শিশু তৃষা ধর্ষণ ও হত্যা : স্বীকারোক্তি, আলামত, প্রমাণ, তারপরও খালাস

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট, তদন্ত প্রতিবেদন, সাক্ষ্য সবই ঠিক কিন্তু রায় হয়েছে একদম উল্টো। এক শিশুকে ধর্ষণ ও হত্যা করে আসামিরা সবাই খালাস পেয়েছে। তারা এখন বুক ফুলিয়ে, মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর বাদী জীবনের শঙ্কায় পরিবার নিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। এই রায়ে বাদী, আইনজীবী, এলাকাবাসী, যশোরের সচেতন মানুষ ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত।

তৃষা আফরিন কথা। কারবালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২য় শ্রেণীর ছাত্রী ছিল। ২০১৯ সালের ৩ মার্চ বিকেলে বাড়ির পাশে গির্জার মাঠে খেলতে যায় তৃষা। সেখান থেকে দুর্বৃত্তরা তাকে ফুঁসলিয়ে নিয়ে যায় এবং কয়েকজন মিলে ধর্ষণ করে। পরবর্তীতে তাকে শ^াসরোধে হত্যা করে একটি বস্তায় ভরে মাটি খুঁড়ে পুতে রাখে। হত্যার পরদিন ৪ মার্চ তার দেহ উদ্ধার করা হয়। তৃষার বাবা যশোর কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলা করেন।

তৃষার বাবা তরিকুল ইসলাম যশোর শহরে ইজিবাইক চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তার আদি বাড়ি নড়াইল জেলায়। জীবিকার প্রয়োজনে যশোর শহরে এসে খোলাডাঙ্গায় ভাড়া বাড়িতে পরিবারসহ বসবাস করতেন।

চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি যশোরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক টিএম মুসা এই মামলার রায় ঘোষণা করেন।

খালাসপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন শহরের খোলাডাঙ্গা গাজীপাড়ার কামরুজ্জামানের ছেলে মেহেদী হাসান শক্তি এবং মৃত আবদুল আওয়ালের ছেলে সাইফুল ইসলাম। এই মামলার প্রধান সন্দেহভাজন শামীম পুলিশের কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়।

সম্প্রতি এই মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি পাওয়া গেছে। রায়ে বর্ণনা ও পর্যবেক্ষণে বেশকিছু অসঙ্গতি থাকায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন আইনজীবীরা।

মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০১৯ সালের ৩ মার্চ বিকেলে বাড়ির পাশে গির্জার মাঠে খেলতে যায় তৃষা। সন্ধ্যার পরও তৃষা বাড়ি না ফেরায় স্বজনরা খোঁজাখুঁজি করেন, কিন্তু তার খোঁজ মেলেনি।

পরদিন তৃষার বাবা কোতোয়ালি মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। এদিন বিকেলে এলাকার প্রফুল্ল’র বাড়ির পাশে মাটি খোঁড়া দেখে সবার সন্দেহ হয়। এরপর সেখানকার মাটি সরিয়ে বস্তাবন্দী তৃষার লাশ উদ্ধার করা হয়। তৃষার বাবা তরিকুল তখন অজ্ঞাতনামা আসামি দিয়ে কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।

মামলার তদন্ত সূত্রে জানা যায়, তৃষা হত্যা ও ধর্ষণে জড়িত সন্দেহে তদন্ত কর্মকর্তা যশোর কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক শেহাবুর রহমান আসামি সাইফুল ইসলামকে আটক করেন। সাইফুল ইসলাম একই এলাকার আবদুল আওয়ালের ছেলে। ওই সময় সাইফুল হত্যা ও ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা পুলিশের কাছে স্বীকার করে। এরপর এই ঘটনার প্রধান সন্দেহভাজন শামীমকে পুলিশ আটক করতে গেলে দুইপক্ষের মধ্যে ‘গোলাগুলিতে’ শামীম নিহত হয়।

শামীমকে মাদক সেবনে বাধা ও জোর করে ইজিবাইকে উঠা নিয়ে তৃষার বাবার সঙ্গে বিরোধের জেরে পরিকল্পিতভাবে তারা তৃষাকে ধর্ষণের পর হত্যা করেছিল বলে তদন্তে উঠে আসে। তদন্ত শেষে আটক আসামিদের দেয়া তথ্য ও সাক্ষীদের বক্তব্যে হত্যা ও ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত থাকায় মেহেদী হাসান শক্তি এবং সাইফুলসহ দু’জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন পুলিশ পরিদর্শক শেহাবুর রহমান শিহাব।

দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে বলা হয়, আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগের কোন প্রমাণ না পাওয়ায় তাদের খালাস দেয়া হয়। এই রায়ে তৃষার বাবা, মা, মামলার আইনজীবী এবং যশোরের বিভিন্নস্তরের মানুষ বিস্মিত, স্তম্ভিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছে। আর ১৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ে বেশকিছু অসঙ্গতি তুলে ধরেছেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা।

আইনজীবীদের মতে, মামলার ভিকটিম তৃষাকে ডেকে নিয়ে আসামি শামীমের ঘরে ধর্ষণ ও হত্যা এবং শামীমের বাড়ির পেছনে পুঁতে রাখা হয়। ফলে এই মামলার কোন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী নেই। কিন্তু আসামি সাইফুল ইসলামের স্বীকারোক্তি, ভিকটিমের পরিধেয় জামা ও প্যান্টের ছেঁড়া অংশ সাইফুলের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী তার ঘর থেকে উদ্ধার, লাশ উদ্ধারসহ পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য দ্বারা মামলাটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও রায়ে আসামিদের খালাস দেয়া হয়েছে।

রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়েছে, তদন্তকারী কর্মকর্তা আসামি সাইফুলের রিমান্ড শেষে প্রদত্ত প্রতিবেদনে দুটি মেডিকেল টিকিট দিয়েছেন। টিকিটে ‘ট্রমাটিক পেইন ও ফিভার (জ্বর)’ লেখা আছে। ফলে আসামিকে রিমান্ডে নিয়ে মারপিট করে দোষ স্বীকার (১৬৪ ধারায়) করানো হয়েছে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।

কিন্তু আইনজীবীদের মতে, এই পর্যবেক্ষণ যথার্থ নয়। কারণ ট্রমাটিক পেইন অর্থ শারীরিক আঘাত নয়, এটা মানসিক আঘাতকে বুঝায়। তৃষার মতো একটি শিশুকে ধর্ষণ ও হত্যা করার কারণে আসামি সাইফুল ট্রমাটিক পেইনে ভুগছিলেন, এমন পর্যবেক্ষণ আসাই প্রাসঙ্গিক ও আইনানুগ ছিল। আর ফিভার বা জ্বর, সেটা যে শারীরিক আঘাতের কারণেই হয়েছে, এমন পর্যবেক্ষণও মোটেই আইনানুগ নয়।

আসামি সাইফুল ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছে, ‘সে তৃষার পায়ুপথে ধর্ষণ করে চলে যায়। তখন তৃষা অজ্ঞান অবস্থায় পড়েছিল।’ অথচ রায়ের ১৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আসামি সাইফুলের স্বীকারোক্তি মতে, এই আসামি শামীমের ঘরে ঢুকার আগেই ভিকটিমের হাত পা বাঁধা ও মুখে কাপড় গুঁজে ধর্ষণসহ হত্যা করা হয়েছিল দেখা যায়।’ অর্থাৎ জবানবন্দিতে সাইফুল বলেছে, তৃষা অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল, সাইফুলের বয়ান উদৃত করে রায়ে বলা হয়েছে, ‘ ধর্ষণসহ হত্যা করা হয়েছিল দেখা যায়’। জব্দ তালিকা অনুযায়ী, তৃষার পরিধেয় জামা ও প্যান্টের ছেঁড়া অংশ আসামি সাইফুলের দেখানো মতে তার ঘর থেকে উদ্ধার এবং জব্দ তালিকা করা হয়। সাক্ষ্য আইনের ২৭ ধারা মতে এই আলামত উদ্ধার আসামির বিরুদ্ধে শতভাগ প্রমাণ বহন করে। আরেকটি জব্দ তালিকায় সালোয়ারের অংশবিশেষ দিয়ে ভিকটিমের মুখ বাঁধা ছিল।

আলামত সম্পর্কে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, একই আলামত অর্থাৎ ভিকটিমের পরনের কাপড় দুই জায়গা থেকে জব্দ দেখানো হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হলো, ভিকটিমের পরনের কাপড়ের ছেঁড়া অংশ সাইফুলের ঘর থেকে এবং অন্য অংশ লাশের সঙ্গে ছিল। ফলে ওই পর্যবেক্ষণও আইনসিদ্ধ নয়।

এছাড়া আসামি সাইফুলের স্বীকারোক্তি সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাপ্রণোদিত এবং সত্য বলে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিচারিক হাকিম। অথচ রায়ে স্বীকারোক্তি সত্য নয় বলে পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে যশোর জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট কাজী ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘তৃষা ধর্ষণ ও হত্যা মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ে বেশকিছু অসঙ্গতি রয়েছে, যেগুলো আইনসিদ্ধ নয়। আসামি সাইফুলের স্বীকারোক্তি এবং সে অনুযায়ী আলামত উদ্ধার, লাশ উদ্ধারসহ পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য মামলাটিকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে কিন্তু তারপরও রায়ে আসামিদের খালাস দেয়া হয়েছে। এই রায়ে বিস্মিত ও হতবাক।’

মহিলা পরিষদ যশোরের লিগ্যাল এইড সেল প্রধান অ্যাডভোকেট কামরুন নাহার কনা জানান, ‘অনেক মামলার ক্ষেত্রে চাক্ষুস সাক্ষী মিথ্যা বলতে পারে কিন্তু পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য কখনও মিথ্যা বলে না। তাই পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যকে এড়িয়ে কিভাবে আসামিরা খালাস পেলো তা বোধগম্য নয়। এটি একটি অস্বাভাবিক রায়।’

যশোর নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির সদস্যসচিব ও আইইডির ব্যবস্থাপক বীথিকা সরকার এই রায়ে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘আসামিরা এলাকার চিহ্নিত বখাটে ও মাদকসেবী। তারা এলাকায় মাথা নিচু করে বেড়াতো। রায়ের পর মাথা উঁচু করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।’ তিনি বলেন, এই স্পর্শকাতর মামলাটি সুস্পষ্ট’ বিচারের স্বার্থে সরকার পক্ষের উচতি অবিলম্বে আপিল বিভাগে যাওয়া।

শনিবার, ১৯ জুন ২০২১ , ৫ আষাঢ় ১৪২৮ ৭ জিলকদ ১৪৪২

শিশু তৃষা ধর্ষণ ও হত্যা : স্বীকারোক্তি, আলামত, প্রমাণ, তারপরও খালাস

রুকুনউদ্দৌলাহ, যশোর

image

যশোর : তৃষার ধর্ষণ ও হত্যকারীদের ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন -সংবাদ

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট, তদন্ত প্রতিবেদন, সাক্ষ্য সবই ঠিক কিন্তু রায় হয়েছে একদম উল্টো। এক শিশুকে ধর্ষণ ও হত্যা করে আসামিরা সবাই খালাস পেয়েছে। তারা এখন বুক ফুলিয়ে, মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর বাদী জীবনের শঙ্কায় পরিবার নিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। এই রায়ে বাদী, আইনজীবী, এলাকাবাসী, যশোরের সচেতন মানুষ ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত।

তৃষা আফরিন কথা। কারবালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২য় শ্রেণীর ছাত্রী ছিল। ২০১৯ সালের ৩ মার্চ বিকেলে বাড়ির পাশে গির্জার মাঠে খেলতে যায় তৃষা। সেখান থেকে দুর্বৃত্তরা তাকে ফুঁসলিয়ে নিয়ে যায় এবং কয়েকজন মিলে ধর্ষণ করে। পরবর্তীতে তাকে শ^াসরোধে হত্যা করে একটি বস্তায় ভরে মাটি খুঁড়ে পুতে রাখে। হত্যার পরদিন ৪ মার্চ তার দেহ উদ্ধার করা হয়। তৃষার বাবা যশোর কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলা করেন।

তৃষার বাবা তরিকুল ইসলাম যশোর শহরে ইজিবাইক চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তার আদি বাড়ি নড়াইল জেলায়। জীবিকার প্রয়োজনে যশোর শহরে এসে খোলাডাঙ্গায় ভাড়া বাড়িতে পরিবারসহ বসবাস করতেন।

চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি যশোরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক টিএম মুসা এই মামলার রায় ঘোষণা করেন।

খালাসপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন শহরের খোলাডাঙ্গা গাজীপাড়ার কামরুজ্জামানের ছেলে মেহেদী হাসান শক্তি এবং মৃত আবদুল আওয়ালের ছেলে সাইফুল ইসলাম। এই মামলার প্রধান সন্দেহভাজন শামীম পুলিশের কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়।

সম্প্রতি এই মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি পাওয়া গেছে। রায়ে বর্ণনা ও পর্যবেক্ষণে বেশকিছু অসঙ্গতি থাকায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন আইনজীবীরা।

মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০১৯ সালের ৩ মার্চ বিকেলে বাড়ির পাশে গির্জার মাঠে খেলতে যায় তৃষা। সন্ধ্যার পরও তৃষা বাড়ি না ফেরায় স্বজনরা খোঁজাখুঁজি করেন, কিন্তু তার খোঁজ মেলেনি।

পরদিন তৃষার বাবা কোতোয়ালি মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। এদিন বিকেলে এলাকার প্রফুল্ল’র বাড়ির পাশে মাটি খোঁড়া দেখে সবার সন্দেহ হয়। এরপর সেখানকার মাটি সরিয়ে বস্তাবন্দী তৃষার লাশ উদ্ধার করা হয়। তৃষার বাবা তরিকুল তখন অজ্ঞাতনামা আসামি দিয়ে কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।

মামলার তদন্ত সূত্রে জানা যায়, তৃষা হত্যা ও ধর্ষণে জড়িত সন্দেহে তদন্ত কর্মকর্তা যশোর কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক শেহাবুর রহমান আসামি সাইফুল ইসলামকে আটক করেন। সাইফুল ইসলাম একই এলাকার আবদুল আওয়ালের ছেলে। ওই সময় সাইফুল হত্যা ও ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা পুলিশের কাছে স্বীকার করে। এরপর এই ঘটনার প্রধান সন্দেহভাজন শামীমকে পুলিশ আটক করতে গেলে দুইপক্ষের মধ্যে ‘গোলাগুলিতে’ শামীম নিহত হয়।

শামীমকে মাদক সেবনে বাধা ও জোর করে ইজিবাইকে উঠা নিয়ে তৃষার বাবার সঙ্গে বিরোধের জেরে পরিকল্পিতভাবে তারা তৃষাকে ধর্ষণের পর হত্যা করেছিল বলে তদন্তে উঠে আসে। তদন্ত শেষে আটক আসামিদের দেয়া তথ্য ও সাক্ষীদের বক্তব্যে হত্যা ও ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত থাকায় মেহেদী হাসান শক্তি এবং সাইফুলসহ দু’জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন পুলিশ পরিদর্শক শেহাবুর রহমান শিহাব।

দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে বলা হয়, আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগের কোন প্রমাণ না পাওয়ায় তাদের খালাস দেয়া হয়। এই রায়ে তৃষার বাবা, মা, মামলার আইনজীবী এবং যশোরের বিভিন্নস্তরের মানুষ বিস্মিত, স্তম্ভিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছে। আর ১৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ে বেশকিছু অসঙ্গতি তুলে ধরেছেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা।

আইনজীবীদের মতে, মামলার ভিকটিম তৃষাকে ডেকে নিয়ে আসামি শামীমের ঘরে ধর্ষণ ও হত্যা এবং শামীমের বাড়ির পেছনে পুঁতে রাখা হয়। ফলে এই মামলার কোন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী নেই। কিন্তু আসামি সাইফুল ইসলামের স্বীকারোক্তি, ভিকটিমের পরিধেয় জামা ও প্যান্টের ছেঁড়া অংশ সাইফুলের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী তার ঘর থেকে উদ্ধার, লাশ উদ্ধারসহ পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য দ্বারা মামলাটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও রায়ে আসামিদের খালাস দেয়া হয়েছে।

রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়েছে, তদন্তকারী কর্মকর্তা আসামি সাইফুলের রিমান্ড শেষে প্রদত্ত প্রতিবেদনে দুটি মেডিকেল টিকিট দিয়েছেন। টিকিটে ‘ট্রমাটিক পেইন ও ফিভার (জ্বর)’ লেখা আছে। ফলে আসামিকে রিমান্ডে নিয়ে মারপিট করে দোষ স্বীকার (১৬৪ ধারায়) করানো হয়েছে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।

কিন্তু আইনজীবীদের মতে, এই পর্যবেক্ষণ যথার্থ নয়। কারণ ট্রমাটিক পেইন অর্থ শারীরিক আঘাত নয়, এটা মানসিক আঘাতকে বুঝায়। তৃষার মতো একটি শিশুকে ধর্ষণ ও হত্যা করার কারণে আসামি সাইফুল ট্রমাটিক পেইনে ভুগছিলেন, এমন পর্যবেক্ষণ আসাই প্রাসঙ্গিক ও আইনানুগ ছিল। আর ফিভার বা জ্বর, সেটা যে শারীরিক আঘাতের কারণেই হয়েছে, এমন পর্যবেক্ষণও মোটেই আইনানুগ নয়।

আসামি সাইফুল ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছে, ‘সে তৃষার পায়ুপথে ধর্ষণ করে চলে যায়। তখন তৃষা অজ্ঞান অবস্থায় পড়েছিল।’ অথচ রায়ের ১৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আসামি সাইফুলের স্বীকারোক্তি মতে, এই আসামি শামীমের ঘরে ঢুকার আগেই ভিকটিমের হাত পা বাঁধা ও মুখে কাপড় গুঁজে ধর্ষণসহ হত্যা করা হয়েছিল দেখা যায়।’ অর্থাৎ জবানবন্দিতে সাইফুল বলেছে, তৃষা অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল, সাইফুলের বয়ান উদৃত করে রায়ে বলা হয়েছে, ‘ ধর্ষণসহ হত্যা করা হয়েছিল দেখা যায়’। জব্দ তালিকা অনুযায়ী, তৃষার পরিধেয় জামা ও প্যান্টের ছেঁড়া অংশ আসামি সাইফুলের দেখানো মতে তার ঘর থেকে উদ্ধার এবং জব্দ তালিকা করা হয়। সাক্ষ্য আইনের ২৭ ধারা মতে এই আলামত উদ্ধার আসামির বিরুদ্ধে শতভাগ প্রমাণ বহন করে। আরেকটি জব্দ তালিকায় সালোয়ারের অংশবিশেষ দিয়ে ভিকটিমের মুখ বাঁধা ছিল।

আলামত সম্পর্কে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, একই আলামত অর্থাৎ ভিকটিমের পরনের কাপড় দুই জায়গা থেকে জব্দ দেখানো হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হলো, ভিকটিমের পরনের কাপড়ের ছেঁড়া অংশ সাইফুলের ঘর থেকে এবং অন্য অংশ লাশের সঙ্গে ছিল। ফলে ওই পর্যবেক্ষণও আইনসিদ্ধ নয়।

এছাড়া আসামি সাইফুলের স্বীকারোক্তি সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাপ্রণোদিত এবং সত্য বলে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিচারিক হাকিম। অথচ রায়ে স্বীকারোক্তি সত্য নয় বলে পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে যশোর জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট কাজী ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘তৃষা ধর্ষণ ও হত্যা মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ে বেশকিছু অসঙ্গতি রয়েছে, যেগুলো আইনসিদ্ধ নয়। আসামি সাইফুলের স্বীকারোক্তি এবং সে অনুযায়ী আলামত উদ্ধার, লাশ উদ্ধারসহ পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য মামলাটিকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে কিন্তু তারপরও রায়ে আসামিদের খালাস দেয়া হয়েছে। এই রায়ে বিস্মিত ও হতবাক।’

মহিলা পরিষদ যশোরের লিগ্যাল এইড সেল প্রধান অ্যাডভোকেট কামরুন নাহার কনা জানান, ‘অনেক মামলার ক্ষেত্রে চাক্ষুস সাক্ষী মিথ্যা বলতে পারে কিন্তু পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য কখনও মিথ্যা বলে না। তাই পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যকে এড়িয়ে কিভাবে আসামিরা খালাস পেলো তা বোধগম্য নয়। এটি একটি অস্বাভাবিক রায়।’

যশোর নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির সদস্যসচিব ও আইইডির ব্যবস্থাপক বীথিকা সরকার এই রায়ে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘আসামিরা এলাকার চিহ্নিত বখাটে ও মাদকসেবী। তারা এলাকায় মাথা নিচু করে বেড়াতো। রায়ের পর মাথা উঁচু করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।’ তিনি বলেন, এই স্পর্শকাতর মামলাটি সুস্পষ্ট’ বিচারের স্বার্থে সরকার পক্ষের উচতি অবিলম্বে আপিল বিভাগে যাওয়া।