চিরদিনের অভিভাবক

দেবাহুতি চক্রবর্তী

প্রায় গোটা একটা শতক ধরেই সুফিয়া কামালের জীবন। তার জন্ম-১৯১১ মৃত্যু-১৯৯৯। মানবসমাজের ইতিহাসে এই বিংশ শতক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বিশ্বজুড়েই এই শতকে ভাঙা গড়ার ঘনঘটা। উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী তীব্র আন্দোলন, দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, ৪৭-এর দেশভাগ, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, বৃহত্তর অঙ্গনে দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধ, হিরোশিমা -নাগাসাকিতে পারমানবিক বিস্ফোরণ, রুশ বিপ্লব, সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতের পতন, জাতিসংঘের জন্ম, দেশে দেশে ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে বিপ্লব- বিদ্রোহ, বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব জয়যাত্রা ইত্যাদি অগুনতি ইতিবাচক এবং নেতিবাচক ঘটনার সমাহার পুরো বিংশ শতকজুড়ে। এর মাঝেই সুফিয়া কামালের জন্ম এবং নিজেকে নিজের মতো বুঝে নেবার লড়াই শুরু।

লড়াইটা শুরু হয় পরিবার থেকেই। তখনকার অভিজাত বনেদি পরিবারের রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে দীর্ঘসময় তিনি লড়াই করেন। এই লড়াইগুলো কত কঠিন তা বাইরে থেকে অনুমেয় নয়। বাংলায় জন্মে বাংলাভাষা শেখার জন্যই প্রথম লড়াই শুরু। তারপর আবার সাহিত্য চর্চা, পত্রিকায় নাম প্রকাশ, বরিশালে বোরখা পরিহিত অবস্থায় স্বদেশী আন্দোলনে অংশ নেয়া, মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ, স্বামীর সঙ্গে প্রথম বাঙালি মুসলিম নারী হিসেবে উড়োজাহাজে ভ্রমণ কোনোটাই পরিবার ও সমাজ ভালোভাবে নেয়নি। কিন্তু সহযোগিতা করেন, পাশে থাকেন স্বামী নেহাল আহমেদ। সেই সংসার জীবন মাত্র ছয় বছরের। এক কন্যা নিয়ে অকাল বৈধব্যের শিকার হন সুফিয়া কামাল। তবু ভেঙে পড়েননি। কলকাতার এক স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। সঙ্গে কাব্যচর্চাও নিয়মিত চলতে থাকে। বাড়তে থাকে সামাজিক সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ। কয় বছরের মধ্যে দ্বিতীয় বিয়ে হয় কামালউদ্দিন খানের সঙ্গে। সরকারি চাকরিজীবী, সাহিত্যপ্রেমিক এই মানুষটিও সুফিয়া কামালের ইপ্সিত চলার পথে হাত বাড়িয়ে দেন, হাতে হাত মেলান।

১৯৪৬-এর কলকাতার দাঙ্গার ভয়াবহ রূপ তিনি সরাসরি প্রত্যক্ষ করেন। দাঙ্গাপীড়িত মানুষের সেবায় দুয়ারে দুয়ারে ঘোরেন। দেশভাগ পরবর্তীতে স্থায়ীভাবে তিনি পরিবারসহ ফিরে আসেন তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে। পাকিস্তানকে স্বাগত জানান। কায়েদ-ই-আজমের প্রশস্তিমূলক কবিতা লেখেন। অনেকের মতই হয়তো মনে হতে পারে মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। অথবা নিজের জন্মভূমিতে ফিরে আসাটাই আকাক্সক্ষার হতে পারে। যেটাই হোক, সুফিয়া কামাল ধার্মিক ছিলেন। কিন্তু সাম্প্রদায়িক ছিলেন না কখনই। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক চেহারা অল্পদিনের মধ্যেই সবার সামনে প্রকাশ পেতে থাকে। ধর্মের নামে, ভাষার নামে পাক শাসকদের নগ্ন চেহারা ক্রমশ এই ভূখণ্ডের মানুষের পাকিস্তান প্রীতির মোহভঙ্গ ঘটাতে শুরু করে।

সুফিয়া কামালের গার্হস্থ্য জীবন স্বামী সন্তানাদি পরিজন নিয়ে যখন ভরপুর, হাসিমুখে সেই দায়িত্ব পালন করতে করতে তখনই তিনি জড়িয়ে যান নানা সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে। পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতি, ঢাকা শিশু রক্ষা সমিতি, ওয়ারি মহিলা সমিতি, ছায়ানট, রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ, মহিলা সংগ্রাম পরিষদ, কচি কাঁচার মেলা সর্বত্রই তিনি আর তিনি। এর বাইরে ৫২ র ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকেন। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে ১৯৫৫ সনে ঢাকার রাজপথে নারীদের বিক্ষোভ মিছিলে নেতৃত্ব দেন। এদেশে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ ঘোষণার পর তার ছায়াতলে, তার বাড়ি হয়ে ওঠে দেশের সামাজিক -সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূতিকাগার। কোনোরকম রক্তচক্ষুকে পরোয়া না করে বলেন, রবীন্দ্রসংগীত আমার জীবনে উপাসনার নামান্তর।”

ছোটখাট একটা শান্ত মানুষ কত কঠিন, কত নির্ভীক হতে পারেন তার প্রমাণ প্রবল পরাক্রান্ত পাক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এক সভায় বাঙালিদের জানোয়ার- বলে গালি দেওয়ায় উঠে দাঁড়িয়ে তিনিই বলতে পারেন, — আপনি সেই জানোয়ারদের প্রেসিডেন্ট। ৬৯/৭০-এর গণ-আন্দোলনের সঙ্গে তিনি একাত্ম থাকেন। একাত্তরে চেষ্টা করেও হানাদার বাহিনী তাদের অনুকূলে কোনো বিবৃতিতে তাকে দিয়ে সই করাতে পারেনি। কবি- সাহিত্যিক সুফিয়া কামাল দেশ বিদেশে পরিচিত একটি নাম। তাকে হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে একবারই তিনি বাধ্য হয়ে বেতারে আসেন এবং জানান দেন তিনি বেঁচে আছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি বাংলাদেশ সোভিয়েত মৈত্রী সংস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত হন।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপ্রধান হিসেবে দাবি দাওয়া নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। যুদ্ধাহত ও অসহায় নারীদের পুনর্বাসনের জন্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিধ্বস্ত মানুষের জন্য, বিভিন্ন সময় দাঙ্গা প্রতিরোধে ও দাঙ্গাপীড়িত মানুষের জন্য, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য, স্বৈরাচারী শাসকের পতনের জন্য, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য, নারী মুক্তির জন্য সব আন্দোলনে সংগ্রামে বলিষ্ঠ ও পুরোধা ভূমিকায় থাকেন। ৭২ সনেই তিনি যুদ্ধাহত নারীদের মুক্তিযোদ্ধা ঘোষণার দাবি জানান, যা এখনও চলমান প্রক্রিয়া। এই বৃহৎ জীবনের নানা রঙের বৈচিত্র্যময় ক্যানভাস স্বল্প পরিসরে তুলে ধরা সম্ভব নয়।

একটা মানুষ লেখায়- কবিতায়, সংসারে, সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে একেবারেই যেন দশভুজা। কিন্তু রণরঙ্গিণী মূর্তিতে নয়। যাকে কাছে টানার কাছে টেনেছেন, যাকে দূরে ঠেলার দূরে ঠেলেছেন। সব মিলিয়ে এক নির্মোহ বৈরাগ্য জীবনাচারণে। তিনি আমাদের বলতেন, মহিলা পরিষদে কেউ নেত্রী নয়, সবাই কর্মী। ‘... ছোট বড়, ধর্ম বর্ণ কোনো ভেদাভেদ তিনি কখনো করেননি। কবি হিসেবে আমরা তাকে বেশি জানি। কর্মবহুল জীবনের মাঝেও কাব্যচর্চা থেকে দূরে সরে যাননি। নিজের কবিতা নিয়ে বলেন, ...’ আমার কবিতা-সাজানো বাগানের ফুল নয়, গুণে গুণে কোনোটির পর কোনোটির কথা আমি মালীর হাতে তৈরি ফুলের তোড়ার মতো সাজাইনি, ও বিদ্যা আমার নেই। আমি বন্য, আমি অরণ্য, আমি নামহীন। ‘... কবি জানতেন, এই নামহীন বুনো ফুলের সুঘ্রাণ কতদূর ছড়াতে পারে!

১৯৯৭ সনে মহিলা পরিষদের সম্মেলনে হুইল চেয়ারে করে সুফিয়া কামাল আসেন। মঞ্চে থাকেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা সেই সম্মেলনে ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি’... ঘোষণা করেন। প্রাণভরে অভিনন্দন জানান সুফিয়া কামাল বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রীকে।

দুঃখের বিষয় সেই নীতি বাস্তবায়ন থেকে আজও আমরা অনেক দূরে রয়ে গেছি। রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার সময় থেকেই সুফিয়া কামাল বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী ও নারীর মানবাধিকার অর্জনের বিরোধী বলে প্রতিবাদ করেন, অথচ সেগুলো আরও দৃঢ়ভাবে সন্নিবেশিত হয়েছে আমাদের সংবিধানে।

নানাভাবে এই শতকের অতিক্রান্ত প্রথম দুই দশকেই আমরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি অনেক ক্ষেত্রে। আমাদের প্রাপ্তি যেমন অনেক, তেমনি নারী নির্যাতন, ধর্ষণ বেড়েছে মাত্রাতিরিক্তভাবে। মৌলবাদ খামচা দিয়ে ধরেছে সংবিধান, পতাকা, জাতীয় সংগীত। দুর্নীতি আজ সর্বগ্রাসী। সততার সঙ্গে, সাহসের সঙ্গে মানব ধর্ম পালনের যে নীতিতে সুফিয়া কামাল অনড় অটল ছিলেন তা আজ অনেক দোদুল্যমান। আজ যেন আমরা অনেক বেশি অভিভাবক শূন্য। আজ এই জাতির বিবেককে তেমন করে ধমক দেয়ার কেউ যেন কোথাও নেই। অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে তবু এই দেশের নারী সমাজ, সাধারণ মানুষ ফিরে আসে সুফিয়া কামালের কাছেই। ...’ বাঙালি জীবনে একুশ শতক আসছে। নারী ও শিশুর উপর আর নির্যাতন হবে না ... তা এই জনগণ প্রতিষ্ঠা করবে, এটা আমার বিশ্বাস। ‘... আর, যে দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনমুক্ত হতে পারে সে দেশে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব হতেই হবে। তাই সেই বিশ্বাসে আমরা আস্থা স্থাপন করতে হবে। সব ত্রুটি বিচ্যুতির ঊর্ধ্বে নারী পুরুষের সমতাপূর্ণ গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের লড়াইয়ে সুফিয়া কামাল আজও সবাইকে ডেকে বলে যাচ্ছেন, ...’ ওঠো জাগো, সমাজ ও দেশের জন্য কিছু কাজ করো। মানুষের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করো। সবার মঙ্গল করো।”

[লেখক: আইনজীবী; সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।]

রবিবার, ২০ জুন ২০২১ , ৬ আষাঢ় ১৪২৮ ৮ জিলকদ ১৪৪২

চিরদিনের অভিভাবক

দেবাহুতি চক্রবর্তী

image

প্রায় গোটা একটা শতক ধরেই সুফিয়া কামালের জীবন। তার জন্ম-১৯১১ মৃত্যু-১৯৯৯। মানবসমাজের ইতিহাসে এই বিংশ শতক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বিশ্বজুড়েই এই শতকে ভাঙা গড়ার ঘনঘটা। উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী তীব্র আন্দোলন, দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, ৪৭-এর দেশভাগ, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, বৃহত্তর অঙ্গনে দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধ, হিরোশিমা -নাগাসাকিতে পারমানবিক বিস্ফোরণ, রুশ বিপ্লব, সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতের পতন, জাতিসংঘের জন্ম, দেশে দেশে ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে বিপ্লব- বিদ্রোহ, বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব জয়যাত্রা ইত্যাদি অগুনতি ইতিবাচক এবং নেতিবাচক ঘটনার সমাহার পুরো বিংশ শতকজুড়ে। এর মাঝেই সুফিয়া কামালের জন্ম এবং নিজেকে নিজের মতো বুঝে নেবার লড়াই শুরু।

লড়াইটা শুরু হয় পরিবার থেকেই। তখনকার অভিজাত বনেদি পরিবারের রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে দীর্ঘসময় তিনি লড়াই করেন। এই লড়াইগুলো কত কঠিন তা বাইরে থেকে অনুমেয় নয়। বাংলায় জন্মে বাংলাভাষা শেখার জন্যই প্রথম লড়াই শুরু। তারপর আবার সাহিত্য চর্চা, পত্রিকায় নাম প্রকাশ, বরিশালে বোরখা পরিহিত অবস্থায় স্বদেশী আন্দোলনে অংশ নেয়া, মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ, স্বামীর সঙ্গে প্রথম বাঙালি মুসলিম নারী হিসেবে উড়োজাহাজে ভ্রমণ কোনোটাই পরিবার ও সমাজ ভালোভাবে নেয়নি। কিন্তু সহযোগিতা করেন, পাশে থাকেন স্বামী নেহাল আহমেদ। সেই সংসার জীবন মাত্র ছয় বছরের। এক কন্যা নিয়ে অকাল বৈধব্যের শিকার হন সুফিয়া কামাল। তবু ভেঙে পড়েননি। কলকাতার এক স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। সঙ্গে কাব্যচর্চাও নিয়মিত চলতে থাকে। বাড়তে থাকে সামাজিক সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ। কয় বছরের মধ্যে দ্বিতীয় বিয়ে হয় কামালউদ্দিন খানের সঙ্গে। সরকারি চাকরিজীবী, সাহিত্যপ্রেমিক এই মানুষটিও সুফিয়া কামালের ইপ্সিত চলার পথে হাত বাড়িয়ে দেন, হাতে হাত মেলান।

১৯৪৬-এর কলকাতার দাঙ্গার ভয়াবহ রূপ তিনি সরাসরি প্রত্যক্ষ করেন। দাঙ্গাপীড়িত মানুষের সেবায় দুয়ারে দুয়ারে ঘোরেন। দেশভাগ পরবর্তীতে স্থায়ীভাবে তিনি পরিবারসহ ফিরে আসেন তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে। পাকিস্তানকে স্বাগত জানান। কায়েদ-ই-আজমের প্রশস্তিমূলক কবিতা লেখেন। অনেকের মতই হয়তো মনে হতে পারে মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। অথবা নিজের জন্মভূমিতে ফিরে আসাটাই আকাক্সক্ষার হতে পারে। যেটাই হোক, সুফিয়া কামাল ধার্মিক ছিলেন। কিন্তু সাম্প্রদায়িক ছিলেন না কখনই। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক চেহারা অল্পদিনের মধ্যেই সবার সামনে প্রকাশ পেতে থাকে। ধর্মের নামে, ভাষার নামে পাক শাসকদের নগ্ন চেহারা ক্রমশ এই ভূখণ্ডের মানুষের পাকিস্তান প্রীতির মোহভঙ্গ ঘটাতে শুরু করে।

সুফিয়া কামালের গার্হস্থ্য জীবন স্বামী সন্তানাদি পরিজন নিয়ে যখন ভরপুর, হাসিমুখে সেই দায়িত্ব পালন করতে করতে তখনই তিনি জড়িয়ে যান নানা সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে। পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতি, ঢাকা শিশু রক্ষা সমিতি, ওয়ারি মহিলা সমিতি, ছায়ানট, রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ, মহিলা সংগ্রাম পরিষদ, কচি কাঁচার মেলা সর্বত্রই তিনি আর তিনি। এর বাইরে ৫২ র ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকেন। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে ১৯৫৫ সনে ঢাকার রাজপথে নারীদের বিক্ষোভ মিছিলে নেতৃত্ব দেন। এদেশে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ ঘোষণার পর তার ছায়াতলে, তার বাড়ি হয়ে ওঠে দেশের সামাজিক -সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূতিকাগার। কোনোরকম রক্তচক্ষুকে পরোয়া না করে বলেন, রবীন্দ্রসংগীত আমার জীবনে উপাসনার নামান্তর।”

ছোটখাট একটা শান্ত মানুষ কত কঠিন, কত নির্ভীক হতে পারেন তার প্রমাণ প্রবল পরাক্রান্ত পাক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এক সভায় বাঙালিদের জানোয়ার- বলে গালি দেওয়ায় উঠে দাঁড়িয়ে তিনিই বলতে পারেন, — আপনি সেই জানোয়ারদের প্রেসিডেন্ট। ৬৯/৭০-এর গণ-আন্দোলনের সঙ্গে তিনি একাত্ম থাকেন। একাত্তরে চেষ্টা করেও হানাদার বাহিনী তাদের অনুকূলে কোনো বিবৃতিতে তাকে দিয়ে সই করাতে পারেনি। কবি- সাহিত্যিক সুফিয়া কামাল দেশ বিদেশে পরিচিত একটি নাম। তাকে হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে একবারই তিনি বাধ্য হয়ে বেতারে আসেন এবং জানান দেন তিনি বেঁচে আছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি বাংলাদেশ সোভিয়েত মৈত্রী সংস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত হন।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপ্রধান হিসেবে দাবি দাওয়া নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। যুদ্ধাহত ও অসহায় নারীদের পুনর্বাসনের জন্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিধ্বস্ত মানুষের জন্য, বিভিন্ন সময় দাঙ্গা প্রতিরোধে ও দাঙ্গাপীড়িত মানুষের জন্য, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য, স্বৈরাচারী শাসকের পতনের জন্য, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য, নারী মুক্তির জন্য সব আন্দোলনে সংগ্রামে বলিষ্ঠ ও পুরোধা ভূমিকায় থাকেন। ৭২ সনেই তিনি যুদ্ধাহত নারীদের মুক্তিযোদ্ধা ঘোষণার দাবি জানান, যা এখনও চলমান প্রক্রিয়া। এই বৃহৎ জীবনের নানা রঙের বৈচিত্র্যময় ক্যানভাস স্বল্প পরিসরে তুলে ধরা সম্ভব নয়।

একটা মানুষ লেখায়- কবিতায়, সংসারে, সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে একেবারেই যেন দশভুজা। কিন্তু রণরঙ্গিণী মূর্তিতে নয়। যাকে কাছে টানার কাছে টেনেছেন, যাকে দূরে ঠেলার দূরে ঠেলেছেন। সব মিলিয়ে এক নির্মোহ বৈরাগ্য জীবনাচারণে। তিনি আমাদের বলতেন, মহিলা পরিষদে কেউ নেত্রী নয়, সবাই কর্মী। ‘... ছোট বড়, ধর্ম বর্ণ কোনো ভেদাভেদ তিনি কখনো করেননি। কবি হিসেবে আমরা তাকে বেশি জানি। কর্মবহুল জীবনের মাঝেও কাব্যচর্চা থেকে দূরে সরে যাননি। নিজের কবিতা নিয়ে বলেন, ...’ আমার কবিতা-সাজানো বাগানের ফুল নয়, গুণে গুণে কোনোটির পর কোনোটির কথা আমি মালীর হাতে তৈরি ফুলের তোড়ার মতো সাজাইনি, ও বিদ্যা আমার নেই। আমি বন্য, আমি অরণ্য, আমি নামহীন। ‘... কবি জানতেন, এই নামহীন বুনো ফুলের সুঘ্রাণ কতদূর ছড়াতে পারে!

১৯৯৭ সনে মহিলা পরিষদের সম্মেলনে হুইল চেয়ারে করে সুফিয়া কামাল আসেন। মঞ্চে থাকেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা সেই সম্মেলনে ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি’... ঘোষণা করেন। প্রাণভরে অভিনন্দন জানান সুফিয়া কামাল বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রীকে।

দুঃখের বিষয় সেই নীতি বাস্তবায়ন থেকে আজও আমরা অনেক দূরে রয়ে গেছি। রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার সময় থেকেই সুফিয়া কামাল বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী ও নারীর মানবাধিকার অর্জনের বিরোধী বলে প্রতিবাদ করেন, অথচ সেগুলো আরও দৃঢ়ভাবে সন্নিবেশিত হয়েছে আমাদের সংবিধানে।

নানাভাবে এই শতকের অতিক্রান্ত প্রথম দুই দশকেই আমরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি অনেক ক্ষেত্রে। আমাদের প্রাপ্তি যেমন অনেক, তেমনি নারী নির্যাতন, ধর্ষণ বেড়েছে মাত্রাতিরিক্তভাবে। মৌলবাদ খামচা দিয়ে ধরেছে সংবিধান, পতাকা, জাতীয় সংগীত। দুর্নীতি আজ সর্বগ্রাসী। সততার সঙ্গে, সাহসের সঙ্গে মানব ধর্ম পালনের যে নীতিতে সুফিয়া কামাল অনড় অটল ছিলেন তা আজ অনেক দোদুল্যমান। আজ যেন আমরা অনেক বেশি অভিভাবক শূন্য। আজ এই জাতির বিবেককে তেমন করে ধমক দেয়ার কেউ যেন কোথাও নেই। অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে তবু এই দেশের নারী সমাজ, সাধারণ মানুষ ফিরে আসে সুফিয়া কামালের কাছেই। ...’ বাঙালি জীবনে একুশ শতক আসছে। নারী ও শিশুর উপর আর নির্যাতন হবে না ... তা এই জনগণ প্রতিষ্ঠা করবে, এটা আমার বিশ্বাস। ‘... আর, যে দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনমুক্ত হতে পারে সে দেশে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব হতেই হবে। তাই সেই বিশ্বাসে আমরা আস্থা স্থাপন করতে হবে। সব ত্রুটি বিচ্যুতির ঊর্ধ্বে নারী পুরুষের সমতাপূর্ণ গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের লড়াইয়ে সুফিয়া কামাল আজও সবাইকে ডেকে বলে যাচ্ছেন, ...’ ওঠো জাগো, সমাজ ও দেশের জন্য কিছু কাজ করো। মানুষের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করো। সবার মঙ্গল করো।”

[লেখক: আইনজীবী; সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।]