সাদা মনের এক মানুষ

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

­আমরা পাঁচ ভাই দুই বোন। বড় ভাইয়ের বয়স এখন ৮৪ বছর। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর থেকেই তিনি ফেনী, জিএমহাট, নুরপুর গ্রামে আছেন। মেজো ভাই মহিউদ্দিন আহমদ যাকে নিয়ে আমার আজকের কলাম, তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন এবং অবসর নেন সম্ভবত ২০০১ সনের জানুয়ারি মাসে। চাকরি ও পদমর্যাদা আকর্ষণীয় হলেও তিনি কখনও আর্থিকভাবে সচ্ছল ছিলেন না। কারণ চাকরির শুরু থেকেই তাকে পিতার সংসার ও ভাইবোনদের পড়ার খরচ জোগাতে হয়েছে। অবশ্য এই খরচে তার আনন্দ ছিল। আমাদের বাবা ছিলেন গ্রামের একটি মাইনর স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক, তার পক্ষে সব খরচ বহন করা সম্ভব ছিল না। মহিউদ্দিন আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স করে ইন্টারউইং স্কলারশিপ নিয়ে করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেন। ১৯৬৫ সনে মাস্টার্স শেষ করেই তিনি রেডিও পাকিস্তান করাচিতে অনুবাদকের চাকরি নেন। কিছুদিন পর রেডিও পাকিস্তানের চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি দেশে এসে ফেনী কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এই কলেজ থেকেই তিনি পাকিস্তান সুপারিয়র সার্ভিসে পরীক্ষা দিয়ে ১৯৬৭ সনে পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগ দেন, প্রশিক্ষণ শেষে তার প্রথম পোস্টিং হয় লন্ডনে পাকিস্তান দূতাবাসে।

একাত্তরের পহেলা আগস্টে তিনি পাকিস্তান দূতাবাস ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য স্বীকার করেন। মুক্তিযদ্ধের শুরুতেই তিনি বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য স্বীকার করার ইচ্ছে পোষণ করেছিলেন। কিন্তু বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীর অভিমত ছিল, আনুগত্য স্বীকারের সময় তখনো হয়নি। ফলে তাকে আগস্ট মাস পর্যন্ত বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীর সবুজ সংকেতের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। তবুও ইউরোপে তিনিই প্রথম বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য স্বীকার করেন। লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে হাজার হাজার বাঙালির মুহুর্মুহু সেøাগানের ভেতর মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। তার আনুগত্য ঘোষণার এই উৎসবমুখর ঘটনার মনোরম বর্ণনা রয়েছে সুনীল গঙ্গাপাধ্যায়ের ‘পূর্ব পশ্চিম’ উপন্যাসে। পাকিস্তান দূতাবাসের চাকরি ছেড়ে দিয়ে কোথায় কীভাবে থাকবেন, কীভাবে খাবেন তা তার মাথায় ছিল না, মাথায় ছিল শুধু মুক্তিযুদ্ধ। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে নিয়ে তার মাথা গোঁজার কোন ঠাঁই ছিল না, হাতে টাকা ছিল না, কিন্তু এই সব সমস্যা তাকে আনুগত্যের ঘোষণা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। কারণ তিনি পাকিস্তানি শাসকদের প্রতি ছিলেন ক্ষুব্ধ, করাচিতে পড়াশোনা করতে গিয়ে তিনি বাঙালিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের বঞ্ছনা ও শোষণের প্রকৃত চিত্র দেখতে পেয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হলে সক্রিয়ভাবে ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।

বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে তিনি লন্ডনে বসে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে কাজ করতে থাকেন। যাদের আত্মীয়-স্বজন তখন পশ্চিম পাকিস্তানে থাকতেন তারা জানেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের বাঙালিরা লন্ডনের মাধ্যমে দেশে চিঠিপত্র পাঠাতেন, আমার এই মেজো ভাই-ই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পাওয়া চিঠিপত্র বাংলাদেশে প্রেরণের ব্যবস্থা করতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনিই আবার ১৯৭৩ সনে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত বাঙালিদের দিল্লি বিমানবন্দরে রিসিভ করে বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। এই বিমানবন্দরে তিনি পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত রিয়াজ রহমানকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীদের আক্রোশ থেকে রক্ষা করেছিলেন; অথচ রিয়াজ রহমান পররাষ্ট্র সচিব থাকাকালীনই আমার এই মেজো ভাই চাকরিচ্যুত হন। পাকিস্তানের প্রতি অনুগত রিয়াজ রহমান পরবর্তীতে বিএনপি আমলে পররাষ্ট্র সচিব এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন।

বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মহিউদ্দিন আহমদকে নিউইয়র্কে জাতিসংঘে বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করা হয়। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরপরই বিএনপির একদল সাংসদ নিউইয়র্কে সরকারি সফরে যান, তাদের মধ্যে নোয়াখালীর জিয়াউল হক জিয়াও ছিলেন। তিনি মেজো ভাইয়ের অফিসে গিয়ে দুটি ছবি দেখে ঢাকায় এসে বিএনপি সরকারের কাছে নালিশ করেন; নূর হোসেনের বুক-পিঠে লেখা সেই বিখ্যাত ছবিসহ বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের পাশে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার ঘোমটা টানার অপরূপ দৃশ্য সম্বলিত ঐতিহাসিক ছবিটি তার অফিস কক্ষে টাঙ্গানো ছিলো। এই দুটি ছবি রাখার অপরাধে চাকরির ২৫ বছর পূর্তিতে বিএনপি সরকার তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে দেয়; তিনি এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মামলা প্রত্যাহার করার শর্তে তাকে চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়।

তিনি মুক্তিযোদ্ধা চাকরিজীবী হিসেবে সরকার প্রদত্ত দুই বছরের এন্টিডেইটেড সুবিধা গ্রহণ করেননি, এমন কি তিনি বহু বছর মুক্তিযোদ্ধা সনদ এবং ভাতাও নেননি। মাত্র দুই/তিন বছর পূর্বে তিনি মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়ে ভাতা গ্রহণ শুরু করন। ভাতা গ্রহণের ব্যাপারে বন্ধুদের পরামর্শ ছিল, এই অল্প সম্মানী সরকারকে দিয়ে দিলে সরকারের কোন উপকার হবে না, এই টাকা নিয়ে বরং তার পছন্দানুযায়ী গরিবদের দেয়া হলে তারা উপকৃত হবে; তারা জানতেন, তাদের এই বন্ধুটি সম্পদশালী না হলেও গরিব ও অসহায়দের সম্পদ বিলাতে অকৃপণ। তার গাড়ি নেই, অতিরিক্ত সম্পদ নেই; অবসর গ্রহণের পর তিনি পাবলিক বাসে যাতায়াত করতেন। এখন বয়সের কারণে আর বাসে চড়তে পারেন না, তার বন্ধু সাংবাদিক আমিনুল ইসলাম বেদুর গাড়ি দিয়ে বা উবারে চলাফেরা করেন। পর্যাপ্ত অর্থ না থাকলেও তিনি গ্রামের গরিব ও তার বাল্যকালের ঘনিষ্ঠতম নিঃস্ব বন্ধুদের প্রতি মাসে অর্থ সাহায্য করে যাচ্ছেন; মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাওয়ার পর থেকে অর্থ গ্রহনেচ্ছু বন্ধুদের নিয়ে তার প্রণীত তালিকা বড় হয়েছে। এছাড়াও তিনি ধর্ষিতা, নির্যাতিত গৃহকর্মী, আগুনে পোড়া ও দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় ও নিঃস্বদেরও নিয়মিত অর্থ সহায়তা করে থাকেন। তার জমা অর্থের কিছু আমাকে নমিনি করেছেন যাতে উক্ত টাকার লভ্যাংশসহ মুক্তিযোদ্ধা ভাতা তার করা তালিকা অনুযায়ী তার অবর্তমানে বিলি করতে পারি।

মেজো ভাই শিশুদের খুব পছন্দ করেন, তার বাসায় তিনি ললিপপ, চকোলেট জমা রাখেন- কোন শিশু তার বাসায় গেলেই এগুলো দেন। তিনি রবীন্দ্রসংগীত শুনতে ভালোবাসেন, বিবিসি শোনা কখনো বাদ যায় না, বিবিসি শোনার সময় কেউ ফোনে বা অন্য কোনভাবে ডিসটার্ব করলে তিনি বিরক্ত হন। জাতির উদ্দেশ্যে আইয়ুব খানের ভাষণ শোনার জন্য তিনি আমাকে নিয়ে গ্রামের বাজারে ডা. সতীশ দাদার চেম্বারে চলে যেতেন। তিনি মঞ্চ-নাটকের ভক্ত; স্বাধীনতার পর ত্রিশ/চল্লিশ জন নিয়ে তিনি মঞ্চ-নাটক দেখতেন; এত লোক নিয়ে নাটক দেখার দুটি উদ্দেশ্য- নাটককে প্রমোট করা এবং নাটকের প্রতি ছোটদের আগ্রহী করে তোলা। তিনি বইমেলা থেকেও প্রচুর বই কিনেন, তার অনেকগুলো বুকশেলফ রয়েছে। পরিবারের ছোটদের তিনি বইমেলা থেকে বই কেনার জন্য টাকা দেন। তিনি প্রচুর পড়েন; তিনি ঘুমানো ছাড়া বাকি সময় পত্রিকা, ম্যাগাজিন পড়ে সময় কাটান।

মেজো ভাই দেশের উল্লেখযোগ্য দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রায় পনের শত কলাম লিখেছেন। দৈনিক সংবাদের সঙ্গে তার রয়েছে আত্মিক সম্পর্ক; বজলুর রহমান সাহেব থাকতে তিনি নিয়মিত সংবাদে কলাম লিখতেন। তার কলাম খুব জনপ্রিয় ছিল। তার দুটি অহঙ্কার আছে- এক, মুক্তিযোদ্ধা হিসেব পরিচয় দিতে তিনি অহঙ্কারবোধ করেন; দুই, তিনি অহঙ্কার করেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সনের ৮ জানুয়ারি লন্ডন হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণ করলে তাকে অভ্যর্থনা জানানোর বিরল সুযোগ পেয়েছিলেন আমার এই ভাই। মৃত্যুর কোল থেকে ফেরত আসা বঙ্গবন্ধুকে দেখে মেজো ভাই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লে, বঙ্গবন্ধু তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলেছিলেন, ‘ভয় নেই, আমি এসে গেছি’। বাঙালির ইতিহাসের অংশ পুরাপুরি অসম্প্রদায়িক মহিউদ্দিন আহমদ চলতি মাসের ১৯ জুনে ৮০ বছর বয়সে পদার্পণ করেছেন। তার জন্মদিনে আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com

রবিবার, ২০ জুন ২০২১ , ৬ আষাঢ় ১৪২৮ ৮ জিলকদ ১৪৪২

সাদা মনের এক মানুষ

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

image

­আমরা পাঁচ ভাই দুই বোন। বড় ভাইয়ের বয়স এখন ৮৪ বছর। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর থেকেই তিনি ফেনী, জিএমহাট, নুরপুর গ্রামে আছেন। মেজো ভাই মহিউদ্দিন আহমদ যাকে নিয়ে আমার আজকের কলাম, তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন এবং অবসর নেন সম্ভবত ২০০১ সনের জানুয়ারি মাসে। চাকরি ও পদমর্যাদা আকর্ষণীয় হলেও তিনি কখনও আর্থিকভাবে সচ্ছল ছিলেন না। কারণ চাকরির শুরু থেকেই তাকে পিতার সংসার ও ভাইবোনদের পড়ার খরচ জোগাতে হয়েছে। অবশ্য এই খরচে তার আনন্দ ছিল। আমাদের বাবা ছিলেন গ্রামের একটি মাইনর স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক, তার পক্ষে সব খরচ বহন করা সম্ভব ছিল না। মহিউদ্দিন আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স করে ইন্টারউইং স্কলারশিপ নিয়ে করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেন। ১৯৬৫ সনে মাস্টার্স শেষ করেই তিনি রেডিও পাকিস্তান করাচিতে অনুবাদকের চাকরি নেন। কিছুদিন পর রেডিও পাকিস্তানের চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি দেশে এসে ফেনী কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এই কলেজ থেকেই তিনি পাকিস্তান সুপারিয়র সার্ভিসে পরীক্ষা দিয়ে ১৯৬৭ সনে পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগ দেন, প্রশিক্ষণ শেষে তার প্রথম পোস্টিং হয় লন্ডনে পাকিস্তান দূতাবাসে।

একাত্তরের পহেলা আগস্টে তিনি পাকিস্তান দূতাবাস ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য স্বীকার করেন। মুক্তিযদ্ধের শুরুতেই তিনি বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য স্বীকার করার ইচ্ছে পোষণ করেছিলেন। কিন্তু বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীর অভিমত ছিল, আনুগত্য স্বীকারের সময় তখনো হয়নি। ফলে তাকে আগস্ট মাস পর্যন্ত বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীর সবুজ সংকেতের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। তবুও ইউরোপে তিনিই প্রথম বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য স্বীকার করেন। লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে হাজার হাজার বাঙালির মুহুর্মুহু সেøাগানের ভেতর মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। তার আনুগত্য ঘোষণার এই উৎসবমুখর ঘটনার মনোরম বর্ণনা রয়েছে সুনীল গঙ্গাপাধ্যায়ের ‘পূর্ব পশ্চিম’ উপন্যাসে। পাকিস্তান দূতাবাসের চাকরি ছেড়ে দিয়ে কোথায় কীভাবে থাকবেন, কীভাবে খাবেন তা তার মাথায় ছিল না, মাথায় ছিল শুধু মুক্তিযুদ্ধ। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে নিয়ে তার মাথা গোঁজার কোন ঠাঁই ছিল না, হাতে টাকা ছিল না, কিন্তু এই সব সমস্যা তাকে আনুগত্যের ঘোষণা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। কারণ তিনি পাকিস্তানি শাসকদের প্রতি ছিলেন ক্ষুব্ধ, করাচিতে পড়াশোনা করতে গিয়ে তিনি বাঙালিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের বঞ্ছনা ও শোষণের প্রকৃত চিত্র দেখতে পেয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হলে সক্রিয়ভাবে ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।

বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে তিনি লন্ডনে বসে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে কাজ করতে থাকেন। যাদের আত্মীয়-স্বজন তখন পশ্চিম পাকিস্তানে থাকতেন তারা জানেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের বাঙালিরা লন্ডনের মাধ্যমে দেশে চিঠিপত্র পাঠাতেন, আমার এই মেজো ভাই-ই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পাওয়া চিঠিপত্র বাংলাদেশে প্রেরণের ব্যবস্থা করতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনিই আবার ১৯৭৩ সনে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত বাঙালিদের দিল্লি বিমানবন্দরে রিসিভ করে বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। এই বিমানবন্দরে তিনি পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত রিয়াজ রহমানকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীদের আক্রোশ থেকে রক্ষা করেছিলেন; অথচ রিয়াজ রহমান পররাষ্ট্র সচিব থাকাকালীনই আমার এই মেজো ভাই চাকরিচ্যুত হন। পাকিস্তানের প্রতি অনুগত রিয়াজ রহমান পরবর্তীতে বিএনপি আমলে পররাষ্ট্র সচিব এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন।

বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মহিউদ্দিন আহমদকে নিউইয়র্কে জাতিসংঘে বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করা হয়। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরপরই বিএনপির একদল সাংসদ নিউইয়র্কে সরকারি সফরে যান, তাদের মধ্যে নোয়াখালীর জিয়াউল হক জিয়াও ছিলেন। তিনি মেজো ভাইয়ের অফিসে গিয়ে দুটি ছবি দেখে ঢাকায় এসে বিএনপি সরকারের কাছে নালিশ করেন; নূর হোসেনের বুক-পিঠে লেখা সেই বিখ্যাত ছবিসহ বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের পাশে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার ঘোমটা টানার অপরূপ দৃশ্য সম্বলিত ঐতিহাসিক ছবিটি তার অফিস কক্ষে টাঙ্গানো ছিলো। এই দুটি ছবি রাখার অপরাধে চাকরির ২৫ বছর পূর্তিতে বিএনপি সরকার তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে দেয়; তিনি এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মামলা প্রত্যাহার করার শর্তে তাকে চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়।

তিনি মুক্তিযোদ্ধা চাকরিজীবী হিসেবে সরকার প্রদত্ত দুই বছরের এন্টিডেইটেড সুবিধা গ্রহণ করেননি, এমন কি তিনি বহু বছর মুক্তিযোদ্ধা সনদ এবং ভাতাও নেননি। মাত্র দুই/তিন বছর পূর্বে তিনি মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়ে ভাতা গ্রহণ শুরু করন। ভাতা গ্রহণের ব্যাপারে বন্ধুদের পরামর্শ ছিল, এই অল্প সম্মানী সরকারকে দিয়ে দিলে সরকারের কোন উপকার হবে না, এই টাকা নিয়ে বরং তার পছন্দানুযায়ী গরিবদের দেয়া হলে তারা উপকৃত হবে; তারা জানতেন, তাদের এই বন্ধুটি সম্পদশালী না হলেও গরিব ও অসহায়দের সম্পদ বিলাতে অকৃপণ। তার গাড়ি নেই, অতিরিক্ত সম্পদ নেই; অবসর গ্রহণের পর তিনি পাবলিক বাসে যাতায়াত করতেন। এখন বয়সের কারণে আর বাসে চড়তে পারেন না, তার বন্ধু সাংবাদিক আমিনুল ইসলাম বেদুর গাড়ি দিয়ে বা উবারে চলাফেরা করেন। পর্যাপ্ত অর্থ না থাকলেও তিনি গ্রামের গরিব ও তার বাল্যকালের ঘনিষ্ঠতম নিঃস্ব বন্ধুদের প্রতি মাসে অর্থ সাহায্য করে যাচ্ছেন; মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাওয়ার পর থেকে অর্থ গ্রহনেচ্ছু বন্ধুদের নিয়ে তার প্রণীত তালিকা বড় হয়েছে। এছাড়াও তিনি ধর্ষিতা, নির্যাতিত গৃহকর্মী, আগুনে পোড়া ও দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় ও নিঃস্বদেরও নিয়মিত অর্থ সহায়তা করে থাকেন। তার জমা অর্থের কিছু আমাকে নমিনি করেছেন যাতে উক্ত টাকার লভ্যাংশসহ মুক্তিযোদ্ধা ভাতা তার করা তালিকা অনুযায়ী তার অবর্তমানে বিলি করতে পারি।

মেজো ভাই শিশুদের খুব পছন্দ করেন, তার বাসায় তিনি ললিপপ, চকোলেট জমা রাখেন- কোন শিশু তার বাসায় গেলেই এগুলো দেন। তিনি রবীন্দ্রসংগীত শুনতে ভালোবাসেন, বিবিসি শোনা কখনো বাদ যায় না, বিবিসি শোনার সময় কেউ ফোনে বা অন্য কোনভাবে ডিসটার্ব করলে তিনি বিরক্ত হন। জাতির উদ্দেশ্যে আইয়ুব খানের ভাষণ শোনার জন্য তিনি আমাকে নিয়ে গ্রামের বাজারে ডা. সতীশ দাদার চেম্বারে চলে যেতেন। তিনি মঞ্চ-নাটকের ভক্ত; স্বাধীনতার পর ত্রিশ/চল্লিশ জন নিয়ে তিনি মঞ্চ-নাটক দেখতেন; এত লোক নিয়ে নাটক দেখার দুটি উদ্দেশ্য- নাটককে প্রমোট করা এবং নাটকের প্রতি ছোটদের আগ্রহী করে তোলা। তিনি বইমেলা থেকেও প্রচুর বই কিনেন, তার অনেকগুলো বুকশেলফ রয়েছে। পরিবারের ছোটদের তিনি বইমেলা থেকে বই কেনার জন্য টাকা দেন। তিনি প্রচুর পড়েন; তিনি ঘুমানো ছাড়া বাকি সময় পত্রিকা, ম্যাগাজিন পড়ে সময় কাটান।

মেজো ভাই দেশের উল্লেখযোগ্য দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রায় পনের শত কলাম লিখেছেন। দৈনিক সংবাদের সঙ্গে তার রয়েছে আত্মিক সম্পর্ক; বজলুর রহমান সাহেব থাকতে তিনি নিয়মিত সংবাদে কলাম লিখতেন। তার কলাম খুব জনপ্রিয় ছিল। তার দুটি অহঙ্কার আছে- এক, মুক্তিযোদ্ধা হিসেব পরিচয় দিতে তিনি অহঙ্কারবোধ করেন; দুই, তিনি অহঙ্কার করেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সনের ৮ জানুয়ারি লন্ডন হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণ করলে তাকে অভ্যর্থনা জানানোর বিরল সুযোগ পেয়েছিলেন আমার এই ভাই। মৃত্যুর কোল থেকে ফেরত আসা বঙ্গবন্ধুকে দেখে মেজো ভাই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লে, বঙ্গবন্ধু তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলেছিলেন, ‘ভয় নেই, আমি এসে গেছি’। বাঙালির ইতিহাসের অংশ পুরাপুরি অসম্প্রদায়িক মহিউদ্দিন আহমদ চলতি মাসের ১৯ জুনে ৮০ বছর বয়সে পদার্পণ করেছেন। তার জন্মদিনে আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com