বন্ধু দুই মন্ত্রী সিলেটের উন্নয়ন এবং ফেইসবুক স্ট্যাটাস

নিজ এলাকা সুনামগঞ্জের উন্নয়ন কর্মকা- বিষয়ে সিলেটের এমপি পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেনের একটি ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলেও সেটাকে ‘বড় করে’ দেখতে চান না পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। এ বিষয়ে ফেইসবুকে দুই বন্ধুর পাল্টাপাল্টি স্ট্যাটাসের ব্যাখ্যায় গতকাল সাংবাদিকদের কাছে তিনি এই প্রতিক্রিয়া জানান। মান্নান বলেন, ‘ওনি নিজেইতো স্ট্যাটাসে বলেছেন, আমাদের ৫০ বছরের বন্ধুত্ব। বরং আরও দুই চার বছর বেশিও হতে পারে, এটা তেমন বড় বিষয় না। আমাদের মধ্যে কোন মতভেদ আছে এমন কোন বিষয় নয়।

রেললাইনের একটি রুট নিয়ে সরকারি দলের সংসদ সদস্য ও সাবেক আমলা এই দুই বন্ধুর মুখোমুখি অবস্থানের প্রকাশ প্রথম সামনে আসে ১৪ জুন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ফেইসবুক পোস্ট থেকে।

এদিকে সিলেট অঞ্চলের এই দুই মন্ত্রীর মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও দূরত্বের কারণে সিলেটের উন্নয়ন কার্যক্রম থমকে আছে বলে সিলেটের একটি দৈনিকে খবর প্রকাশ হলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী তা অস্বীকার করেন।

তবে গত রোববার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে ‘পরিকল্পনামন্ত্রীর দপ্তর’ ফেইসবুক পেজে দেয়া এক স্ট্যাটাসে বলা হয়েছে, সুনামগঞ্জ থেকে ছাতক পর্যন্ত প্রস্তাবিত রেললাইন নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেনের ভূমিকায় বিস্মিত হয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। তিনি বলেন, দু’জনের মধ্যে দীর্ঘ ৫০ বছরের বন্ধুত্ব, একই সঙ্গে মন্ত্রিসভার সহকর্মী হয়েও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভূমিকা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এই স্ট্যাটাসেই দ্বন্দ্বের বিষয়টি প্রকাশ্যে চলে আসে।

ফেইসবুক পেজে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘এটা সত্য যে, ড. মোমেনের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দীর্ঘ ৫০ বছরের। কিন্তু তিনি সুনামগঞ্জের পাঁচজন সংসদ সদস্যের পাশে রয়েছেন উল্লেখ করে রেলমন্ত্রীর কাছে যে আধাসরকারিপত্র (ডিও) দিয়েছেন, সেটি আমাকে বিস্মিত করেছে। তিনি যে পাঁচজন এমপির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, সেখানে একজন জাতীয় পার্টির এমপিও রয়েছেন।

আবদুল মোমেন ভালো করেই জানেন, আমিও (মান্নান) সুনামগঞ্জের একজন সংসদ সদস্য। সুনামগঞ্জের সঙ্গে ছাতকের রেললাইন নির্মাণ নিয়ে তিনি যেমন অবগত, ঠিক তেমনি বিষয়টি আমিও অবগত। আমি যতটুকু জানি, তার বর্ণিল জীবনে তিনি কখনও সুনামগঞ্জে যাননি। সুনামগঞ্জে কখনও তার পা পর্যন্ত পড়েনি।

অথচ তিনি রেললাইন নির্মাণ নিয়ে একটি পক্ষের অবস্থান নিয়েছেন। অন্য কেউ হলে এই পরিস্থিতিতে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইতেন। কিন্তু আমাদের দীর্ঘ ৫০ বছরের বন্ধুত্ব একই সঙ্গে আমরা দুজনেই মন্ত্রিসভার সদস্য অথচ তিনি আমার সঙ্গে এ বিষয়ে এতটুকু যোগাযোগ করেননি। আমার সঙ্গে কথা না বলে অন্য পাঁচজন সংসদ সদস্যের পক্ষ নিয়ে রেলমন্ত্রীকে ডিও লেটার পাঠানো কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।’

এর আগে স্থানীয় একটি দৈনিকে লিখা হয়েছিল, সিলেট-১ আসনের সংসদ সদস্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন ও সুনামগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নানের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে সিলেটের অনেক মেগা প্রকল্প কাগজে কলমে নেয়া হলেও তা বাস্তবায়নে দেখা দিয়েছে চরম ধীরগতি। মন্ত্রীদের দূরত্বের কারণে ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছে সিলেট।

তাদের দ্বন্দ্বের সুযোগ নিচ্ছে সিলেটের উন্নয়ন বিদ্বেষী চক্র। ফলে উন্নয়নের দৌড়ে বার বার হোঁচট খাচ্ছে সিলেট। অন্যান্য অঞ্চলে যেখানে মেগা প্রজেক্ট দ্রুত বাস্তবায়ন হচ্ছে সেখানে উল্টো চিত্র সিলেটে। সুশীল সমাজ মনে করে, সফল নেতৃত্বের কারণে ঢাকা-চট্টগাম চারলেন প্রকল্প এখন দৃশ্যমান।

সিলেট-ঢাকার চেয়েও কম গুরুত্বপূর্ণ কুমিল্লা-নোয়াখালী মহাসড়ক প্রকল্প এগিয়ে চলেছে। অথচ ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক প্রকল্প এখনও অন্ধকারের মহাসমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট এধাধিক সূত্র জানিয়েছে, বর্তমান এই দুই মন্ত্রীর কেবল দেখা হয় মন্ত্রীপরিষদ মিটিংয়ে। এর বাইরে তাদের দু’জনের চোখের দেখা কিংবা কথা হয় না বললেই চলে। একজন অন্যজনকে এড়িয়ে চলেন। একজনের উন্নয়নের ক্রেডিট অন্যজন দিতে চান না। তবে এর মাঝে একজন উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে। তার হাত ধরেই সুনামগঞ্জ এখন অনেকটাই উন্নয়নের মহাসড়কে। তার কারণেই সুনামগঞ্জ হয়েছে মেডিকেল কলেজ।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পও কাগজে কলমে এগিয়েছে অনেকদূর। এছাড়া তিনি প্রচুর ব্রিজ-কালভার্ট, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করেছেন। স্বপ্ন দেখাচ্ছেন রেললাইন এবং বিমানমন্দরেরও। তবে উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে অন্য মন্ত্রী। এখনও তার মেগা কোন প্রকল্প দৃশ্যমান হয়নি। যা হচ্ছে তা কেবল রুটিন উন্নয়নই বলা চলে। এ নিয়ে গত ১০ জুন সভা করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সিলেট উন্নয়ন পরিষদ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, স্বপ্নের সিলেট-ঢাকা চারলেন প্রকল্প এখনও সুদূর পরাহত। কারণ যেখানে মহাসড়কের ২১০ কিলোমিটারের টেন্ডার হওয়ার কথা, সেখানে গত ২৯ এপ্রিল ঢাকা থেকে নরসিংদী পর্যন্ত মাত্র ৩৫ কিলোমিটার টেন্ডার আহ্বান করেছে সড়ক ও জনপথ।

নরসিংদী থেকে সিলেট পর্যন্ত এখনও টেন্ডার আহ্বান করা হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, ঢাকা থেকে নরসিংদী পর্যন্ত কাজ হওয়ার পর সিলেট অংশ দীর্ঘসূত্রতায় পড়তে পারে। নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব, অনৈক্য ও সমন্বয়হীনতায় সিলেট-ঢাকা চারলেন প্রকল্পও হারিয়ে যেতে পারে অন্ধকারে।

তবে সড়ক ও জনপথ বলছে, ৬ প্যাকেজে এই চারলেন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে। প্রথম ধাপে ঢাকা-নরসিংদী ৩৫ কিলোমিটার, ২য় ধাপে নরসিংদী-ভৈরব ৩৩ কিলোমিটার, ৩য় ধাপে সরাইল-বুদন্দিপুর ২৮ কিলোমিটার, ৪র্থ ধাপে বুদন্দিপুর-বাহুবল ২৮ কিলোমিটার, ৫ম ধাপে বাহুবল-শেরপুর ব্রিজ ৩৫ কিলোমিটার ও ৬ষ্ঠ ধাপে শেরপুর-পীর হবিবুর রহমান চত্বর সিলেট ৩৬ কিলোমিটার সড়ক বাস্তবায়ন হবে।

প্রকল্পের আওতায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে আটটি উড়ালসেতু, ২২টি ওভারপাস, পাঁচটি রেলওয়ে ওভারপাস, ৬৯টি ছোটবড় সেতু, দশটি আন্ডারপাস, তিনটি সড়ক মোহনা উন্নয়ন এবং ২৯টি ফুটওভারব্রিজ নির্মাণ করা হবে।

কিন্তু ৬ প্যাকেজের কথা বলা হলেও এখনও নরসিংদী থেকে সিলেট অংশের টেন্ডার হয়নি। হয়নি জমি অধিগ্রহণ। অথচ জুনের মধ্যে প্রকল্প অনুমোদন না হলে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চারলেন প্রকল্পে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) টাকা ফেরত চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। এডিবি এরইমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছে, নির্মাণ প্রকল্প জুনের মধ্যে অনুমোদন হলে জুলাইতে অর্থায়ন বিষয় নিয়ে আলোচনা সম্পন্ন করে সেপ্টেম্বর থেকে অর্থ ছাড় করতে প্রস্তুত তারা। তবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় মহাসড়ক প্রকল্পে বিলম্ব হলে তাদের অর্থ এখান থেকে সরিয়ে অন্য প্রকল্পে নেবে এডিবি।

সূত্র জানায়, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ প্রকল্পটি যাচাই-বাছাই করতে ৪৫-৬০ দিনের সময় নেবে। যেখানে জুনের মধ্যে মহাসড়কের নকশার অনুমোদন চেয়েছে ব্যাংকটি।

শুধু সিলেট-ঢাকা মহাসড়কই নয়, সিলেট বিমানবন্দর থেকে বাদাঘাট বাইপাস চারলেনেও দেখা দিয়েছে দীর্ঘসূত্রতা। দীর্ঘদিন ধরে সড়কটি চার লেনে উন্নীত করার দাবি সিলেটের মানুষের। সড়ক ও জনপথ বিভাগ থেকে এ বিষয়ে প্রস্তাবনাও পাঠানো হয়েছিল সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু সেই প্রস্তাবনা রহস্যজনক কারণে পাচ্ছে না গতি। ফলে সিলেট নগরীর মধ্যে পাথরবাহী ট্রাকে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে, ট্রাকচাপায় ঝরছে প্রাণ, দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন নগরবাসী। এখানেও সিলেটের নেতৃত্বের দুর্বলতা ও মন্ত্রীদের সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করছেন অনেকে।

একইভাবে ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উন্নয়ন প্রকল্পও থমকে আছে বলে দাবি করছে বিভিন্ন সূত্র। ২০১৮ সালে বিমানবন্দরে ৩৪ হাজার ৯১৯ বর্গমিটারের অত্যাধুনিক আন্তর্জাতিক মানের টার্মিনাল ভবন নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেয় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। সে অনুযায়ী কাজও পায় একটি চীনা কোম্পানি। এই প্রকল্পও গতি হারিয়েছে বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ খবর প্রকাশের পর গত ১৪ জুন দেয়া এক স্ট্যাটাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিখেছিলেন, ‘মান্নান আমার বন্ধু, মান্নানের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ৫০ বছরের অধিক। আমি এবং মান্নান সুখে-দুঃখে সব সময়ই ছিলাম এবং আছি, ভবিষ্যতেও আমৃত্যু থাকব বলেই আশা করি। দুঃখজনক যে, সিলেটের একটি স্থানীয় সংবাদপত্রে দেখলাম আমার এবং মান্নানের মধ্যে নাকি দ্বন্দ্ব রয়েছে এবং এই দ্বন্দ্বের কারণে নাকি সিলেটের অনেক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে! কে বা কারা এই সংবাদটি প্রচার করছেন জানি না, তবে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং বানোয়াট।

যে বা যারা এটি প্রচার করছেন, তারা হয়তোবা কোন বিশেষ বা অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য করছেন। ফেইসবুকে এই স্ট্যাটাসটির প্রয়োজন আছে বলে মনে করছি না, তবে একটি বিশেষ কারণে দিচ্ছি আর তা হলো আমার এবং মান্নানের স্থানীয় অনেক শুভাকাক্সক্ষী রয়েছেন আর তাদের মধ্যে যাতে কোন বিভ্রান্তির সৃষ্টি না হয়।’

সুনামগঞ্জ থেকে ছাতক পর্যন্ত রেললাইন হওয়ার কথা রয়েছে। রেললাইনের রুট নির্ধারণ নিয়ে রেলমন্ত্রী কথা বলেছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রীর সঙ্গে। যেখান দিয়ে রুটটি করলে লাভজনক হয়, পরিবেশ প্রতিবেশের কোন ক্ষতি না হয়, সেদিক দিয়েই করার কথা বলেন পরিকল্পনামন্ত্রী।

বুধবার, ২৩ জুন ২০২১ , ৯ আষাঢ় ১৪২৮ ১১ জিলকদ ১৪৪২

বন্ধু দুই মন্ত্রী সিলেটের উন্নয়ন এবং ফেইসবুক স্ট্যাটাস

আকাশ চৌধুরী, সিলেট

image

নিজ এলাকা সুনামগঞ্জের উন্নয়ন কর্মকা- বিষয়ে সিলেটের এমপি পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেনের একটি ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলেও সেটাকে ‘বড় করে’ দেখতে চান না পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। এ বিষয়ে ফেইসবুকে দুই বন্ধুর পাল্টাপাল্টি স্ট্যাটাসের ব্যাখ্যায় গতকাল সাংবাদিকদের কাছে তিনি এই প্রতিক্রিয়া জানান। মান্নান বলেন, ‘ওনি নিজেইতো স্ট্যাটাসে বলেছেন, আমাদের ৫০ বছরের বন্ধুত্ব। বরং আরও দুই চার বছর বেশিও হতে পারে, এটা তেমন বড় বিষয় না। আমাদের মধ্যে কোন মতভেদ আছে এমন কোন বিষয় নয়।

রেললাইনের একটি রুট নিয়ে সরকারি দলের সংসদ সদস্য ও সাবেক আমলা এই দুই বন্ধুর মুখোমুখি অবস্থানের প্রকাশ প্রথম সামনে আসে ১৪ জুন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ফেইসবুক পোস্ট থেকে।

এদিকে সিলেট অঞ্চলের এই দুই মন্ত্রীর মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও দূরত্বের কারণে সিলেটের উন্নয়ন কার্যক্রম থমকে আছে বলে সিলেটের একটি দৈনিকে খবর প্রকাশ হলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী তা অস্বীকার করেন।

তবে গত রোববার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে ‘পরিকল্পনামন্ত্রীর দপ্তর’ ফেইসবুক পেজে দেয়া এক স্ট্যাটাসে বলা হয়েছে, সুনামগঞ্জ থেকে ছাতক পর্যন্ত প্রস্তাবিত রেললাইন নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেনের ভূমিকায় বিস্মিত হয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। তিনি বলেন, দু’জনের মধ্যে দীর্ঘ ৫০ বছরের বন্ধুত্ব, একই সঙ্গে মন্ত্রিসভার সহকর্মী হয়েও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভূমিকা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এই স্ট্যাটাসেই দ্বন্দ্বের বিষয়টি প্রকাশ্যে চলে আসে।

ফেইসবুক পেজে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘এটা সত্য যে, ড. মোমেনের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দীর্ঘ ৫০ বছরের। কিন্তু তিনি সুনামগঞ্জের পাঁচজন সংসদ সদস্যের পাশে রয়েছেন উল্লেখ করে রেলমন্ত্রীর কাছে যে আধাসরকারিপত্র (ডিও) দিয়েছেন, সেটি আমাকে বিস্মিত করেছে। তিনি যে পাঁচজন এমপির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, সেখানে একজন জাতীয় পার্টির এমপিও রয়েছেন।

আবদুল মোমেন ভালো করেই জানেন, আমিও (মান্নান) সুনামগঞ্জের একজন সংসদ সদস্য। সুনামগঞ্জের সঙ্গে ছাতকের রেললাইন নির্মাণ নিয়ে তিনি যেমন অবগত, ঠিক তেমনি বিষয়টি আমিও অবগত। আমি যতটুকু জানি, তার বর্ণিল জীবনে তিনি কখনও সুনামগঞ্জে যাননি। সুনামগঞ্জে কখনও তার পা পর্যন্ত পড়েনি।

অথচ তিনি রেললাইন নির্মাণ নিয়ে একটি পক্ষের অবস্থান নিয়েছেন। অন্য কেউ হলে এই পরিস্থিতিতে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইতেন। কিন্তু আমাদের দীর্ঘ ৫০ বছরের বন্ধুত্ব একই সঙ্গে আমরা দুজনেই মন্ত্রিসভার সদস্য অথচ তিনি আমার সঙ্গে এ বিষয়ে এতটুকু যোগাযোগ করেননি। আমার সঙ্গে কথা না বলে অন্য পাঁচজন সংসদ সদস্যের পক্ষ নিয়ে রেলমন্ত্রীকে ডিও লেটার পাঠানো কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।’

এর আগে স্থানীয় একটি দৈনিকে লিখা হয়েছিল, সিলেট-১ আসনের সংসদ সদস্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন ও সুনামগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নানের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে সিলেটের অনেক মেগা প্রকল্প কাগজে কলমে নেয়া হলেও তা বাস্তবায়নে দেখা দিয়েছে চরম ধীরগতি। মন্ত্রীদের দূরত্বের কারণে ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছে সিলেট।

তাদের দ্বন্দ্বের সুযোগ নিচ্ছে সিলেটের উন্নয়ন বিদ্বেষী চক্র। ফলে উন্নয়নের দৌড়ে বার বার হোঁচট খাচ্ছে সিলেট। অন্যান্য অঞ্চলে যেখানে মেগা প্রজেক্ট দ্রুত বাস্তবায়ন হচ্ছে সেখানে উল্টো চিত্র সিলেটে। সুশীল সমাজ মনে করে, সফল নেতৃত্বের কারণে ঢাকা-চট্টগাম চারলেন প্রকল্প এখন দৃশ্যমান।

সিলেট-ঢাকার চেয়েও কম গুরুত্বপূর্ণ কুমিল্লা-নোয়াখালী মহাসড়ক প্রকল্প এগিয়ে চলেছে। অথচ ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক প্রকল্প এখনও অন্ধকারের মহাসমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট এধাধিক সূত্র জানিয়েছে, বর্তমান এই দুই মন্ত্রীর কেবল দেখা হয় মন্ত্রীপরিষদ মিটিংয়ে। এর বাইরে তাদের দু’জনের চোখের দেখা কিংবা কথা হয় না বললেই চলে। একজন অন্যজনকে এড়িয়ে চলেন। একজনের উন্নয়নের ক্রেডিট অন্যজন দিতে চান না। তবে এর মাঝে একজন উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে। তার হাত ধরেই সুনামগঞ্জ এখন অনেকটাই উন্নয়নের মহাসড়কে। তার কারণেই সুনামগঞ্জ হয়েছে মেডিকেল কলেজ।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পও কাগজে কলমে এগিয়েছে অনেকদূর। এছাড়া তিনি প্রচুর ব্রিজ-কালভার্ট, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করেছেন। স্বপ্ন দেখাচ্ছেন রেললাইন এবং বিমানমন্দরেরও। তবে উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে অন্য মন্ত্রী। এখনও তার মেগা কোন প্রকল্প দৃশ্যমান হয়নি। যা হচ্ছে তা কেবল রুটিন উন্নয়নই বলা চলে। এ নিয়ে গত ১০ জুন সভা করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সিলেট উন্নয়ন পরিষদ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, স্বপ্নের সিলেট-ঢাকা চারলেন প্রকল্প এখনও সুদূর পরাহত। কারণ যেখানে মহাসড়কের ২১০ কিলোমিটারের টেন্ডার হওয়ার কথা, সেখানে গত ২৯ এপ্রিল ঢাকা থেকে নরসিংদী পর্যন্ত মাত্র ৩৫ কিলোমিটার টেন্ডার আহ্বান করেছে সড়ক ও জনপথ।

নরসিংদী থেকে সিলেট পর্যন্ত এখনও টেন্ডার আহ্বান করা হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, ঢাকা থেকে নরসিংদী পর্যন্ত কাজ হওয়ার পর সিলেট অংশ দীর্ঘসূত্রতায় পড়তে পারে। নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব, অনৈক্য ও সমন্বয়হীনতায় সিলেট-ঢাকা চারলেন প্রকল্পও হারিয়ে যেতে পারে অন্ধকারে।

তবে সড়ক ও জনপথ বলছে, ৬ প্যাকেজে এই চারলেন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে। প্রথম ধাপে ঢাকা-নরসিংদী ৩৫ কিলোমিটার, ২য় ধাপে নরসিংদী-ভৈরব ৩৩ কিলোমিটার, ৩য় ধাপে সরাইল-বুদন্দিপুর ২৮ কিলোমিটার, ৪র্থ ধাপে বুদন্দিপুর-বাহুবল ২৮ কিলোমিটার, ৫ম ধাপে বাহুবল-শেরপুর ব্রিজ ৩৫ কিলোমিটার ও ৬ষ্ঠ ধাপে শেরপুর-পীর হবিবুর রহমান চত্বর সিলেট ৩৬ কিলোমিটার সড়ক বাস্তবায়ন হবে।

প্রকল্পের আওতায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে আটটি উড়ালসেতু, ২২টি ওভারপাস, পাঁচটি রেলওয়ে ওভারপাস, ৬৯টি ছোটবড় সেতু, দশটি আন্ডারপাস, তিনটি সড়ক মোহনা উন্নয়ন এবং ২৯টি ফুটওভারব্রিজ নির্মাণ করা হবে।

কিন্তু ৬ প্যাকেজের কথা বলা হলেও এখনও নরসিংদী থেকে সিলেট অংশের টেন্ডার হয়নি। হয়নি জমি অধিগ্রহণ। অথচ জুনের মধ্যে প্রকল্প অনুমোদন না হলে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চারলেন প্রকল্পে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) টাকা ফেরত চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। এডিবি এরইমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছে, নির্মাণ প্রকল্প জুনের মধ্যে অনুমোদন হলে জুলাইতে অর্থায়ন বিষয় নিয়ে আলোচনা সম্পন্ন করে সেপ্টেম্বর থেকে অর্থ ছাড় করতে প্রস্তুত তারা। তবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় মহাসড়ক প্রকল্পে বিলম্ব হলে তাদের অর্থ এখান থেকে সরিয়ে অন্য প্রকল্পে নেবে এডিবি।

সূত্র জানায়, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ প্রকল্পটি যাচাই-বাছাই করতে ৪৫-৬০ দিনের সময় নেবে। যেখানে জুনের মধ্যে মহাসড়কের নকশার অনুমোদন চেয়েছে ব্যাংকটি।

শুধু সিলেট-ঢাকা মহাসড়কই নয়, সিলেট বিমানবন্দর থেকে বাদাঘাট বাইপাস চারলেনেও দেখা দিয়েছে দীর্ঘসূত্রতা। দীর্ঘদিন ধরে সড়কটি চার লেনে উন্নীত করার দাবি সিলেটের মানুষের। সড়ক ও জনপথ বিভাগ থেকে এ বিষয়ে প্রস্তাবনাও পাঠানো হয়েছিল সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু সেই প্রস্তাবনা রহস্যজনক কারণে পাচ্ছে না গতি। ফলে সিলেট নগরীর মধ্যে পাথরবাহী ট্রাকে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে, ট্রাকচাপায় ঝরছে প্রাণ, দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন নগরবাসী। এখানেও সিলেটের নেতৃত্বের দুর্বলতা ও মন্ত্রীদের সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করছেন অনেকে।

একইভাবে ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উন্নয়ন প্রকল্পও থমকে আছে বলে দাবি করছে বিভিন্ন সূত্র। ২০১৮ সালে বিমানবন্দরে ৩৪ হাজার ৯১৯ বর্গমিটারের অত্যাধুনিক আন্তর্জাতিক মানের টার্মিনাল ভবন নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেয় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। সে অনুযায়ী কাজও পায় একটি চীনা কোম্পানি। এই প্রকল্পও গতি হারিয়েছে বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ খবর প্রকাশের পর গত ১৪ জুন দেয়া এক স্ট্যাটাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিখেছিলেন, ‘মান্নান আমার বন্ধু, মান্নানের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ৫০ বছরের অধিক। আমি এবং মান্নান সুখে-দুঃখে সব সময়ই ছিলাম এবং আছি, ভবিষ্যতেও আমৃত্যু থাকব বলেই আশা করি। দুঃখজনক যে, সিলেটের একটি স্থানীয় সংবাদপত্রে দেখলাম আমার এবং মান্নানের মধ্যে নাকি দ্বন্দ্ব রয়েছে এবং এই দ্বন্দ্বের কারণে নাকি সিলেটের অনেক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে! কে বা কারা এই সংবাদটি প্রচার করছেন জানি না, তবে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং বানোয়াট।

যে বা যারা এটি প্রচার করছেন, তারা হয়তোবা কোন বিশেষ বা অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য করছেন। ফেইসবুকে এই স্ট্যাটাসটির প্রয়োজন আছে বলে মনে করছি না, তবে একটি বিশেষ কারণে দিচ্ছি আর তা হলো আমার এবং মান্নানের স্থানীয় অনেক শুভাকাক্সক্ষী রয়েছেন আর তাদের মধ্যে যাতে কোন বিভ্রান্তির সৃষ্টি না হয়।’

সুনামগঞ্জ থেকে ছাতক পর্যন্ত রেললাইন হওয়ার কথা রয়েছে। রেললাইনের রুট নির্ধারণ নিয়ে রেলমন্ত্রী কথা বলেছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রীর সঙ্গে। যেখান দিয়ে রুটটি করলে লাভজনক হয়, পরিবেশ প্রতিবেশের কোন ক্ষতি না হয়, সেদিক দিয়েই করার কথা বলেন পরিকল্পনামন্ত্রী।