উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলে রোগীর ভিড়, হাসপাতালে শয্যা সংকট

দেশের উত্তর এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী জেলায় বেড়েই চলেছে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুহার। নেয়া হয়েছে আঞ্চলিক লকডাউনসহ নানা পরিকল্পনা। তবুও কমানো যাচ্ছে না দেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর করোনা সংক্রমণ। হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে নতুন রোগী, শয্যা সংকট দেখা দিয়েছে। বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতার অভাব। মানুষের চলাচলের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হলেও কেউ বিধি মোটেও মেনে চলছেন না। খোদ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, উত্তরবঙ্গের হাসপাতালগুলো করোনা রোগীতে ভরে গেছে। রোগীদের সামাল দেয়া কঠিন হচ্ছে। আমরা চাই না ঢাকা ও দেশের অন্যান্য জেলায় এই সমস্যা দেখা দিক। এদিকে, বিশেষ করে করোনার হটস্পট এখনও রাজশাহী। এই জেলায় একদিনে ৩৫৯ জনের করোনা ধরা পড়েছে। এটি গত ২৪ ঘণ্টায় বিভাগে করোনা সংক্রমণের সর্বোচ্চ রেকর্ড। এছাড়া হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদের ৪০ ভাগই আসছেন গ্রাম থেকে। তারা এতটা দেরি করে আসছেন যে কেউ কেউ পথেই মারা যাচ্ছেন।

অন্যদিকে, উত্তরবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলার হাসপাতালগুলোতে করোনা মোকাবিলায় রীতিমতো যেন ভেঙে পড়েছে সামগ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থা। সাধারণ জ্বর-কাশি তো নয়ই, হৃদরোগসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্তরাও চিকিৎসা পাচ্ছেন না হাসপাতালে। সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্লান্ট, সিসিইউ, আইসিইউ, হাইফ্লো ন্যাজাল, ক্যানুলাসহ কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার ন্যূনতম ব্যবস্থা নেই। কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার প্রাথমিক যে উপকরণ অক্সিজেন তারও পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই। সিলিন্ডারের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ কিছুটা বজায় রাখা হয়েছে। নেই কাক্সিক্ষত জনবলও। এ অবস্থায় শহরের মতো গ্রামেও লকডাউন দেয়া এবং মানুষের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, যত দ্রুত রোগী বাড়ছে তত দ্রুত সক্ষমতা বাড়ানো যাচ্ছে না। ফলে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

দেশের কোন কোন জেলায় করোনার সংক্রমণ ৩০-৪০ শতাংশ হয়ে গেছে উল্লেখ করে জাহিদ মালেক বলেন, ‘দেশের উত্তরবঙ্গে, বিশেষ করে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রংপুর, খুলনা, সাতক্ষীরা ও নওগাঁয় করোনা সংক্রমণ বেড়েছে। নোয়াখালীতেও করোনা বাড়তি এবং রাজবাড়ী পর্যন্তও পৌঁছে গেছে।’

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঢাকায় এখন ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সামাজিক সংক্রমণের সময়কাল চলছে। ঢাকায় যারা এখনও ভ্যাকসিন পায় নাই, যারা এখনও করোনা আক্রান্ত হননি তারা এই ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। ঢাকায় যদিও সংক্রমণ কম হলেও, ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোয় এই ভ্যারিয়েন্টের প্রভাব পড়বে, সেখানে সংক্রমণ বাড়বে আর সেখানকার রোগীদের ঢাকায় নিয়ে আসা হবে, তখন এখানে চাপ বেড়ে যাবে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘সংক্রমণ হার রোধ করতে হলে আমাদের কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। ‘গণপরিবহনে গাদাগাদি করে যাত্রী যাতায়াত করে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এসব কারণে সংক্রমণ হার বাড়ছে। গণপরিবহনে সরকারের নির্দেশ মেনে যাতায়াত করতে হবে এবং অর্ধেক সিট খালি রাখতে হবে।’

প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর

রাজশাহী : রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৬ করোনা পজেটিভ ছিলেন। বাকিরা মারা যান উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায়। হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে শুক্রবার সকাল ৬টার মধ্যে বিভিন্ন সময় তারা মারা যান। মৃতদের মধ্যে রাজশাহীর ৫ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ২, নাটোরের ২ ও নওগাঁর ৩ জন করে। এ নিয়ে চলতি মাসের গত ১৮ দিনে (১ জুন সকাল ৬টা থেকে ১৮ জুন সকাল ৬টা পর্যন্ত) এ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে মারা গেছেন ১৮৩ জন।

শামীম ইয়াজদানী জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪১ জন। গত বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত এ হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৩৪৯ জন। আগের দিন ভর্তি ছিলেন ৩৫৮ জন। চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা কমেছে।

তিনি জানান, গত ১৩ ও ১৬ জুন ১৩ জন করে এবং ১৪ ও ১৫ জুন ১২ জন করে মারা যায়। চলতি মাসে সবচেয়ে বেশি মারা যায় গত ৪ জুন ১৬ জন এবং সবচেয়ে কম ১২ জুন চারজন আর রোগী ভর্তি গত ১৫ জুন ৫৮ জন, ১৬ জুন ৪৮ জন এবং ১৭ জুন ৪৪ জন। চলতি মাসে সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হয়েছে ১৫ জুন ৫৮ জন।

শামীম ইয়াজদানী জানান, গত বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত এ হাসপাতালের ২০টি আইসিইউসহ ৩০৯ বেডের বিপরীতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৩৫৮ জন। এর মধ্যে রাজশাহীর ১৯৯, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৯৮, নাটোরের ২৪, নওগাঁর ২৪, পাবনার ৪, কুষ্টিয়ার ৪, চুয়াডাঙ্গার ২ জন রয়েছেন।

চিকিৎসাধীন ৩৫৮ রোগীর মধ্যে করোনা পজেটিভ ১৬৪ জন। বাকিদের শ্বাসকষ্টসহ করোনা উপসর্গ রয়েছে। তাদের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হওয়া ৪৪ রোগীর মধ্যে রাজশাহীর ২৬ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সাত, নাটোরের চার, নওগাঁর চার, মেহেরপুরের দুই ও চুয়াডাঙ্গার একজন। একই সময় সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ৩১ জন।

রাজশাহীতে সামান্য কমেছে করোনা শনাক্তের হার। গত বুধবার দুটি ল্যাবে রাজশাহীর ৪০০ নমুনা পরীক্ষা করে ১৬৬ জনের শরীরে করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে। রাতে প্রকাশিত দুটি পিসিআর ল্যাবের নমুনা পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, আগের দিনের চেয়ে ১ দশমিক ৯৪ শতাংশ কমে করোনা শনাক্তের হার হয়েছে ৪১ দশমিক ৫০ শতাংশ। যা আগের দিন মঙ্গলবার ছিল ৪৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ। রাজশাহীতে করোনা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় শুধু সিটি করপোরেশন এলাকায় সাতদিনের সর্বাত্মক লকডাউন দেয়া হয়েছে। তবে করোনা ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামেও। রাজশাহীর উপজেলাগুলোর বাড়িতে বাড়িতে এখন জ্বর, সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্টের রোগী। শহর থেকে পশ্চিমে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সঙ্গে লাগোয়া রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও তানোর উপজেলার অবস্থা বেশি খারাপ।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী জানিয়েছেন, হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদের ৪০ ভাগই আসছেন গ্রাম থেকে। তারা এতটা দেরি করে আসছেন যে কেউ কেউ মারাও যাচ্ছেন। এ অবস্থায় শহরের মতো গ্রামেও লকডাউন দেয়া এবং মানুষের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন তিনি।

রাজশাহীর সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, গত ১৫ মার্চ রাজশাহীর ৯ উপজেলার কোথাও করোনা রোগী ছিল না। সেদিন শুধু সিটি করপোরেশন এলাকায় রোগীর সংখ্যা ছিল ২৪৩ জন। এর একমাস আগে ১৫ এপ্রিল রাজশাহীর ৯ উপজেলায় ৬০ জন শনাক্ত করোনা রোগী ছিলেন আর গত ১৫ মে ৯ উপজেলায় রোগীর সংখ্যা কমে ২২ জনে দাঁড়ায়। এর একমাস পর গত মঙ্গলবার জেলার ৯ উপজেলায় রোগীর সংখ্যা বেড়ে ৭৬০ জনে দাঁড়িয়েছে।

হাসপাতাল পরিচালক শামীম ইয়াজদানী বলছেন, যত দ্রুত রোগী বাড়ছে তত দ্রুত সক্ষমতা বাড়ানো যাচ্ছে না। ফলে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এছাড়া করোনা রোগীদের জন্য নতুন নতুন ওয়ার্ড ছেড়ে দেয়ার কারণে অন্যান্য সাধারণ রোগের চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

উত্তরবঙ্গের বৃহৎ এই হাসপাতালটিতে মোট ১ হাজার ২০০টি শয্যা আছে। এখানে রাজশাহী ছাড়াও চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ, জয়পুরহাট, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গার রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসেন আর কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে ভিড় আরও বেড়েছে। হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে লকডাউন একটি উত্তম পন্থা। টানা দুই সপ্তাহ সর্বাত্মক লকডাউন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হলে ভালো ফল পাওয়া যায়। রাজশাহীর যে লকডাউন চলছে এতে আমরা সুফল পাব বলে আশা করছি।

নাটোর : নাটোর ও সিংড়া পৌরসভায় দ্বিতীয় দফায় লকডাউনের দ্বিতীয় দিন চলছে। জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান সত্ত্বেও শহর এলাকায় সংক্রমণ হার বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে। কোনভাবেই তা কমছে না। গতকাল সকালে সিভিল সার্জন ডা. মিজানুর রহমান জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় আজ ২৭৬ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৬৫ জন করোনা পজেটিভ হয়েছেন। পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ২৩.৫৫ শতাংশ। নাটোর সদর উপজেলার ২৮ জন, এর মধ্যে শহরের ১৮ জন। করোনা উপসর্গ নিয়ে নাটোর সদর হাসপাতালে মারা গেছেন এক নারী ও দুইজন পুরুষ। গত বৃহস্পতিবার ২৪ ঘণ্টায় নাটোরে ১২৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করে নতুন করে ৬৬ জন আক্রান্ত ছিল। সংক্রমণ হার ছিল ৫১.৫০ শতাংশ। শহর এলাকায় ৫০ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৩৮ জনের করোনা পজেটিভ রেজাল্ট পাওয়া গিয়েছিল। সংক্রমণ হার ছিল ৭০.৬৫ শতাংশ। গত এক সপ্তাহে ১০০৪ জনের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষায় ৪৪৯ জন করোনা পজেটিভ হন।

পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ৪৪.৭২ শতাংশ। এক সপ্তাহে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৮ জন। তবে এতসংখ্যক শনাক্ত হলেও এর মধ্যে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট আছে কিনা তা জানাতে পারেননি জেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।

নাটোর সদর হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্লান্ট, সিসিইউ, আইসিইউ, হাইফ্লো ন্যাজাল, ক্যানুলাসহ কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার ন্যূনতম ব্যবস্থা নেই। কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার প্রাথমিক যে উপকরণ অক্সিজেন তারও পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই। সিলিন্ডারের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ কিছুটা বজায় রাখা হয়েছে। নেই কাক্সিক্ষত জনবলও। রোগীর অবস্থা কিছুটা জটিল হলেই তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। এভাবেই সংক্রমণ হার বৃদ্ধি পেতে থাকলে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে বলে মনে করে সচেতন মহল।

দিনাজপুর : উত্তরবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলা দিনাজপুরে দফায় দফায় বেড়ে চলেছে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুহার। সপ্তাহের শুরুতে জেলায় করোনা সংক্রমণ হার ছিল ২৯ দশমিক ৯৩ ভাগ। সপ্তাহ শেষে সে হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৭ দশমিক ৪৪ ভাগে। মারা গেছেন ১০ জন। গতকাল দিনাজপুর সিভিল সার্জন এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, গত এক সপ্তাহে জেলায় ১ হাজার ৮শ’ ৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৬শ’ ৬৭ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়। মৃত ১০ জনের মধ্যে ৮ জন সদরের ও ২ জন বিরামপুর উপজেলার। তবে সুস্থতার হার কম। গত এক সপ্তাহে সুস্থ হয়েছেন ১শ’ ৬০ জন।

এদিকে সংক্রমণ ও মৃত্যুহার বৃদ্ধি বিবেচনায় জেলার সদর ও হাকিমপুর উপজেলায় ৭ দিনের লকডাউন ঘোষণা করেছে জেলা করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ কমিটি। লকডাউন চলবে আগামী ২১ জুন রাত ১২ পর্যন্ত।

গতকাল দিনাজপুরে কোভিড-১৯ সংক্রমণসংক্রান্ত নিয়মিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে সিভিল সার্জন ডা. আবদুল কুদ্দুছ জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় দিনাজপুরে ১শ’ ৯৬ জনকে পরীক্ষা করে ৯৩ জনের দেহে করোনা পজেটিভ শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ৪৭ দশমিক ৪৪ ভাগ আর এদের মধ্যে ৬৮ জনই সদরের। জেলায় মোট আক্রান্ত ৬ হাজার ৮শ’ ১১ জন। সদরেই আক্রান্ত মোট ৩ হাজার ৯শ’ ৪২ জন। জেলায় এ পর্যন্ত মারা গেছেন ১শ’ ৪৭ জন। এর মধ্যে সদরেই ৭৪ জন।

সদরে ১৫ জুন হতে লকডাউনে মানুষের চলাচলের উপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হলেও মানুষজন স্বাস্থ্যবিধি মোটেও মেনে চলছেন না। গতকাল লকডাউনের চতুর্থ দিনে অফিস-আদালত বন্ধ থাকায় অস্থায়ী কাঁচাবাজারেগুলোতে মানুষের ভিড় নেমেছে। মাস্ক পরলেও এদের মধ্যে শারীরিক দূরত্ব মেনে চলার প্রবণতা কারোর মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ঢিলেঢালাভাবে চলছে লকডাউন। স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করে হালকা যানবাহন ও মানুষজন সড়ক-মহাসড়কে অবাধে বিচরণ করছে।

লকডাউনের আওতায় বাস-মাইক্রোবাস, কার চলাচল বন্ধসহ অন্যান্য হালকা যানবাহন শহরের প্রবেশপথগুলোতে বাঁশ দিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে গতিরোধ করতে কাজ করে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সড়কগুলোতে অটোরিকশা চলাচলের সংখ্যাই বেশি। অপ্রয়োজনে মানুষজন নানা অজুহাতে সড়কে চলাচল করছে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে। তবে দোকানপাটসহ বিপণিবিতানগুলো বন্ধ রয়েছে।

বেশ কয়েকজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ টহল অব্যাহত রেখেছে। শহরের প্রবেশ দ্বারে পুলিশ চেকপোস্ট বসিয়ে অন্যান্য স্থান থেকে আসা যানবাহনকে বাধা প্রদান করছে। শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে অটোবাইক আটকসহ মানুষজনকে স্বাস্থ্যবিধি অমান্যের কারণে জরিমানাসহ নানান দণ্ডবিধি অব্যাহত রেখেছে।

রংপুর প্রতিনিধি জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় রংপুরে করোনা আক্রান্ত হয়েছে ২০ জন। এ নিয়ে গত এক সপ্তাহে আক্রান্তের সংখ্যা ২শ’ ছাড়ালো। অন্যদিকে করোনা আক্রান্ত হয়ে ২৪ ঘণ্টায় আরও ২ জন মারা গেছে। এদিকে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় রংপুরে মানুষের মাঝে আতংক সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে হাসপাতালগুলোতে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় রংপুরে কোভিড-১৯ বিশেষায়িত হাসপাতালে রোগীদের নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসকদের। সেই সঙ্গে মাত্র ১০টি আইসিইউ বেড নিয়ে গুরুতর অনেক অসুস্থ রোগীর চিকিৎসা দেয়া যাচ্ছে না বলে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানিয়েছেন।

এ ব্যাপারে রংপুর হাসপাতালের সিভিল সার্জন ডা. হিরম্ব কুমার জানিয়েছেন, রংপুরে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। আক্রান্তের হার ২৫ ভাগে এসে পৌঁছেছে। অন্যদিকে নগরী ছাড়াও উপজেলা পর্যায়ে করোনা রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। সামাজিক দূরত্ব না মানা, মাস্ক না পরা, স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করার কারণে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে বলে জানান তিনি।

কুষ্টিয়া : কুষ্টিয়ায় দ্রুত বদলে যাচ্ছে করোনার দৃশ্যপট। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। গত এক সপ্তাহে এখানে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৬২৪ জন, একই সময়ে মারা গেছেন ১৬ জন। কুষ্টিয়ায় সর্বোচ্চ আক্রান্ত হয়েছে গত বৃহস্পতিবার, এদিন শনাক্ত হয়েছে ১৫৬ জন করোনা রোগী। মারা গেছেন ৪ জন।

জেলায় মোট আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়ালো ৬০৬৩ জন, সুস্থ হয়েছেন ৪৯৪৭ জন। মারা গেছেন ১৪০ জন।

গতকাল রাতে জেলা প্রশাসনের জারি করা এক সপ্তাহের জন্য কুষ্টিয়া পৌর এলাকায় কঠোর বিধিনিষেধ জারির সময় শেষ হয়েছে। তবে এ বিধিনিষেধ তেমন কোন সুফল এনে দিতে পারেনি।

এমন অবস্থায় এই বিধিনিষেধ বাড়িয়ে নতুন গণবিজ্ঞপ্তি জারি হবে বলে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এবারের বিধিনিষেধ আরও কঠোর হবে। যা আজ থেকে কার্যকর হওয়ার কথা।

এদিকে কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন এইচ এম আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, শহর থেকে প্রায় প্রতিটি গ্রামে করোনা ছড়িয়ে পড়েছে এবং এটা ভারতীয় ডেল্টা প্রকৃতির। কেননা আইসোলেশন ওয়ার্ডে এর আগে রোগীদের অ্যাটেনডেন্টরা কখনও আক্রান্ত হননি কিন্তু এখন হচ্ছে। তিনি মনে করেন, আরও করোনা শনাক্ত ছড়িয়ে পড়বে, একই সঙ্গে বাড়বে মৃত্যু। হাসপাতালে দিন দিন রোগী বাড়ায় সেখানে চিকিৎসক ও নার্সদের সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে ভয়াবহতার দিকে যাচ্ছে। জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আবদুল মোমেন বলেন, ২৫০ শয্যার এই হাসপাতালকে কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড ঘোষণা ছাড়া কোন উপায় দেখছি না।

জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এএসএম মুসা কবির বলেন, এখনই হটলাইন চালু করতে হবে। যারা আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের প্রত্যেককে ফোনে অডিও বা ভিডিও কলে ব্যবস্থাপত্র নিশ্চিত করতে হবে। এতে হাসপাতালের চাপ কমবে। মানুষকে ঘর থেকে বের না হতে যা যা প্রয়োজন, তার সবটুকু প্রয়োগ করতে হবে। এ ছাড়া কোনভাবেই করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ কমানো যাবে না।

যশোর : যশোরে কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেও প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ হার। জেলায় গড় করোনা শনাক্তের হার ৪৮.৬৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যে এই জেলায় করোনা আক্রান্ত হয়ে শতাধিক রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছে ৪ জন। এই সময়ে নতুন করে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ২৪৭ জন। করোনার প্রথম ধাপে চিহ্নিত করা হটস্পটগুলোতে দ্বিতীয় ধাপেও আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হচ্ছে। বর্তমানে শহর থেকে গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে সংক্রমণ।

করোনার প্রথম অবস্থায় আক্রান্তের সংখ্যা বেশি ছিল শহর এলাকাতে কিন্তু এখন করোনা সংক্রমণ গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে। গত ২ মাসে যশোর জেলায় যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের অধিকাংশের বাড়ি গ্রামে। এ পর্যন্ত যশোরে করোনায় ১০১ জন মারা গেছে। এরমধ্যে যশোর সদরে ৬৮, অভয়নগরে ১০, বাঘারপাড়ায় ৩, চৌগাছায় ৪, ঝিকরগাছায় ৩, কেশবপুর ৬ ও শার্শায় ৭ জন। এর মধ্যে যারা মারা গেছেন, তাদের অধিকাংশের বাড়ি গ্রামে।

সম্প্রতি মারা যাওয়া কয়েকজন হলেন, যশোর সদর উপজেলার ঝুমঝুমপুর এলাকার লিয়াকত আলী (৪৫), একই এলাকার ঝুমঝুমপুর এলাকার মাসুদ রানার মেয়ে সুমি খাতুন (১৪) এনায়েতপুর গ্রামের জিয়াউর রহমান জিয়া (৪০), নওদাগ্রামের সাহেব আলীর স্ত্রী বিউটি খাতুন (৩৫), যশোরের শার্শা উপজেলার মাটিপুকুর গ্রামের সাগর বিশ্বাসের ছেলে আলমগীর হোসেন (৩৬), রঘুনাথপুর গ্রামের মৃত আজগর আলীর ছেলে রফি উদ্দিন (৭০), ধান্যতাড়া গ্রামের মৃত ইমাম আলীর ছেলে আতিয়ার রহমান (৭৫) ও কাশিয়ানী গ্রামের মতিয়ার রহমানের স্ত্রী মরিয়ম বেগম (৪০), চৌগাছা উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের বড় খানপুর গ্রামের বাসিন্দা আমিন উদ্দিন (৬৫), নারায়ণপুর গ্রামের জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী সুফিয়া বেগম (৪৮), বড় খানপুর গ্রামের বাসিন্দা আমিন উদ্দিন (৬৫), মণিরামপুর উপজেলার রাজগঞ্জ উপজেলার ফজলুর রহমানের ছেলে শাহবুদ্দিন (৬৫), ঝিকরগাছা উপজেলার নাভারণ এলাকার হাবীবুর রহমানের স্ত্রী আঞ্জুয়ারা বেগম (৫৫), বাঘারপাড়া উপজেলার চণ্ডীপুর গ্রামের জয়নুদ্দিনের ছেলে ও জহুরপুর ইউনিয়ন পরিষদের সচিব কামরুজ্জামান তুহিন (৪৫)। এসব গ্রামে আক্রান্তের সংখ্যাও বেশি হচ্ছে।

সিভিল সার্জন অফিসের একটি সূত্র জানায়, করোনার প্রথম ধাপে যেসব এলাকা রেডজোন ঘোষণা করা হয়েছিল। করোনার দ্বিতীয় ধাপেও সেইসব এলাকায় আক্রান্ত লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। যশোর সিভিল সার্জন ডা. শেখ আবু শাহীন জানান, ১৮ জুন পর্যন্ত যশোর জেলায় ৯ হাজার ২৪১ জন কোভিড-১৯এ আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ১০১ জন নারী-পুরুষ। সুস্থ হয়েছেন ৬ হাজার ৭শ’ ৪০ জন। এখনও হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৮৪ জন। হোম এবং হাসপাতাল আইসোলেশনে চিকিৎসাধীন আছেন ২ হাজার ৩শ’ ১৬ জন।

যবিপ্রবির অনুজীব বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও পরীক্ষণ দলের সদস্য অধ্যাপক ড. ইকবাল কবীর জাহিদ জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় যবিপ্রবির জিনোম সেন্টারে নমুনা পরীক্ষায় ২৭২ জনের কোভিড-১৯ পজেটিভ ফল এসেছে। এরমধ্যে যশোরের ৫৩৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ২৪৭ জনের, মাগুরার ৩৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ১০ জনের ও নড়াইলের ৭৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ১৫ জনের নমুনাতে কোভিড-১৯ পজেটিভ পাওয়া গেছে।

অর্থাৎ যবিপ্রবির ল্যাবে মোট ৬৫০ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ২৭২ জনের করোনা পজেটিভ এবং ৩৭৮ জনের নেগেটিভ ফল এসেছে।

যবিপ্রবি ছাড়াও যশোরে বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, যশোর আড়াইশ’ শয্যা হাসপাতালে অ্যান্টিজেন ও জিন এক্সপার্ট পরীক্ষার পর আরও ৪৪ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে। এরমধ্যে যশোর সদর উপজেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় ২১৪, অভয়নগরে ১৭, চৌগাছায় ৮, ঝিকরগাছায় ২৬, কেশবপুরে ৩, মণিরামপুরে ২ ও শার্শায় ২১ জন।

করোনা আক্রান্তের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়তে থাকায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ৯ জুন রাত থেকে যশোর ও নওয়াপাড়া পৌরসভার সব ওয়ার্ডে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ তমিজুল ইসলাম। এরমধ্যে করোনা পরিস্থিতি প্রতিদিন রেকর্ড ভাঙছে। এরপর গত ১৫ জুন জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির দ্বিতীয় সভায় বিধিনিষেধ বাড়িয়ে যুক্ত করা হয় ঝিকরগাছা পৌরসভা, সদরের উপশহর, নওয়াপাড়া, আরবপুর, চাঁচড়া, শার্শা ইউনিয়ন ও বেনাপোল বাজার।

যশোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজেস্ট্রেট কাজী মো. সায়েমুজ্জামান বলেন, করোনা শনাক্তের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় আর একটি করোনা ডেডিকেটেড হসপিটাল প্রস্তুত করা হয়েছে। সদর হসপিটালে করোনা রোগীর চাপ বৃদ্ধি পেলে সেখানেও রোগী হস্তান্তর শুরু করা হবে। পাশাপাশি লকডাউনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে প্রশাসন সর্বোচ্চ তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে।

শনিবার, ১৯ জুন ২০২১ , ৫ আষাঢ় ১৪২৮ ৭ জিলকদ ১৪৪২

উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলে রোগীর ভিড়, হাসপাতালে শয্যা সংকট

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

দেশের উত্তর এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী জেলায় বেড়েই চলেছে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুহার। নেয়া হয়েছে আঞ্চলিক লকডাউনসহ নানা পরিকল্পনা। তবুও কমানো যাচ্ছে না দেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর করোনা সংক্রমণ। হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে নতুন রোগী, শয্যা সংকট দেখা দিয়েছে। বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতার অভাব। মানুষের চলাচলের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হলেও কেউ বিধি মোটেও মেনে চলছেন না। খোদ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, উত্তরবঙ্গের হাসপাতালগুলো করোনা রোগীতে ভরে গেছে। রোগীদের সামাল দেয়া কঠিন হচ্ছে। আমরা চাই না ঢাকা ও দেশের অন্যান্য জেলায় এই সমস্যা দেখা দিক। এদিকে, বিশেষ করে করোনার হটস্পট এখনও রাজশাহী। এই জেলায় একদিনে ৩৫৯ জনের করোনা ধরা পড়েছে। এটি গত ২৪ ঘণ্টায় বিভাগে করোনা সংক্রমণের সর্বোচ্চ রেকর্ড। এছাড়া হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদের ৪০ ভাগই আসছেন গ্রাম থেকে। তারা এতটা দেরি করে আসছেন যে কেউ কেউ পথেই মারা যাচ্ছেন।

অন্যদিকে, উত্তরবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলার হাসপাতালগুলোতে করোনা মোকাবিলায় রীতিমতো যেন ভেঙে পড়েছে সামগ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থা। সাধারণ জ্বর-কাশি তো নয়ই, হৃদরোগসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্তরাও চিকিৎসা পাচ্ছেন না হাসপাতালে। সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্লান্ট, সিসিইউ, আইসিইউ, হাইফ্লো ন্যাজাল, ক্যানুলাসহ কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার ন্যূনতম ব্যবস্থা নেই। কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার প্রাথমিক যে উপকরণ অক্সিজেন তারও পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই। সিলিন্ডারের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ কিছুটা বজায় রাখা হয়েছে। নেই কাক্সিক্ষত জনবলও। এ অবস্থায় শহরের মতো গ্রামেও লকডাউন দেয়া এবং মানুষের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, যত দ্রুত রোগী বাড়ছে তত দ্রুত সক্ষমতা বাড়ানো যাচ্ছে না। ফলে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

দেশের কোন কোন জেলায় করোনার সংক্রমণ ৩০-৪০ শতাংশ হয়ে গেছে উল্লেখ করে জাহিদ মালেক বলেন, ‘দেশের উত্তরবঙ্গে, বিশেষ করে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রংপুর, খুলনা, সাতক্ষীরা ও নওগাঁয় করোনা সংক্রমণ বেড়েছে। নোয়াখালীতেও করোনা বাড়তি এবং রাজবাড়ী পর্যন্তও পৌঁছে গেছে।’

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঢাকায় এখন ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সামাজিক সংক্রমণের সময়কাল চলছে। ঢাকায় যারা এখনও ভ্যাকসিন পায় নাই, যারা এখনও করোনা আক্রান্ত হননি তারা এই ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। ঢাকায় যদিও সংক্রমণ কম হলেও, ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোয় এই ভ্যারিয়েন্টের প্রভাব পড়বে, সেখানে সংক্রমণ বাড়বে আর সেখানকার রোগীদের ঢাকায় নিয়ে আসা হবে, তখন এখানে চাপ বেড়ে যাবে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘সংক্রমণ হার রোধ করতে হলে আমাদের কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। ‘গণপরিবহনে গাদাগাদি করে যাত্রী যাতায়াত করে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এসব কারণে সংক্রমণ হার বাড়ছে। গণপরিবহনে সরকারের নির্দেশ মেনে যাতায়াত করতে হবে এবং অর্ধেক সিট খালি রাখতে হবে।’

প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর

রাজশাহী : রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৬ করোনা পজেটিভ ছিলেন। বাকিরা মারা যান উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায়। হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে শুক্রবার সকাল ৬টার মধ্যে বিভিন্ন সময় তারা মারা যান। মৃতদের মধ্যে রাজশাহীর ৫ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ২, নাটোরের ২ ও নওগাঁর ৩ জন করে। এ নিয়ে চলতি মাসের গত ১৮ দিনে (১ জুন সকাল ৬টা থেকে ১৮ জুন সকাল ৬টা পর্যন্ত) এ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে মারা গেছেন ১৮৩ জন।

শামীম ইয়াজদানী জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪১ জন। গত বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত এ হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৩৪৯ জন। আগের দিন ভর্তি ছিলেন ৩৫৮ জন। চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা কমেছে।

তিনি জানান, গত ১৩ ও ১৬ জুন ১৩ জন করে এবং ১৪ ও ১৫ জুন ১২ জন করে মারা যায়। চলতি মাসে সবচেয়ে বেশি মারা যায় গত ৪ জুন ১৬ জন এবং সবচেয়ে কম ১২ জুন চারজন আর রোগী ভর্তি গত ১৫ জুন ৫৮ জন, ১৬ জুন ৪৮ জন এবং ১৭ জুন ৪৪ জন। চলতি মাসে সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হয়েছে ১৫ জুন ৫৮ জন।

শামীম ইয়াজদানী জানান, গত বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত এ হাসপাতালের ২০টি আইসিইউসহ ৩০৯ বেডের বিপরীতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৩৫৮ জন। এর মধ্যে রাজশাহীর ১৯৯, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৯৮, নাটোরের ২৪, নওগাঁর ২৪, পাবনার ৪, কুষ্টিয়ার ৪, চুয়াডাঙ্গার ২ জন রয়েছেন।

চিকিৎসাধীন ৩৫৮ রোগীর মধ্যে করোনা পজেটিভ ১৬৪ জন। বাকিদের শ্বাসকষ্টসহ করোনা উপসর্গ রয়েছে। তাদের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হওয়া ৪৪ রোগীর মধ্যে রাজশাহীর ২৬ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সাত, নাটোরের চার, নওগাঁর চার, মেহেরপুরের দুই ও চুয়াডাঙ্গার একজন। একই সময় সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ৩১ জন।

রাজশাহীতে সামান্য কমেছে করোনা শনাক্তের হার। গত বুধবার দুটি ল্যাবে রাজশাহীর ৪০০ নমুনা পরীক্ষা করে ১৬৬ জনের শরীরে করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে। রাতে প্রকাশিত দুটি পিসিআর ল্যাবের নমুনা পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, আগের দিনের চেয়ে ১ দশমিক ৯৪ শতাংশ কমে করোনা শনাক্তের হার হয়েছে ৪১ দশমিক ৫০ শতাংশ। যা আগের দিন মঙ্গলবার ছিল ৪৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ। রাজশাহীতে করোনা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় শুধু সিটি করপোরেশন এলাকায় সাতদিনের সর্বাত্মক লকডাউন দেয়া হয়েছে। তবে করোনা ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামেও। রাজশাহীর উপজেলাগুলোর বাড়িতে বাড়িতে এখন জ্বর, সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্টের রোগী। শহর থেকে পশ্চিমে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সঙ্গে লাগোয়া রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও তানোর উপজেলার অবস্থা বেশি খারাপ।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী জানিয়েছেন, হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদের ৪০ ভাগই আসছেন গ্রাম থেকে। তারা এতটা দেরি করে আসছেন যে কেউ কেউ মারাও যাচ্ছেন। এ অবস্থায় শহরের মতো গ্রামেও লকডাউন দেয়া এবং মানুষের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন তিনি।

রাজশাহীর সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, গত ১৫ মার্চ রাজশাহীর ৯ উপজেলার কোথাও করোনা রোগী ছিল না। সেদিন শুধু সিটি করপোরেশন এলাকায় রোগীর সংখ্যা ছিল ২৪৩ জন। এর একমাস আগে ১৫ এপ্রিল রাজশাহীর ৯ উপজেলায় ৬০ জন শনাক্ত করোনা রোগী ছিলেন আর গত ১৫ মে ৯ উপজেলায় রোগীর সংখ্যা কমে ২২ জনে দাঁড়ায়। এর একমাস পর গত মঙ্গলবার জেলার ৯ উপজেলায় রোগীর সংখ্যা বেড়ে ৭৬০ জনে দাঁড়িয়েছে।

হাসপাতাল পরিচালক শামীম ইয়াজদানী বলছেন, যত দ্রুত রোগী বাড়ছে তত দ্রুত সক্ষমতা বাড়ানো যাচ্ছে না। ফলে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এছাড়া করোনা রোগীদের জন্য নতুন নতুন ওয়ার্ড ছেড়ে দেয়ার কারণে অন্যান্য সাধারণ রোগের চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

উত্তরবঙ্গের বৃহৎ এই হাসপাতালটিতে মোট ১ হাজার ২০০টি শয্যা আছে। এখানে রাজশাহী ছাড়াও চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ, জয়পুরহাট, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গার রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসেন আর কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে ভিড় আরও বেড়েছে। হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে লকডাউন একটি উত্তম পন্থা। টানা দুই সপ্তাহ সর্বাত্মক লকডাউন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হলে ভালো ফল পাওয়া যায়। রাজশাহীর যে লকডাউন চলছে এতে আমরা সুফল পাব বলে আশা করছি।

নাটোর : নাটোর ও সিংড়া পৌরসভায় দ্বিতীয় দফায় লকডাউনের দ্বিতীয় দিন চলছে। জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান সত্ত্বেও শহর এলাকায় সংক্রমণ হার বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে। কোনভাবেই তা কমছে না। গতকাল সকালে সিভিল সার্জন ডা. মিজানুর রহমান জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় আজ ২৭৬ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৬৫ জন করোনা পজেটিভ হয়েছেন। পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ২৩.৫৫ শতাংশ। নাটোর সদর উপজেলার ২৮ জন, এর মধ্যে শহরের ১৮ জন। করোনা উপসর্গ নিয়ে নাটোর সদর হাসপাতালে মারা গেছেন এক নারী ও দুইজন পুরুষ। গত বৃহস্পতিবার ২৪ ঘণ্টায় নাটোরে ১২৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করে নতুন করে ৬৬ জন আক্রান্ত ছিল। সংক্রমণ হার ছিল ৫১.৫০ শতাংশ। শহর এলাকায় ৫০ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৩৮ জনের করোনা পজেটিভ রেজাল্ট পাওয়া গিয়েছিল। সংক্রমণ হার ছিল ৭০.৬৫ শতাংশ। গত এক সপ্তাহে ১০০৪ জনের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষায় ৪৪৯ জন করোনা পজেটিভ হন।

পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ৪৪.৭২ শতাংশ। এক সপ্তাহে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৮ জন। তবে এতসংখ্যক শনাক্ত হলেও এর মধ্যে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট আছে কিনা তা জানাতে পারেননি জেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।

নাটোর সদর হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্লান্ট, সিসিইউ, আইসিইউ, হাইফ্লো ন্যাজাল, ক্যানুলাসহ কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার ন্যূনতম ব্যবস্থা নেই। কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার প্রাথমিক যে উপকরণ অক্সিজেন তারও পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই। সিলিন্ডারের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ কিছুটা বজায় রাখা হয়েছে। নেই কাক্সিক্ষত জনবলও। রোগীর অবস্থা কিছুটা জটিল হলেই তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। এভাবেই সংক্রমণ হার বৃদ্ধি পেতে থাকলে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে বলে মনে করে সচেতন মহল।

দিনাজপুর : উত্তরবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলা দিনাজপুরে দফায় দফায় বেড়ে চলেছে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুহার। সপ্তাহের শুরুতে জেলায় করোনা সংক্রমণ হার ছিল ২৯ দশমিক ৯৩ ভাগ। সপ্তাহ শেষে সে হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৭ দশমিক ৪৪ ভাগে। মারা গেছেন ১০ জন। গতকাল দিনাজপুর সিভিল সার্জন এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, গত এক সপ্তাহে জেলায় ১ হাজার ৮শ’ ৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৬শ’ ৬৭ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়। মৃত ১০ জনের মধ্যে ৮ জন সদরের ও ২ জন বিরামপুর উপজেলার। তবে সুস্থতার হার কম। গত এক সপ্তাহে সুস্থ হয়েছেন ১শ’ ৬০ জন।

এদিকে সংক্রমণ ও মৃত্যুহার বৃদ্ধি বিবেচনায় জেলার সদর ও হাকিমপুর উপজেলায় ৭ দিনের লকডাউন ঘোষণা করেছে জেলা করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ কমিটি। লকডাউন চলবে আগামী ২১ জুন রাত ১২ পর্যন্ত।

গতকাল দিনাজপুরে কোভিড-১৯ সংক্রমণসংক্রান্ত নিয়মিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে সিভিল সার্জন ডা. আবদুল কুদ্দুছ জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় দিনাজপুরে ১শ’ ৯৬ জনকে পরীক্ষা করে ৯৩ জনের দেহে করোনা পজেটিভ শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ৪৭ দশমিক ৪৪ ভাগ আর এদের মধ্যে ৬৮ জনই সদরের। জেলায় মোট আক্রান্ত ৬ হাজার ৮শ’ ১১ জন। সদরেই আক্রান্ত মোট ৩ হাজার ৯শ’ ৪২ জন। জেলায় এ পর্যন্ত মারা গেছেন ১শ’ ৪৭ জন। এর মধ্যে সদরেই ৭৪ জন।

সদরে ১৫ জুন হতে লকডাউনে মানুষের চলাচলের উপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হলেও মানুষজন স্বাস্থ্যবিধি মোটেও মেনে চলছেন না। গতকাল লকডাউনের চতুর্থ দিনে অফিস-আদালত বন্ধ থাকায় অস্থায়ী কাঁচাবাজারেগুলোতে মানুষের ভিড় নেমেছে। মাস্ক পরলেও এদের মধ্যে শারীরিক দূরত্ব মেনে চলার প্রবণতা কারোর মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ঢিলেঢালাভাবে চলছে লকডাউন। স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করে হালকা যানবাহন ও মানুষজন সড়ক-মহাসড়কে অবাধে বিচরণ করছে।

লকডাউনের আওতায় বাস-মাইক্রোবাস, কার চলাচল বন্ধসহ অন্যান্য হালকা যানবাহন শহরের প্রবেশপথগুলোতে বাঁশ দিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে গতিরোধ করতে কাজ করে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সড়কগুলোতে অটোরিকশা চলাচলের সংখ্যাই বেশি। অপ্রয়োজনে মানুষজন নানা অজুহাতে সড়কে চলাচল করছে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে। তবে দোকানপাটসহ বিপণিবিতানগুলো বন্ধ রয়েছে।

বেশ কয়েকজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ টহল অব্যাহত রেখেছে। শহরের প্রবেশ দ্বারে পুলিশ চেকপোস্ট বসিয়ে অন্যান্য স্থান থেকে আসা যানবাহনকে বাধা প্রদান করছে। শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে অটোবাইক আটকসহ মানুষজনকে স্বাস্থ্যবিধি অমান্যের কারণে জরিমানাসহ নানান দণ্ডবিধি অব্যাহত রেখেছে।

রংপুর প্রতিনিধি জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় রংপুরে করোনা আক্রান্ত হয়েছে ২০ জন। এ নিয়ে গত এক সপ্তাহে আক্রান্তের সংখ্যা ২শ’ ছাড়ালো। অন্যদিকে করোনা আক্রান্ত হয়ে ২৪ ঘণ্টায় আরও ২ জন মারা গেছে। এদিকে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় রংপুরে মানুষের মাঝে আতংক সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে হাসপাতালগুলোতে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় রংপুরে কোভিড-১৯ বিশেষায়িত হাসপাতালে রোগীদের নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসকদের। সেই সঙ্গে মাত্র ১০টি আইসিইউ বেড নিয়ে গুরুতর অনেক অসুস্থ রোগীর চিকিৎসা দেয়া যাচ্ছে না বলে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানিয়েছেন।

এ ব্যাপারে রংপুর হাসপাতালের সিভিল সার্জন ডা. হিরম্ব কুমার জানিয়েছেন, রংপুরে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। আক্রান্তের হার ২৫ ভাগে এসে পৌঁছেছে। অন্যদিকে নগরী ছাড়াও উপজেলা পর্যায়ে করোনা রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। সামাজিক দূরত্ব না মানা, মাস্ক না পরা, স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করার কারণে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে বলে জানান তিনি।

কুষ্টিয়া : কুষ্টিয়ায় দ্রুত বদলে যাচ্ছে করোনার দৃশ্যপট। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। গত এক সপ্তাহে এখানে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৬২৪ জন, একই সময়ে মারা গেছেন ১৬ জন। কুষ্টিয়ায় সর্বোচ্চ আক্রান্ত হয়েছে গত বৃহস্পতিবার, এদিন শনাক্ত হয়েছে ১৫৬ জন করোনা রোগী। মারা গেছেন ৪ জন।

জেলায় মোট আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়ালো ৬০৬৩ জন, সুস্থ হয়েছেন ৪৯৪৭ জন। মারা গেছেন ১৪০ জন।

গতকাল রাতে জেলা প্রশাসনের জারি করা এক সপ্তাহের জন্য কুষ্টিয়া পৌর এলাকায় কঠোর বিধিনিষেধ জারির সময় শেষ হয়েছে। তবে এ বিধিনিষেধ তেমন কোন সুফল এনে দিতে পারেনি।

এমন অবস্থায় এই বিধিনিষেধ বাড়িয়ে নতুন গণবিজ্ঞপ্তি জারি হবে বলে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এবারের বিধিনিষেধ আরও কঠোর হবে। যা আজ থেকে কার্যকর হওয়ার কথা।

এদিকে কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন এইচ এম আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, শহর থেকে প্রায় প্রতিটি গ্রামে করোনা ছড়িয়ে পড়েছে এবং এটা ভারতীয় ডেল্টা প্রকৃতির। কেননা আইসোলেশন ওয়ার্ডে এর আগে রোগীদের অ্যাটেনডেন্টরা কখনও আক্রান্ত হননি কিন্তু এখন হচ্ছে। তিনি মনে করেন, আরও করোনা শনাক্ত ছড়িয়ে পড়বে, একই সঙ্গে বাড়বে মৃত্যু। হাসপাতালে দিন দিন রোগী বাড়ায় সেখানে চিকিৎসক ও নার্সদের সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে ভয়াবহতার দিকে যাচ্ছে। জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আবদুল মোমেন বলেন, ২৫০ শয্যার এই হাসপাতালকে কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড ঘোষণা ছাড়া কোন উপায় দেখছি না।

জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এএসএম মুসা কবির বলেন, এখনই হটলাইন চালু করতে হবে। যারা আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের প্রত্যেককে ফোনে অডিও বা ভিডিও কলে ব্যবস্থাপত্র নিশ্চিত করতে হবে। এতে হাসপাতালের চাপ কমবে। মানুষকে ঘর থেকে বের না হতে যা যা প্রয়োজন, তার সবটুকু প্রয়োগ করতে হবে। এ ছাড়া কোনভাবেই করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ কমানো যাবে না।

যশোর : যশোরে কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেও প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ হার। জেলায় গড় করোনা শনাক্তের হার ৪৮.৬৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যে এই জেলায় করোনা আক্রান্ত হয়ে শতাধিক রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছে ৪ জন। এই সময়ে নতুন করে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ২৪৭ জন। করোনার প্রথম ধাপে চিহ্নিত করা হটস্পটগুলোতে দ্বিতীয় ধাপেও আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হচ্ছে। বর্তমানে শহর থেকে গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে সংক্রমণ।

করোনার প্রথম অবস্থায় আক্রান্তের সংখ্যা বেশি ছিল শহর এলাকাতে কিন্তু এখন করোনা সংক্রমণ গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে। গত ২ মাসে যশোর জেলায় যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের অধিকাংশের বাড়ি গ্রামে। এ পর্যন্ত যশোরে করোনায় ১০১ জন মারা গেছে। এরমধ্যে যশোর সদরে ৬৮, অভয়নগরে ১০, বাঘারপাড়ায় ৩, চৌগাছায় ৪, ঝিকরগাছায় ৩, কেশবপুর ৬ ও শার্শায় ৭ জন। এর মধ্যে যারা মারা গেছেন, তাদের অধিকাংশের বাড়ি গ্রামে।

সম্প্রতি মারা যাওয়া কয়েকজন হলেন, যশোর সদর উপজেলার ঝুমঝুমপুর এলাকার লিয়াকত আলী (৪৫), একই এলাকার ঝুমঝুমপুর এলাকার মাসুদ রানার মেয়ে সুমি খাতুন (১৪) এনায়েতপুর গ্রামের জিয়াউর রহমান জিয়া (৪০), নওদাগ্রামের সাহেব আলীর স্ত্রী বিউটি খাতুন (৩৫), যশোরের শার্শা উপজেলার মাটিপুকুর গ্রামের সাগর বিশ্বাসের ছেলে আলমগীর হোসেন (৩৬), রঘুনাথপুর গ্রামের মৃত আজগর আলীর ছেলে রফি উদ্দিন (৭০), ধান্যতাড়া গ্রামের মৃত ইমাম আলীর ছেলে আতিয়ার রহমান (৭৫) ও কাশিয়ানী গ্রামের মতিয়ার রহমানের স্ত্রী মরিয়ম বেগম (৪০), চৌগাছা উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের বড় খানপুর গ্রামের বাসিন্দা আমিন উদ্দিন (৬৫), নারায়ণপুর গ্রামের জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী সুফিয়া বেগম (৪৮), বড় খানপুর গ্রামের বাসিন্দা আমিন উদ্দিন (৬৫), মণিরামপুর উপজেলার রাজগঞ্জ উপজেলার ফজলুর রহমানের ছেলে শাহবুদ্দিন (৬৫), ঝিকরগাছা উপজেলার নাভারণ এলাকার হাবীবুর রহমানের স্ত্রী আঞ্জুয়ারা বেগম (৫৫), বাঘারপাড়া উপজেলার চণ্ডীপুর গ্রামের জয়নুদ্দিনের ছেলে ও জহুরপুর ইউনিয়ন পরিষদের সচিব কামরুজ্জামান তুহিন (৪৫)। এসব গ্রামে আক্রান্তের সংখ্যাও বেশি হচ্ছে।

সিভিল সার্জন অফিসের একটি সূত্র জানায়, করোনার প্রথম ধাপে যেসব এলাকা রেডজোন ঘোষণা করা হয়েছিল। করোনার দ্বিতীয় ধাপেও সেইসব এলাকায় আক্রান্ত লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। যশোর সিভিল সার্জন ডা. শেখ আবু শাহীন জানান, ১৮ জুন পর্যন্ত যশোর জেলায় ৯ হাজার ২৪১ জন কোভিড-১৯এ আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ১০১ জন নারী-পুরুষ। সুস্থ হয়েছেন ৬ হাজার ৭শ’ ৪০ জন। এখনও হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৮৪ জন। হোম এবং হাসপাতাল আইসোলেশনে চিকিৎসাধীন আছেন ২ হাজার ৩শ’ ১৬ জন।

যবিপ্রবির অনুজীব বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও পরীক্ষণ দলের সদস্য অধ্যাপক ড. ইকবাল কবীর জাহিদ জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় যবিপ্রবির জিনোম সেন্টারে নমুনা পরীক্ষায় ২৭২ জনের কোভিড-১৯ পজেটিভ ফল এসেছে। এরমধ্যে যশোরের ৫৩৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ২৪৭ জনের, মাগুরার ৩৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ১০ জনের ও নড়াইলের ৭৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ১৫ জনের নমুনাতে কোভিড-১৯ পজেটিভ পাওয়া গেছে।

অর্থাৎ যবিপ্রবির ল্যাবে মোট ৬৫০ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ২৭২ জনের করোনা পজেটিভ এবং ৩৭৮ জনের নেগেটিভ ফল এসেছে।

যবিপ্রবি ছাড়াও যশোরে বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, যশোর আড়াইশ’ শয্যা হাসপাতালে অ্যান্টিজেন ও জিন এক্সপার্ট পরীক্ষার পর আরও ৪৪ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে। এরমধ্যে যশোর সদর উপজেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় ২১৪, অভয়নগরে ১৭, চৌগাছায় ৮, ঝিকরগাছায় ২৬, কেশবপুরে ৩, মণিরামপুরে ২ ও শার্শায় ২১ জন।

করোনা আক্রান্তের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়তে থাকায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ৯ জুন রাত থেকে যশোর ও নওয়াপাড়া পৌরসভার সব ওয়ার্ডে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ তমিজুল ইসলাম। এরমধ্যে করোনা পরিস্থিতি প্রতিদিন রেকর্ড ভাঙছে। এরপর গত ১৫ জুন জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির দ্বিতীয় সভায় বিধিনিষেধ বাড়িয়ে যুক্ত করা হয় ঝিকরগাছা পৌরসভা, সদরের উপশহর, নওয়াপাড়া, আরবপুর, চাঁচড়া, শার্শা ইউনিয়ন ও বেনাপোল বাজার।

যশোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজেস্ট্রেট কাজী মো. সায়েমুজ্জামান বলেন, করোনা শনাক্তের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় আর একটি করোনা ডেডিকেটেড হসপিটাল প্রস্তুত করা হয়েছে। সদর হসপিটালে করোনা রোগীর চাপ বৃদ্ধি পেলে সেখানেও রোগী হস্তান্তর শুরু করা হবে। পাশাপাশি লকডাউনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে প্রশাসন সর্বোচ্চ তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে।