আমাদের লোহানী ভাই

কাজী তামান্না

আলো-অন্ধকারে যাই- মাথার ভিতরে,

স্বপ্ন নয়,- কোন এক বোধ কাজ করে!

স্বপ্ন নয়- শান্তি নয়- ভালোবাসা নয়,

হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!

আমি তারে পারি না এড়াতে,

সে আমার হাত রাখে হাতে;

সব কাজ তুচ্ছ হয়- প- মনে হয়,

সব চিন্তা- প্রার্থনার সকল সময়

শূন্য মনে হয়,

শূন্য মনে হয়!

দু’হাজার বিশ সাল! এমনই এক শূন্যতা নিয়ে এসেছে সমস্ত মানব সমাজে। একাকিত্ব মানুষকে অনেক সময় সৃষ্টিশীল করে তোলে। সৃজনশীলতার উৎসমুখে একাকী থাকার আনন্দ উপভোগ করা যায়। কিন্তু শূন্যতা বোধে সত্যি সব কাজ তুচ্ছ মনে হয়, প- হয়ে যায়। তাই বোধ হয় মনুষ্য জাতির এই দারুণ দুঃসময়, কেমন একটা অদ্ভুত অন্ধকার অসহায়ত্বে আমি বারবার কবি জীবনানন্দ দাশের কাছে ফিরে আসি। এর পূর্বে কখনো এমনটা হয়নি। সংকটে সংশয়ে বিপদে, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শরণাপন্ন হয়েছি। সঞ্চয়িতা গীতবিতানের আশ্রয় নিয়েছি। কিন্তু এখন কেবল জীবনানন্দ মনের আনাচে কানাচে ঘোরাফেরা করে। কিছু না, স্বপ্ন তো নয়ই শুধুই একটা অজানা বোধ কাজ করে। অসহায়ত্বের বোধ কারও পাশে না দাঁড়ানোর অসহায়ত্ব! “কেউ কারও নয়”। “তুমি শুধু তোমাকে রক্ষা করো”। “মানুষের কাছ থেকে নিরাপদ দূরে থাকো”। এই এক বাণী অষ্টপ্রহর আমাদের তাড়িত করে নিয়ে চলেছে। কোথায় এর শেষ জানি না, শুধু প্রাণটুকু নিয়ে বেঁচে থাকার এই যুদ্ধে আমরা কি বলতে পারছি- ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা/ বিপদে আমি না যেন করি ভয়।’ ভয়! মানুষকে মানুষের ভয়! এ কোন দুর্বিপাকে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়াতে হলো আমাদের। জগৎ সংসার কেমন বদলে গেল। চেনা পৃথিবীটা অচেনা হয়ে উঠেছে। এ এক দারুণ শূন্যতাবোধে কি একান্ত আপনজন সম্পর্কে লেখা যায়? যে মানুষটিকে শৈশব থেকে ভাই বলে ডেকে এসেছি। তার চলে যাবার পর তাকে স্মরণ করে লেখাটা প্রচণ্ড কষ্টের। আপনজন তো মনে আসেই প্রায় প্রত্যহই নানা ছলে নানা বোলে। একটা প্রকাণ্ড কালকে; বিভিন্নভাবে নিজের আদর্শের অবেষ্ঠনীর মধ্যে ধরে রাখার ক্ষমতা রাখতেন যে মানুষটা। যাকে সকলে একই রূপে; একই পোশাকে নির্দিষ্ট একটা দৃঢ় বিশ্বাস ও সুন্দর চেতনা নিয়ে বরাবর দেখে এসেছে। দীর্ঘ ছিয়াশি বছরের জীবন। তাঁকে কয়েক পাতায় কলমের আঁচড়ে তুলে ধরা কি সম্ভব?

কামাল লোহানী শুধু একজন ব্যক্তি নন, প্রতিষ্ঠানও। আমাদের ভাইবোনের লোহানী ভাই। আমার আব্বা কাজী মোহাম্মদ ইদরিসও লোহানী ভাইয়ের ভাই ও আম্মা ভাবী ছিলেন। ডাকাডাকিতে কী এসে যায়! সম্পর্কের টানটাই সবচেয়ে বড়। নিজস্ব পরিবারের সদস্য ছাড়া এমন কত কত সুন্দর ভালো মানুষের সংস্পর্শে এসেছি আমরা ভাইবোনেরা। কিছু না জেনে না বুঝেও শৈশব থেকে জেনে এসেছি এঁরা খুব “ভালো মানুষ”। এঁরা দেশের দশের সমাজের ভালো চায়। সকল ক্ষেত্রে মানুষের মঙ্গল হোক। শুধু নিজের কথা ভাবার জন্য ধরণীতে মনুষ্য জন্ম নয়।

এটুকুই বুঝতে শিখেছি নিজস্ব গতির মধ্যে। ধীরে ধীরে বড় হয়ছি। কত ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে চেনা সেই মানুষগুলোর পথ চলার সঙ্গে নিজেও এগিয়ে চলেছি। কিন্তু সকলে সেই শুভ পথে হাঁটতে পারেননি। অনেকের পদস্খলন দেখেছি। আবার অনেকেই হাজার চড়াই উতরাই পেরিয়েও নিজের বিশ্বাস আদর্শ থেকে একবিন্দুও সরে দাঁড়াননি- তাদেরই একজন আমাদের শ্রদ্ধার ভালোবাসার মানুষ কামাল লোহানী। আমাকে “তুই” বলে সম্বোধন করতেন। এতেই বোঝা যায় সম্পর্কের গভীরতা। এমন সহজ সরল কাছের মানুষের কথা লেখা ততধিক কঠিন। তাঁর মেয়ে বন্যার বারবার অনুরোধেই কলম ধরেছি। আবেগতাড়িত হয়ে লেখাটা কষ্টসাধ্য।

লোহানী ভাই সর্বাঙ্গীন একজন সুন্দর মানুষ। ঋজু দীর্ঘদেহ। মাথাভর্তি চুল। গভীর চোখ, উন্নত প্রশস্ত কপাল। চলাফেরা সাবলীল। কথাবার্তা স্পষ্ট, শ্বেতবস্ত্র পরিচ্ছদে হাজার মানুষের মাঝেও আলাদা একটা মাত্রা যোগ হতো। এটা সবাইকে কাছে টানত। অনেক সৃজনশীল মানুষের কাছাকাছি হয়তো হওয়া যায় না। কিন্তু এই বিরল গুণটি তার ছিল। তাইতো তিনি একাধিক কাজে নিজেকে অনায়াসে সম্পৃক্ত করতে পেরেছিলেন।

কামাল লোহানী নামটার মধ্যেই একটা ঝংকার আছে।

একটা ছন্দ দোলা দেয়। এবং বাংলাদেশে লোহানী পদবিটি শুধু নির্দিষ্ট একটি বংশই বহন করে চলেছে। যেমন ফজলে লোহানী, ফতেহ লোহানী। এবং তারা সকলেই দারুণ সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ। বিশেষত্বটি বহন করে একটি পরিবারে। সেটা আমরা দেখে আসছি। লোহানী ভাই সত্য সুন্দরের জন্য লড়েছেন সেই ভাষা আন্দোলন থেকে! তখন তিনি কিশোর। ১৯৫২-তেই ম্যাট্রিক পাস করেছেন। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের পাবনা সফরের প্রতিরোধ ও মুসলিম লীগ সম্মেলন ভণ্ডুল করে দেয়ার অপরাধে কারাবরণ করেন। আবার ’৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের হয়ে কাজ করার অপরাধে গ্রেফতার হন। যুক্তফ্রন্টের নিরংকুশ বিজয়ে সরকার গঠন করার পর পাকিস্তানের কুশাসনের নজির ভারত শাসন আইনের ৫৪ (ক) ধারা জারির মাধ্যমে প্রাদেশিক পরিষদ ও মন্ত্রিসভা বাতিল করার পর আবারও কামাল লোহানী কারারুদ্ধ হন। কিন্তু কৈশোরে মা-হারা ছেলেটি কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা না করে আপন বিশ্বাসে, জেদি মনোভাব নিয়ে অসাধারণ যাপিত জীবন বেছে নিয়েছিলেন। ’৬২-এর শিক্ষানীতি ও সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় কামাল লোহানী বিবাহিত যুবক। প্রথম সন্তান সাগরের বয়স যখন তেরো দিন আবার গ্রেপ্তার হলেন। সংসার তাকে সংগ্রাম থেকে দূরে সরাতে পারেনি।

সাংসারিক তথা পরিবারিক বেষ্টনীতে তিনি কেমন ছিলেন সেটা খুব মনোমুগ্ধকরভাবে প্রকাশ করেছেন তার সত্তরতম জন্মতিথিতে স্ত্রী দীপ্তি লোহানী। ‘আমি কিন্তু ওকে একজন জেদি মানুষ হিসেবে জানি। কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তাকে সেই কাজ করতেই হবে। এই জেলে, এই বেকার, আবার পুলিশি নজর এড়িয়ে চলা ইত্যাকার কারণে তিনি তো হয় কারাগারে না হয় পলাতক, আমার অবস্থা সারা।’ কেমন মায়া মমতা জড়ানো ভালোবাসার মানুষটি সম্পর্কে আমাদের দীপ্তি বৌদি কত কথা লিখে গেছেন। সেই একান্ত পারিবারিক জীবনটা কত ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে প্রতিকূলতাকে সরিয়ে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল সেটা আমরা কাছ থেকে দেখেছি। একদিনের একটি ঘটনা বলি। একটি অনুষ্ঠানে লোহানী ভাইয়ের পাশে বসে উপভোগ করছি হঠাৎ বললেন ‘যাইরে তোর বৌদির গোসলের সময় হয়েছে।’ আমরা জানি, তার স্ত্রী বেশ কয়েক বছর অসুস্থ ছিলেন। সব কিছু করিয়ে দিতে হতো। হাজার কাজের মাঝেও স্ত্রীর পরিচর্যা করতে কখনো ভুল হয়নি। এই মমতা মাখানো ভালোবাসায় ভরপুর একান্ত নিজস্ব জীবন সেখানেও লোহানী ভাই পরিপূর্ণ ছিলেন। অসম্ভব সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল কামাল লোহানীর। বিচিত্র তার গতিবিধি। যাতে হাত দিয়েছেন সোনা ফলিয়েছেন। একজন রাজনীতিক, সাংবাদিক যে সমান তালে সাংস্কৃতিক আন্দোলনে চর্চায় আজীবন মেতে থাকতে পারেন সেটা প্রায় অবিশ্বাস্য! সেই পঞ্চাশের দশকে সংস্কৃতি সংসদের সংশ্লিষ্টতা দিয়ে পথচলা শুরু। বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন কমিটি তার ফলস্বরূপ ছায়ানটের জন্ম। সেই শুরুতেই ঔপনিবেশিকের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক আন্দোলন তথা বাংলা ভাষা ও বাঙ্গালিত্বকে বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রামের হাল ধরলেন লোহানী ভাই। প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও অসীম ক্ষমতাবলে প্রাণপ্রাচুর্যে উজ্জ্বল ভরপুর যুবক কামাল লোহানী ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদকরূপে দুবছরেই সংগঠনকে একটি মর্যাদার আসনে পৌঁছে দিয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় সে কথা এখনকার প্রজন্মকে সেভাবে অবহিত করা হয়নি।

কজন জানে বুলবুল ললিতকলা একাডেমির উদ্যোগে নৃত্যনাট্য ‘শ্যামার’ বজসেনরূপে নেচেছিলেন উন্নতকান্তি লোহানী ভাই। গান গাইতেন না কিন্তু গণনাট্য সংঘের গানগুলি তাকে উদ্যোগী করে তুলেছিল গণসঙ্গীতের প্রতি। তিনি বিশ্বাস করতেন সাধারণ মানুষের জাগরণের রূপটি তুলে ধরা যায় নাটকে সঙ্গীতে নৃত্যে। এই আস্থা থেকে পরবর্তীকালে অনেকে সরে এসেছেন কিন্তু লোহানী ভাই তার নিজস্ব চিন্তাধারা থেকে তিল পরিমাণ সরে আসেননি। কোনো মধ্যবিত্তসুলভ মনোভাবে তিনি কখনোই বিভ্রান্ত হননি। এটা সত্যিই দুর্লভ। ১৯৬৭তে একান্ত নিজের চিন্তার প্রতিফলন দেখি তার উদ্যোগে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংস্থা ক্রান্তির প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। কামাল লোহানীর নেতৃত্বে ও পরিচালনায় কয়েক বছরের ব্যবধানে একের পর এক নৃত্যনাট্য, জ্বলছে আগুন ক্ষেতে খামারে, গীতিনকশা ‘ধানের গুচ্ছে রক্ত জমেছে’ নাটক ‘আলোর পথযাত্রী’ মঞ্চস্থ হয়। সবই ক্রান্তির পরিচালনায়। আয়ুব বিরোধী তথা সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের সেই উত্তাল দিনগুলোতে ’৬৭, ’৬৯-৭০-৭১-এ তিনি তাঁর ক্রান্তিদল নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের শহর বন্দর গ্রামগঞ্জে গণসংগীত শুনিয়েছেন এদেশের আপামর জনসাধারণকে। এভাবে সাংস্কৃতিক আন্দোলন অনেক ক্ষেত্রে তৎকালীন রাজনৈতিক আন্দোলনকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। সঙ্গীত নৃত্য নাটক যে মানুষের মুক্তির হাতিয়ার একথা তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে গেছেন আজীবন। পরবর্তীকালে গণশিল্পী সংস্থার মূল কর্ণধার রূপে আপন, বিশ্বাসে অটল থাকেন। তাইতো জীবনের শেষ প্রান্তে উদীচীর মতো গণমানুষের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সভাপতির পদ অলংকৃত করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। তিনি শহীদ আলতাফ মাহমুদ সংগীত বিদ্যানিকেতন প্রতিষ্ঠা করেন। রাজশাহী চারুকলা মহাবিদ্যালয়েরও প্রতিষ্ঠাতা কামাল লোহানী। এমনটা সহসা দেখা যায় না।

কামাল লোহানীর পেশাগত পরিচয় তিনি একজন মুক্তমনা সাংবাদিক। দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে তিনি সর্বোচ্চ পদ অলংকৃত করেছেন। তার ক্ষুরধার লেখনিতে দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক নানা বিষয় উজ্জ্বল স্বাক্ষর বহন করে। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউটের গুরুত্বপূর্ণ পদ অলংকৃত করেন। বিস্মিত হতে হয় যখন দেখি শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া দুই বৈরী মনোভাবের প্রধানমন্ত্রীত্ব কালে লোহানী ভাই বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক। এই মানবিক পরিচয় বহনকারী মানুষটির আপন চিন্তা-চেতানারই প্রতিফলন দেখেছি তাঁর কাছে। তবে তাঁর সবচাইতে বড় ভূমিকা ও কৃতিত্ব হলো একাত্তরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কাজের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া। তিনি তাঁর উদাত্ত কণ্ঠে সংবাদপাঠ করতেন এবং বার্তা সম্পাদক হিসাবে নিজ দায়িত্ব পালন করেছেন। লোহানী ভাই বাংলাদেশের সবচেয়ে গৌরবময় দিন ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে দেশের আপামর জনসাধারণ যে বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে এসেছিল সেই চূড়ান্ত মুহূর্তের বিজয়বার্তা পাঠ করেছিলেন। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হয়? পর পর তিনবার তাঁর কণ্ঠে আমরা ঐতিহাসিক তিনটি ধারাভাষ্য শুনতে পাই। ’৭১-এ স্বাধীনতার পর ২২শে ডিসেম্বর কলকাতা থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী সর্বজনাব তাজউদ্দিন আহমদসহ সরকারের মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকায় আগমনের ধারাবিবরণী ১৯৭২-এর ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশে পদার্পণের সেই আনন্দাশ্রুর বিশেষ মুহূর্তের আবেগঘন ভরাট কণ্ঠের ধারাভাষ্য আজও কানে ভাসে। আবার ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধুর কলকাতা সফরকালে ক্যালকাটা প্যারেডগ্রাউন্ডে সভায় তিনিই উদ্বোধনী ঘোষণা দেন।

১৯৭২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনার থেকে রাতব্যাপী ধারাবর্ণনা তাঁরই কণ্ঠে উচ্চারিত হয়। প্রসঙ্গত বলে রাখি ১৯৬৩ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষাসৈনিকদের স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কামাল লোহানী তাঁর আবেগঘন কণ্ঠে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর সেই বিখ্যাত কবিতা কুমড়ো ফুলে ফুলে/নুয়ে পড়েছে লতাটা, ... খোকা তুই কবে আসবি/কবে আসবিই আবৃত্তি করে হাজার হাজার মানুষকে চোখের জলে ভাসিয়েছিলেন। অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেছিলেন শহীদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম এবং জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে যখন তিনি তাঁর দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন প্রায় চলচ্ছক্তিহীন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জে নিজ জন্মভূমিতে সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজ মাঠে জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন পরিষদের ঊনচল্লিশতম বার্ষিক অধিবেশনে ৬ই মার্চ ২০২০ প্রধান অতিথির ভাষণ দেন। সেই একছাটের লম্বা ফুলের পাঞ্জাবি, ঢোলা পায়জামা শ্বেত শ্রভ্র কেশ, দেহ কিছুটা নুয়ে পড়েছে কিন্তু চেহারার উজ্জ্বলতা হারাননি, উদাত্ত কণ্ঠে এদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে সঠিক পথে অগ্রসর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সেদিনই লোহানী ভাইয়ের সঙ্গে আমার শেষ দেখা। এদেশের সকল রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কিংবদন্তিসম সাক্ষী ও অংশগ্রহণকারী আর কোনো ব্যক্তিত্ব আছে বলে জানি না।

ত্রিকালদ্রষ্টা কামাল লোহানী এক ব্যতিক্রমী মানুষ হয়েই ছিলেন। নষ্ট সমাজ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মানবতার মৃত্যু, বাংলার মন্বন্তর দাঙ্গা দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা বেকারি, এসবের আঁচ বহন করেছেন। তিনিও ১৯৪৮ সালে কলকাতা থেকে এক প্রকার উদ্বাস্তু হয়ে পাবনায় আসেন। তারপর ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ’৫৮’র সামরিক শাসন, ’৬২’র সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ’৬৪’র দাঙ্গা, ’৬৫’র ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের খেলা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের গণজোয়ার ও তারপর বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ তাকে মনেপ্রাণে একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক বাঙালি তৈরি করেছিল। সেটা তার চলনে বলনে আহারে বিহারে গৃহে সর্বত্র প্রকাশিত। শূন্যতা বোধ নিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম কিন্তু শেষে এসে কেমন ইতিবাচক মনোভাবের অবয়ব অনুভব করছি। সেটা নিয়েই মানুষ বাঁচে। ঠিক এক বৎসর আগে ২০ জুন কামাল লোহানী অন্য এক লোকে পাড়ি দিয়েছেন। আজ তাঁকে আমার এই ছোট অর্ঘ্যে শ্রদ্ধা ভালোবাসা জানালাম। জগতের আনন্দযজ্ঞে তিনি নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন। তাই তাঁর মানবজীবন ধন্য। সার্থক।

বৃহস্পতিবার, ২৪ জুন ২০২১ , ১০ আষাঢ় ১৪২৮ ১২ জিলকদ ১৪৪২

আমাদের লোহানী ভাই

কাজী তামান্না

image

কামাল লোহানী / জন্ম : ২৬ জুন ১৯৩৪; মৃত্যু : ২০ জুন ২০২০

আলো-অন্ধকারে যাই- মাথার ভিতরে,

স্বপ্ন নয়,- কোন এক বোধ কাজ করে!

স্বপ্ন নয়- শান্তি নয়- ভালোবাসা নয়,

হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!

আমি তারে পারি না এড়াতে,

সে আমার হাত রাখে হাতে;

সব কাজ তুচ্ছ হয়- প- মনে হয়,

সব চিন্তা- প্রার্থনার সকল সময়

শূন্য মনে হয়,

শূন্য মনে হয়!

দু’হাজার বিশ সাল! এমনই এক শূন্যতা নিয়ে এসেছে সমস্ত মানব সমাজে। একাকিত্ব মানুষকে অনেক সময় সৃষ্টিশীল করে তোলে। সৃজনশীলতার উৎসমুখে একাকী থাকার আনন্দ উপভোগ করা যায়। কিন্তু শূন্যতা বোধে সত্যি সব কাজ তুচ্ছ মনে হয়, প- হয়ে যায়। তাই বোধ হয় মনুষ্য জাতির এই দারুণ দুঃসময়, কেমন একটা অদ্ভুত অন্ধকার অসহায়ত্বে আমি বারবার কবি জীবনানন্দ দাশের কাছে ফিরে আসি। এর পূর্বে কখনো এমনটা হয়নি। সংকটে সংশয়ে বিপদে, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শরণাপন্ন হয়েছি। সঞ্চয়িতা গীতবিতানের আশ্রয় নিয়েছি। কিন্তু এখন কেবল জীবনানন্দ মনের আনাচে কানাচে ঘোরাফেরা করে। কিছু না, স্বপ্ন তো নয়ই শুধুই একটা অজানা বোধ কাজ করে। অসহায়ত্বের বোধ কারও পাশে না দাঁড়ানোর অসহায়ত্ব! “কেউ কারও নয়”। “তুমি শুধু তোমাকে রক্ষা করো”। “মানুষের কাছ থেকে নিরাপদ দূরে থাকো”। এই এক বাণী অষ্টপ্রহর আমাদের তাড়িত করে নিয়ে চলেছে। কোথায় এর শেষ জানি না, শুধু প্রাণটুকু নিয়ে বেঁচে থাকার এই যুদ্ধে আমরা কি বলতে পারছি- ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা/ বিপদে আমি না যেন করি ভয়।’ ভয়! মানুষকে মানুষের ভয়! এ কোন দুর্বিপাকে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়াতে হলো আমাদের। জগৎ সংসার কেমন বদলে গেল। চেনা পৃথিবীটা অচেনা হয়ে উঠেছে। এ এক দারুণ শূন্যতাবোধে কি একান্ত আপনজন সম্পর্কে লেখা যায়? যে মানুষটিকে শৈশব থেকে ভাই বলে ডেকে এসেছি। তার চলে যাবার পর তাকে স্মরণ করে লেখাটা প্রচণ্ড কষ্টের। আপনজন তো মনে আসেই প্রায় প্রত্যহই নানা ছলে নানা বোলে। একটা প্রকাণ্ড কালকে; বিভিন্নভাবে নিজের আদর্শের অবেষ্ঠনীর মধ্যে ধরে রাখার ক্ষমতা রাখতেন যে মানুষটা। যাকে সকলে একই রূপে; একই পোশাকে নির্দিষ্ট একটা দৃঢ় বিশ্বাস ও সুন্দর চেতনা নিয়ে বরাবর দেখে এসেছে। দীর্ঘ ছিয়াশি বছরের জীবন। তাঁকে কয়েক পাতায় কলমের আঁচড়ে তুলে ধরা কি সম্ভব?

কামাল লোহানী শুধু একজন ব্যক্তি নন, প্রতিষ্ঠানও। আমাদের ভাইবোনের লোহানী ভাই। আমার আব্বা কাজী মোহাম্মদ ইদরিসও লোহানী ভাইয়ের ভাই ও আম্মা ভাবী ছিলেন। ডাকাডাকিতে কী এসে যায়! সম্পর্কের টানটাই সবচেয়ে বড়। নিজস্ব পরিবারের সদস্য ছাড়া এমন কত কত সুন্দর ভালো মানুষের সংস্পর্শে এসেছি আমরা ভাইবোনেরা। কিছু না জেনে না বুঝেও শৈশব থেকে জেনে এসেছি এঁরা খুব “ভালো মানুষ”। এঁরা দেশের দশের সমাজের ভালো চায়। সকল ক্ষেত্রে মানুষের মঙ্গল হোক। শুধু নিজের কথা ভাবার জন্য ধরণীতে মনুষ্য জন্ম নয়।

এটুকুই বুঝতে শিখেছি নিজস্ব গতির মধ্যে। ধীরে ধীরে বড় হয়ছি। কত ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে চেনা সেই মানুষগুলোর পথ চলার সঙ্গে নিজেও এগিয়ে চলেছি। কিন্তু সকলে সেই শুভ পথে হাঁটতে পারেননি। অনেকের পদস্খলন দেখেছি। আবার অনেকেই হাজার চড়াই উতরাই পেরিয়েও নিজের বিশ্বাস আদর্শ থেকে একবিন্দুও সরে দাঁড়াননি- তাদেরই একজন আমাদের শ্রদ্ধার ভালোবাসার মানুষ কামাল লোহানী। আমাকে “তুই” বলে সম্বোধন করতেন। এতেই বোঝা যায় সম্পর্কের গভীরতা। এমন সহজ সরল কাছের মানুষের কথা লেখা ততধিক কঠিন। তাঁর মেয়ে বন্যার বারবার অনুরোধেই কলম ধরেছি। আবেগতাড়িত হয়ে লেখাটা কষ্টসাধ্য।

লোহানী ভাই সর্বাঙ্গীন একজন সুন্দর মানুষ। ঋজু দীর্ঘদেহ। মাথাভর্তি চুল। গভীর চোখ, উন্নত প্রশস্ত কপাল। চলাফেরা সাবলীল। কথাবার্তা স্পষ্ট, শ্বেতবস্ত্র পরিচ্ছদে হাজার মানুষের মাঝেও আলাদা একটা মাত্রা যোগ হতো। এটা সবাইকে কাছে টানত। অনেক সৃজনশীল মানুষের কাছাকাছি হয়তো হওয়া যায় না। কিন্তু এই বিরল গুণটি তার ছিল। তাইতো তিনি একাধিক কাজে নিজেকে অনায়াসে সম্পৃক্ত করতে পেরেছিলেন।

কামাল লোহানী নামটার মধ্যেই একটা ঝংকার আছে।

একটা ছন্দ দোলা দেয়। এবং বাংলাদেশে লোহানী পদবিটি শুধু নির্দিষ্ট একটি বংশই বহন করে চলেছে। যেমন ফজলে লোহানী, ফতেহ লোহানী। এবং তারা সকলেই দারুণ সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ। বিশেষত্বটি বহন করে একটি পরিবারে। সেটা আমরা দেখে আসছি। লোহানী ভাই সত্য সুন্দরের জন্য লড়েছেন সেই ভাষা আন্দোলন থেকে! তখন তিনি কিশোর। ১৯৫২-তেই ম্যাট্রিক পাস করেছেন। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের পাবনা সফরের প্রতিরোধ ও মুসলিম লীগ সম্মেলন ভণ্ডুল করে দেয়ার অপরাধে কারাবরণ করেন। আবার ’৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের হয়ে কাজ করার অপরাধে গ্রেফতার হন। যুক্তফ্রন্টের নিরংকুশ বিজয়ে সরকার গঠন করার পর পাকিস্তানের কুশাসনের নজির ভারত শাসন আইনের ৫৪ (ক) ধারা জারির মাধ্যমে প্রাদেশিক পরিষদ ও মন্ত্রিসভা বাতিল করার পর আবারও কামাল লোহানী কারারুদ্ধ হন। কিন্তু কৈশোরে মা-হারা ছেলেটি কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা না করে আপন বিশ্বাসে, জেদি মনোভাব নিয়ে অসাধারণ যাপিত জীবন বেছে নিয়েছিলেন। ’৬২-এর শিক্ষানীতি ও সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় কামাল লোহানী বিবাহিত যুবক। প্রথম সন্তান সাগরের বয়স যখন তেরো দিন আবার গ্রেপ্তার হলেন। সংসার তাকে সংগ্রাম থেকে দূরে সরাতে পারেনি।

সাংসারিক তথা পরিবারিক বেষ্টনীতে তিনি কেমন ছিলেন সেটা খুব মনোমুগ্ধকরভাবে প্রকাশ করেছেন তার সত্তরতম জন্মতিথিতে স্ত্রী দীপ্তি লোহানী। ‘আমি কিন্তু ওকে একজন জেদি মানুষ হিসেবে জানি। কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তাকে সেই কাজ করতেই হবে। এই জেলে, এই বেকার, আবার পুলিশি নজর এড়িয়ে চলা ইত্যাকার কারণে তিনি তো হয় কারাগারে না হয় পলাতক, আমার অবস্থা সারা।’ কেমন মায়া মমতা জড়ানো ভালোবাসার মানুষটি সম্পর্কে আমাদের দীপ্তি বৌদি কত কথা লিখে গেছেন। সেই একান্ত পারিবারিক জীবনটা কত ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে প্রতিকূলতাকে সরিয়ে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল সেটা আমরা কাছ থেকে দেখেছি। একদিনের একটি ঘটনা বলি। একটি অনুষ্ঠানে লোহানী ভাইয়ের পাশে বসে উপভোগ করছি হঠাৎ বললেন ‘যাইরে তোর বৌদির গোসলের সময় হয়েছে।’ আমরা জানি, তার স্ত্রী বেশ কয়েক বছর অসুস্থ ছিলেন। সব কিছু করিয়ে দিতে হতো। হাজার কাজের মাঝেও স্ত্রীর পরিচর্যা করতে কখনো ভুল হয়নি। এই মমতা মাখানো ভালোবাসায় ভরপুর একান্ত নিজস্ব জীবন সেখানেও লোহানী ভাই পরিপূর্ণ ছিলেন। অসম্ভব সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল কামাল লোহানীর। বিচিত্র তার গতিবিধি। যাতে হাত দিয়েছেন সোনা ফলিয়েছেন। একজন রাজনীতিক, সাংবাদিক যে সমান তালে সাংস্কৃতিক আন্দোলনে চর্চায় আজীবন মেতে থাকতে পারেন সেটা প্রায় অবিশ্বাস্য! সেই পঞ্চাশের দশকে সংস্কৃতি সংসদের সংশ্লিষ্টতা দিয়ে পথচলা শুরু। বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন কমিটি তার ফলস্বরূপ ছায়ানটের জন্ম। সেই শুরুতেই ঔপনিবেশিকের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক আন্দোলন তথা বাংলা ভাষা ও বাঙ্গালিত্বকে বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রামের হাল ধরলেন লোহানী ভাই। প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও অসীম ক্ষমতাবলে প্রাণপ্রাচুর্যে উজ্জ্বল ভরপুর যুবক কামাল লোহানী ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদকরূপে দুবছরেই সংগঠনকে একটি মর্যাদার আসনে পৌঁছে দিয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় সে কথা এখনকার প্রজন্মকে সেভাবে অবহিত করা হয়নি।

কজন জানে বুলবুল ললিতকলা একাডেমির উদ্যোগে নৃত্যনাট্য ‘শ্যামার’ বজসেনরূপে নেচেছিলেন উন্নতকান্তি লোহানী ভাই। গান গাইতেন না কিন্তু গণনাট্য সংঘের গানগুলি তাকে উদ্যোগী করে তুলেছিল গণসঙ্গীতের প্রতি। তিনি বিশ্বাস করতেন সাধারণ মানুষের জাগরণের রূপটি তুলে ধরা যায় নাটকে সঙ্গীতে নৃত্যে। এই আস্থা থেকে পরবর্তীকালে অনেকে সরে এসেছেন কিন্তু লোহানী ভাই তার নিজস্ব চিন্তাধারা থেকে তিল পরিমাণ সরে আসেননি। কোনো মধ্যবিত্তসুলভ মনোভাবে তিনি কখনোই বিভ্রান্ত হননি। এটা সত্যিই দুর্লভ। ১৯৬৭তে একান্ত নিজের চিন্তার প্রতিফলন দেখি তার উদ্যোগে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংস্থা ক্রান্তির প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। কামাল লোহানীর নেতৃত্বে ও পরিচালনায় কয়েক বছরের ব্যবধানে একের পর এক নৃত্যনাট্য, জ্বলছে আগুন ক্ষেতে খামারে, গীতিনকশা ‘ধানের গুচ্ছে রক্ত জমেছে’ নাটক ‘আলোর পথযাত্রী’ মঞ্চস্থ হয়। সবই ক্রান্তির পরিচালনায়। আয়ুব বিরোধী তথা সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের সেই উত্তাল দিনগুলোতে ’৬৭, ’৬৯-৭০-৭১-এ তিনি তাঁর ক্রান্তিদল নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের শহর বন্দর গ্রামগঞ্জে গণসংগীত শুনিয়েছেন এদেশের আপামর জনসাধারণকে। এভাবে সাংস্কৃতিক আন্দোলন অনেক ক্ষেত্রে তৎকালীন রাজনৈতিক আন্দোলনকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। সঙ্গীত নৃত্য নাটক যে মানুষের মুক্তির হাতিয়ার একথা তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে গেছেন আজীবন। পরবর্তীকালে গণশিল্পী সংস্থার মূল কর্ণধার রূপে আপন, বিশ্বাসে অটল থাকেন। তাইতো জীবনের শেষ প্রান্তে উদীচীর মতো গণমানুষের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সভাপতির পদ অলংকৃত করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। তিনি শহীদ আলতাফ মাহমুদ সংগীত বিদ্যানিকেতন প্রতিষ্ঠা করেন। রাজশাহী চারুকলা মহাবিদ্যালয়েরও প্রতিষ্ঠাতা কামাল লোহানী। এমনটা সহসা দেখা যায় না।

কামাল লোহানীর পেশাগত পরিচয় তিনি একজন মুক্তমনা সাংবাদিক। দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে তিনি সর্বোচ্চ পদ অলংকৃত করেছেন। তার ক্ষুরধার লেখনিতে দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক নানা বিষয় উজ্জ্বল স্বাক্ষর বহন করে। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউটের গুরুত্বপূর্ণ পদ অলংকৃত করেন। বিস্মিত হতে হয় যখন দেখি শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া দুই বৈরী মনোভাবের প্রধানমন্ত্রীত্ব কালে লোহানী ভাই বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক। এই মানবিক পরিচয় বহনকারী মানুষটির আপন চিন্তা-চেতানারই প্রতিফলন দেখেছি তাঁর কাছে। তবে তাঁর সবচাইতে বড় ভূমিকা ও কৃতিত্ব হলো একাত্তরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কাজের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া। তিনি তাঁর উদাত্ত কণ্ঠে সংবাদপাঠ করতেন এবং বার্তা সম্পাদক হিসাবে নিজ দায়িত্ব পালন করেছেন। লোহানী ভাই বাংলাদেশের সবচেয়ে গৌরবময় দিন ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে দেশের আপামর জনসাধারণ যে বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে এসেছিল সেই চূড়ান্ত মুহূর্তের বিজয়বার্তা পাঠ করেছিলেন। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হয়? পর পর তিনবার তাঁর কণ্ঠে আমরা ঐতিহাসিক তিনটি ধারাভাষ্য শুনতে পাই। ’৭১-এ স্বাধীনতার পর ২২শে ডিসেম্বর কলকাতা থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী সর্বজনাব তাজউদ্দিন আহমদসহ সরকারের মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকায় আগমনের ধারাবিবরণী ১৯৭২-এর ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশে পদার্পণের সেই আনন্দাশ্রুর বিশেষ মুহূর্তের আবেগঘন ভরাট কণ্ঠের ধারাভাষ্য আজও কানে ভাসে। আবার ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধুর কলকাতা সফরকালে ক্যালকাটা প্যারেডগ্রাউন্ডে সভায় তিনিই উদ্বোধনী ঘোষণা দেন।

১৯৭২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনার থেকে রাতব্যাপী ধারাবর্ণনা তাঁরই কণ্ঠে উচ্চারিত হয়। প্রসঙ্গত বলে রাখি ১৯৬৩ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষাসৈনিকদের স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কামাল লোহানী তাঁর আবেগঘন কণ্ঠে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর সেই বিখ্যাত কবিতা কুমড়ো ফুলে ফুলে/নুয়ে পড়েছে লতাটা, ... খোকা তুই কবে আসবি/কবে আসবিই আবৃত্তি করে হাজার হাজার মানুষকে চোখের জলে ভাসিয়েছিলেন। অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেছিলেন শহীদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম এবং জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে যখন তিনি তাঁর দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন প্রায় চলচ্ছক্তিহীন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জে নিজ জন্মভূমিতে সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজ মাঠে জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন পরিষদের ঊনচল্লিশতম বার্ষিক অধিবেশনে ৬ই মার্চ ২০২০ প্রধান অতিথির ভাষণ দেন। সেই একছাটের লম্বা ফুলের পাঞ্জাবি, ঢোলা পায়জামা শ্বেত শ্রভ্র কেশ, দেহ কিছুটা নুয়ে পড়েছে কিন্তু চেহারার উজ্জ্বলতা হারাননি, উদাত্ত কণ্ঠে এদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে সঠিক পথে অগ্রসর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সেদিনই লোহানী ভাইয়ের সঙ্গে আমার শেষ দেখা। এদেশের সকল রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কিংবদন্তিসম সাক্ষী ও অংশগ্রহণকারী আর কোনো ব্যক্তিত্ব আছে বলে জানি না।

ত্রিকালদ্রষ্টা কামাল লোহানী এক ব্যতিক্রমী মানুষ হয়েই ছিলেন। নষ্ট সমাজ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মানবতার মৃত্যু, বাংলার মন্বন্তর দাঙ্গা দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা বেকারি, এসবের আঁচ বহন করেছেন। তিনিও ১৯৪৮ সালে কলকাতা থেকে এক প্রকার উদ্বাস্তু হয়ে পাবনায় আসেন। তারপর ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ’৫৮’র সামরিক শাসন, ’৬২’র সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ’৬৪’র দাঙ্গা, ’৬৫’র ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের খেলা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের গণজোয়ার ও তারপর বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ তাকে মনেপ্রাণে একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক বাঙালি তৈরি করেছিল। সেটা তার চলনে বলনে আহারে বিহারে গৃহে সর্বত্র প্রকাশিত। শূন্যতা বোধ নিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম কিন্তু শেষে এসে কেমন ইতিবাচক মনোভাবের অবয়ব অনুভব করছি। সেটা নিয়েই মানুষ বাঁচে। ঠিক এক বৎসর আগে ২০ জুন কামাল লোহানী অন্য এক লোকে পাড়ি দিয়েছেন। আজ তাঁকে আমার এই ছোট অর্ঘ্যে শ্রদ্ধা ভালোবাসা জানালাম। জগতের আনন্দযজ্ঞে তিনি নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন। তাই তাঁর মানবজীবন ধন্য। সার্থক।