টিকা কখন

রণেশ মৈত্র

ভ্যাকসিন নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে একেক সময় একেক কথা বলায় এবং বহুদিন যাবত টিকা প্রদান বন্ধ থাকায় মানুষের মনে সীমাহীন উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যার প্রতিদিন হ্রাস-বৃদ্ধি এই শঙ্কাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। এই শঙ্কার হাত থেকে কবে-কখন মুক্তি পাওয়া যাবে, আকার-ইঙ্গিতেও তা বুঝে উঠা যাচ্ছে না। অপরদিকে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধের ব্যাপারে সরকারি পদক্ষেপ প্রয়োজনের তুলনায় আজও ভয়ানকভাবে অপ্রতুল।

দেশে করোনা ভ্যাকসিন উৎপাদনের কথা বহুদিন থেকে শুনা গেলেও বাস্তবে কাজ যে আদৌ এগোয়নি, তা অতি সহজেই বুঝা যায়। এবারের বাজেটে এই ভ্যাকসিন তৈরির কারখানা নির্মাণে কোন অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে তা সুষ্পষ্টভাবে বুঝা যায়নি; তবে হয়ে থাকলে ভালো। কিন্তু তা হলে কারখানা নির্মাণ কাজ কতদিনে শুরু হবে, কতদিনে সেখানে ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হবে, কতদিনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি হবে। কতদিনে বিশেষজ্ঞরা তা নিয়ে উৎপাদন শুরু করতে পারবেন, উৎপাদিত পণ্য মানসম্মত হবে কিনা, তা নানা প্রাণীদেহে প্রয়োগ এবং অবশেষে সে প্রয়োগ সফল হলে মানবদেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের অনুমতি কতদিনে পাওয়া যাবে, পাওয়ার পর তা সফল হলে তার বাজারজাত করণ ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনই বা কতদিনে পাওয়া যাবে- এসবই অস্পষ্ট।

অপরদিকে ভারতের সঙ্গে অ্যাস্ট্রাজেনেকা ক্রয়-বিক্রয়ের চুক্তি আংশিকভাবে পালনের পর আর কোন বিকল্প উৎস সময়মতো অনুসন্ধান ও চুক্তি না করা ভয়ংকর ক্ষতির কারণ হয়েছে। বলতে গেলে টিকাদান কার্যকলাপ প্রায় বন্ধই হয়ে রয়েছে। চীন যে পাঁচ লক্ষ ডোজ উপহার হিসেবে দিয়েছে-তার একাংশ এদেশে কর্মরত চীনাদের জন্য সংরক্ষিত রাখার পর হয়তো ৪ লাখ ডোজের মতো বাংলাদেশের নাগরিকদের দেওয়া হবে। দুই ডোজ করে প্রত্যেককে দেওয়ার ফলে ওই ভ্যাকসিন মাত্র দুই লক্ষ লোককে দেওয়া যাবে। ভারতের যে ভ্যাকসিন এসেছিল তা সম্ভবত ৩০ লাখের মতো মানুষকে দুই ডোজ করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। ফলে এ যাবত মোট মাত্র ৩২ লক্ষ মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া যাবে।

চীনের সঙ্গে দেড় কোটি ডোজের যে চুক্তি হতে যাচ্ছিল তা স্বাস্থ্য অধিফতরের দায়িত্বহীন এক অতি উৎসাহী কর্মকর্তার দায়িত্বহীন উক্তির ফলে তা সম্পন্ন হতে পারেনি। সংবাদমাধ্যম সূত্রে যতদূর জানা যায়, তাতে বাংলাদেশ সরকার এটি স্বীকার করে এবং ভবিষ্যতে আর এমন কিছু ঘটবে না বলে নিশ্চয়তা দিয়ে চীন সরকারকে পত্র লিখেছেন; যার কোন সদুত্তর আজও না মেলায় চুক্তি স্বাক্ষর আদৌ হবে কিনা বা হলে কবেনাগাদ হবে তা জানা যাচ্ছে না। তবে জানা গেল, শীঘ্রই নাকি চীন থেকে আরও ছয় লক্ষ ডোজ টিকা উপহার হিসেবে আসছে। যদি আসে তবে তা দিয়ে আর তিন লক্ষ লোককে টিকা দেওয়া যাবে এবং তা যদি হয় তবে মোট টিকাপ্রাপ্ত লোকের সংখ্যা ৩৩ লাখে দাঁড়াবে।

এ অনিশ্চয়তা এবং এতদিনে মাত্র ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ লাখ মানুষের টিকাদান বাদ-বাকি বারো কোটি (শিশুদের বাদ দিয়ে) মানুষকে টিকা দিতে যে কতদিন আরও লাগবে তা কল্পনায় আনতে শিউরে উঠতে হয়। তবু স্তাবকদের স্তাবকতা থেমে নেই বেড়েই চলেছে বরং। বাংলাদেশ সরকার যে অসাধারণ দক্ষতা ও আন্তরিকতা দিয়ে করোনা সক্রমণ প্রতিরোধে ‘সাফল্য দেখালেন’ তাদের মতো গোটা বিশ্বে এমন নজির নেই বললেই চলে। মৃত্যু ও সংক্রমণের দৈনন্দিন প্রকাশিত তত্যে অবশ্য সত্যই দেখা যায়, অপরাপর দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ ও করোনায় মৃত্যু অনেক কম। কিন্তু এই তথ্য কতটা গ্রহণযোগ্য তা নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন রয়েছে। যেমন অপরাপর দেশগুলোতে বিনাপয়সায় প্রায় শতভাগ মানুষের করোনা টেস্ট করা বাধ্যতামূলক এবং এ কাজটি সব দেশই কমপক্ষে ৯০ ভাগ ইতোমধ্যেই শেষ করেছে ওই দেশগুলো। অনেক দেশ শতভাগ সম্পন্ন করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা টেস্ট করাটাই হলো প্রাথমিক কাজ। আর সেই কাজটি আমাদের দেশে আজও চরমভাবে অবহেলিত। বহু জেলা আছে টেস্টিং কিট সরবরাহ নেই প্রয়োজনানুরূপ। আবার টেস্টিং কিট থাকলেও সেই নমুনা পরীক্ষার জন্য ভিন্ন জেলায় নমুনা পাঠাতে হয়। ফলাফল আসতে সময় লাগে তিন থেকে সাত দিন।

এই গেল জেলাগুলোর চিত্র। কিন্তু উপজেলাগুলোর কথা তো মনে হয় কারও হিসাবেই নেই। সেখানে কিটসের প্রচণ্ড অভাব, দারিদ্র্যজনিত কারণে টাকার বিনিময়ে পরীক্ষার শক্তি তাদের নেই। আর পিসিআর ল্যাব? তা হলো স্বপ্নের জিনিস। অথচ প্রতি উপজেলায়ই ওষুধ থাক বা না থাক, ডাক্তার-নার্স প্রয়োজনমতো থাকুন বা না থাকুন ৩০ শয্যার হাসপাতাল ঠিকই আছে। কমাতে চাইলে পিসিআর ল্যাব প্রতি উপজেলা হাসপাতালগুলোতেই বসানো যায়।

গ্রামের লোকের কি করোনা হয়? সম্ভবত সবাই বা অনেকেই ভাবেন গ্রামে তো করোনা নেই। এমন ধারণা বিস্ময়কর। এর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও নেই। একটি কারণ অবশ্য উল্লেখ করা যায়, গ্রামের মানুষ কায়িক পরিশ্রম অনেক বেশি করেন, পরিবেশ দূষণও অপেক্ষাকৃতভাবে দূষণমুক্ত, টাটকা শাকসবজি ক্ষেতে থেকে তুলে খেতে পারেন। ফলে তাদের দেহে করোনা সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা তুলনামূলকভাবে কম থকে।

এ ধারণা আংশিক সত্য হলেও করোনা যেহেতু একটি মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগ, গ্রামাঞ্চলে যেহেতু মাস্ক পরার অভ্যাস গড়ে ওঠেনি- শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার প্রশ্নও ওঠে না; কারণ সপ্তাহের প্রায় সাত দিনই তাদের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে নানা হাট-বাজারে যেতে হয়। সেহেতু তাদের কাছে দূরত্বের প্রশ্নটি অবান্তর। কিন্তু করোনা প্রতিরোধে এগুলো আবশ্যিক। তদুপরি আজও ঘনঘন সাবান-জলে হাত ধোয়া, বাইরে থেকে এসে পরনের যাবতীয় পোশাক আধাঘণ্টা সাবান-জলে ভিজিয়ে রাখা এবং স্নান না করে ঘরে ঢুকা, স্যানিটাইজার ব্যবহার না করার চিত্র গ্রামাঞ্চলের সর্বত্র; অথচ সেখানেই মোট জনসংখ্যার ৮৫ ভাগের বাস।

এমতাবস্থায় বিশাল গ্রামাঞ্চলে প্রতিদিন যে শত শত মানুষের মৃত্যু ঘটছে তাদের মৃত্যুর কারণ শনাক্ত করারও কোন সুযোগ নেই। ফলে বিষয়টি জরুরিভিত্তিতে ভেবে এবং করোনা মোকাবিলার বিজ্ঞানসম্মত আয়োজনের যে প্রচণ্ড অভাব দেশজুড়ে আজও বিরাজ করছে- সেই অভাব পূরণ না করে আত্মতুষ্টি প্রকাশের কোন সুযোগ নেই। যেহেতু ৯০ ভাগ মানুষ এখনো করোনা পরীক্ষার আওতার বাইরে রয়ে গেছেন, তাই স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রচারিত প্রতিদিনকার করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা যে এ ব্যাপারে পূর্ণ সত্য প্রকাশ করে না, তা বলাই বাহুল্য।

সুতরাং কার্যকরভাবে করোনা প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন-

এক. দ্রুততম সময়ের মধ্যে সবার করোনা পরীক্ষা বিনামূল্যে এবং বাধ্যতামূলকভাবে সম্পন্ন করা;

দুই. প্রতি ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করা;

তিন. প্রতি জেলা ও উপজেলার সরকারি হাসপাতালগুলোতে এসিআর ল্যব যথেষ্টসংখ্যক প্রতিষ্ঠা করে দ্রুততার সঙ্গে ফলাফল জানার ব্যবস্থা করা;

চার. উপজেলা হাসপাতালগুলো কমপক্ষে ২০ শয্যা এবং জেলা হাসপাতালগুলোতে ন্যূনতম ৫০ শয্যাবিশিষ্ট করোনা ওয়ার্ড প্রতিষ্ঠা এবং উপজেলা হাসপাতালে কমপক্ষে ৪টি করে ও জেলা হাসপাতালগুলোতে ন্যূনতম ২৫টি করে আইসিইউ বেড স্থাপন, যথেষ্ট পরিমাণে অক্সিজেন সব হাসপাতালে সংরক্ষণের ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরি;

পাঁচ. করোনা ভ্যাকসিন অতিশয় দ্রুততার সঙ্গে কমপক্ষে ৫ কোটি ডোজ আমদানি করা ও দেশে ভ্যাকসিন উৎপাদনের যাবতীয় ব্যবস্থা অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে শেষ করা;

ছয়. একই সঙ্গে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যে দুর্নীতি বিরাজ করছে- কঠোর হস্তে তার মূলোচ্ছেদ করা; নইলে সব ইতিবাচক প্রচেষ্টা ভেস্তে যাবে।

[লেখক : সভাপতিম-লীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ]

সোমবার, ১৪ জুন ২০২১ , ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২ জিলকদ ১৪৪২

টিকা কখন

রণেশ মৈত্র

image

ভ্যাকসিন নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে একেক সময় একেক কথা বলায় এবং বহুদিন যাবত টিকা প্রদান বন্ধ থাকায় মানুষের মনে সীমাহীন উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যার প্রতিদিন হ্রাস-বৃদ্ধি এই শঙ্কাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। এই শঙ্কার হাত থেকে কবে-কখন মুক্তি পাওয়া যাবে, আকার-ইঙ্গিতেও তা বুঝে উঠা যাচ্ছে না। অপরদিকে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধের ব্যাপারে সরকারি পদক্ষেপ প্রয়োজনের তুলনায় আজও ভয়ানকভাবে অপ্রতুল।

দেশে করোনা ভ্যাকসিন উৎপাদনের কথা বহুদিন থেকে শুনা গেলেও বাস্তবে কাজ যে আদৌ এগোয়নি, তা অতি সহজেই বুঝা যায়। এবারের বাজেটে এই ভ্যাকসিন তৈরির কারখানা নির্মাণে কোন অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে তা সুষ্পষ্টভাবে বুঝা যায়নি; তবে হয়ে থাকলে ভালো। কিন্তু তা হলে কারখানা নির্মাণ কাজ কতদিনে শুরু হবে, কতদিনে সেখানে ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হবে, কতদিনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি হবে। কতদিনে বিশেষজ্ঞরা তা নিয়ে উৎপাদন শুরু করতে পারবেন, উৎপাদিত পণ্য মানসম্মত হবে কিনা, তা নানা প্রাণীদেহে প্রয়োগ এবং অবশেষে সে প্রয়োগ সফল হলে মানবদেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের অনুমতি কতদিনে পাওয়া যাবে, পাওয়ার পর তা সফল হলে তার বাজারজাত করণ ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনই বা কতদিনে পাওয়া যাবে- এসবই অস্পষ্ট।

অপরদিকে ভারতের সঙ্গে অ্যাস্ট্রাজেনেকা ক্রয়-বিক্রয়ের চুক্তি আংশিকভাবে পালনের পর আর কোন বিকল্প উৎস সময়মতো অনুসন্ধান ও চুক্তি না করা ভয়ংকর ক্ষতির কারণ হয়েছে। বলতে গেলে টিকাদান কার্যকলাপ প্রায় বন্ধই হয়ে রয়েছে। চীন যে পাঁচ লক্ষ ডোজ উপহার হিসেবে দিয়েছে-তার একাংশ এদেশে কর্মরত চীনাদের জন্য সংরক্ষিত রাখার পর হয়তো ৪ লাখ ডোজের মতো বাংলাদেশের নাগরিকদের দেওয়া হবে। দুই ডোজ করে প্রত্যেককে দেওয়ার ফলে ওই ভ্যাকসিন মাত্র দুই লক্ষ লোককে দেওয়া যাবে। ভারতের যে ভ্যাকসিন এসেছিল তা সম্ভবত ৩০ লাখের মতো মানুষকে দুই ডোজ করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। ফলে এ যাবত মোট মাত্র ৩২ লক্ষ মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া যাবে।

চীনের সঙ্গে দেড় কোটি ডোজের যে চুক্তি হতে যাচ্ছিল তা স্বাস্থ্য অধিফতরের দায়িত্বহীন এক অতি উৎসাহী কর্মকর্তার দায়িত্বহীন উক্তির ফলে তা সম্পন্ন হতে পারেনি। সংবাদমাধ্যম সূত্রে যতদূর জানা যায়, তাতে বাংলাদেশ সরকার এটি স্বীকার করে এবং ভবিষ্যতে আর এমন কিছু ঘটবে না বলে নিশ্চয়তা দিয়ে চীন সরকারকে পত্র লিখেছেন; যার কোন সদুত্তর আজও না মেলায় চুক্তি স্বাক্ষর আদৌ হবে কিনা বা হলে কবেনাগাদ হবে তা জানা যাচ্ছে না। তবে জানা গেল, শীঘ্রই নাকি চীন থেকে আরও ছয় লক্ষ ডোজ টিকা উপহার হিসেবে আসছে। যদি আসে তবে তা দিয়ে আর তিন লক্ষ লোককে টিকা দেওয়া যাবে এবং তা যদি হয় তবে মোট টিকাপ্রাপ্ত লোকের সংখ্যা ৩৩ লাখে দাঁড়াবে।

এ অনিশ্চয়তা এবং এতদিনে মাত্র ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ লাখ মানুষের টিকাদান বাদ-বাকি বারো কোটি (শিশুদের বাদ দিয়ে) মানুষকে টিকা দিতে যে কতদিন আরও লাগবে তা কল্পনায় আনতে শিউরে উঠতে হয়। তবু স্তাবকদের স্তাবকতা থেমে নেই বেড়েই চলেছে বরং। বাংলাদেশ সরকার যে অসাধারণ দক্ষতা ও আন্তরিকতা দিয়ে করোনা সক্রমণ প্রতিরোধে ‘সাফল্য দেখালেন’ তাদের মতো গোটা বিশ্বে এমন নজির নেই বললেই চলে। মৃত্যু ও সংক্রমণের দৈনন্দিন প্রকাশিত তত্যে অবশ্য সত্যই দেখা যায়, অপরাপর দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ ও করোনায় মৃত্যু অনেক কম। কিন্তু এই তথ্য কতটা গ্রহণযোগ্য তা নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন রয়েছে। যেমন অপরাপর দেশগুলোতে বিনাপয়সায় প্রায় শতভাগ মানুষের করোনা টেস্ট করা বাধ্যতামূলক এবং এ কাজটি সব দেশই কমপক্ষে ৯০ ভাগ ইতোমধ্যেই শেষ করেছে ওই দেশগুলো। অনেক দেশ শতভাগ সম্পন্ন করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা টেস্ট করাটাই হলো প্রাথমিক কাজ। আর সেই কাজটি আমাদের দেশে আজও চরমভাবে অবহেলিত। বহু জেলা আছে টেস্টিং কিট সরবরাহ নেই প্রয়োজনানুরূপ। আবার টেস্টিং কিট থাকলেও সেই নমুনা পরীক্ষার জন্য ভিন্ন জেলায় নমুনা পাঠাতে হয়। ফলাফল আসতে সময় লাগে তিন থেকে সাত দিন।

এই গেল জেলাগুলোর চিত্র। কিন্তু উপজেলাগুলোর কথা তো মনে হয় কারও হিসাবেই নেই। সেখানে কিটসের প্রচণ্ড অভাব, দারিদ্র্যজনিত কারণে টাকার বিনিময়ে পরীক্ষার শক্তি তাদের নেই। আর পিসিআর ল্যাব? তা হলো স্বপ্নের জিনিস। অথচ প্রতি উপজেলায়ই ওষুধ থাক বা না থাক, ডাক্তার-নার্স প্রয়োজনমতো থাকুন বা না থাকুন ৩০ শয্যার হাসপাতাল ঠিকই আছে। কমাতে চাইলে পিসিআর ল্যাব প্রতি উপজেলা হাসপাতালগুলোতেই বসানো যায়।

গ্রামের লোকের কি করোনা হয়? সম্ভবত সবাই বা অনেকেই ভাবেন গ্রামে তো করোনা নেই। এমন ধারণা বিস্ময়কর। এর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও নেই। একটি কারণ অবশ্য উল্লেখ করা যায়, গ্রামের মানুষ কায়িক পরিশ্রম অনেক বেশি করেন, পরিবেশ দূষণও অপেক্ষাকৃতভাবে দূষণমুক্ত, টাটকা শাকসবজি ক্ষেতে থেকে তুলে খেতে পারেন। ফলে তাদের দেহে করোনা সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা তুলনামূলকভাবে কম থকে।

এ ধারণা আংশিক সত্য হলেও করোনা যেহেতু একটি মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগ, গ্রামাঞ্চলে যেহেতু মাস্ক পরার অভ্যাস গড়ে ওঠেনি- শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার প্রশ্নও ওঠে না; কারণ সপ্তাহের প্রায় সাত দিনই তাদের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে নানা হাট-বাজারে যেতে হয়। সেহেতু তাদের কাছে দূরত্বের প্রশ্নটি অবান্তর। কিন্তু করোনা প্রতিরোধে এগুলো আবশ্যিক। তদুপরি আজও ঘনঘন সাবান-জলে হাত ধোয়া, বাইরে থেকে এসে পরনের যাবতীয় পোশাক আধাঘণ্টা সাবান-জলে ভিজিয়ে রাখা এবং স্নান না করে ঘরে ঢুকা, স্যানিটাইজার ব্যবহার না করার চিত্র গ্রামাঞ্চলের সর্বত্র; অথচ সেখানেই মোট জনসংখ্যার ৮৫ ভাগের বাস।

এমতাবস্থায় বিশাল গ্রামাঞ্চলে প্রতিদিন যে শত শত মানুষের মৃত্যু ঘটছে তাদের মৃত্যুর কারণ শনাক্ত করারও কোন সুযোগ নেই। ফলে বিষয়টি জরুরিভিত্তিতে ভেবে এবং করোনা মোকাবিলার বিজ্ঞানসম্মত আয়োজনের যে প্রচণ্ড অভাব দেশজুড়ে আজও বিরাজ করছে- সেই অভাব পূরণ না করে আত্মতুষ্টি প্রকাশের কোন সুযোগ নেই। যেহেতু ৯০ ভাগ মানুষ এখনো করোনা পরীক্ষার আওতার বাইরে রয়ে গেছেন, তাই স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রচারিত প্রতিদিনকার করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা যে এ ব্যাপারে পূর্ণ সত্য প্রকাশ করে না, তা বলাই বাহুল্য।

সুতরাং কার্যকরভাবে করোনা প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন-

এক. দ্রুততম সময়ের মধ্যে সবার করোনা পরীক্ষা বিনামূল্যে এবং বাধ্যতামূলকভাবে সম্পন্ন করা;

দুই. প্রতি ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করা;

তিন. প্রতি জেলা ও উপজেলার সরকারি হাসপাতালগুলোতে এসিআর ল্যব যথেষ্টসংখ্যক প্রতিষ্ঠা করে দ্রুততার সঙ্গে ফলাফল জানার ব্যবস্থা করা;

চার. উপজেলা হাসপাতালগুলো কমপক্ষে ২০ শয্যা এবং জেলা হাসপাতালগুলোতে ন্যূনতম ৫০ শয্যাবিশিষ্ট করোনা ওয়ার্ড প্রতিষ্ঠা এবং উপজেলা হাসপাতালে কমপক্ষে ৪টি করে ও জেলা হাসপাতালগুলোতে ন্যূনতম ২৫টি করে আইসিইউ বেড স্থাপন, যথেষ্ট পরিমাণে অক্সিজেন সব হাসপাতালে সংরক্ষণের ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরি;

পাঁচ. করোনা ভ্যাকসিন অতিশয় দ্রুততার সঙ্গে কমপক্ষে ৫ কোটি ডোজ আমদানি করা ও দেশে ভ্যাকসিন উৎপাদনের যাবতীয় ব্যবস্থা অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে শেষ করা;

ছয়. একই সঙ্গে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যে দুর্নীতি বিরাজ করছে- কঠোর হস্তে তার মূলোচ্ছেদ করা; নইলে সব ইতিবাচক প্রচেষ্টা ভেস্তে যাবে।

[লেখক : সভাপতিম-লীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ]