ডিঙ্গাপোতা হাওরের হাতছানি

হাওর এক বিশাল জলাশয় যা বর্ষাকালে সমুদ্রের রূপ ধারণ করে। পানি প্রায় পাঁচ-ছয় মাস থাকার পর শুকিয়ে বিস্তৃত শ্যামল প্রান্তরে পরিণত হয়। চারিদিকে তখন সবুজ আর সবুজ ধানখেত। যখন পানি অল্প থাকে তখন পানির নিচে থাকা রাস্তা দিয়ে হেঁটে এবং গাড়িতেও চলাচল করা যায়। তখন দৃশ্যটা দূর থেকে বেশ বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে। মনে হয়, গাড়ি আর নৌকা পাশাপাশি হাওরে ভেসে ভেসে চলছে। আবার আস্তে আস্তে পানি বৃদ্ধি পেয়ে চারদিক অথৈ পানিতে তলিয়ে গেলে জলযানই যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হয়ে উঠে।

নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলায় বিশাল ‘ডিঙ্গাপোতা’ হাওরের অবস্থান। হাওরটির মোট আয়তন প্রায় ৮৫০০ হেক্টর। এখানে প্রায় পাঁচ-ছয় (জ্যৈষ্ঠ-কার্তিক) মাস পানি থাকে। আশ্বিন মাসের রৌদ্রজ্জ্বল এক দুপুরে সুন্দর সেই ডিঙ্গাপোতা হাওরটি দেখার উদ্দেশে মোহনগঞ্জ সদর থেকে গাড়িযোগে রওনা হলাম। যাত্রাপথের দুইপাশে ঘন সবুজ গাছ আর মাঝে মাঝে সবুজ ধান খেত। কিছুদূর পর পর চারিদিকে পানি আর গাছপালায় ঘেরা বাড়িঘরগুলোকে দ্বীপের মতো লাগছিল। কিছু বড় বড় গাছ অর্ধেক পানির নিচে ডুবে থেকে অনেকটা ম্যানগ্রোভ বনের মতো মনে হচ্ছিল। কোথাওবা গাছের মাথায় সাদা বক লম্বা পায়ের উপর ভর দিয়ে যেন গভীর ধ্যানে বসে আছে। কিছুক্ষণ পরপরই ঘুঘুর ডাক এর সঙ্গে দু’পাশে কাশফুলগুলো স্নিগ্ধতা মাখা বাতাসে দুলে দুলে শরতের আগমনী বার্তা জানিয়ে দিচ্ছিল। সাদা কাশফুলগুলো যেন হেসে হেসে বলছে, ‘শরৎ এসে গেছে, শরৎ এসে গেছে।‘ নীল আকাশে খ- খ- শুভ্র মেঘের উড়োউড়ি আর আশ্বিনের সোনালী রোদে চারিদিক ঝলমল। মনে পড়ে গেল, কবি জীবনানন্দ দাশের লেখা কবিতার কয়েকটি লাইন-

‘এখানে আকাশ নীল-নীলাভ আকাশ জুড়ে সজিনার ফুল/ ফুটে থাকে হিম শাদা-রং তার আশ্বিনের আলোর মতন/আকন্দফুলের কালো ভীমরুল এইখানে করে গুঞ্জরণ’

প্রকৃতির শোভাম-িত সৌন্দর্য দেখতে দেখতে হাওরের কাছাকাছি পৌঁছাই। উপজেলা সদর থেকে এখানে আসতে সময় লেগেছে প্রায় বিশ মিনিটের মতো। চারিদিকে দোয়েল, শালিক, শ্যামা, মাছরাঙা, চড়ুইসহ নাম না জানা হরেক রকম পাখিদের কলকাকলি। ফড়িংয়ের ছুটোছুটি। বাতাসে হঠাৎ ভেসে আসে শেফালি ফুলের সুবাস। স্পিডবোটযোগে বেশ কিছুক্ষণ ধরে হাওরে ঘুরে সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। রৌদ্রস্নাত দিন। হালকা বাতাস হাওরে নিয়ে আসে শীতের আমেজ। হাওরের পানির দিক তাকিয়ে বহুল প্রচলিত কয়েকটি চরণ বারবার মনে হতে থাকে-

‘আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে/ পূবালী বাতাসে-/ বাদাম দেইখ্যা, চাইয়া থাকি’

গানগুলোর রচয়িতা বিখ্যাত বাউল সাধক মরহুম উকিল মুন্সী। মরহুম উকিল মুন্সীর সমাধিস্থল মোহনগঞ্জের জৈনপুর গ্রামে। বর্ষায় এই ডিঙ্গাপোতা হাওর পাড়ি দিয়েই উকিল মুন্সীর সমাধিস্থলে যেতে হয়। জৈনপুর গ্রামে প্রতিবছরই এই বাউল সাধকের স্মরণে উকিল মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

নীল আকাশের নিচে শ্যামল প্রান্তরে কখনও ফুটবল, ক্রিকেট খেলায় মেতে উঠে উচ্ছল কিশোরের দল। ছক্কা, চার, আউট কিংবা গোল শব্দে মুখরিত হয় এই প্রান্তর। কোন কোন জায়গায়, অস্থায়ী জমজমাট হাটবাজারও বসে। শুকনো মৌসুমে এখানে বিশাল জায়গাজুড়ে জেগে উঠে অনিন্দ্য সুন্দর হিজলবন। জানতে পারলাম, স্থানীয়রা এই বনকে ভালবেসে ‘অক্সিজেন পার্ক’ বলে। হিজলের সঙ্গে যেন সই পেতে মিশে থাকে বটগাছ আর করচ গাছ। তৃণভূমিতে উদ্ভিদ, প্রাণী মিলে এক মায়াময় ভুবন গড়ে তোলে হিজলবন।

জায়গাটা দেখে বোঝাই যায় না, বর্ষাকালে পানিতে টইটুম্বুর থাকে। ঢেউগুলো আপন মনে নীরবে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছন্দে ছন্দে ছুটে প্রকৃতিকে কাব্যময় করে তুলেছে। বহমান ঢেউগুলোকে মনে হচ্ছে আলপনা। কোথা থেকে এই পানি আসে, কীভাবে আসে? আবার কোথায় যায়। তাকিয়ে দেখি, নীল আকাশের নিচে হাওরের পানিতে ঝাঁকে ঝাঁকে হাঁস ভেসে চলেছে।

দূরে ঘন সবুজ গাছে ঘেরা সহজ সরল গ্রামীণ বসতি। হাওরের আশপাশের গ্রামগুলো দেখে বারবার মনে হচ্ছিল, হাওর পাড়ের মানুষগুলো কীভাবে জীবন সংগ্রাম করে জীবন অতিবাহিত করছে। নৌপথেই তাদের একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নৌকা করেই স্কুলে যাতায়াত করতে হয়। হাওরবাসীদের বৈরী আবহাওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টির সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়।

রোদের তীব্রতা কমে আস্তে আস্তে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এলো। শেষ বিকেলের আলোয় পানি যেন ঝলমল করছে। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। নীরব সন্ধ্যায় আলো-আঁধারিতে নতুন এক মোহনীয় রূপ ধারণ করেছে হাওরাঞ্চল। ইতোমধ্যে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ছে লাল টুকটুকে সূর্য । মনে হচ্ছে নীল আকাশের কপালে কে যেন সযতেœ লাল টিপ পরিয়ে দিয়েছে। সূর্যাস্তের লাল আভা ছড়িয়ে আকাশ লাল নীল রঙে একাকার। আকাশের নিচে ধূসর সন্ধ্যায় হাওর আরও মায়াবী হয়ে ওঠে। দূরের ঘরগুলোতে আস্তে আস্তে সন্ধ্যার বাতি জ্বলে উঠছে। সাঁঝবেলায় ধূসর মেঘের নিচে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা ছুটে চলেছে নীড়ের সন্ধানে। আমাদের ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে। পেছন ফিরে আবার আমরা ডিঙ্গপোতা হাওরের দিকে তাকাই। অপার সৌন্দর্য নীরবে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

নিঝুম নিঃস্তব্ধ অপরূপ হাওর ছেড়ে আস্তে আস্তে কর্মব্যস্ত যান্ত্রিক শহরের দিকে এগিয়ে চললাম।

রবিবার, ২০ জুন ২০২১ , ৬ আষাঢ় ১৪২৮ ৮ জিলকদ ১৪৪২

ডিঙ্গাপোতা হাওরের হাতছানি

লায়লা আরজুমান

image

হাওর এক বিশাল জলাশয় যা বর্ষাকালে সমুদ্রের রূপ ধারণ করে। পানি প্রায় পাঁচ-ছয় মাস থাকার পর শুকিয়ে বিস্তৃত শ্যামল প্রান্তরে পরিণত হয়। চারিদিকে তখন সবুজ আর সবুজ ধানখেত। যখন পানি অল্প থাকে তখন পানির নিচে থাকা রাস্তা দিয়ে হেঁটে এবং গাড়িতেও চলাচল করা যায়। তখন দৃশ্যটা দূর থেকে বেশ বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে। মনে হয়, গাড়ি আর নৌকা পাশাপাশি হাওরে ভেসে ভেসে চলছে। আবার আস্তে আস্তে পানি বৃদ্ধি পেয়ে চারদিক অথৈ পানিতে তলিয়ে গেলে জলযানই যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হয়ে উঠে।

নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলায় বিশাল ‘ডিঙ্গাপোতা’ হাওরের অবস্থান। হাওরটির মোট আয়তন প্রায় ৮৫০০ হেক্টর। এখানে প্রায় পাঁচ-ছয় (জ্যৈষ্ঠ-কার্তিক) মাস পানি থাকে। আশ্বিন মাসের রৌদ্রজ্জ্বল এক দুপুরে সুন্দর সেই ডিঙ্গাপোতা হাওরটি দেখার উদ্দেশে মোহনগঞ্জ সদর থেকে গাড়িযোগে রওনা হলাম। যাত্রাপথের দুইপাশে ঘন সবুজ গাছ আর মাঝে মাঝে সবুজ ধান খেত। কিছুদূর পর পর চারিদিকে পানি আর গাছপালায় ঘেরা বাড়িঘরগুলোকে দ্বীপের মতো লাগছিল। কিছু বড় বড় গাছ অর্ধেক পানির নিচে ডুবে থেকে অনেকটা ম্যানগ্রোভ বনের মতো মনে হচ্ছিল। কোথাওবা গাছের মাথায় সাদা বক লম্বা পায়ের উপর ভর দিয়ে যেন গভীর ধ্যানে বসে আছে। কিছুক্ষণ পরপরই ঘুঘুর ডাক এর সঙ্গে দু’পাশে কাশফুলগুলো স্নিগ্ধতা মাখা বাতাসে দুলে দুলে শরতের আগমনী বার্তা জানিয়ে দিচ্ছিল। সাদা কাশফুলগুলো যেন হেসে হেসে বলছে, ‘শরৎ এসে গেছে, শরৎ এসে গেছে।‘ নীল আকাশে খ- খ- শুভ্র মেঘের উড়োউড়ি আর আশ্বিনের সোনালী রোদে চারিদিক ঝলমল। মনে পড়ে গেল, কবি জীবনানন্দ দাশের লেখা কবিতার কয়েকটি লাইন-

‘এখানে আকাশ নীল-নীলাভ আকাশ জুড়ে সজিনার ফুল/ ফুটে থাকে হিম শাদা-রং তার আশ্বিনের আলোর মতন/আকন্দফুলের কালো ভীমরুল এইখানে করে গুঞ্জরণ’

প্রকৃতির শোভাম-িত সৌন্দর্য দেখতে দেখতে হাওরের কাছাকাছি পৌঁছাই। উপজেলা সদর থেকে এখানে আসতে সময় লেগেছে প্রায় বিশ মিনিটের মতো। চারিদিকে দোয়েল, শালিক, শ্যামা, মাছরাঙা, চড়ুইসহ নাম না জানা হরেক রকম পাখিদের কলকাকলি। ফড়িংয়ের ছুটোছুটি। বাতাসে হঠাৎ ভেসে আসে শেফালি ফুলের সুবাস। স্পিডবোটযোগে বেশ কিছুক্ষণ ধরে হাওরে ঘুরে সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। রৌদ্রস্নাত দিন। হালকা বাতাস হাওরে নিয়ে আসে শীতের আমেজ। হাওরের পানির দিক তাকিয়ে বহুল প্রচলিত কয়েকটি চরণ বারবার মনে হতে থাকে-

‘আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে/ পূবালী বাতাসে-/ বাদাম দেইখ্যা, চাইয়া থাকি’

গানগুলোর রচয়িতা বিখ্যাত বাউল সাধক মরহুম উকিল মুন্সী। মরহুম উকিল মুন্সীর সমাধিস্থল মোহনগঞ্জের জৈনপুর গ্রামে। বর্ষায় এই ডিঙ্গাপোতা হাওর পাড়ি দিয়েই উকিল মুন্সীর সমাধিস্থলে যেতে হয়। জৈনপুর গ্রামে প্রতিবছরই এই বাউল সাধকের স্মরণে উকিল মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

নীল আকাশের নিচে শ্যামল প্রান্তরে কখনও ফুটবল, ক্রিকেট খেলায় মেতে উঠে উচ্ছল কিশোরের দল। ছক্কা, চার, আউট কিংবা গোল শব্দে মুখরিত হয় এই প্রান্তর। কোন কোন জায়গায়, অস্থায়ী জমজমাট হাটবাজারও বসে। শুকনো মৌসুমে এখানে বিশাল জায়গাজুড়ে জেগে উঠে অনিন্দ্য সুন্দর হিজলবন। জানতে পারলাম, স্থানীয়রা এই বনকে ভালবেসে ‘অক্সিজেন পার্ক’ বলে। হিজলের সঙ্গে যেন সই পেতে মিশে থাকে বটগাছ আর করচ গাছ। তৃণভূমিতে উদ্ভিদ, প্রাণী মিলে এক মায়াময় ভুবন গড়ে তোলে হিজলবন।

জায়গাটা দেখে বোঝাই যায় না, বর্ষাকালে পানিতে টইটুম্বুর থাকে। ঢেউগুলো আপন মনে নীরবে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছন্দে ছন্দে ছুটে প্রকৃতিকে কাব্যময় করে তুলেছে। বহমান ঢেউগুলোকে মনে হচ্ছে আলপনা। কোথা থেকে এই পানি আসে, কীভাবে আসে? আবার কোথায় যায়। তাকিয়ে দেখি, নীল আকাশের নিচে হাওরের পানিতে ঝাঁকে ঝাঁকে হাঁস ভেসে চলেছে।

দূরে ঘন সবুজ গাছে ঘেরা সহজ সরল গ্রামীণ বসতি। হাওরের আশপাশের গ্রামগুলো দেখে বারবার মনে হচ্ছিল, হাওর পাড়ের মানুষগুলো কীভাবে জীবন সংগ্রাম করে জীবন অতিবাহিত করছে। নৌপথেই তাদের একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নৌকা করেই স্কুলে যাতায়াত করতে হয়। হাওরবাসীদের বৈরী আবহাওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টির সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়।

রোদের তীব্রতা কমে আস্তে আস্তে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এলো। শেষ বিকেলের আলোয় পানি যেন ঝলমল করছে। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। নীরব সন্ধ্যায় আলো-আঁধারিতে নতুন এক মোহনীয় রূপ ধারণ করেছে হাওরাঞ্চল। ইতোমধ্যে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ছে লাল টুকটুকে সূর্য । মনে হচ্ছে নীল আকাশের কপালে কে যেন সযতেœ লাল টিপ পরিয়ে দিয়েছে। সূর্যাস্তের লাল আভা ছড়িয়ে আকাশ লাল নীল রঙে একাকার। আকাশের নিচে ধূসর সন্ধ্যায় হাওর আরও মায়াবী হয়ে ওঠে। দূরের ঘরগুলোতে আস্তে আস্তে সন্ধ্যার বাতি জ্বলে উঠছে। সাঁঝবেলায় ধূসর মেঘের নিচে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা ছুটে চলেছে নীড়ের সন্ধানে। আমাদের ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে। পেছন ফিরে আবার আমরা ডিঙ্গপোতা হাওরের দিকে তাকাই। অপার সৌন্দর্য নীরবে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

নিঝুম নিঃস্তব্ধ অপরূপ হাওর ছেড়ে আস্তে আস্তে কর্মব্যস্ত যান্ত্রিক শহরের দিকে এগিয়ে চললাম।