ভার্চুয়াল মুদ্রায় অনলাইন জুয়া

বছরে পাচার হচ্ছে ১২শ’ কোটি টাকারও বেশি

শত শত অ্যাপে টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে তরুণীদের বিটিআরসির নজরদারির অভাব

অনলাইনে তরুণীদের সঙ্গে লাইভ ভিডিও আড্ডার নামে অনলাইন জুয়া খেলা বাড়ছে। আইনি প্রক্রিয়ায় নিষিদ্ধ না হওয়ায় উঠতি বয়সী তরুণসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ এ খেলায় চরমভাবে আসক্ত হয়ে পড়ছে। ডিজিটাল কয়েন (ভার্চুয়াল মুদ্রা) কিনে এ খেলায় যুক্ত হতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের অ্যাপসে প্রবেশ করছে ব্যবহাকারীরা। প্রতিবছর অনলাইন জুয়ার নামে দেশ থেকে ১২০০ কোটি টাকারও বেশি পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। পাচার হওয়া অর্থ ভারত, পাকিস্তান, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে বলে তথ্য পেয়েছে পুলিশ।

গত মে মাসে অনলাইন গেমিং অ্যাপ স্ট্রিমকারের ব্যবহার নিয়ে তদন্ত করতে গিয়ে এসব তথ্য মিলেছে। জঙ্গি কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ এবং দমনে অভিযান পরিচালনাকারী পুলিশের বিশেষ ইউনিট অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের (এটিইউ) একটি অনুসন্ধানে এমন তথ্য এসেছে। স্ট্রিমকার অ্যাপে তরুণীদের সঙ্গে লাইভ ভিডিও আড্ডার নামে জুয়ার খেলা এবং অর্থ পাচারের অভিযোগে মে মাসে ৪ জনকে গ্রেপ্তারও করে এটিইউ। পরে তারা মামলাটি হস্তান্তর করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির সাইবার পুলিশ ইউনিটের কাছে। ওই মামলার তদন্ত করতে গিয়ে বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত ডিআইজি কামরুল আহসান আরও দুজনকে গ্রেপ্তার করার তথ্য জানান। তিনি বলেছেন, শুধু স্ট্রিমকার অ্যাপভিত্তিক জুয়া খেলার নামে দেশ থেকে এক বছরে ৩০ কোটি টাকা পাচার হয়েছে।

সমাজ বিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. জিয়া রহমান টেলিফোনে সংবাদকে বলেন, বাংলাদেশে অপরাধের ক্ষেত্রে আমি ৩টি সমস্যা চিহ্নিত করেছি তার মধ্যে সাইবার অপরাধ একটি। সাইবারভিত্তিক অপরাধ বাড়লেও এর নিয়ন্ত্রণে সক্ষমতা আমাদের এখন তৈরি হয়নি। সাইবারের বিভিন্ন অপরাধের মধ্যে অ্যাপে জুয়া খেলা এবং এ জুয়ার নামে অর্থ বিদেশে অর্থ পাচার হওয়া আমাদের দেশের জন্য বড় ধরনের বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এটিকে এখনি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে বিপর্যয় তৈরি হবে।

প্রফেসর ড. জিয়া রহমান বলেন, আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠান আছে কিন্তু প্রতিষ্ঠানের কাঠামো নেই। এ ধরনের অপরাধ নিয়ে গবেষণা করতে হবে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করতে হবে। সেখানে যারা অপরাধের বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণা করেন তাদের যুক্ত করতে হবে। প্রো-অ্যাকটিভ পুলিশিং, সমাজ ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করতে হবে। অপরাধ হওয়ার আগেই যেন অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। তিনি বলেন, উন্নত বিশ্বে অপরাধের ধরন অনুযায়ী স্পেশালাইজড ইউনিট গঠন করে এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করা হয়। সেগুলো ফলো করে আমাদের দেশেও এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আলাদা প্রতিষ্ঠান গঠন করতে হবে এবং আলাদা জনবল নিয়োগ করতে হবে। যাদের কাজই হবে এসব অপরাধ নিয়ে কাজ করা।

সিআইডির অতিরিক্ত জিআইজি কামরুল আহসান জানান, গেমিং অ্যাপে লাইভ আড্ডার নামে ভার্চুয়াল মুদ্রা কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত ২০ থেকে ২২ জন এজন্টকে তারা চিহ্নিত করেছে। গত বুধবার তারা সিলেটে অভিযান চালিয়ে দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে। ওই দুই এজেন্ট স্ট্রিমকার অ্যাপে ১ মাসে ১৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে। মোটামুটি সারাদেশেই চলছে অনলাইন জুয়া। অ্যাপগুলো নিয়ন্ত্রণ হয় বিদেশ থেকে। তাদের দেশীয় সহযোগীরা অ্যাপ ব্যবহাকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ভার্চুয়াল মুদ্রা বিক্রি করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাষ্য, সারাদেশেই উঠতি বয়সের তরুণসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে অনলাইন জুয়া। মূলত বাংলাদেশের আইনে প্রকাশ্যে জুয়া খেলা নিষিদ্ধ হলেও অনলাইনে জুয়া খেলার বিষয়ে কোন আইন নেই। তবে অনলাইনে জুয়া খেলতে হলে ভার্চুয়াল মুদ্রা কিনতে হয়। এটি লেনদেন বাংলাদেশের আইনে অবৈধ। যারা অনলাইনে জুয়া খেলেন তারা ভার্চুয়াল মুদ্রা কিনেন এ খেলার নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে যুক্ত বাংলাদেশি এজেন্টদের কাছ থেকে। এসব এজেন্ট মাসিক বেতন অথবা কমিশনের ভিত্তিতে অনলাইন জুয়ার অ্যাপস নিয়ন্ত্রণকারী বিদেশি চক্রের সঙ্গে কাজ করেন। প্রত্যেক এজেন্টের একাধিক ব্যাংক হিসাব থাকে। তারা ভার্চুয়াল মুদ্রার অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে পরিশোধ করেন আবার নিজেদের বেতন বা কমিশনের টাকাও হুন্ডির মাধ্যমে নিয়ে থাকেন। সুদর্শন নারীদের মডেল বানিয়ে আড্ডার প্রলোভনে ফেলে জুয়া খেলার টোপ দেয়া হয় আর এ টোপে যারা পড়েন তাদের রীতিমতো এটি নেশা হয়ে ওঠে। এ নেশায় খরচ হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। এসব অর্থ চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। প্রতি বছর দেশ থেকে অনলাইন জুয়া থেকে ১২০০ কোটি টাকার মতো পাচার হচ্ছে। বিদেশে বসে অ্যাপস নিয়ন্ত্রণকারীদের হয়ে বাংলাদেশি এজেন্টরা অর্থ সংগ্রহ করে তা পাচার করে দিচ্ছেন। নজরদারিতে না এলে এবং অ্যাপসভিত্তিক জুয়া খেলা বন্ধ করা সম্ভব না হলে এটি বড় ধরনের অপরাধের প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন অপরাধ বিশ্লেষকরা।

এন্টি টেররিজম ইউনিটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আসলাম খান টেলিফোনে সংবাদকে জানান, শত শত অ্যাপ আছে। লাইভ ভিডিওতে মডেলদের সঙ্গে আড্ডাসহ নানা ইস্যুতে এসব অ্যাপে যুক্ত হন ব্যবহারকারীরা। মূলত অ্যাপটি আসে ইনস্ট্রল করতে হয়। এরপর বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত দিয়ে একটি অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। এক একটি অ্যাপ একেক প্রক্রিয়ায় চলে। অ্যাপগুলো বিদেশ থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বাংলাদেশি এজেন্টরা বিভিন্ন বয়সী নারীদের ভাড়া করেন। তারা ওইসব ভাড়া করা নারীদের সেলিব্রেটি বলে তাদের সঙ্গে আড্ডা দেয়ার আমন্ত্রণ জানান। বিনিময়ে ডিজিটাল মুদ্রা কিনে কথিত মডেলদের উপহার দিতে হবে বলে শর্তজুড়ে দেন। শর্তানুযায়ী যারা ডিজিটাল মুদ্রা কিনতে চান তারা এজেন্টদের কাছে টাকা বিকাশসহ বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পরিশোধ করেন।

আসলাম খান বলেন, মে মাসে ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে অনলাইন জুয়ার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন এটিইউ। তবে এটিইউর মূল কাজ জঙ্গি কার্যক্রমবিরোধী হওয়ার কারণে ওই বিষয় নিয়ে তারা খুব বেশি এগোতে পারেননি। মামলা করে সেই মামলা তারা সিআইডির কাছে হস্তান্তর করেছে। এটিইউর এক কর্মকর্তা বলেন, শত শত অ্যাপ বাংলাদেশে ব্যবহার হচ্ছে। লাখ লাখ ব্যবহারকারী এসব অ্যাপ ব্যবহার করছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণের মূল দায়িত্ব তদারকি প্রতিষ্ঠান বিটিআরসির। বিটিআরসি এসব অ্যাপ ব্যবহার বন্ধ করতে পারবে। শুধু পুলিশের একার পক্ষে এটি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, আমেরিকা, ভারত, পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশ থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় অনলাইন গেমিং অ্যাপস। স্ট্রিমকার, নাইন উইকেট, বোট ৩৬৫, নাইন এক্সচেঞ্জ, লাইক ইয়ার্স, গেডি,পাবস, ক্রিকেট৩৬৯, লাইকী, ক্রিকেট ৩৬৫ ফাইভসহ শত শত অ্যাপস রয়েছে গুগল প্লে-স্টোরে। এসব অ্যাপস মোবাইলে ইন্সটল করার জন্য নানাভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয় স্মার্টফোন ব্যবহাকারীদের। প্লে-স্টোরে গিয়ে এসব অ্যাপস ইন্সটল করার পর অনেকেই কৌতূহলবশত প্রবেশ করেন। এরপর তাদের নানা ধরনের টোপ দেয়া হয়। প্রথমত, সুন্দরী তরুণীদের সঙ্গে লাইভে আড্ডা, গল্প করা, সরাসরি চ্যাটিংসহ নানা ধরনের অফার দেয়া হয়। সেখানে জুয়া নিয়ন্ত্রণকারীরা দুটি ডিজিটাল কয়েন দিয়ে থাকেন। বলা হয় আপনি যার সঙ্গে আড্ডা দিবেন তাকে আগে ওই দুটি কয়েন কিনে উপহার দিতে হবে। উপহার দিলেই মেলে সঙ্গ। উঠতি বয়সী তরুণসহ নানা বয়সী মানুষ এ লোভে পড়ে এক লাখ বিন্স এক হাজার ২০ টাকায় এবং এক লাখ জেমস ৬০০ টাকায় কিনতে হতো ব্যবহারকারীদের। এরপর তারা আড্ডার সঙ্গে যুক্ত হতো।

শনিবার, ১২ জুন ২০২১ , ২৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ৩০ শাওয়াল ১৪৪২

ভার্চুয়াল মুদ্রায় অনলাইন জুয়া

বছরে পাচার হচ্ছে ১২শ’ কোটি টাকারও বেশি

শত শত অ্যাপে টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে তরুণীদের বিটিআরসির নজরদারির অভাব

সাইফ বাবলু

image

অনলাইনে তরুণীদের সঙ্গে লাইভ ভিডিও আড্ডার নামে অনলাইন জুয়া খেলা বাড়ছে। আইনি প্রক্রিয়ায় নিষিদ্ধ না হওয়ায় উঠতি বয়সী তরুণসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ এ খেলায় চরমভাবে আসক্ত হয়ে পড়ছে। ডিজিটাল কয়েন (ভার্চুয়াল মুদ্রা) কিনে এ খেলায় যুক্ত হতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের অ্যাপসে প্রবেশ করছে ব্যবহাকারীরা। প্রতিবছর অনলাইন জুয়ার নামে দেশ থেকে ১২০০ কোটি টাকারও বেশি পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। পাচার হওয়া অর্থ ভারত, পাকিস্তান, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে বলে তথ্য পেয়েছে পুলিশ।

গত মে মাসে অনলাইন গেমিং অ্যাপ স্ট্রিমকারের ব্যবহার নিয়ে তদন্ত করতে গিয়ে এসব তথ্য মিলেছে। জঙ্গি কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ এবং দমনে অভিযান পরিচালনাকারী পুলিশের বিশেষ ইউনিট অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের (এটিইউ) একটি অনুসন্ধানে এমন তথ্য এসেছে। স্ট্রিমকার অ্যাপে তরুণীদের সঙ্গে লাইভ ভিডিও আড্ডার নামে জুয়ার খেলা এবং অর্থ পাচারের অভিযোগে মে মাসে ৪ জনকে গ্রেপ্তারও করে এটিইউ। পরে তারা মামলাটি হস্তান্তর করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির সাইবার পুলিশ ইউনিটের কাছে। ওই মামলার তদন্ত করতে গিয়ে বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত ডিআইজি কামরুল আহসান আরও দুজনকে গ্রেপ্তার করার তথ্য জানান। তিনি বলেছেন, শুধু স্ট্রিমকার অ্যাপভিত্তিক জুয়া খেলার নামে দেশ থেকে এক বছরে ৩০ কোটি টাকা পাচার হয়েছে।

সমাজ বিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. জিয়া রহমান টেলিফোনে সংবাদকে বলেন, বাংলাদেশে অপরাধের ক্ষেত্রে আমি ৩টি সমস্যা চিহ্নিত করেছি তার মধ্যে সাইবার অপরাধ একটি। সাইবারভিত্তিক অপরাধ বাড়লেও এর নিয়ন্ত্রণে সক্ষমতা আমাদের এখন তৈরি হয়নি। সাইবারের বিভিন্ন অপরাধের মধ্যে অ্যাপে জুয়া খেলা এবং এ জুয়ার নামে অর্থ বিদেশে অর্থ পাচার হওয়া আমাদের দেশের জন্য বড় ধরনের বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এটিকে এখনি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে বিপর্যয় তৈরি হবে।

প্রফেসর ড. জিয়া রহমান বলেন, আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠান আছে কিন্তু প্রতিষ্ঠানের কাঠামো নেই। এ ধরনের অপরাধ নিয়ে গবেষণা করতে হবে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করতে হবে। সেখানে যারা অপরাধের বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণা করেন তাদের যুক্ত করতে হবে। প্রো-অ্যাকটিভ পুলিশিং, সমাজ ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করতে হবে। অপরাধ হওয়ার আগেই যেন অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। তিনি বলেন, উন্নত বিশ্বে অপরাধের ধরন অনুযায়ী স্পেশালাইজড ইউনিট গঠন করে এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করা হয়। সেগুলো ফলো করে আমাদের দেশেও এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আলাদা প্রতিষ্ঠান গঠন করতে হবে এবং আলাদা জনবল নিয়োগ করতে হবে। যাদের কাজই হবে এসব অপরাধ নিয়ে কাজ করা।

সিআইডির অতিরিক্ত জিআইজি কামরুল আহসান জানান, গেমিং অ্যাপে লাইভ আড্ডার নামে ভার্চুয়াল মুদ্রা কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত ২০ থেকে ২২ জন এজন্টকে তারা চিহ্নিত করেছে। গত বুধবার তারা সিলেটে অভিযান চালিয়ে দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে। ওই দুই এজেন্ট স্ট্রিমকার অ্যাপে ১ মাসে ১৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে। মোটামুটি সারাদেশেই চলছে অনলাইন জুয়া। অ্যাপগুলো নিয়ন্ত্রণ হয় বিদেশ থেকে। তাদের দেশীয় সহযোগীরা অ্যাপ ব্যবহাকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ভার্চুয়াল মুদ্রা বিক্রি করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাষ্য, সারাদেশেই উঠতি বয়সের তরুণসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে অনলাইন জুয়া। মূলত বাংলাদেশের আইনে প্রকাশ্যে জুয়া খেলা নিষিদ্ধ হলেও অনলাইনে জুয়া খেলার বিষয়ে কোন আইন নেই। তবে অনলাইনে জুয়া খেলতে হলে ভার্চুয়াল মুদ্রা কিনতে হয়। এটি লেনদেন বাংলাদেশের আইনে অবৈধ। যারা অনলাইনে জুয়া খেলেন তারা ভার্চুয়াল মুদ্রা কিনেন এ খেলার নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে যুক্ত বাংলাদেশি এজেন্টদের কাছ থেকে। এসব এজেন্ট মাসিক বেতন অথবা কমিশনের ভিত্তিতে অনলাইন জুয়ার অ্যাপস নিয়ন্ত্রণকারী বিদেশি চক্রের সঙ্গে কাজ করেন। প্রত্যেক এজেন্টের একাধিক ব্যাংক হিসাব থাকে। তারা ভার্চুয়াল মুদ্রার অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে পরিশোধ করেন আবার নিজেদের বেতন বা কমিশনের টাকাও হুন্ডির মাধ্যমে নিয়ে থাকেন। সুদর্শন নারীদের মডেল বানিয়ে আড্ডার প্রলোভনে ফেলে জুয়া খেলার টোপ দেয়া হয় আর এ টোপে যারা পড়েন তাদের রীতিমতো এটি নেশা হয়ে ওঠে। এ নেশায় খরচ হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। এসব অর্থ চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। প্রতি বছর দেশ থেকে অনলাইন জুয়া থেকে ১২০০ কোটি টাকার মতো পাচার হচ্ছে। বিদেশে বসে অ্যাপস নিয়ন্ত্রণকারীদের হয়ে বাংলাদেশি এজেন্টরা অর্থ সংগ্রহ করে তা পাচার করে দিচ্ছেন। নজরদারিতে না এলে এবং অ্যাপসভিত্তিক জুয়া খেলা বন্ধ করা সম্ভব না হলে এটি বড় ধরনের অপরাধের প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন অপরাধ বিশ্লেষকরা।

এন্টি টেররিজম ইউনিটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আসলাম খান টেলিফোনে সংবাদকে জানান, শত শত অ্যাপ আছে। লাইভ ভিডিওতে মডেলদের সঙ্গে আড্ডাসহ নানা ইস্যুতে এসব অ্যাপে যুক্ত হন ব্যবহারকারীরা। মূলত অ্যাপটি আসে ইনস্ট্রল করতে হয়। এরপর বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত দিয়ে একটি অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। এক একটি অ্যাপ একেক প্রক্রিয়ায় চলে। অ্যাপগুলো বিদেশ থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বাংলাদেশি এজেন্টরা বিভিন্ন বয়সী নারীদের ভাড়া করেন। তারা ওইসব ভাড়া করা নারীদের সেলিব্রেটি বলে তাদের সঙ্গে আড্ডা দেয়ার আমন্ত্রণ জানান। বিনিময়ে ডিজিটাল মুদ্রা কিনে কথিত মডেলদের উপহার দিতে হবে বলে শর্তজুড়ে দেন। শর্তানুযায়ী যারা ডিজিটাল মুদ্রা কিনতে চান তারা এজেন্টদের কাছে টাকা বিকাশসহ বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পরিশোধ করেন।

আসলাম খান বলেন, মে মাসে ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে অনলাইন জুয়ার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন এটিইউ। তবে এটিইউর মূল কাজ জঙ্গি কার্যক্রমবিরোধী হওয়ার কারণে ওই বিষয় নিয়ে তারা খুব বেশি এগোতে পারেননি। মামলা করে সেই মামলা তারা সিআইডির কাছে হস্তান্তর করেছে। এটিইউর এক কর্মকর্তা বলেন, শত শত অ্যাপ বাংলাদেশে ব্যবহার হচ্ছে। লাখ লাখ ব্যবহারকারী এসব অ্যাপ ব্যবহার করছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণের মূল দায়িত্ব তদারকি প্রতিষ্ঠান বিটিআরসির। বিটিআরসি এসব অ্যাপ ব্যবহার বন্ধ করতে পারবে। শুধু পুলিশের একার পক্ষে এটি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, আমেরিকা, ভারত, পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশ থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় অনলাইন গেমিং অ্যাপস। স্ট্রিমকার, নাইন উইকেট, বোট ৩৬৫, নাইন এক্সচেঞ্জ, লাইক ইয়ার্স, গেডি,পাবস, ক্রিকেট৩৬৯, লাইকী, ক্রিকেট ৩৬৫ ফাইভসহ শত শত অ্যাপস রয়েছে গুগল প্লে-স্টোরে। এসব অ্যাপস মোবাইলে ইন্সটল করার জন্য নানাভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয় স্মার্টফোন ব্যবহাকারীদের। প্লে-স্টোরে গিয়ে এসব অ্যাপস ইন্সটল করার পর অনেকেই কৌতূহলবশত প্রবেশ করেন। এরপর তাদের নানা ধরনের টোপ দেয়া হয়। প্রথমত, সুন্দরী তরুণীদের সঙ্গে লাইভে আড্ডা, গল্প করা, সরাসরি চ্যাটিংসহ নানা ধরনের অফার দেয়া হয়। সেখানে জুয়া নিয়ন্ত্রণকারীরা দুটি ডিজিটাল কয়েন দিয়ে থাকেন। বলা হয় আপনি যার সঙ্গে আড্ডা দিবেন তাকে আগে ওই দুটি কয়েন কিনে উপহার দিতে হবে। উপহার দিলেই মেলে সঙ্গ। উঠতি বয়সী তরুণসহ নানা বয়সী মানুষ এ লোভে পড়ে এক লাখ বিন্স এক হাজার ২০ টাকায় এবং এক লাখ জেমস ৬০০ টাকায় কিনতে হতো ব্যবহারকারীদের। এরপর তারা আড্ডার সঙ্গে যুক্ত হতো।