ঢিলেঢালা লকডাউন, মানুষের ভোগান্তি

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ঢাকার আশপাশের ৭ জেলায় বিধিনিষেধের প্রথমদিন গতকাল ছিল ঢিলেঢালা ভাব। বিধিনিষেধের কারণে ঢাকামুখী সব জেলার দূরাপাল্লার বাস ও লঞ্চ সার্ভিস বন্ধ করে দেয়া হলেও বন্ধ হয়নি ঢাকামুখী মানুষের স্রোত।

প্রশাসনের লক্ষ্য ছিল ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করা। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অফিস ও কলকারখানা খোলা থাকায় প্রয়োজনেই ঢাকামুখী হতে হয়েছে তাদের। নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে থেকে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ঢাকায় এসে অফিস করেন। গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও সিএনজি, অটোরিক্সা, মোটরসাইকেল ও পিকআপ ভ্যানে মানুষকে ঢাকায় প্রবেশ করতে দেখা গেছে। হেঁটে ও ছোট যানবাহনে ভেঙে ভেঙে ঢাকা প্রবেশ করায় নানা দুর্ভোগ ও ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে বলে জানান তারা।

জানা গেছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিস্তার ঠেকাতে মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী ও গোপালগঞ্জ এসব জেলায় গতকাল সকাল থেকে ৩০ জুন মধ্যরাত পর্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধের ঘোষণা দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। তাই ঢাকামুখী দূরপাল্লার বাস, লঞ্চ ও ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া। প্রথমে দূরপাল্লার বাস বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়। পরে গতকাল সকাল থেকে লঞ্চ ও রাত ১২টা থেকে ট্রেন সার্ভিস বন্ধ ঘোষণা করা হয়। হঠাৎ করে বাস, ট্রেন ও লঞ্চ সার্ভিস বন্ধ ঘোষণায় যাত্রীরা চরম ভোগান্তির শিকার হন বলে স্থানীয়রা জানান।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় আনোয়ার হোসেন নামের নারায়ণগঞ্জের এক বাসিন্দা সংবাদকে বলেন, ‘সরকার নারায়ণগঞ্জ জেলায় লকডাউন দিয়েছে। কিন্তু আমি তো ঢাকায় চাকরি করি। আমার অফিস তো খোলা। প্রতিদিন নারয়ণগঞ্জের সানারপাড় থেকে অফিস করি। কিন্তু আজ (মঙ্গলবার) বাস পাইনি। তাই সিএনজি করে ভেঙে ভেঙে ঢাকা আসতে হয়েছে। ভাড়া নিয়েছে বেশী।’ সরকারি এসব সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আমাদের সাধারণ মানুষের কথা ভাবা উচিত বলে জানান তিনি। যাত্ররাড়ী এলাকায় আব্দুল হান্নান নামের চট্টগ্রামের অপর এক যাত্রী সংবাদ বলেন, ‘হঠাৎ করে দূরপাল্লার বাস বন্ধ করে দেয়ায় অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। সোমবার রাতে চট্টগ্রাম থেকে উদ্দেশে রওয়ানা দেয়। মঙ্গলবার সকালে মেঘনা সেতু পর্যন্ত আসার পর আর গাড়ি ঢাকা ডুকতে দেয়া হয় না। তাই মেঘনা সেতু থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত আসি পিকআপ ভ্যানে। তারপর কাঁচপুর থেকে সিএনজিতে শনিরআখড়া পর্যন্ত আসি। সেখান থেকে বাসে ঢাকার যাত্রাবাড়ী আসলাম।’ এভাবে ঢাকা আসায় দ্বিগুণ টাকা খরচ হয়েছে বলে জানান তিনি।

একই অবস্থা গাজীপুর থেকে ঢাকামুখী সব গণপরিবহনে। কঠোর বিধিনিষেধের কারণে গতকাল সকালে থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ঢাকামুখী সব বাসের যাত্রী নামিয়ে ফিরিয়ে দেয়া হয়। তবে ভোগান্তি শিকার হয় বিভিন্ন পোশাক কারখানার শ্রমিকদের। গাজীপুরের চৌরাস্তা এলাকায় পারভীন নামের এক পোশাক করাখানার নারী শ্রমিক বলেন, ‘করোনার কারণে লকডাউন দিয়েছে, অন্যদিকে অফিসও খোলা রাখছে। কোন কারণ ছাড়া রাস্তার মধ্যে যাত্রী নামিয়ে দেয়া হচ্ছে। কাজ না করলে তো অফিস বেতন দেবে না। তাই বাধ্য হয়েই বেশি ভাড়া দিয়েই অফিসে যাচ্ছি।’ একইভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন জহুরা বেগম, আয়েশা আক্তার, ফুলমতি বেগম ও রেহেনা আক্তারসহ অসংখ্য পোশাক কারাখানার শ্রমিকরা।

সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন বাস টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে, গতকাল সকাল থেকে সায়েদাবাদ, ফুলবাড়িয়া, গাবতলী ও মহাখালীসহ বাস টার্মিনালগুলোর টিকিট কাউন্টার বন্ধ ছিল। অলস সময় কাটাচ্ছেন পরিবহন শ্রমিকরা। তবে নারায়ণগঞ্জের সাইনবোড, মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও গাজীপুরের টঙ্গি থেকে যাত্রী নিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করতে দেখা কিছু লোকাল বাস। এসব বাস ঢাকা ভেতরে বিভিন্ন রুটে চলাচল করে। তবে ৭ জেলায় প্রথমদিনের লকডাউন ছিল ঢিলেঢালা ভাব। এছাড়া দুই-একজনের মুখে মাস্ক থাকলেও বেশিরভাগ স্বাস্থ্যবিধি মানতে উদাসহীন ছিল বলে স্থানীয়রা জানান।

গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, গতকাল সকালে বৃষ্টির কারণে সড়কে যানবাহন কম থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। জেলার বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে বাস ছাড়া অন্যান্য যানবাহন চলাচল করতে দেখা গেছে। তবে গাজীপুর দিয়ে বিভিন্ন গন্তব্যে ট্রেন চলাচল করলেও জেলার কোন স্টেশনে ট্রেন থামেনি। সরকারি অফিস খোলা থাকলেও অফিসিয়াল কাজকর্ম ছিল কম।

তবে বাস বন্ধ থাকায় ভোগান্তি শিকার হতে হয়েছে যাত্রীরা জানান। গাজীপুরের বাসিন্দা ঢাকায় চাকরিজীবী ফারজানা আক্তার মীম বলেন, ‘‘আগেরবারের লকডাউনে গণপরিবহন নিষিদ্ধ থাকলেও অটোরিকশাসহ লোকাল যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক ছিল। এবার সরকার একদিন আগে বিশেষ ট্রেন চালু করে পরের দিন আবার লকডাউন দিয়েছে। আমার মতো অনেকেই নিজস্ব গাড়ি নেই। নিয়মিত ঢাকায় গিয়ে অফিস করতে হয়। তাই লকডাউনেও অটোরিকশার মতো হালকা যানবাহনই কর্মস্থলে যাতায়তের জন্য একমাত্র ভরসা।’’

নগরীর চৌরাস্তা এলাকার এক পোশাক কারখানার শ্রমিক মোসা. মিলি বেগম বলেন, ‘‘চান্দনা-চৌরাস্তা এলাকা থেকে আমাদের ইসলামপুর গিয়ে গার্মেন্টসে কাজ করতে হয়। হঠাৎ করে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমরা সমস্যায় পড়ে গেছি।’’ তিনি কারখানা কর্তৃপক্ষকে কিছু বাস ভাড়া নিয়ে শ্রমিক পরিবহনের দাবি জানান।

শ্রীপুরের মাওনাগামী জসিম উদ্দিন নামের এক যাত্রী জানান, ‘‘কোন গাড়ি না পেয়ে সকাল ১০টার দিকে তিনি পারিবারিক জরুরি প্রয়োজনে গাজীপুর শহর থেকে গ্রামের বাড়ি শ্রীপুরের জৈনা বাজারে যাওয়ার জন্য সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশা ভাড়া নেন ১ হাজার টাকায়। অন্য সময় বাসে গেলে সর্বোচ্চ লাগতো মাত্র ৫০ টাকা বা সিএনজিতে গেলেও লাগতো ৩শ‘ টাকা।

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সাতদিনের কড়া বিধিনিষেধের মধ্যেও নারায়ণগঞ্জে যানবাহন ও মানুষের চলাচল স্বাভাবিক ছিল। শহরের ভেতর অধিকাংশ মার্কেট ও দোকানপাট বন্ধ থাকলেও শহরতলীর দোকানপাট ছিল সব খোলা। বন্ধ ছিল যাত্রীবাহী বাস ও লঞ্চ চলাচল। গতকাল সকাল থেকে দিনভর জেলার বিভিন্ন পয়েন্ট নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের টহল দেখা গেছে। সড়ক ও মহাসড়কে ছিল চেকপোস্ট। তবে এত কড়াকড়ির মধ্যেও রিকশা, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ব্যক্তিগত গাড়ি সড়কে চলাচল করতে দেখা গেছে। করোনা পরিস্থিতিতে সপ্তাহব্যাপী লকডাউনের প্রথম দিন অনেকটা ঢিলেঢালা ভাবেই কেটেছে।

মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, কঠোর লকডাউনের কোন প্রকার প্রভাব দেখা যায়নি। পূর্বের চেয়ে মানুষের চলাচল এবং অটো, মিশুক, বাজারের সকল দোকানপাট খোলা অবস্থায় রয়েছে। দেদারছে যাত্রী নিয়ে চলছে মোটরচালিত অটো ও মিশুক। সরকারি-বেসরকারি সকল অফিস খোলা। কোন কিছুই বন্ধ হয়নি। তাহলে এমন প্রতারণামূলক লকডাউনের কি অর্থ আছে এটাই এখন সাধারণ মানুষের প্রশ্ন।

মুন্সীগঞ্জ থেকে যে কোন থানায় যাতায়াত করা ছিল খুবই স্বাভাবিক। কোন ধরনের লকডাউনের প্রভাব পড়েনি জনজীবনে। গজারিয়ার ভবেরচর বাজারের ইউনিয়ন ভূমি অফিসের উদ্যোগে বিরাট ছাগলের হাট বসেছে। টঙ্গীবাড়ী, লৌহজং, সিরাজদিখান, শ্রীনগর সর্বত্রই যাতায়াত করা যায়। কোন প্রকার দোকানপাট বন্ধ করা হয়নি। তা হলে এমন কঠোর লকডাউনের ঘোষণা দিয়ে প্রশাসন কি ঘুমিয়ে পড়েছে। আসলে এই লকডাউনের মানে কি এটাই এখন সাধারণ ও সচেতন নাগরিকের প্রশ্ন।

গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, লকডাউনের প্রথম দিনে দূরপাল্লার গাড়ি না চললেও সরকারি বিধিনিষেধ অমান্য করে কাজে বেরিয়েছে মাহেন্দ্র, ইজিবাইক ও ভ্যান চালকরা। এছাড়া চায়ের দোকানসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে বসে আছে বিক্রেতারা। পাটগাতী ইউনিয়নের কাকইবুনিয়া গ্রামের মঙ্গল বিশ্বাস বলেন, কয়েকদিন ধরে বৃষ্টির জন্য এমনিতেই আয় রোজগার নেই, তারপর আবার লকডাউন। যদি ভ্যান চালায়ে আয়-রোজগার না করতে পারি তাহলে স্ত্রী ছেলে-মেয়ে নিয়ে খাব কি।

শ্রমিক বাবলু শেখ বলেন, ‘‘সরকার লকডাউন দিছে ভালো কথা কিন্তু আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করে দিক। তাইলে আমরা কাজে বের না হয়ে ঘরে বসে খাব। যারা বড়লোক তাদের কোন চিন্তা নেই। কিন্তু পরিবার নিয়ে চিন্তা তো আমাদের। পাটগাতী বাজারের চায়ের দোকানদার মান্নান শেখ বলেন, রাতে মাইকিং করে বলল সবকিছু বন্ধ থাকবে। যদি দোকান বন্ধ করে রাখি তাহলে খাব কি। তাই বাধ্য হয়েই দোকান খুলেছি। যদি সরকার আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করে তাইলে দোকান বন্ধ রাখতে কোন অসুবিধা নেই।’’

মাদারীপুর প্রতিনিধি জানায়, মাদারীপুরে লকডাউন প্রথম দিন ঢিলেঢালাভাবে চলেছে। গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও রাস্তায় দেখা গেছে তিন চাকার ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও রিকশা। শহরে দোকানপাটও দেখা গেছে খোলা রয়েছে। মাঝে মাঝে শহরের বিভিন্ন মোড়ে পুলিশ দেখা গেলেও কার্যত পুলিশও ছিল নরমাল মুডে। প্রশাসনেরও তৎপরতাও তেমন চোখে পড়েনি। ফলে পুরো জেলাতেই লকডাউন ঢিলেঢালাভাবে চলেছে। এতে সাধারণ মানুষ পড়েছে বিপাকে।

বুধবার, ২৩ জুন ২০২১ , ৯ আষাঢ় ১৪২৮ ১১ জিলকদ ১৪৪২

ঢিলেঢালা লকডাউন, মানুষের ভোগান্তি

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

image

প্রথম দিনই লকডাউন ঢিলেঢালা, মানুষ মানছে না কোন বিধিনিষেধ, দুর্ভোগ হলেও হেঁটে কর্মজীবী মানুষ দলে দলে ঢাকায় ঢুকছে। গতকাল ঢাকার প্রবেশপথ আবদুল্লাহপুরের সড়ক চিত্র -সংবাদ

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ঢাকার আশপাশের ৭ জেলায় বিধিনিষেধের প্রথমদিন গতকাল ছিল ঢিলেঢালা ভাব। বিধিনিষেধের কারণে ঢাকামুখী সব জেলার দূরাপাল্লার বাস ও লঞ্চ সার্ভিস বন্ধ করে দেয়া হলেও বন্ধ হয়নি ঢাকামুখী মানুষের স্রোত।

প্রশাসনের লক্ষ্য ছিল ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করা। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অফিস ও কলকারখানা খোলা থাকায় প্রয়োজনেই ঢাকামুখী হতে হয়েছে তাদের। নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে থেকে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ঢাকায় এসে অফিস করেন। গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও সিএনজি, অটোরিক্সা, মোটরসাইকেল ও পিকআপ ভ্যানে মানুষকে ঢাকায় প্রবেশ করতে দেখা গেছে। হেঁটে ও ছোট যানবাহনে ভেঙে ভেঙে ঢাকা প্রবেশ করায় নানা দুর্ভোগ ও ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে বলে জানান তারা।

জানা গেছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিস্তার ঠেকাতে মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী ও গোপালগঞ্জ এসব জেলায় গতকাল সকাল থেকে ৩০ জুন মধ্যরাত পর্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধের ঘোষণা দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। তাই ঢাকামুখী দূরপাল্লার বাস, লঞ্চ ও ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া। প্রথমে দূরপাল্লার বাস বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়। পরে গতকাল সকাল থেকে লঞ্চ ও রাত ১২টা থেকে ট্রেন সার্ভিস বন্ধ ঘোষণা করা হয়। হঠাৎ করে বাস, ট্রেন ও লঞ্চ সার্ভিস বন্ধ ঘোষণায় যাত্রীরা চরম ভোগান্তির শিকার হন বলে স্থানীয়রা জানান।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় আনোয়ার হোসেন নামের নারায়ণগঞ্জের এক বাসিন্দা সংবাদকে বলেন, ‘সরকার নারায়ণগঞ্জ জেলায় লকডাউন দিয়েছে। কিন্তু আমি তো ঢাকায় চাকরি করি। আমার অফিস তো খোলা। প্রতিদিন নারয়ণগঞ্জের সানারপাড় থেকে অফিস করি। কিন্তু আজ (মঙ্গলবার) বাস পাইনি। তাই সিএনজি করে ভেঙে ভেঙে ঢাকা আসতে হয়েছে। ভাড়া নিয়েছে বেশী।’ সরকারি এসব সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আমাদের সাধারণ মানুষের কথা ভাবা উচিত বলে জানান তিনি। যাত্ররাড়ী এলাকায় আব্দুল হান্নান নামের চট্টগ্রামের অপর এক যাত্রী সংবাদ বলেন, ‘হঠাৎ করে দূরপাল্লার বাস বন্ধ করে দেয়ায় অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। সোমবার রাতে চট্টগ্রাম থেকে উদ্দেশে রওয়ানা দেয়। মঙ্গলবার সকালে মেঘনা সেতু পর্যন্ত আসার পর আর গাড়ি ঢাকা ডুকতে দেয়া হয় না। তাই মেঘনা সেতু থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত আসি পিকআপ ভ্যানে। তারপর কাঁচপুর থেকে সিএনজিতে শনিরআখড়া পর্যন্ত আসি। সেখান থেকে বাসে ঢাকার যাত্রাবাড়ী আসলাম।’ এভাবে ঢাকা আসায় দ্বিগুণ টাকা খরচ হয়েছে বলে জানান তিনি।

একই অবস্থা গাজীপুর থেকে ঢাকামুখী সব গণপরিবহনে। কঠোর বিধিনিষেধের কারণে গতকাল সকালে থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ঢাকামুখী সব বাসের যাত্রী নামিয়ে ফিরিয়ে দেয়া হয়। তবে ভোগান্তি শিকার হয় বিভিন্ন পোশাক কারখানার শ্রমিকদের। গাজীপুরের চৌরাস্তা এলাকায় পারভীন নামের এক পোশাক করাখানার নারী শ্রমিক বলেন, ‘করোনার কারণে লকডাউন দিয়েছে, অন্যদিকে অফিসও খোলা রাখছে। কোন কারণ ছাড়া রাস্তার মধ্যে যাত্রী নামিয়ে দেয়া হচ্ছে। কাজ না করলে তো অফিস বেতন দেবে না। তাই বাধ্য হয়েই বেশি ভাড়া দিয়েই অফিসে যাচ্ছি।’ একইভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন জহুরা বেগম, আয়েশা আক্তার, ফুলমতি বেগম ও রেহেনা আক্তারসহ অসংখ্য পোশাক কারাখানার শ্রমিকরা।

সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন বাস টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে, গতকাল সকাল থেকে সায়েদাবাদ, ফুলবাড়িয়া, গাবতলী ও মহাখালীসহ বাস টার্মিনালগুলোর টিকিট কাউন্টার বন্ধ ছিল। অলস সময় কাটাচ্ছেন পরিবহন শ্রমিকরা। তবে নারায়ণগঞ্জের সাইনবোড, মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও গাজীপুরের টঙ্গি থেকে যাত্রী নিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করতে দেখা কিছু লোকাল বাস। এসব বাস ঢাকা ভেতরে বিভিন্ন রুটে চলাচল করে। তবে ৭ জেলায় প্রথমদিনের লকডাউন ছিল ঢিলেঢালা ভাব। এছাড়া দুই-একজনের মুখে মাস্ক থাকলেও বেশিরভাগ স্বাস্থ্যবিধি মানতে উদাসহীন ছিল বলে স্থানীয়রা জানান।

গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, গতকাল সকালে বৃষ্টির কারণে সড়কে যানবাহন কম থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। জেলার বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে বাস ছাড়া অন্যান্য যানবাহন চলাচল করতে দেখা গেছে। তবে গাজীপুর দিয়ে বিভিন্ন গন্তব্যে ট্রেন চলাচল করলেও জেলার কোন স্টেশনে ট্রেন থামেনি। সরকারি অফিস খোলা থাকলেও অফিসিয়াল কাজকর্ম ছিল কম।

তবে বাস বন্ধ থাকায় ভোগান্তি শিকার হতে হয়েছে যাত্রীরা জানান। গাজীপুরের বাসিন্দা ঢাকায় চাকরিজীবী ফারজানা আক্তার মীম বলেন, ‘‘আগেরবারের লকডাউনে গণপরিবহন নিষিদ্ধ থাকলেও অটোরিকশাসহ লোকাল যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক ছিল। এবার সরকার একদিন আগে বিশেষ ট্রেন চালু করে পরের দিন আবার লকডাউন দিয়েছে। আমার মতো অনেকেই নিজস্ব গাড়ি নেই। নিয়মিত ঢাকায় গিয়ে অফিস করতে হয়। তাই লকডাউনেও অটোরিকশার মতো হালকা যানবাহনই কর্মস্থলে যাতায়তের জন্য একমাত্র ভরসা।’’

নগরীর চৌরাস্তা এলাকার এক পোশাক কারখানার শ্রমিক মোসা. মিলি বেগম বলেন, ‘‘চান্দনা-চৌরাস্তা এলাকা থেকে আমাদের ইসলামপুর গিয়ে গার্মেন্টসে কাজ করতে হয়। হঠাৎ করে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমরা সমস্যায় পড়ে গেছি।’’ তিনি কারখানা কর্তৃপক্ষকে কিছু বাস ভাড়া নিয়ে শ্রমিক পরিবহনের দাবি জানান।

শ্রীপুরের মাওনাগামী জসিম উদ্দিন নামের এক যাত্রী জানান, ‘‘কোন গাড়ি না পেয়ে সকাল ১০টার দিকে তিনি পারিবারিক জরুরি প্রয়োজনে গাজীপুর শহর থেকে গ্রামের বাড়ি শ্রীপুরের জৈনা বাজারে যাওয়ার জন্য সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশা ভাড়া নেন ১ হাজার টাকায়। অন্য সময় বাসে গেলে সর্বোচ্চ লাগতো মাত্র ৫০ টাকা বা সিএনজিতে গেলেও লাগতো ৩শ‘ টাকা।

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সাতদিনের কড়া বিধিনিষেধের মধ্যেও নারায়ণগঞ্জে যানবাহন ও মানুষের চলাচল স্বাভাবিক ছিল। শহরের ভেতর অধিকাংশ মার্কেট ও দোকানপাট বন্ধ থাকলেও শহরতলীর দোকানপাট ছিল সব খোলা। বন্ধ ছিল যাত্রীবাহী বাস ও লঞ্চ চলাচল। গতকাল সকাল থেকে দিনভর জেলার বিভিন্ন পয়েন্ট নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের টহল দেখা গেছে। সড়ক ও মহাসড়কে ছিল চেকপোস্ট। তবে এত কড়াকড়ির মধ্যেও রিকশা, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ব্যক্তিগত গাড়ি সড়কে চলাচল করতে দেখা গেছে। করোনা পরিস্থিতিতে সপ্তাহব্যাপী লকডাউনের প্রথম দিন অনেকটা ঢিলেঢালা ভাবেই কেটেছে।

মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, কঠোর লকডাউনের কোন প্রকার প্রভাব দেখা যায়নি। পূর্বের চেয়ে মানুষের চলাচল এবং অটো, মিশুক, বাজারের সকল দোকানপাট খোলা অবস্থায় রয়েছে। দেদারছে যাত্রী নিয়ে চলছে মোটরচালিত অটো ও মিশুক। সরকারি-বেসরকারি সকল অফিস খোলা। কোন কিছুই বন্ধ হয়নি। তাহলে এমন প্রতারণামূলক লকডাউনের কি অর্থ আছে এটাই এখন সাধারণ মানুষের প্রশ্ন।

মুন্সীগঞ্জ থেকে যে কোন থানায় যাতায়াত করা ছিল খুবই স্বাভাবিক। কোন ধরনের লকডাউনের প্রভাব পড়েনি জনজীবনে। গজারিয়ার ভবেরচর বাজারের ইউনিয়ন ভূমি অফিসের উদ্যোগে বিরাট ছাগলের হাট বসেছে। টঙ্গীবাড়ী, লৌহজং, সিরাজদিখান, শ্রীনগর সর্বত্রই যাতায়াত করা যায়। কোন প্রকার দোকানপাট বন্ধ করা হয়নি। তা হলে এমন কঠোর লকডাউনের ঘোষণা দিয়ে প্রশাসন কি ঘুমিয়ে পড়েছে। আসলে এই লকডাউনের মানে কি এটাই এখন সাধারণ ও সচেতন নাগরিকের প্রশ্ন।

গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, লকডাউনের প্রথম দিনে দূরপাল্লার গাড়ি না চললেও সরকারি বিধিনিষেধ অমান্য করে কাজে বেরিয়েছে মাহেন্দ্র, ইজিবাইক ও ভ্যান চালকরা। এছাড়া চায়ের দোকানসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে বসে আছে বিক্রেতারা। পাটগাতী ইউনিয়নের কাকইবুনিয়া গ্রামের মঙ্গল বিশ্বাস বলেন, কয়েকদিন ধরে বৃষ্টির জন্য এমনিতেই আয় রোজগার নেই, তারপর আবার লকডাউন। যদি ভ্যান চালায়ে আয়-রোজগার না করতে পারি তাহলে স্ত্রী ছেলে-মেয়ে নিয়ে খাব কি।

শ্রমিক বাবলু শেখ বলেন, ‘‘সরকার লকডাউন দিছে ভালো কথা কিন্তু আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করে দিক। তাইলে আমরা কাজে বের না হয়ে ঘরে বসে খাব। যারা বড়লোক তাদের কোন চিন্তা নেই। কিন্তু পরিবার নিয়ে চিন্তা তো আমাদের। পাটগাতী বাজারের চায়ের দোকানদার মান্নান শেখ বলেন, রাতে মাইকিং করে বলল সবকিছু বন্ধ থাকবে। যদি দোকান বন্ধ করে রাখি তাহলে খাব কি। তাই বাধ্য হয়েই দোকান খুলেছি। যদি সরকার আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করে তাইলে দোকান বন্ধ রাখতে কোন অসুবিধা নেই।’’

মাদারীপুর প্রতিনিধি জানায়, মাদারীপুরে লকডাউন প্রথম দিন ঢিলেঢালাভাবে চলেছে। গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও রাস্তায় দেখা গেছে তিন চাকার ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও রিকশা। শহরে দোকানপাটও দেখা গেছে খোলা রয়েছে। মাঝে মাঝে শহরের বিভিন্ন মোড়ে পুলিশ দেখা গেলেও কার্যত পুলিশও ছিল নরমাল মুডে। প্রশাসনেরও তৎপরতাও তেমন চোখে পড়েনি। ফলে পুরো জেলাতেই লকডাউন ঢিলেঢালাভাবে চলেছে। এতে সাধারণ মানুষ পড়েছে বিপাকে।