দুর্নীতি কি চলতেই থাকবে

রণেশ মৈত্র

বাড়ির বাইরে গেলেই সর্বত্র দুর্নীতি চোখে পড়ে। দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার যে প্রত্যয়, কর্তাব্যক্তিরা তা প্রতিনিয়ত আওড়ালেও চারিদিককার নিত্যদিনের পরিস্থিতি দেখে, মানুষ তাদের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। যেখানেই টাকা, সেখানেই দুর্নীতি-যেখানেই উন্নয়ন প্রকল্প সেখানেই দুর্নীতি-যেন দেশটা একটি বিশাল বৃক্ষ-ওই বৃক্ষে ধরে আছে অজস্র দুর্নীতির সুযোগে ভরা নানা প্রকল্পের সমারোহ।

দৈনন্দিন জীবনে মানুষকে বাইরে যেতেই হয়। তা সে হাঁটাপথেই হোক-বা অন্যবিধ যানবাহনেই হোক। যানবাহনগুলো তো চলে সড়ক-মহাসড়ক-সেতুর উপর দিয়ে। আর এই সড়ক-সেতুর ক্ষেত্রে যে সীমাহীন দুর্নীতি-তা তো ইদানীং সংবাদপত্রের পৃষ্ঠা ছাড়িয়ে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতেও দিব্যি দেখানো হচ্ছে। কোটি কোটি টাকা লোপাটের ক্ষেত্র এটি। হাত দিয়ে তুলতে চাইলেই কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সড়কের পিচ উঠে আসছে-দৃশ্যমান হচ্ছে ইটের খোয়া। সাক্ষাতকারে স্থানীয় বাসিন্দারা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। হয়তো আবার মেরামত হবে-আবার তহবিল আসবে কিন্তু সড়কের মান যা তাই থেকে যাবে। কোথায় ইঞ্জিনিয়ার, কোথায় প্রজেক্ট অফিসার আর কোথায়ই বা সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন মন্ত্রী বা সচিব!

স্থানীয় এমপিরা নীরব। ছোটখাটো রাস্তা-সেতু তাদেরকে উদ্বোধন করে ‘উন্নয়নের সরকার’ বলে প্রশস্তি গাইতেও শুনা যায়। কিন্তু সেতুটি যে নির্মাণকাজ সমাপ্তির পর তিন দিন যেতে না যেতেই ধসে পড়লো-সে সন্ধান কে রাখে? ফলে এই খাতেই, অর্থাৎ সেতু ও সড়ক খাতেই সম্ভবত প্রতি বছর বাজেটে সর্বোচ্চ অংক বরাদ্দ দেয়া হয়-তেমনই আবার এই খাতে বিশাল বিশাল প্রকল্পও হাতে নেয়া হয়।

আন্তর্জাতিক মহলের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশেই সড়ক ও সেতু নির্মাণ ব্যয় গোটা পৃথিবীর মধ্যে সর্বাধিক। যদিও বাংলাদেশেই শ্রমিক সর্বাপেক্ষা সস্তা, ইট, সুরকি, সিমেন্ট বালিসহ তাবৎ উপকরণও বাংলাদেশে সব চাইতে সস্তা। তাহলে কোন যুক্তিতে সড়ক-সেতু নির্মাণে এ দেশে সর্বাধিক টাকা লাগে?

কর্তাব্যক্তিরা জানেন, মন্ত্রণালয়ের সকলে জানেন, জানেন খোদ মন্ত্রী এবং স্বয়ং সচিবও। কিন্তু অজানা কারণে তাদের মন্ত্রণালয়ের এই হাল সম্পর্কে কদাপি একটি উক্তি করেন না। যদিও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী প্রায় প্রতিদিনই সাংবাদিকদের ডাকেন সংবাদ সম্মেলনে। কিন্তু যা বলেন তা প্রধানত ভিন্ন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত বিষয়। আমরা জানি পৃথিবীর কোন গণতান্ত্রিক দেশে কোন মন্ত্রী এত সংবাদ সম্মেলন করেন না-করার সময়ও পান না-বা তেমন আগ্রহ পোষণ করেন না।

এবারে যদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দিকে তাকানো যায়-মনে হয় সেই পুরনো আমলের বহু-ব্যবহৃত প্রবাদ বাক্যটির। ‘আঁধার ঘরে সাপ-সকল ঘরে সাপ’ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে এ প্রবাদটি যথোপযুক্তই বটে। এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব জনস্বাস্থ্য সংরক্ষণের। অর্থাৎ বিনামূল্যে চিকিৎসা সুযোগ সকল হাসপাতালে যাতে পান তার ব্যবস্থা করতে। আসলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আহার, বাসস্থান এবং কাজ এগুলো হলো মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু দেশের মানুষের অভিজ্ঞতা কী। হাসপাতালে ভর্তি হতে টাকা, ওষুধ পেতে টাকা, অপারেশন করতে টাকা, বেড পেতে এবং তা দুই বেলা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করাতেও টাকা। ফলে দেশের ৯৫ ভাগ মানুষের কপালে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার কোন সুযোগই নেই। আর যে যে বাবদে টাকাগুলোর কথা উল্লেখ করলাম- ওই সব বাবদে সরকারি হাসপাতালগুলোতে একটি পয়সাও লাগার কথা না। তবুও লাগে এবং বাধ্যতামূলকভাবে লাগে। এ কথাও সবাই জানেন কিন্তু কেউ এর প্রতিকার করতে এগিয়ে আসেন না। জেলা-উপজেলাগুলোতে সরকারি হাসপাতালে সেই ৩০-৪০ বছর আগে কত বেডের হাসপাতাল হবে তা নির্ধারণ করা হয়েছিল-আজও তার কোন হেরফের হয়নি। ২৫০ বেডের জেলা হাসপাতাগুলোতে যে আজ ১০০০ বেডের হাসপাতালে পরিণতও করা প্রয়োজন-আর ত্রিশ বেডের উপজেলা হাসপাতালগুলোকে যে কমপক্ষে ১০০ বেড হাসপাতালে উন্নীত করা প্রয়োজন; জনসংখ্যার বিপুল বৃদ্ধির এবং নিত্য-নতুন কঠিন রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণে তা মানুষে বুঝলেও সরকার বুঝতে অক্ষম।

আসন সংখ্যা কম থাকার কারণেই যে বেড কেনাবেচা হয়, ওষুধ কেনাবেচা হয়, অপারেশন চার্জ বহুগুণ বেশি নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়- তা বুঝতে নিশ্চয়ই কোন বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই।

করোনা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আবার আসল চেহারা স্পষ্ট করেছে। দুর্নীতিবাজ অনেকের নাম শিরোনামে এসেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যাপারে একটি কথাই সম্ভবত যথেষ্ট আর তা হলো ‘সর্ব অঙ্গে ঘা, মলম দেব কোথা?’ স্বাস্থ্য দফতরের মন্ত্রী, সচিব, তাদের ঊর্ধ্বতন-অধস্তন সবাই খবরগুলো ভালোভাবেই জানেন কিন্তু কাউকেই এ ব্যাপারে অগ্রসর হতে দেখা যায় না। কিন্তু মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই।

এবারে আসা যাক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। এ মন্ত্রণালয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় কিন্তু আজও উপেক্ষিতই রয়ে গেল। এর জন্য যে বাজেট বরাদ্দ হয় তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। আবার যা-ও বা বরাদ্দ হয় তা শিক্ষার মানোন্নয়নে খরচ না হয়ে খরচ হয় মূলত অবকাঠামো নির্মাণে। আর অবকাঠামো নির্মাণ, দালানকোঠা নির্মাণ ও সংস্কার, চেয়ার-টেবিল বেঞ্চ প্রভৃতি তৈরি-এতেই যে দুর্নীতির সর্বাধিক উপযুক্ত খাত। বাদ-বাকি যা খরচ হয় শিক্ষকদের বেতন-ভাতা প্রভৃতি ক্ষেত্রে এবং বিনামূল্যে বিতরণের জন্য কোটি কোটি কপি পাঠ্যবই ছাপা ও বিতরণ বাবদে।

কিন্তু যে অমোঘ সত্যটি সর্বদাই শিক্ষা মন্ত্রণালয় বুঝতে চায় না বা বুঝতে ভুল করে তা হলো- আমাদের টপ টু বটম শিক্ষক-শিক্ষিকা উচ্চহারে বেতন পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও নিজেরা নিজেদের উন্নতমানের শিক্ষকে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে পড়াশুনা বা গবেষণায় নিজেরদের আত্মনিয়োগ করেন না। অল্প কিছু সংখ্যক সৎশিক্ষক-শিক্ষিকা বাদে অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকা কোচিং সেন্টার খুলে বসেন, প্রাইভেট টিউশনিতে আত্মনিয়োগ করেন। যেমন করে থাকেন সরকারি ডাক্তারেরা। এ অবস্থায় শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ১০টা-৫টা নিয়মিত শ্রেণীকক্ষে শিক্ষাদান বাধ্যতামূলক করা। ভাইস চ্যান্সেলরগণ, কলেজের অধ্যক্ষ ও স্কুলের প্রধান শিক্ষক-শিক্ষিকারা নিয়মিত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পাঠদান পর্যবেক্ষণ করবেন এবং প্রতি তিন মাসে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অত্যন্ত সততার সঙ্গে প্রতিটি শিক্ষক-শিক্ষিকা সম্পর্কে প্রতিবেদন দেবেন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। একই সঙ্গে শিক্ষক নিয়োগে প্রায় সকল পর্যায়ে যে ব্যাপক দুর্নীতি প্রচলিত রয়েছে, যে কোন মূল্যে তার শেকড় উপড়ে ফেলতে হবে।

এবারে পানি সম্পদ, বিদ্যুৎ ও গ্যাস বা জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে প্রচলিত ব্যাপক দুর্নীতি, ব্যাংকিং সেক্টরে প্রচলিত ভয়াবহ এবং ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি যে দেশের মানুষের কষ্টার্জিত অর্থের মারাত্মক অপচয় নানাভাবে ঘটছে-তা বন্ধ করার ক্ষেত্রে যে নির্লিস্ততা দেখা যায় তার ফলে যে লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে- এ কথা আজ সবার মুখে মুখে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ নির্বিকার।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সততা বহুকাল যাবত প্রশ্নবিদ্ধ। পুলিশে এবং অপরাপর বহির্বিশ্বে লোক নিয়োগ খুব কম ক্ষেত্রেই মেধা ও ক্ষমতার ভিত্তিতে হয়ে থাকে। পরিণতিতে এজাহার গ্রহণ করার জন্য টাকা, না করার জন্য টাকা, অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করার বা না করার জন্য টাকা- ইত্যকার ঘটনা সম্পর্কে বহু ক্ষেত্রেই অভিযোগ পাওয়া গেলেও তার ক্ষেত্রে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ সচরাচর পরিলক্ষিত হয় না।

মুনিয়া হত্যার আসামিকে গ্রেপ্তার ও সাগর-রুনি সাংবাদিক দম্পতি হত্যার আসামি খুঁজে বের করা বা ত্বকী হত্যার আসামিদের গ্রেফতারে পুলিশের অনীহা এর জাজ্জ্বল্যমান প্রমাণ।

এবারে দেখা যাক ধর্মীয় খাতের অবস্থা। হেফাজত নেতাদের অবৈধ অর্থের খবর জানা যাচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে সংগঠনটির নতুন আমীর বাবুনাগরী, সাবেক যুগ্ম-সম্পাদক মুমিনুল হকসহ আরও অনেকের বিরুদ্ধে (অন্তত ৯৮ জন)। খুঁজলে এমন অনেক অভিযোগ আরও অনেকের বিরুদ্ধে পাওয়া যাবে। ধর্মীয় কাজের নামে দেশ-বিদেশ থেকে নিয়মিত বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ, সেই টাকায় অতিমাত্রায় বিলাসী জীবন, প্রয়োজনে হেলিকপ্টার ভাড়া করে ওয়াজে, বা দূরবর্তী হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যাতায়াত- এ জাতীয় তথ্য মানুষকে বিস্মিত করেছে। বাবুনগরীসহ অভিযুক্ত হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা থাকা সত্ত্বেও তারা গ্রেফতারের ঊর্ধ্বে থাকার বিষয়টি আজ ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।

জামায়াতে ইসলামীর মূল নেতারা গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত হয়ে বিচারে ফাঁসির আদেশ হলে তা কার্যকরী করা হয়। কিন্তু ওই নেতাদের ১৯৭১ সালে ও তার আগে অর্জিত সম্পদ, অপরাপর জামায়াত নেতাদের সম্পদ অনুসন্ধান করার দাবিও উপেক্ষিত। খোদ জামায়াতে ইসলামী নামের ব্যাংক হিসাব ও অন্যান্য সম্পদ বাজেয়াফত করার দাবিও শূন্যেই মিলিয়ে যাচ্ছে।

এ বিষয়গুলোর প্রতিবিধান করতে অবৈধভাবে অর্জিত ও বিদেশে পাঠানো অর্থ উদ্ধার করলে বাংলাদেশে কোন অভাব দারিদ্র্য কি থাকত?

[লেখক : সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ]

সোমবার, ২১ জুন ২০২১ , ৭ আষাঢ় ১৪২৮ ৯ জিলকদ ১৪৪২

দুর্নীতি কি চলতেই থাকবে

রণেশ মৈত্র

বাড়ির বাইরে গেলেই সর্বত্র দুর্নীতি চোখে পড়ে। দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার যে প্রত্যয়, কর্তাব্যক্তিরা তা প্রতিনিয়ত আওড়ালেও চারিদিককার নিত্যদিনের পরিস্থিতি দেখে, মানুষ তাদের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। যেখানেই টাকা, সেখানেই দুর্নীতি-যেখানেই উন্নয়ন প্রকল্প সেখানেই দুর্নীতি-যেন দেশটা একটি বিশাল বৃক্ষ-ওই বৃক্ষে ধরে আছে অজস্র দুর্নীতির সুযোগে ভরা নানা প্রকল্পের সমারোহ।

দৈনন্দিন জীবনে মানুষকে বাইরে যেতেই হয়। তা সে হাঁটাপথেই হোক-বা অন্যবিধ যানবাহনেই হোক। যানবাহনগুলো তো চলে সড়ক-মহাসড়ক-সেতুর উপর দিয়ে। আর এই সড়ক-সেতুর ক্ষেত্রে যে সীমাহীন দুর্নীতি-তা তো ইদানীং সংবাদপত্রের পৃষ্ঠা ছাড়িয়ে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতেও দিব্যি দেখানো হচ্ছে। কোটি কোটি টাকা লোপাটের ক্ষেত্র এটি। হাত দিয়ে তুলতে চাইলেই কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সড়কের পিচ উঠে আসছে-দৃশ্যমান হচ্ছে ইটের খোয়া। সাক্ষাতকারে স্থানীয় বাসিন্দারা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। হয়তো আবার মেরামত হবে-আবার তহবিল আসবে কিন্তু সড়কের মান যা তাই থেকে যাবে। কোথায় ইঞ্জিনিয়ার, কোথায় প্রজেক্ট অফিসার আর কোথায়ই বা সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন মন্ত্রী বা সচিব!

স্থানীয় এমপিরা নীরব। ছোটখাটো রাস্তা-সেতু তাদেরকে উদ্বোধন করে ‘উন্নয়নের সরকার’ বলে প্রশস্তি গাইতেও শুনা যায়। কিন্তু সেতুটি যে নির্মাণকাজ সমাপ্তির পর তিন দিন যেতে না যেতেই ধসে পড়লো-সে সন্ধান কে রাখে? ফলে এই খাতেই, অর্থাৎ সেতু ও সড়ক খাতেই সম্ভবত প্রতি বছর বাজেটে সর্বোচ্চ অংক বরাদ্দ দেয়া হয়-তেমনই আবার এই খাতে বিশাল বিশাল প্রকল্পও হাতে নেয়া হয়।

আন্তর্জাতিক মহলের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশেই সড়ক ও সেতু নির্মাণ ব্যয় গোটা পৃথিবীর মধ্যে সর্বাধিক। যদিও বাংলাদেশেই শ্রমিক সর্বাপেক্ষা সস্তা, ইট, সুরকি, সিমেন্ট বালিসহ তাবৎ উপকরণও বাংলাদেশে সব চাইতে সস্তা। তাহলে কোন যুক্তিতে সড়ক-সেতু নির্মাণে এ দেশে সর্বাধিক টাকা লাগে?

কর্তাব্যক্তিরা জানেন, মন্ত্রণালয়ের সকলে জানেন, জানেন খোদ মন্ত্রী এবং স্বয়ং সচিবও। কিন্তু অজানা কারণে তাদের মন্ত্রণালয়ের এই হাল সম্পর্কে কদাপি একটি উক্তি করেন না। যদিও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী প্রায় প্রতিদিনই সাংবাদিকদের ডাকেন সংবাদ সম্মেলনে। কিন্তু যা বলেন তা প্রধানত ভিন্ন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত বিষয়। আমরা জানি পৃথিবীর কোন গণতান্ত্রিক দেশে কোন মন্ত্রী এত সংবাদ সম্মেলন করেন না-করার সময়ও পান না-বা তেমন আগ্রহ পোষণ করেন না।

এবারে যদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দিকে তাকানো যায়-মনে হয় সেই পুরনো আমলের বহু-ব্যবহৃত প্রবাদ বাক্যটির। ‘আঁধার ঘরে সাপ-সকল ঘরে সাপ’ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে এ প্রবাদটি যথোপযুক্তই বটে। এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব জনস্বাস্থ্য সংরক্ষণের। অর্থাৎ বিনামূল্যে চিকিৎসা সুযোগ সকল হাসপাতালে যাতে পান তার ব্যবস্থা করতে। আসলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আহার, বাসস্থান এবং কাজ এগুলো হলো মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু দেশের মানুষের অভিজ্ঞতা কী। হাসপাতালে ভর্তি হতে টাকা, ওষুধ পেতে টাকা, অপারেশন করতে টাকা, বেড পেতে এবং তা দুই বেলা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করাতেও টাকা। ফলে দেশের ৯৫ ভাগ মানুষের কপালে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার কোন সুযোগই নেই। আর যে যে বাবদে টাকাগুলোর কথা উল্লেখ করলাম- ওই সব বাবদে সরকারি হাসপাতালগুলোতে একটি পয়সাও লাগার কথা না। তবুও লাগে এবং বাধ্যতামূলকভাবে লাগে। এ কথাও সবাই জানেন কিন্তু কেউ এর প্রতিকার করতে এগিয়ে আসেন না। জেলা-উপজেলাগুলোতে সরকারি হাসপাতালে সেই ৩০-৪০ বছর আগে কত বেডের হাসপাতাল হবে তা নির্ধারণ করা হয়েছিল-আজও তার কোন হেরফের হয়নি। ২৫০ বেডের জেলা হাসপাতাগুলোতে যে আজ ১০০০ বেডের হাসপাতালে পরিণতও করা প্রয়োজন-আর ত্রিশ বেডের উপজেলা হাসপাতালগুলোকে যে কমপক্ষে ১০০ বেড হাসপাতালে উন্নীত করা প্রয়োজন; জনসংখ্যার বিপুল বৃদ্ধির এবং নিত্য-নতুন কঠিন রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণে তা মানুষে বুঝলেও সরকার বুঝতে অক্ষম।

আসন সংখ্যা কম থাকার কারণেই যে বেড কেনাবেচা হয়, ওষুধ কেনাবেচা হয়, অপারেশন চার্জ বহুগুণ বেশি নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়- তা বুঝতে নিশ্চয়ই কোন বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই।

করোনা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আবার আসল চেহারা স্পষ্ট করেছে। দুর্নীতিবাজ অনেকের নাম শিরোনামে এসেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যাপারে একটি কথাই সম্ভবত যথেষ্ট আর তা হলো ‘সর্ব অঙ্গে ঘা, মলম দেব কোথা?’ স্বাস্থ্য দফতরের মন্ত্রী, সচিব, তাদের ঊর্ধ্বতন-অধস্তন সবাই খবরগুলো ভালোভাবেই জানেন কিন্তু কাউকেই এ ব্যাপারে অগ্রসর হতে দেখা যায় না। কিন্তু মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই।

এবারে আসা যাক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। এ মন্ত্রণালয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় কিন্তু আজও উপেক্ষিতই রয়ে গেল। এর জন্য যে বাজেট বরাদ্দ হয় তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। আবার যা-ও বা বরাদ্দ হয় তা শিক্ষার মানোন্নয়নে খরচ না হয়ে খরচ হয় মূলত অবকাঠামো নির্মাণে। আর অবকাঠামো নির্মাণ, দালানকোঠা নির্মাণ ও সংস্কার, চেয়ার-টেবিল বেঞ্চ প্রভৃতি তৈরি-এতেই যে দুর্নীতির সর্বাধিক উপযুক্ত খাত। বাদ-বাকি যা খরচ হয় শিক্ষকদের বেতন-ভাতা প্রভৃতি ক্ষেত্রে এবং বিনামূল্যে বিতরণের জন্য কোটি কোটি কপি পাঠ্যবই ছাপা ও বিতরণ বাবদে।

কিন্তু যে অমোঘ সত্যটি সর্বদাই শিক্ষা মন্ত্রণালয় বুঝতে চায় না বা বুঝতে ভুল করে তা হলো- আমাদের টপ টু বটম শিক্ষক-শিক্ষিকা উচ্চহারে বেতন পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও নিজেরা নিজেদের উন্নতমানের শিক্ষকে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে পড়াশুনা বা গবেষণায় নিজেরদের আত্মনিয়োগ করেন না। অল্প কিছু সংখ্যক সৎশিক্ষক-শিক্ষিকা বাদে অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকা কোচিং সেন্টার খুলে বসেন, প্রাইভেট টিউশনিতে আত্মনিয়োগ করেন। যেমন করে থাকেন সরকারি ডাক্তারেরা। এ অবস্থায় শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ১০টা-৫টা নিয়মিত শ্রেণীকক্ষে শিক্ষাদান বাধ্যতামূলক করা। ভাইস চ্যান্সেলরগণ, কলেজের অধ্যক্ষ ও স্কুলের প্রধান শিক্ষক-শিক্ষিকারা নিয়মিত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পাঠদান পর্যবেক্ষণ করবেন এবং প্রতি তিন মাসে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অত্যন্ত সততার সঙ্গে প্রতিটি শিক্ষক-শিক্ষিকা সম্পর্কে প্রতিবেদন দেবেন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। একই সঙ্গে শিক্ষক নিয়োগে প্রায় সকল পর্যায়ে যে ব্যাপক দুর্নীতি প্রচলিত রয়েছে, যে কোন মূল্যে তার শেকড় উপড়ে ফেলতে হবে।

এবারে পানি সম্পদ, বিদ্যুৎ ও গ্যাস বা জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে প্রচলিত ব্যাপক দুর্নীতি, ব্যাংকিং সেক্টরে প্রচলিত ভয়াবহ এবং ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি যে দেশের মানুষের কষ্টার্জিত অর্থের মারাত্মক অপচয় নানাভাবে ঘটছে-তা বন্ধ করার ক্ষেত্রে যে নির্লিস্ততা দেখা যায় তার ফলে যে লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে- এ কথা আজ সবার মুখে মুখে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ নির্বিকার।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সততা বহুকাল যাবত প্রশ্নবিদ্ধ। পুলিশে এবং অপরাপর বহির্বিশ্বে লোক নিয়োগ খুব কম ক্ষেত্রেই মেধা ও ক্ষমতার ভিত্তিতে হয়ে থাকে। পরিণতিতে এজাহার গ্রহণ করার জন্য টাকা, না করার জন্য টাকা, অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করার বা না করার জন্য টাকা- ইত্যকার ঘটনা সম্পর্কে বহু ক্ষেত্রেই অভিযোগ পাওয়া গেলেও তার ক্ষেত্রে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ সচরাচর পরিলক্ষিত হয় না।

মুনিয়া হত্যার আসামিকে গ্রেপ্তার ও সাগর-রুনি সাংবাদিক দম্পতি হত্যার আসামি খুঁজে বের করা বা ত্বকী হত্যার আসামিদের গ্রেফতারে পুলিশের অনীহা এর জাজ্জ্বল্যমান প্রমাণ।

এবারে দেখা যাক ধর্মীয় খাতের অবস্থা। হেফাজত নেতাদের অবৈধ অর্থের খবর জানা যাচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে সংগঠনটির নতুন আমীর বাবুনাগরী, সাবেক যুগ্ম-সম্পাদক মুমিনুল হকসহ আরও অনেকের বিরুদ্ধে (অন্তত ৯৮ জন)। খুঁজলে এমন অনেক অভিযোগ আরও অনেকের বিরুদ্ধে পাওয়া যাবে। ধর্মীয় কাজের নামে দেশ-বিদেশ থেকে নিয়মিত বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ, সেই টাকায় অতিমাত্রায় বিলাসী জীবন, প্রয়োজনে হেলিকপ্টার ভাড়া করে ওয়াজে, বা দূরবর্তী হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যাতায়াত- এ জাতীয় তথ্য মানুষকে বিস্মিত করেছে। বাবুনগরীসহ অভিযুক্ত হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা থাকা সত্ত্বেও তারা গ্রেফতারের ঊর্ধ্বে থাকার বিষয়টি আজ ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।

জামায়াতে ইসলামীর মূল নেতারা গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত হয়ে বিচারে ফাঁসির আদেশ হলে তা কার্যকরী করা হয়। কিন্তু ওই নেতাদের ১৯৭১ সালে ও তার আগে অর্জিত সম্পদ, অপরাপর জামায়াত নেতাদের সম্পদ অনুসন্ধান করার দাবিও উপেক্ষিত। খোদ জামায়াতে ইসলামী নামের ব্যাংক হিসাব ও অন্যান্য সম্পদ বাজেয়াফত করার দাবিও শূন্যেই মিলিয়ে যাচ্ছে।

এ বিষয়গুলোর প্রতিবিধান করতে অবৈধভাবে অর্জিত ও বিদেশে পাঠানো অর্থ উদ্ধার করলে বাংলাদেশে কোন অভাব দারিদ্র্য কি থাকত?

[লেখক : সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ]