বিভিন্ন ব্যাংকের ৩০০ কোটি টাকা লোপাটের ৫৪ মামলা, ১০টির বিচার শেষ

বেসরকারি ওয়ান ব্যাংক লিমিটেডের সাড়ে ১৫ কোটি টাকা লোপাটের অপরাধে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য খাদিজাতুল আনোয়ার সনি’র স্বামী মো. পারভেজ আলম ও শ্বশুর এমএস আলম ওরফে শাহ্ আলমের বিরুদ্ধে আবারও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে চট্টগ্রামের একটি আদালত। চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতের বিচারক মুজাজিদুর রহমান এই আদেশ দেন। প্রদত্ত আদেশে সংশ্লিষ্ট থানাকে আসামিদের আটক করে আদালতে হাজির করারও নির্দেশ দেয়া হয়।

ওয়ান ব্যাংক খাতুনগঞ্জ পক্ষে আদালত এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। পরোয়ানার কপি গতকাল নগরীর খুলশী থানায় এসেছে বলেও জানা গেছে। তবে ওই দুইজন বিদেশে পলাতক রয়েছেন বলে জানা গেছে।

মামলা সূত্রে জানা গেছে, ওয়ান ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে মেসার্স শাওন এন্টারপ্রাইজের নাম দেখিয়ে ঋণ নেয় পারভেজ ও শাহ আলম। কিন্তু সেই ঋণের বকেয়া সাড়ে ১৫ কোটি ৫৭ লাখ ৮৪ হাজার ৮৯১ টাকা পরিশোধ করার জন্য ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দফায় দফায় তাগাদা দিলেও তা আমলে নেয়নি আসামিরা। পরে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আদালতে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। এই মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আদালত।

সংসদ সদস্য সনি’র শ্বশুর শাহ আলম দেশের ৮টি ব্যাংক থেকে ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অপরাধে তার বিরুদ্ধে আছে মোট ৫৪টি মামলা। একমধ্যে ৬টি মামলায় তার ৬ বছরের সাজাও হয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রামের সদরঘাটে মেসার্স আলম অ্যান্ড কোম্পানির স্বত্বাধিকারী এমএস আলম ব্যবসায়ী হিসেবে উল্লেখযোগ্য না হলেও বছরের পর বছর কায়দা করে ঋণ ভাগিয়েছেন ব্যাংক থেকে। ঋণ পেতে খাটিয়েছেন রাজনৈতিক প্রভাব। সেই টাকায় জমির ব্যবসা করে নিজে ফুলেফেঁপে উঠলেও আটটি ব্যাংক এখন তার কাছ থেকে পাবে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা।

এমএস আলমের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো দেখাশোনা করছেন আরেক আসামি বড় ছেলে পারভেজ আলম হীরা। পারভেজের স্ত্রী খাদিজাতুল আনোয়ার সনি সংরক্ষিত আসনে মনোনীত সংসদ সদস্য।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম ভিত্তিক মাশরিফা ফুড প্রোডাক্টস নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসেবে নাম আছে এমএস আলমের। ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে পারভেজ আলম এবং ডিরেক্টর হিসেবে রয়েছে তার কন্যা ফারজানা আলম এবং কনিষ্ঠ দুই পুত্র ফরহাদ আলম ও ফয়সাল আলমের নাম। এর মধ্যে ফারজানা আলম চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মনজুর আলমের ছেলের বউ।

জানা গেছে, ২০১১ সালের পর থেকে বিভিন্ন ব্যাংক ঋণের টাকা পেতে এমএস আলমের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের শুরু করে। ৩০০ কোটি টাকা আদায়ের জন্য তার বিরুদ্ধে আটটি ব্যাংক সব মিলিয়ে ৫৪টি মামলা দায়ের করে। এর মধ্যে সাতটি শুধু অর্থঋণ আদালতে দায়ের করা মামলা। যার মধ্যে চারটি মামলার রায় হয়েছে ইতোমধ্যে। বাকি সবগুলোই এনআই অ্যাক্টের মামলা। এনআই অ্যাক্টের ৬ মামলায় তার ৬ বছরের সাজাও হয়েছে।

যেসব ব্যাংক থেকে অর্থ লোপাট করা হয়েছে, তার মধ্যে পূবালী ব্যাংক সদরঘাট শাখা পাবে ৫২ কোটি টাকা, এনসিসি ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার পাওনা ৬৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা, প্রিমিয়ার ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার পাওনা ৯০ কোটি টাকা, ওয়ান ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার পাওনা ২৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা, ব্যাংক এশিয়া খাতুনগঞ্জ শাখার পাওনা ২৯ কোটি টাকা, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার পাওনা আছে ৯ কোটি টাকা, স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক জিইসি শাখার পাওনা ১৩ কোটি টাকা এবং ইস্টার্ন ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার পাওনা ১২ কোটি টাকা।

এ প্রসংঙ্গে প্রিমিয়ার ব্যাংকের ইভিপি ও খাতুনগঞ্জ শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক (বর্তমান জুবলী রোড শাখার ব্যবস্থাপক) নুরুল আবছার বলেন, ব্যাংকের তৎকালীন ঊর্ধ্বতন কর্মকতাদের ম্যানেজ করে ঋণ ভাগিয়ে নিয়েছেন শাহ আলম। আমি খাতুনগঞ্জ শাখায় দায়িত্ব পালনকালে এই টাকা উদ্ধারে অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওই ব্যবসায়ীর টাকা পরিশোধের মানসিকতা নেই। তাই আমরা বাধ্য হয়ে প্রতিষ্ঠানটির মালিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছি। এখন বিভিন্ন ব্যাংকের দায়ের করা মামলায় সাজা হতে শুরু হলে তিনি বিদেশে পালিয়ে গেছেন বলে শুনছি।

জানতে চাইলে ব্যাংক এশিয়ার এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও জোনাল হেড (চট্টগ্রাম) একেএম সাইফুল ইসলাম জানান, পারিবারিকভাবে ব্যবসায় যুক্ত হলেও শাহ আলম খুবই ধূর্ত প্রকৃতির লোক। যার ফলে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে সহজে ঋণ সুবিধা নেন। কিন্তু ব্যবসার জন্য ঋণ নিলেও সেই টাকা বিনিয়োগ করে তিনি জমি কিনেছেন। এভাবে ব্যাংকের টাকা আটকে যাওয়ায় পাওনাদার ব্যাংকগুলো টাকা উদ্ধারে একের পর এক মামলা দায়ের শুরু করে।

খুলশী থানা পুলিশের ওসি মোহাম্মদ শাহীনুজ্জামান ও থানার ওয়ারেন্ট অফিসার আনোয়ার হোসাইন জানান, ব্যবসায়ী শাহ আলমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যাংকের দায়ের করা মামলায় সাজা হওয়ার পর কয়েকবার তার দক্ষিণ খুলশীর বাসায় গিয়েছে পুলিশ। কিন্তু তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি তিনি বিদেশে পালিয়ে গেছেন।

এ বিষয়ে চট্টগ্রামের সদরঘাটে মেসার্স আলম অ্যান্ড কোম্পানির স্বত্বাধিকারী এমএস আলমের সঙ্গে কয়েকবার যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।

বৃহস্পতিবার, ১৭ জুন ২০২১ , ৩ আষাড় ১৪২৮ ৫ জিলকদ ১৪৪২

চট্টগ্রামে জামাই-শ্বশুরের বিরুদ্ধে

বিভিন্ন ব্যাংকের ৩০০ কোটি টাকা লোপাটের ৫৪ মামলা, ১০টির বিচার শেষ

চট্টগ্রাম ব্যুরো

বেসরকারি ওয়ান ব্যাংক লিমিটেডের সাড়ে ১৫ কোটি টাকা লোপাটের অপরাধে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য খাদিজাতুল আনোয়ার সনি’র স্বামী মো. পারভেজ আলম ও শ্বশুর এমএস আলম ওরফে শাহ্ আলমের বিরুদ্ধে আবারও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে চট্টগ্রামের একটি আদালত। চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতের বিচারক মুজাজিদুর রহমান এই আদেশ দেন। প্রদত্ত আদেশে সংশ্লিষ্ট থানাকে আসামিদের আটক করে আদালতে হাজির করারও নির্দেশ দেয়া হয়।

ওয়ান ব্যাংক খাতুনগঞ্জ পক্ষে আদালত এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। পরোয়ানার কপি গতকাল নগরীর খুলশী থানায় এসেছে বলেও জানা গেছে। তবে ওই দুইজন বিদেশে পলাতক রয়েছেন বলে জানা গেছে।

মামলা সূত্রে জানা গেছে, ওয়ান ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে মেসার্স শাওন এন্টারপ্রাইজের নাম দেখিয়ে ঋণ নেয় পারভেজ ও শাহ আলম। কিন্তু সেই ঋণের বকেয়া সাড়ে ১৫ কোটি ৫৭ লাখ ৮৪ হাজার ৮৯১ টাকা পরিশোধ করার জন্য ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দফায় দফায় তাগাদা দিলেও তা আমলে নেয়নি আসামিরা। পরে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আদালতে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। এই মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আদালত।

সংসদ সদস্য সনি’র শ্বশুর শাহ আলম দেশের ৮টি ব্যাংক থেকে ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অপরাধে তার বিরুদ্ধে আছে মোট ৫৪টি মামলা। একমধ্যে ৬টি মামলায় তার ৬ বছরের সাজাও হয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রামের সদরঘাটে মেসার্স আলম অ্যান্ড কোম্পানির স্বত্বাধিকারী এমএস আলম ব্যবসায়ী হিসেবে উল্লেখযোগ্য না হলেও বছরের পর বছর কায়দা করে ঋণ ভাগিয়েছেন ব্যাংক থেকে। ঋণ পেতে খাটিয়েছেন রাজনৈতিক প্রভাব। সেই টাকায় জমির ব্যবসা করে নিজে ফুলেফেঁপে উঠলেও আটটি ব্যাংক এখন তার কাছ থেকে পাবে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা।

এমএস আলমের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো দেখাশোনা করছেন আরেক আসামি বড় ছেলে পারভেজ আলম হীরা। পারভেজের স্ত্রী খাদিজাতুল আনোয়ার সনি সংরক্ষিত আসনে মনোনীত সংসদ সদস্য।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম ভিত্তিক মাশরিফা ফুড প্রোডাক্টস নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসেবে নাম আছে এমএস আলমের। ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে পারভেজ আলম এবং ডিরেক্টর হিসেবে রয়েছে তার কন্যা ফারজানা আলম এবং কনিষ্ঠ দুই পুত্র ফরহাদ আলম ও ফয়সাল আলমের নাম। এর মধ্যে ফারজানা আলম চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মনজুর আলমের ছেলের বউ।

জানা গেছে, ২০১১ সালের পর থেকে বিভিন্ন ব্যাংক ঋণের টাকা পেতে এমএস আলমের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের শুরু করে। ৩০০ কোটি টাকা আদায়ের জন্য তার বিরুদ্ধে আটটি ব্যাংক সব মিলিয়ে ৫৪টি মামলা দায়ের করে। এর মধ্যে সাতটি শুধু অর্থঋণ আদালতে দায়ের করা মামলা। যার মধ্যে চারটি মামলার রায় হয়েছে ইতোমধ্যে। বাকি সবগুলোই এনআই অ্যাক্টের মামলা। এনআই অ্যাক্টের ৬ মামলায় তার ৬ বছরের সাজাও হয়েছে।

যেসব ব্যাংক থেকে অর্থ লোপাট করা হয়েছে, তার মধ্যে পূবালী ব্যাংক সদরঘাট শাখা পাবে ৫২ কোটি টাকা, এনসিসি ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার পাওনা ৬৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা, প্রিমিয়ার ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার পাওনা ৯০ কোটি টাকা, ওয়ান ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার পাওনা ২৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা, ব্যাংক এশিয়া খাতুনগঞ্জ শাখার পাওনা ২৯ কোটি টাকা, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার পাওনা আছে ৯ কোটি টাকা, স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক জিইসি শাখার পাওনা ১৩ কোটি টাকা এবং ইস্টার্ন ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার পাওনা ১২ কোটি টাকা।

এ প্রসংঙ্গে প্রিমিয়ার ব্যাংকের ইভিপি ও খাতুনগঞ্জ শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক (বর্তমান জুবলী রোড শাখার ব্যবস্থাপক) নুরুল আবছার বলেন, ব্যাংকের তৎকালীন ঊর্ধ্বতন কর্মকতাদের ম্যানেজ করে ঋণ ভাগিয়ে নিয়েছেন শাহ আলম। আমি খাতুনগঞ্জ শাখায় দায়িত্ব পালনকালে এই টাকা উদ্ধারে অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওই ব্যবসায়ীর টাকা পরিশোধের মানসিকতা নেই। তাই আমরা বাধ্য হয়ে প্রতিষ্ঠানটির মালিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছি। এখন বিভিন্ন ব্যাংকের দায়ের করা মামলায় সাজা হতে শুরু হলে তিনি বিদেশে পালিয়ে গেছেন বলে শুনছি।

জানতে চাইলে ব্যাংক এশিয়ার এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও জোনাল হেড (চট্টগ্রাম) একেএম সাইফুল ইসলাম জানান, পারিবারিকভাবে ব্যবসায় যুক্ত হলেও শাহ আলম খুবই ধূর্ত প্রকৃতির লোক। যার ফলে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে সহজে ঋণ সুবিধা নেন। কিন্তু ব্যবসার জন্য ঋণ নিলেও সেই টাকা বিনিয়োগ করে তিনি জমি কিনেছেন। এভাবে ব্যাংকের টাকা আটকে যাওয়ায় পাওনাদার ব্যাংকগুলো টাকা উদ্ধারে একের পর এক মামলা দায়ের শুরু করে।

খুলশী থানা পুলিশের ওসি মোহাম্মদ শাহীনুজ্জামান ও থানার ওয়ারেন্ট অফিসার আনোয়ার হোসাইন জানান, ব্যবসায়ী শাহ আলমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যাংকের দায়ের করা মামলায় সাজা হওয়ার পর কয়েকবার তার দক্ষিণ খুলশীর বাসায় গিয়েছে পুলিশ। কিন্তু তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি তিনি বিদেশে পালিয়ে গেছেন।

এ বিষয়ে চট্টগ্রামের সদরঘাটে মেসার্স আলম অ্যান্ড কোম্পানির স্বত্বাধিকারী এমএস আলমের সঙ্গে কয়েকবার যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।