থামছে না মানব পাচার : গডফাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন

ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাতে যাওয়া ৫২৯ বাংলাদেশিকে গত এক মাসে উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মধ্যে তিউনিশিয়া থেকে ৪৪৩ জন এবং লিবিয়া থেকে ৭৬ জনকে উদ্ধার করা হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এ তথ্য থেকে দেশের মানব পাচারের ভয়াবহ চিত্র প্রকাশ পেয়েছে। মানব পাচারের শিকার পাঁচ শতাধিক মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে এক মাসে। প্রশ্ন হচ্ছে, পাচার হয়েছেন উদ্ধার করা যায়নি এমন মানুষের সংখ্যা কত।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) তথ্যানুসারে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১২ জুন পর্যন্ত ভূমধ্যসাগরে ৮১৩ জন অভিবাসন প্রত্যাশীর মৃত্যু হয়েছে। এ সংস্থার সহায়তায় গত মে মাসে দেশে ফিরেছেন ১৬০ জন বাংলাদেশি। তাছাড়া ২০১৫ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত ভূধ্যসাগর থেকে উদ্ধার হওয়া ২ হাজার ৯০০ বাংলাদেশি লিবিয়া থেকে দেশে ফিরেছেন আইওএমের সহযোগিতায়।

ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মানব পাচারের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রুট হচ্ছে ভূমধ্যসাগর। এখানে যাওয়ার সময় অনেকেই সাগরে ডুবে প্রাণ হারান, কেউ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে নির্যাতনের শিকার হন, আবার কেউ পড়েন অপহরণকারীর খপ্পরে। এরপরও বিপজ্জনক এ পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশিদের ইউরোপ যাত্রা যেন থামছেই না।

ভূমধ্যসাগরের একটি রুট ব্যবহার করেই যে শুধু মানব পাচার হচ্ছে তা নয়। বাংলাদেশ পুলিশ ও জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছরই ভারত, পাকিস্তান, সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান, সৌদি আরব, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানব পাচার করা হয়। যাদের অধিকাংশই হচ্ছে নারী ও শিশু। সম্প্রতি ভারতে বাংলাদেশি এক তরুণীকে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর একটি আন্তর্জাতিক নারী পাচারকারী চক্রের সন্ধান পায় পুলিশ। ২০১৫ সালে মালয়েশিয়ার উত্তরে থাইল্যান্ডের সীমান্তঘেঁষা পাহাড়ি জঙ্গলে ২৮টি পরিত্যক্ত বন্দী শিবিরসহ ১৩৯টি গণকবরের সন্ধান মেলে। সাগরপথে পাচার হওয়া শত শত বাংলাদেশি নাগরিকদের পাশাপাশি মায়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকদের মৃতদেহও সেসব গণকবরে মাটিচাপা দেয়া হয়েছে বলে জানা যায়।

মানব পাচার আমাদের দেশের বড় সমস্যাগুলোর একটি। সরকারের এ ব্যাপারে যতটা নজর দেয়ার দরকার ছিল ততটা নেই। বিষয়টি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সরকার মানব পাচারবিষয়ক অপরাধের তদন্ত, মামলা পরিচালনা ও অপরাধীর দ- দেয়া ইত্যাদি বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে মানব পাচার বেড়েই চলেছে।

মানব পাচারের বড় কোন ঘটনা ঘটলে প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। শুরু হয় অভিযান। বিচ্ছিন্ন সেই অভিযান শুরু হতে সময় লাগে না, শেষ হতেও সময় লাগে না। লোক দেখানো অভিযানে কিছু চুনোপুঁটি ধরা পড়লেও রাঘববোয়ালরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থাকে। আইন প্রয়োগের শিথিলতার কারণে মানব পাচার বন্ধ করা যাচ্ছে না। মানব পাচার বন্ধ করতে হলে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। পাচারের নেপথ্যের গডফাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা জরুরি।

উন্নত জীবন বা কর্মসংস্থানের খোঁজে দেশ থেকে প্রতি বছরই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের নানা দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। লোভনীয় চাকরি ও সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন দিয়ে মানব পাচারকারীরা তাদের ফাঁদে ফেলছে। প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সাধারণ মানুষের মধ্যে সচতেনতা বাড়াতে হবে। তিউনিশিয়া ও লিবিয়ায় উদ্ধার হওয়া নাগরিকদের দ্রুত ও নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে।

বৃহস্পতিবার, ১৭ জুন ২০২১ , ৩ আষাড় ১৪২৮ ৫ জিলকদ ১৪৪২

থামছে না মানব পাচার : গডফাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন

ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাতে যাওয়া ৫২৯ বাংলাদেশিকে গত এক মাসে উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মধ্যে তিউনিশিয়া থেকে ৪৪৩ জন এবং লিবিয়া থেকে ৭৬ জনকে উদ্ধার করা হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এ তথ্য থেকে দেশের মানব পাচারের ভয়াবহ চিত্র প্রকাশ পেয়েছে। মানব পাচারের শিকার পাঁচ শতাধিক মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে এক মাসে। প্রশ্ন হচ্ছে, পাচার হয়েছেন উদ্ধার করা যায়নি এমন মানুষের সংখ্যা কত।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) তথ্যানুসারে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১২ জুন পর্যন্ত ভূমধ্যসাগরে ৮১৩ জন অভিবাসন প্রত্যাশীর মৃত্যু হয়েছে। এ সংস্থার সহায়তায় গত মে মাসে দেশে ফিরেছেন ১৬০ জন বাংলাদেশি। তাছাড়া ২০১৫ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত ভূধ্যসাগর থেকে উদ্ধার হওয়া ২ হাজার ৯০০ বাংলাদেশি লিবিয়া থেকে দেশে ফিরেছেন আইওএমের সহযোগিতায়।

ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মানব পাচারের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রুট হচ্ছে ভূমধ্যসাগর। এখানে যাওয়ার সময় অনেকেই সাগরে ডুবে প্রাণ হারান, কেউ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে নির্যাতনের শিকার হন, আবার কেউ পড়েন অপহরণকারীর খপ্পরে। এরপরও বিপজ্জনক এ পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশিদের ইউরোপ যাত্রা যেন থামছেই না।

ভূমধ্যসাগরের একটি রুট ব্যবহার করেই যে শুধু মানব পাচার হচ্ছে তা নয়। বাংলাদেশ পুলিশ ও জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছরই ভারত, পাকিস্তান, সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান, সৌদি আরব, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানব পাচার করা হয়। যাদের অধিকাংশই হচ্ছে নারী ও শিশু। সম্প্রতি ভারতে বাংলাদেশি এক তরুণীকে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর একটি আন্তর্জাতিক নারী পাচারকারী চক্রের সন্ধান পায় পুলিশ। ২০১৫ সালে মালয়েশিয়ার উত্তরে থাইল্যান্ডের সীমান্তঘেঁষা পাহাড়ি জঙ্গলে ২৮টি পরিত্যক্ত বন্দী শিবিরসহ ১৩৯টি গণকবরের সন্ধান মেলে। সাগরপথে পাচার হওয়া শত শত বাংলাদেশি নাগরিকদের পাশাপাশি মায়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকদের মৃতদেহও সেসব গণকবরে মাটিচাপা দেয়া হয়েছে বলে জানা যায়।

মানব পাচার আমাদের দেশের বড় সমস্যাগুলোর একটি। সরকারের এ ব্যাপারে যতটা নজর দেয়ার দরকার ছিল ততটা নেই। বিষয়টি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সরকার মানব পাচারবিষয়ক অপরাধের তদন্ত, মামলা পরিচালনা ও অপরাধীর দ- দেয়া ইত্যাদি বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে মানব পাচার বেড়েই চলেছে।

মানব পাচারের বড় কোন ঘটনা ঘটলে প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। শুরু হয় অভিযান। বিচ্ছিন্ন সেই অভিযান শুরু হতে সময় লাগে না, শেষ হতেও সময় লাগে না। লোক দেখানো অভিযানে কিছু চুনোপুঁটি ধরা পড়লেও রাঘববোয়ালরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থাকে। আইন প্রয়োগের শিথিলতার কারণে মানব পাচার বন্ধ করা যাচ্ছে না। মানব পাচার বন্ধ করতে হলে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। পাচারের নেপথ্যের গডফাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা জরুরি।

উন্নত জীবন বা কর্মসংস্থানের খোঁজে দেশ থেকে প্রতি বছরই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের নানা দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। লোভনীয় চাকরি ও সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন দিয়ে মানব পাচারকারীরা তাদের ফাঁদে ফেলছে। প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সাধারণ মানুষের মধ্যে সচতেনতা বাড়াতে হবে। তিউনিশিয়া ও লিবিয়ায় উদ্ধার হওয়া নাগরিকদের দ্রুত ও নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে।