ভূতের গলি থেকে ভদ্র গলি

এম এ কবীর

‘সরকারি টাকায় নাস্তা করে বিপাকে’ এই শিরোনামে একটি ‘বিচিত্র’ সংবাদ ছাপা হয়েছে পত্রিকায়। বাংলাদেশের পত্রিকায় ছাপা হওয়া খবরটি সুদুর ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবার সংক্রান্ত।

অন্য একটি খবরও পত্রিকায় পাওয়া গেল। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত বর্তমান স্বাধীন বেলারুস সরকার কীভাবে রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করে একজন সাংবাদিককে ধরতে আস্ত একটি বিমান ছিনতাই করে এ খবর থেকে তা জানা যায়। শুধু রাজনৈতিক স্বার্থে রাষ্ট্রীয় শক্তির পুরোটা ব্যবহারের এমন মন্দ নজির রয়েছে পৃথিবীজুড়ে।

‘দুটো খবর জনগণের নামে পরিচালিত শাসনের পরস্পর বিপরীত চিত্র। এক দিকে রয়েছে রাজার প্রজা শাসন, অন্য দিকে জনগণের সেবক। আজকালকার রাজারা জনগণের সার্বভৌম শক্তিকে হাইজ্যাক করেছেন। শাসকরা নিজেদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এটিকে তারা কায়দা করে ব্যবহার করছেন জনগণের বিরুদ্ধেই।’

ফিনল্যান্ডের একটি ট্যাবলয়েড পত্রিকায় বলা হয়েছে, দেশটির প্রধানমন্ত্রী সানা মারিনের পরিবার সকালের নাস্তার জন্য সরকারি কোষাগার থেকে মাসে ৩৬৫ ডলার খরচ করছে। সে দেশের বিরোধী দল প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের প্রাতরাশের জন্য এমন অর্থ ব্যয় দেশটির আইন অনুযায়ী বৈধ নয় বলে স্মরণ করিয়ে দেয়। দেশটির পুলিশ এ ব্যাপারে তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে। তারা দেখতে চান, নাস্তার নামে জনগণের করের টাকা অবৈধভাবে ভর্তুকি নেয়া হচ্ছে কি না। আইন ভঙ্গ করে যে পরিমাণ অর্থ নাস্তার জন্য খরচ করা হচ্ছে টাকার অঙ্কে সেটা ৩০ হাজার। কোন একজন ব্যক্তির জন্য নয়, প্রধানমন্ত্রীর পুরো পরিবারের জন্য। এমন খবর দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী ট্যাবলয়েডটির ওপর ক্ষেপে যাননি। বরং তিনি পিছু হটেছেন। বলেছেন, এ ব্যাপারে তিনি জানতেন না। উত্তর ইউরোপের এ দেশটি বিশ্বের ধনী দেশগুলোর অন্যতম। এ দেশের মাথাপিছু জিডিপি প্রায় ৫০ হাজার ডলার। টাকার অঙ্কে ৪০ লাখ। দেশটির মাত্র একজন ব্যক্তিই আয় করেন গড়ে প্রায় ৪০ লাখ টাকা। সেই হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর পুরো পরিবারের বিরুদ্ধে মাসে নাস্তা বাবদ ৩০ হাজার টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে খরচ করে ফেলার অপরাধকে খাটো করে দেখা হয়নি।

ট্যাবলয়েড পত্রিকাটি যে খবর দিয়েছে তা জনস্বার্থে। প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের এ দুর্নীতি নিয়ে খবর প্রকাশে পত্রিকাটিকে একবারও ভাবতে হয়নি। অন্য দিকে প্রধানমন্ত্রী চুপ থেকে নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ থেকে রেহাই পেয়ে যাবেন, তার কোন উপায়ও নেই। রাষ্ট্রের নিয়োজিত পুলিশ বাহিনী নিজের কর্তব্য পালনে দ্বিধাগ্রস্ত নয়। অভিযোগ উত্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে দেশটির গোয়েন্দা পুলিশ সেটা তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে। জনগণের পক্ষ থেকে শাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে, প্রধানমন্ত্রী থেকে পুলিশ পর্যন্ত কারো মধ্যে কোন জড়তা নেই।

পুলিশকে এ তদন্ত পরিচালনার জন্য অভিযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়নি। রাষ্ট্রের শক্তি পুরোটাই জনগণের পক্ষে ব্যবহার করা হচ্ছে। নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে পুলিশের কনস্টেবল পর্যন্ত জনগণের সার্ভেন্ট।

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এমন কিছু গলি রয়েছে, যেগুলোর নামের সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। নানা করণে এসব নামের উৎপত্তি। অনেক নামের কারণ খুঁজে পেলেও কিছু কিছু নাম আছে যেগুলোর উৎপত্তিগত কারণ সম্পর্কে কিছু জানার উপায় নেই। তেমনি এক নাম ‘ভূতের গলি’। একটি নয়, দুটি ভূতের গলি আছে ঢাকায়। একটি হাতিরপুলের কাছে, অপরটি নারিন্দা এলাকায়। প্রশ্ন হতে পারে, সেই গলিতে ভূতেরা থাকে কি-না। না, ভূতেরা থাকে না। থাকে অদ্ভূত কিছু মানুষ।

গলিটির প্রচলিত নাম ভূতের গলি হলেও আসল নাম ভজহরি সাহা স্ট্রিট। ভূতেরা এখন আর ওখানে থাকে না। কোন কালে ছিল কি-না তাও কেউ জানে না। এ শহরটির যখন পত্তন হয়, তখন এসব এলাকা ঝোড়-জঙ্গলসমৃদ্ধ বিরান জনপথ ছিল। সে সময়ের মানুষদের হয়তো ধারণা জন্মেছিল ওই গলিটিতে ভূতেরা বসবাস করে। হয়তো ভুতুড়ে কোন কা- তাদের মনে এ ধারণার জন্ম দেয়।

এই গলিটির নাম মনে আসে অন্য একটি গলির নাম পত্রিকার পাতায় দেখে। ঢাকার মগবাজারের নয়াটোলায় গলিটির অবস্থান। নাম ‘ভদ্র গলি’। অদ্ভুত নাম এ কথা অস্বীকার করা যাবে না। ধরে নেয়া যায় ওই গলিতে যারা বসবাস করেন তারা সবাই ‘ভদ্র’। কেন, কারা গলিটির নাম ‘ভদ্র গলি’ রেখেছে সে ইতিহাস হয়তো কারোরই জানা নেই। তবে ভদ্র গলির নাম ডাক এখন ধরাশায়ী। কারণ ওই গলিতে চলছে চাঁদাবাজির মতো অভদ্র কায়কারবার। ৪ মে একটি দৈনিকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভদ্র গলির একটি চক্র ‘মগবাজার সোসাইটি (ভদ্র গলি)’ নামে সংগঠন গড়ে এলাকাবাসীর কাছ থেকে চাঁদাবাজি শুরু করেছে। সংগঠনের আহ্বায়ক জনৈক আলিমউল্লাহ খোকন তার স্বজনদের নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষার দোহাই দিয়ে ওই গলির বাড়ি, ফ্ল্যাট এবং সব পর্যায়ের ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে প্রতি মাসে আদায় করা হচ্ছে ১২০ টাকা করে। পত্রিকাটির সরেজমিন ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই সংগঠনের চাঁদাবাজিতে এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ। কিন্তু কেউ এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করার সাহস দেখাচ্ছেন না। ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী পত্রিকাটিকে জানিয়েছেন, চলতি বছরের মার্চ মাসে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, গেট রঙ করা এবং নৈশপ্রহরীর খরচ বাবদ প্রতিটি বাড়ি থেকে তিন হাজারেরও বেশি করে টাকা আদায় করেছে ওই চক্রটি। অভিযুক্ত আলিমউল্লাহ খোকন টাকা আদায়ের কথা স্বীকার করে বলেছেন, যারা সুবিধা ভোগ করবে তারাই তো টাকা দেবে। তবে এই সোসাইটির কোন রেজিস্ট্রেশন নেই, নেই এলাকাবাসীর থেকে চাঁদা আদায়ের বৈধ কোন অনুমোদন। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, আলিমউল্লাহ খোকনের সাঙ্গোপাঙ্গরা বলশালী হওয়ায় এলাকাবাসী নীরবেই সবকিছু হজম করে চলেছে। তাদের এ ক্ষমতার উৎস কোথায়, কে বা কারা তাদের ওই গলিটি লিজ দিল, সে সম্পর্কে প্রতিবেদনে কিছু বলা হয়নি। তবে অনুমান করা যায়, এদের পেছনে এমন কোন মুরব্বি আছেন।

শুধু মগবাজারের ভদ্র গলিতেই চাঁদাবাজির অভদ্র কারবার চলছে এমনটি ভাবার কোন অবকাশ নেই। দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিরাপত্তা রক্ষা, সমস্যা সমাধান ইত্যাদির নাম করে এলাকাবাসীর কাছ থেকে এ ধরনের চাঁদা আদায় অনবরতই চলছে।

প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে এই অপকর্মটির শিকার হন না এমন কেউ নেই এদেশে। আর চাঁদাবাজির ব্যাপক বিস্তারের কথা কে না জানে? কোথায় নেই চাঁদাবাজি? নগর-বন্দর, গ্রামগঞ্জ, হাট-বাজার, অফিস-আদালত সর্বত্র চাঁদাবাজির দৌরাত্ম্য।

বিভিন্ন মার্কেটে এলাকাভিত্তিক ক্যাডাররা চাঁদাবাজি করে থাকে। ফুটপাত এখন হকারদের দখলে। শুধু কি ফুটপাত? রাস্তার দুই পাশের একটি বড় অংশও রয়েছে হকারদের দখলে। সেখানে চলে দেদার চাঁদাবাজি। ক্যাডার নামের একটি গ্রুপ এ চাঁদাবাজির দেখভাল করে। তাদের রয়েছে লাইনম্যান নামের সাগরেদ, যারা ফুটপাতের ওইসব দোকানির কাছ থেকে দৈনিক হারে চাঁদা আদায় করে থাকে। আদায় হওয়া এসব চাঁদার গন্তব্য অনেক দূর, অনেক উঁচুতলা পর্যন্ত। রাজনৈতিক দলের কর্মী, নেতা, সংশ্লিষ্ট এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত এক শ্রেণীর কর্তাব্যক্তি এসব চাঁদার অংশ পেয়ে থাকেন। চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠরা প্রতিকারের জন্য কোথাও যে যাবেন সে উপায়ও নেই। কারণ সব রসুনের এক শেকড়ের মতো এরা সবাই একই গোত্রভুক্ত।

সবচেয়ে বড় চাঁদাবাজির ঘটনাটি ঘটে পরিবহন সেক্টরে। বাস টার্মিনাল, বাস স্ট্যান্ডে মালিক সমিতি, শ্রমিক কমিটি, কল্যাণ ফান্ড নানা নামে আদায় করা হয় চাঁদা। শ্রমিক কল্যাণের নামে প্রতিদিন সারাদেশে আদায় হয় কয়েক কোটি টাকা চাঁদা। ওই টাকা পরিবহন শ্রমিকদের কোন কল্যাণে আসে কি-না কেউ জানে না। বিপদে পড়লে কোন পরিবহন শ্রমিক কল্যাণ ফান্ড থেকে কোনো সাহায্য পেয়েছে এমন নজির নেই। তবে এই চাঁদা পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা শেষ পর্যন্ত যাত্রীদের ঘাড়েই চাপায়। ভাড়ার সঙ্গে চাঁদার অঙ্কটি যোগ করেই আদায় করে ভাড়া। শ্রমিকদের নামে আদায় করা হলেও তাতে ভাগ্য খোলে শ্রমিক নেতা নামে একটি শ্রেণীর। এদের প্রায় সবার গায়ে রয়েছে আবার রাজনৈতিক জার্সি। যখন যে দল রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকে, সে দলের নেতারা নিয়ন্ত্রণ করে সড়ক পরিবহন খাতের চাঁদাবাজি। রাজনৈতিক বিভেদ-বৈরিতা থাকলেও এই চাঁদার ব্যাপারে তাদের একটি অলিখিত সমঝোতা রয়েছে। যারা ক্ষমতায় থাকেন তার সিংহভাগ পান, আর যারা ক্ষমতায় থাকেন না, তারা কম হলেও একেবারে বঞ্চিত থাকেন না।

কৃষকের উৎপাদিত পণ্যটি ঢাকা বা বড় শহরে আসতে কয়েক ঘাটে চাঁদা দিতে হয়। সড়ক-মহাসড়কে চাঁদাবাজি ব্যাপক আকার ধারণ করে কোরবানির ঈদের সময়। চাঁদাবাজদের চাহিদা না মিটিয়ে পশু বোঝাই ট্রাক নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাওয়ার চিন্তাও করা যায় না। বলতে পারেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা কী করে। ওই যে কথায় আছে ‘ভূত তাড়ানো সর্ষেতেই ভূতের বাসা’। এসব নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বহু খবর বেরিয়েছে, সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় লেখা হয়েছে। পরিস্থিতি রয়ে গেছে ‘যথা পূর্বং তথা পরং’।

কিছু মানুষ আছে যারা দৃশ্যমান কোনো পেশার সঙ্গে জড়িত নয়। অথচ দিব্যি শান-শওকতের সঙ্গে জীবনযাপন করছে। কেউ কেউ বিত্ত-বৈভবে সমাজের উঁচুতলার মানুষ! চাঁদাই এদের উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন।

যখন দল ক্ষমতায় থাকে এদের চাঁদাবাজির পরিধি বেড়ে যায়। আর যখন ক্ষমতায় থাকে না, তখন নিজেদের দলের ভেতরেই প্রাকটিসটা অব্যাহত রাখে। তখন এরা কমিটি কিংবা পদ বিক্রি করে বেঁচেবর্তে থাকে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, যে কোন অপরাধ বিস্তারের পেছনে প্রভাবশালীদের মদত টনিকের মতো কাজ করে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় অপরাধীদের অন্যতম রক্ষাকবচও। নামের সঙ্গে রাজনৈতিক পরিচয় যুক্ত থাকলে সমাজে সহজে কেউ এদের ঘাঁটাতে চায় না। প্রশাসনের লোকেরাও খাতির করে। অবশ্য এ খাতির বেশিরভাগ সময় হয়ে থাকে পারস্পরিক লেনদেন ও ভাগবাটোয়ারাভিত্তিক।

মগবাজারের ‘ভদ্র গলি’তে চাঁদাবাজির যে অভদ্র কাজটি চলছে, তার পেছনে মদত দাতা কে বা কারা তা অবশ্য জানা যায়নি। তবে কোন না কোন ‘বড়ভাই’ যে এর পেছনে রয়েছে তা অনুমান করা যায়। পত্রিকায় রিপোর্ট বেরোনোর পর প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নিয়েছে, এখন পর্যন্ত তা শোনা যায়নি। আদৌ তা নেয়া হবে কি-না তাও বলা যায় না। তবে ভদ্র গলির ভদ্রলোকদের যে মুখ বুজে নীরবেই এ অত্যাচার সহ্য করতে হবে, তা একরকম নিশ্চিত করেই বলা যায়।

অনেক আগে ‘আন্ধা কানুন’ নামে একটা সিনেমা দেখেছিলাম। বলা হয়, আইন অন্ধ। আইনের নিজস্ব গতি আছে। সবাই জানে আইন অন্ধও নয়, আইনের নিজস্ব গতিও নেই। সরকার নির্ধারিত গতিতেই চলে আইন। তবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আইনকে সত্যি সত্যি অন্ধ করে দেয়া দরকার। আইনের নিজস্ব গতি থাকাও সত্যিই অপরিহার্য।

[লেখক : সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]

শনিবার, ১৯ জুন ২০২১ , ৫ আষাঢ় ১৪২৮ ৭ জিলকদ ১৪৪২

ভূতের গলি থেকে ভদ্র গলি

এম এ কবীর

‘সরকারি টাকায় নাস্তা করে বিপাকে’ এই শিরোনামে একটি ‘বিচিত্র’ সংবাদ ছাপা হয়েছে পত্রিকায়। বাংলাদেশের পত্রিকায় ছাপা হওয়া খবরটি সুদুর ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবার সংক্রান্ত।

অন্য একটি খবরও পত্রিকায় পাওয়া গেল। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত বর্তমান স্বাধীন বেলারুস সরকার কীভাবে রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করে একজন সাংবাদিককে ধরতে আস্ত একটি বিমান ছিনতাই করে এ খবর থেকে তা জানা যায়। শুধু রাজনৈতিক স্বার্থে রাষ্ট্রীয় শক্তির পুরোটা ব্যবহারের এমন মন্দ নজির রয়েছে পৃথিবীজুড়ে।

‘দুটো খবর জনগণের নামে পরিচালিত শাসনের পরস্পর বিপরীত চিত্র। এক দিকে রয়েছে রাজার প্রজা শাসন, অন্য দিকে জনগণের সেবক। আজকালকার রাজারা জনগণের সার্বভৌম শক্তিকে হাইজ্যাক করেছেন। শাসকরা নিজেদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এটিকে তারা কায়দা করে ব্যবহার করছেন জনগণের বিরুদ্ধেই।’

ফিনল্যান্ডের একটি ট্যাবলয়েড পত্রিকায় বলা হয়েছে, দেশটির প্রধানমন্ত্রী সানা মারিনের পরিবার সকালের নাস্তার জন্য সরকারি কোষাগার থেকে মাসে ৩৬৫ ডলার খরচ করছে। সে দেশের বিরোধী দল প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের প্রাতরাশের জন্য এমন অর্থ ব্যয় দেশটির আইন অনুযায়ী বৈধ নয় বলে স্মরণ করিয়ে দেয়। দেশটির পুলিশ এ ব্যাপারে তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে। তারা দেখতে চান, নাস্তার নামে জনগণের করের টাকা অবৈধভাবে ভর্তুকি নেয়া হচ্ছে কি না। আইন ভঙ্গ করে যে পরিমাণ অর্থ নাস্তার জন্য খরচ করা হচ্ছে টাকার অঙ্কে সেটা ৩০ হাজার। কোন একজন ব্যক্তির জন্য নয়, প্রধানমন্ত্রীর পুরো পরিবারের জন্য। এমন খবর দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী ট্যাবলয়েডটির ওপর ক্ষেপে যাননি। বরং তিনি পিছু হটেছেন। বলেছেন, এ ব্যাপারে তিনি জানতেন না। উত্তর ইউরোপের এ দেশটি বিশ্বের ধনী দেশগুলোর অন্যতম। এ দেশের মাথাপিছু জিডিপি প্রায় ৫০ হাজার ডলার। টাকার অঙ্কে ৪০ লাখ। দেশটির মাত্র একজন ব্যক্তিই আয় করেন গড়ে প্রায় ৪০ লাখ টাকা। সেই হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর পুরো পরিবারের বিরুদ্ধে মাসে নাস্তা বাবদ ৩০ হাজার টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে খরচ করে ফেলার অপরাধকে খাটো করে দেখা হয়নি।

ট্যাবলয়েড পত্রিকাটি যে খবর দিয়েছে তা জনস্বার্থে। প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের এ দুর্নীতি নিয়ে খবর প্রকাশে পত্রিকাটিকে একবারও ভাবতে হয়নি। অন্য দিকে প্রধানমন্ত্রী চুপ থেকে নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ থেকে রেহাই পেয়ে যাবেন, তার কোন উপায়ও নেই। রাষ্ট্রের নিয়োজিত পুলিশ বাহিনী নিজের কর্তব্য পালনে দ্বিধাগ্রস্ত নয়। অভিযোগ উত্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে দেশটির গোয়েন্দা পুলিশ সেটা তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে। জনগণের পক্ষ থেকে শাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে, প্রধানমন্ত্রী থেকে পুলিশ পর্যন্ত কারো মধ্যে কোন জড়তা নেই।

পুলিশকে এ তদন্ত পরিচালনার জন্য অভিযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়নি। রাষ্ট্রের শক্তি পুরোটাই জনগণের পক্ষে ব্যবহার করা হচ্ছে। নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে পুলিশের কনস্টেবল পর্যন্ত জনগণের সার্ভেন্ট।

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এমন কিছু গলি রয়েছে, যেগুলোর নামের সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। নানা করণে এসব নামের উৎপত্তি। অনেক নামের কারণ খুঁজে পেলেও কিছু কিছু নাম আছে যেগুলোর উৎপত্তিগত কারণ সম্পর্কে কিছু জানার উপায় নেই। তেমনি এক নাম ‘ভূতের গলি’। একটি নয়, দুটি ভূতের গলি আছে ঢাকায়। একটি হাতিরপুলের কাছে, অপরটি নারিন্দা এলাকায়। প্রশ্ন হতে পারে, সেই গলিতে ভূতেরা থাকে কি-না। না, ভূতেরা থাকে না। থাকে অদ্ভূত কিছু মানুষ।

গলিটির প্রচলিত নাম ভূতের গলি হলেও আসল নাম ভজহরি সাহা স্ট্রিট। ভূতেরা এখন আর ওখানে থাকে না। কোন কালে ছিল কি-না তাও কেউ জানে না। এ শহরটির যখন পত্তন হয়, তখন এসব এলাকা ঝোড়-জঙ্গলসমৃদ্ধ বিরান জনপথ ছিল। সে সময়ের মানুষদের হয়তো ধারণা জন্মেছিল ওই গলিটিতে ভূতেরা বসবাস করে। হয়তো ভুতুড়ে কোন কা- তাদের মনে এ ধারণার জন্ম দেয়।

এই গলিটির নাম মনে আসে অন্য একটি গলির নাম পত্রিকার পাতায় দেখে। ঢাকার মগবাজারের নয়াটোলায় গলিটির অবস্থান। নাম ‘ভদ্র গলি’। অদ্ভুত নাম এ কথা অস্বীকার করা যাবে না। ধরে নেয়া যায় ওই গলিতে যারা বসবাস করেন তারা সবাই ‘ভদ্র’। কেন, কারা গলিটির নাম ‘ভদ্র গলি’ রেখেছে সে ইতিহাস হয়তো কারোরই জানা নেই। তবে ভদ্র গলির নাম ডাক এখন ধরাশায়ী। কারণ ওই গলিতে চলছে চাঁদাবাজির মতো অভদ্র কায়কারবার। ৪ মে একটি দৈনিকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভদ্র গলির একটি চক্র ‘মগবাজার সোসাইটি (ভদ্র গলি)’ নামে সংগঠন গড়ে এলাকাবাসীর কাছ থেকে চাঁদাবাজি শুরু করেছে। সংগঠনের আহ্বায়ক জনৈক আলিমউল্লাহ খোকন তার স্বজনদের নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষার দোহাই দিয়ে ওই গলির বাড়ি, ফ্ল্যাট এবং সব পর্যায়ের ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে প্রতি মাসে আদায় করা হচ্ছে ১২০ টাকা করে। পত্রিকাটির সরেজমিন ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই সংগঠনের চাঁদাবাজিতে এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ। কিন্তু কেউ এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করার সাহস দেখাচ্ছেন না। ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী পত্রিকাটিকে জানিয়েছেন, চলতি বছরের মার্চ মাসে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, গেট রঙ করা এবং নৈশপ্রহরীর খরচ বাবদ প্রতিটি বাড়ি থেকে তিন হাজারেরও বেশি করে টাকা আদায় করেছে ওই চক্রটি। অভিযুক্ত আলিমউল্লাহ খোকন টাকা আদায়ের কথা স্বীকার করে বলেছেন, যারা সুবিধা ভোগ করবে তারাই তো টাকা দেবে। তবে এই সোসাইটির কোন রেজিস্ট্রেশন নেই, নেই এলাকাবাসীর থেকে চাঁদা আদায়ের বৈধ কোন অনুমোদন। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, আলিমউল্লাহ খোকনের সাঙ্গোপাঙ্গরা বলশালী হওয়ায় এলাকাবাসী নীরবেই সবকিছু হজম করে চলেছে। তাদের এ ক্ষমতার উৎস কোথায়, কে বা কারা তাদের ওই গলিটি লিজ দিল, সে সম্পর্কে প্রতিবেদনে কিছু বলা হয়নি। তবে অনুমান করা যায়, এদের পেছনে এমন কোন মুরব্বি আছেন।

শুধু মগবাজারের ভদ্র গলিতেই চাঁদাবাজির অভদ্র কারবার চলছে এমনটি ভাবার কোন অবকাশ নেই। দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিরাপত্তা রক্ষা, সমস্যা সমাধান ইত্যাদির নাম করে এলাকাবাসীর কাছ থেকে এ ধরনের চাঁদা আদায় অনবরতই চলছে।

প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে এই অপকর্মটির শিকার হন না এমন কেউ নেই এদেশে। আর চাঁদাবাজির ব্যাপক বিস্তারের কথা কে না জানে? কোথায় নেই চাঁদাবাজি? নগর-বন্দর, গ্রামগঞ্জ, হাট-বাজার, অফিস-আদালত সর্বত্র চাঁদাবাজির দৌরাত্ম্য।

বিভিন্ন মার্কেটে এলাকাভিত্তিক ক্যাডাররা চাঁদাবাজি করে থাকে। ফুটপাত এখন হকারদের দখলে। শুধু কি ফুটপাত? রাস্তার দুই পাশের একটি বড় অংশও রয়েছে হকারদের দখলে। সেখানে চলে দেদার চাঁদাবাজি। ক্যাডার নামের একটি গ্রুপ এ চাঁদাবাজির দেখভাল করে। তাদের রয়েছে লাইনম্যান নামের সাগরেদ, যারা ফুটপাতের ওইসব দোকানির কাছ থেকে দৈনিক হারে চাঁদা আদায় করে থাকে। আদায় হওয়া এসব চাঁদার গন্তব্য অনেক দূর, অনেক উঁচুতলা পর্যন্ত। রাজনৈতিক দলের কর্মী, নেতা, সংশ্লিষ্ট এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত এক শ্রেণীর কর্তাব্যক্তি এসব চাঁদার অংশ পেয়ে থাকেন। চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠরা প্রতিকারের জন্য কোথাও যে যাবেন সে উপায়ও নেই। কারণ সব রসুনের এক শেকড়ের মতো এরা সবাই একই গোত্রভুক্ত।

সবচেয়ে বড় চাঁদাবাজির ঘটনাটি ঘটে পরিবহন সেক্টরে। বাস টার্মিনাল, বাস স্ট্যান্ডে মালিক সমিতি, শ্রমিক কমিটি, কল্যাণ ফান্ড নানা নামে আদায় করা হয় চাঁদা। শ্রমিক কল্যাণের নামে প্রতিদিন সারাদেশে আদায় হয় কয়েক কোটি টাকা চাঁদা। ওই টাকা পরিবহন শ্রমিকদের কোন কল্যাণে আসে কি-না কেউ জানে না। বিপদে পড়লে কোন পরিবহন শ্রমিক কল্যাণ ফান্ড থেকে কোনো সাহায্য পেয়েছে এমন নজির নেই। তবে এই চাঁদা পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা শেষ পর্যন্ত যাত্রীদের ঘাড়েই চাপায়। ভাড়ার সঙ্গে চাঁদার অঙ্কটি যোগ করেই আদায় করে ভাড়া। শ্রমিকদের নামে আদায় করা হলেও তাতে ভাগ্য খোলে শ্রমিক নেতা নামে একটি শ্রেণীর। এদের প্রায় সবার গায়ে রয়েছে আবার রাজনৈতিক জার্সি। যখন যে দল রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকে, সে দলের নেতারা নিয়ন্ত্রণ করে সড়ক পরিবহন খাতের চাঁদাবাজি। রাজনৈতিক বিভেদ-বৈরিতা থাকলেও এই চাঁদার ব্যাপারে তাদের একটি অলিখিত সমঝোতা রয়েছে। যারা ক্ষমতায় থাকেন তার সিংহভাগ পান, আর যারা ক্ষমতায় থাকেন না, তারা কম হলেও একেবারে বঞ্চিত থাকেন না।

কৃষকের উৎপাদিত পণ্যটি ঢাকা বা বড় শহরে আসতে কয়েক ঘাটে চাঁদা দিতে হয়। সড়ক-মহাসড়কে চাঁদাবাজি ব্যাপক আকার ধারণ করে কোরবানির ঈদের সময়। চাঁদাবাজদের চাহিদা না মিটিয়ে পশু বোঝাই ট্রাক নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাওয়ার চিন্তাও করা যায় না। বলতে পারেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা কী করে। ওই যে কথায় আছে ‘ভূত তাড়ানো সর্ষেতেই ভূতের বাসা’। এসব নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বহু খবর বেরিয়েছে, সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় লেখা হয়েছে। পরিস্থিতি রয়ে গেছে ‘যথা পূর্বং তথা পরং’।

কিছু মানুষ আছে যারা দৃশ্যমান কোনো পেশার সঙ্গে জড়িত নয়। অথচ দিব্যি শান-শওকতের সঙ্গে জীবনযাপন করছে। কেউ কেউ বিত্ত-বৈভবে সমাজের উঁচুতলার মানুষ! চাঁদাই এদের উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন।

যখন দল ক্ষমতায় থাকে এদের চাঁদাবাজির পরিধি বেড়ে যায়। আর যখন ক্ষমতায় থাকে না, তখন নিজেদের দলের ভেতরেই প্রাকটিসটা অব্যাহত রাখে। তখন এরা কমিটি কিংবা পদ বিক্রি করে বেঁচেবর্তে থাকে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, যে কোন অপরাধ বিস্তারের পেছনে প্রভাবশালীদের মদত টনিকের মতো কাজ করে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় অপরাধীদের অন্যতম রক্ষাকবচও। নামের সঙ্গে রাজনৈতিক পরিচয় যুক্ত থাকলে সমাজে সহজে কেউ এদের ঘাঁটাতে চায় না। প্রশাসনের লোকেরাও খাতির করে। অবশ্য এ খাতির বেশিরভাগ সময় হয়ে থাকে পারস্পরিক লেনদেন ও ভাগবাটোয়ারাভিত্তিক।

মগবাজারের ‘ভদ্র গলি’তে চাঁদাবাজির যে অভদ্র কাজটি চলছে, তার পেছনে মদত দাতা কে বা কারা তা অবশ্য জানা যায়নি। তবে কোন না কোন ‘বড়ভাই’ যে এর পেছনে রয়েছে তা অনুমান করা যায়। পত্রিকায় রিপোর্ট বেরোনোর পর প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নিয়েছে, এখন পর্যন্ত তা শোনা যায়নি। আদৌ তা নেয়া হবে কি-না তাও বলা যায় না। তবে ভদ্র গলির ভদ্রলোকদের যে মুখ বুজে নীরবেই এ অত্যাচার সহ্য করতে হবে, তা একরকম নিশ্চিত করেই বলা যায়।

অনেক আগে ‘আন্ধা কানুন’ নামে একটা সিনেমা দেখেছিলাম। বলা হয়, আইন অন্ধ। আইনের নিজস্ব গতি আছে। সবাই জানে আইন অন্ধও নয়, আইনের নিজস্ব গতিও নেই। সরকার নির্ধারিত গতিতেই চলে আইন। তবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আইনকে সত্যি সত্যি অন্ধ করে দেয়া দরকার। আইনের নিজস্ব গতি থাকাও সত্যিই অপরিহার্য।

[লেখক : সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]