসুমীকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। রায়ের দিন অনুপস্থিত থাকায় আদালত তার বিরুদ্ধে সাজাসহ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।

পরে ২০১৮ সালের ১২ জুন মিনু নামের এক মহিলাকে সাজাপ্রাপ্ত আসামি কুলসুম আক্তার ওরফে কুলসুমী সাজিয়ে আত্মসমর্পণ পর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর ২০১৯ সালের ২৩ এপ্রিল কুলসুমী হাইকোর্টে আপিল করেন।

২০২১ সালের ২১ মার্চ চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে চিঠি দিয়ে জানান যে, ২০১৮ সালের ১২ জুন তারিখে কারাগারে পাঠানো আসামি প্রকৃত সাজাপ্রাপ্ত আসামি কুলসুম আক্তার নয়। এরপর কারাগারে থাকা আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। আসামি আদালতে জবানবন্দিতে জানায়, তার নাম মিনু। মর্জিনা নামের এক মহিলা তাকে চাল-ডাল দেবে বলে জেলে ঢোকায়। প্রকৃত আসাসি কুলসুম আক্তারকে সে চিনে না। এরপর আদালত কারাগারের রেজিস্ট্রার দেখে হাজতি আসামি কুলসুমী এবং সাজাভোগকারী আসামির চেহারায় অমিল খুঁজে পান। এরপর চট্টগ্রামের আদালত কারাগারের রেজিস্ট্রারসহ মামলার যাবতীয় নথি গত ২৩ মার্চ হাইকোর্টে পাঠায়।