আবুল কাসেম
(পূর্ব প্রকাশের পর)
পনেরো.
সম্রাজ্ঞী তেইশেই সেই শোনাগনকে বললেন, তুমি সব কিছুকে এত হালকাভাবে নাও কেন? তোমাকে সম্রাটের সামনে কবিতা পড়তে হবে, তুমি ডায়েরিটাই ফেলে গেছো। ইঝোমির নাম তো আগে শুনিনি এত। আমাদেরকে কী বেকায়দায়ই না ফেলেছে। ভাগ্য ভালো সম্রাট আর সময় দিতে পারেননি, তাহলে আরো সর্বনাশ হতো।
সেই শোনাগন বললেন, ক্ষমা করবেন মহামান্যা, এমন ভুল আর হবে না। আপনার স্তুতিমূলক একটি নিবন্ধ ছিল হাতে। সম্রাটের প্রশংসা করে তা শুনিয়ে দিতাম। সম্রাট তার জ্যেষ্ঠ সম্রাজ্ঞীর গুণের প্রশংসা শুনে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠবেন।
তিনি সেদিন বৃষ্টির কবিতা শুনতে চেয়েছিলেন।
হ্যাঁ, মহামান্যা তাই ছিল চিন্তার বিষয়। ইঝোমি উপস্থিত কবিতা লিখতে পারে, তা জানা ছিল না। ভালো লেখে সে।
এদিকে ঘন হয়ে এসো। সম্রাটের কানে তুলে দিয়েছি, ইঝোমির সময় ফুরোলো বলে।
তাকে নিয়ে আসলেই ভাবনা হচ্ছে।
আর ভাবতে হবে না তোমাকে। শোশির বিষদাঁত ভেঙে দেব আমি। তার অহংকার চূর্ণ না করে আমার শান্তি নেই।
প্রিন্স মিচিনাগা তাঁর পেছনে আছেন।
হ্যাঁ, আমার চাচা। তিনি আমার সর্বনাশই চান। প্রাসাদ থেকে আমার ভাইকে পর্যন্ত তাড়িয়েছেন।
সম্রাটকে আপনার হাতে রাখতে হবে, আমার সম্রাজ্ঞী।
তাই করছি আমি। অন্য তিন স্রীকেও দলে টানতে চাচ্ছি। সমস্যা হচ্ছে এরা মিচিনাগাকে ভয় পায়। কিন্তু শোশিকে নিয়ে যে সন্তুষ্ট তা কিন্তু নয়।
আপনাকে প্রাসাদ এবং সম্রাটের লোকজন শ্রদ্ধা করে।
তোমার জন্যও আমার সম্মান মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। এখানকার বনেদী এবং অভিজাত মানুষেরা তোমার লেখা পছন্দ করছে। আমার সঙ্গে তুমি আছো বলে আমাকেও শ্রদ্ধা করছে। সম্রাটও শ্রেষ্ঠ সম্রাজ্ঞীর সম্মান দিচ্ছেন।
আপনি এ আস্থাই রাখুন মহামান্যা।
আমার আস্থা আছে। এতক্ষণ তুমি কি করছিলে!
কবিতা লিখছিলাম সম্রাজ্ঞী।
শেষ করেছ?
একটু সময় লাগবে।
আমি শুনব তোমার কবিতা, শেষ কর।
সেই শোনাগন কবিতা লিখছিলেন সত্য, তবে তা একটি পত্র কবিতা। আগে থেকেই চলছিল কবিতা পত্র দেয়া নেয়া। এখানে এগুলোর পরিচয় দেয়া যেতে পারে।
সময়মত প্রিয়জন আসেননি। পরে এলে সাক্ষাৎ দেননি। তাই প্রিয়জন পত্রে তাঁকে ‘পাষাণ হৃদয়’ বলেছেন। তার প্রত্যুত্তরে সেই শোনাগন লিখেছেন :
‘অবাক কাণ্ড!
কীভাবে পাষাণ হৃদয় বললে?
আমাকে এই তুমি জেনে ছিলে?
ওয়াদা রক্ষা করনি তুমি
কে তোমার শিখিয়েছে? অবাকই হচ্ছি আমি!’
প্রিয়জন ক্ষোভে, অভিমানে আসছেন না। এবারে কবিতাপত্রে লিখলেন :
‘পরিত্যক্ত হওয়া
নিয়তি আমার
আমি তা ভালোভাবেই জানি
তবুও বুঝে উঠতে অক্ষমতা মানি
ফল: অশ্রুতে ভেসে যাওয়া।’
সেই শোনাগন প্রিয়জনকে গোপন করেছেন। অন্য তিনজন, বিশেষ করে কবি ইঝোমি কিছুই গোপন করেননি।
সম্রাজ্ঞী তেইশেই ডাকলেন আবার তার লেডি-ইন-ওয়েটিংকে। বললেন, কী লিখেছ শোনাও।
সেই শোনাগন আগের লেখা একটি কবিতা শুনিয়ে দিলেন। কবিতাটি এ রকম:
‘ঢেউ যখন তলানিতে
তলদেশে মৎস্য ঝাঁক
কাউকে বলো না যেন
সমুদ্র শৈবাল খেয়ে কেন
খোঁজ তুমি চিহ্ন তার, অবাক ব্যাপার।’
সম্রাজ্ঞী খুশি হয়ে গেলেন কবিতা শুনে। ভাবলেন, এবারে ইঝোমি বা ইমন কেউই সেই শোনাগনকে হারাতে পারবে না।
ইমন আবারো সমস্যায় পড়েছেন। সম্রাজ্ঞী শোশি তার যোদ্ধা লেডি-ইন-ওয়েটিংকে হারিয়ে ফেলে দিক-বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ইমনের ওপর রাগ ঝাড়ছেন। ইমন বললেন, মহামান্যা, সে আর আসবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে।
কেন আসবে না? তার সমস্যা কী?
সাংসারিক ঝামেলা হয়েছে। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।
তা হলে তো এখন আরো বেশি আসার কথা, পিছুটান নেই।
তাকে খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না এখন। শেষ বার এসেছিল দরবারে আসবে না একথা জানাতে। তখন উ™£ান্ত মনে হয়েছিল তাকে।
তুমি লোক লাগাও। তাকে আমার খুব প্রয়োজন।
ইঝোমি আছেন প্রিন্স তামেতাকার প্রাসাদে। আনন্দেই আছেন। প্রিন্স তাকে প্রেমদেবী বলে মেনে নিয়েছেন। তার পূজাই করছেন।
এ সময় সম্রাজ্ঞী শোশির দূত এসে হাজির। ইঝোমি খুব বিরক্ত হয়ে কথা বলতে যাচ্ছিলেন। তামেতাকা তাকে থামালেন। বললেন,
আমি কথা বলছি। তুমি ভেতরে যাও। দূতকে বললেন, ইঝোমি খুব অসুস্থ। কী বলতে কী বলে তার ঠিক নেই। সে সুস্থ হলে যাবে। তুমি গিয়ে বুঝিয়ে বলো। নাও, এ প্যাকেটটা রাখো। বুঝিয়ে বলবে কিন্তু। ভুল করবে না।
দূত চলে গেলে ইঝোমি বললেন, ভুল বললেন কেন? আমি তো সুস্থই আছি। আমি সম্রাজ্ঞীর দরবারে আর যাব না বলেই তো দিয়েছি।
আমাকে ভুল বুঝো না লক্ষ্মীটি। তুমি জেঁদ করলে সম্রাজ্ঞী শোশি জোর করবেন। তার বাবা মিচিনাগাকে তোমার পেছনে লাগাবেন। ব্যাপারটা অশান্তিকর হতে পারে। সম্রাট নাকি মিচিনাগাকে প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছেন। এটিই বাকী ছিল। তিনি এত শক্তিধর যে, চাইলে আমাদের জীবন অতীষ্ঠ করে তুলতে পারেন। তাই আমাদের কৌশলী হতে হবে।
ইঝোমি বললেন, কতদিন মিথ্যে অভিনয় করতে হবে?
হয়ত বেশি দিন না। দেখা যাক।
তাৎক্ষণিকভাবে ইঝোমি একটি কবিতা লিখে ফেলেন।
কবিতাটি এরকম:
‘এটা তো ভ্রমণ অযোগ্য পথ নয়
যদিও কিছু অজুহাত আছে
ইতাদা সাঁকোর ওপর
উঠেছি আমি অনেকবার
পা রাখতে হবে আরেকবার। এই যা।’
মুরাসাকির সংসার ‘ভালো’ লাগছে। স্বামী নোবুতাকা মাঝে মাঝে আসেন। বাবা চলে গেছেন। নোবুনোরিকে নিয়ে গেছেন। একা একা সময় কাটতে চায় না মুরাসাকির। স্বামীকে আসার জন্য মাঝে মধ্যে তাগিদপত্র পাঠান। কিন্তু তা কোনো দূরবর্তী ইশারায় রূপক প্রতীকে।
‘আমি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবই’।
তিনি অন্তরে তা অনুভব করেন।
মাতসুরায় কাটে দিন
আয়নার দেবতা কি
দেখতে পান সেই সব আকাশ, অবাক আমি
কলির কৃষ্ণ নোবুতাকা। কথা দিয়ে কথা রাখেন না। তাতে মুরাসাকির বিরহ বাড়ে। একা ছিলেন সেই ভালো ছিলেন, মাঝে-মধ্যে এ কথা মনে হয়। সঙ্গে সঙ্গে হাজারো চিন্তা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা মনের মধ্যে ভিড় করে। নৃত্যে-নটরাজ নোবুতাকার প্রতি বহু নারীর আগ্রহ, কৃষ্ণলীলায় মত্ত? তিনি শপথ করেছেন। কিন্তু পুরুষ শপথ করে শপথ ভাঙ্গার জন্য। এসব ভেবে অস্থির লাগছে তার।
ইচিঝেনের কথা মনে করার চেষ্টা করলেন। ভালো ভালো মুহূর্তগুলো, স্মৃতিগুলোও এখন ভালো লাগছে না। বই নিয়ে বসলেন। মনোসংযোগ হচ্ছে না। সুন্দর সুন্দর ক্যালিগ্রাফির লেখাগুলো যেন দৃষ্টির সীমা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। উদাস হয়ে যাচ্ছেন তিনি।
এ সময় দরজার টোকা পড়ল। ভাবলেন তাহলে এসেছেন আয়নার দেবতা। দরজা খুলে দিল দাস দাসীদের একজন। মুরাসাকি সাজপোষাক ঠিকঠাক করলেন। মাথার লম্বা চুল আঁচড়ে নিয়ে নিজেকে আয়নায় দেখলেন, প্রেমদেবী আফ্রোদিতের মতোই লাগছে।
কিন্তু হায়! মেয়েটি সংবাদ দিল আকাঝোমি ইমন এসেছেন।
বসতে বলো। বলে একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস গোপন করলেন। মনের দুঃখমেঘ তাড়িয়ে হাসি-খুশি এসে ইমনকে স্বাগত জানালেন মাথা নত করে।
ইমন বললেন, বিয়ের পর তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে। নোবুতাকা সান ব্যস্ত মানুষ। আর এই সম্রাটের দরবারে অনুষ্ঠানাদি লেগেই থাকে। ঐতিহ্যবাহী উৎসবগুলো তো আছেই।
সম্রাজ্ঞী মোশি কেমন আছেন?
তিনি ইঝোমিকে নিয়ে সমস্যায় আছেন।
ইঝোমির কী হয়েছে?
তুমি তা হলে কিছুই জানো না? তার তো স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। বাবা-মা ত্যাজ্যকন্যা করে দিয়েছেন।
কেন?
প্রিন্স তামেতাকার সঙ্গে
একটু শুনেছিলাম।
শোশির দরবারে আসাও বন্ধ করে দিয়েছে।
মেয়েটা কোথায়?
তার স্বামী নিয়ে গেছে।
সে সামলে নেবে সবকিছু, সাহস আছে।
সমস্যা আরো আছে। সম্রাজ্ঞী তেইশি সম্রাটের কানে তার বিরুদ্ধে বলে তার অবস্থানটা খারাপ করে দিয়েছেন। সম্রাট তার কবিতা পছন্দ করতেন।
সেদিন তো দেখলাম।
তোমার কবিতাটি যেমন ভালো ছিল, পড়েছও চমৎকার।
মুরাসাকি হাসি দিয়ে বললেন, ধন্যবাদ। আপনি কিন্তু সেদিন আমাদেরকে ফাঁকি দিয়েছেন।
সুযোগ পেলাম কোথায়? এখন শুনবে?
কী সৌভাগ্য আমার।
ইমন পাঠ করলেন :
‘অতএব, তখন, তাই হবে।
নারুমিতে যখন, ভুলে গেছ?
আমি কি আমার ঘর বানাবই!
নাকি দূর থেকে দূরে হারাবই?
যন্ত্রণার শীর্ষে থাকা ব্যাকুল প্রতীক্ষায়’
অসাধারণ, অদ্ভুত! বললেন মুরাসাকি।
কাগেরো নিক্কি পড়ে লিখেছিলাম। তোমার জন্য নিয়ে আসতে পারতাম। এনেছি অন্য বই, রোমান্টিক প্রেমের কবিতা। ভালো করিনি?
মুরাসাকি ইমনের কথায় শুধু হাসলেন।
ষোলো
মিচিনাগা প্রাক্তন সম্রাট রেইঝেই এর প্রাসাদে গেছেন। প্রাক্তন সম্রাট রাশভারী মানুষ। বয়সও হয়েছে। মাত্র দুই বছর সম্রাট ছিলেন। তারপরই সিংহাসন ছেড়ে দেন। সিংহাসন ছেড়ে অবসরে আছেন প্রায় ত্রিশ বছর হলো। শরীর স্বাস্থ্য ভালোই আছে।
মিচিনাগার আসার কথা শুনে ভেতর থেকে বের হয়ে এলেন। বললেন, এত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এখানে?
আপনার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ না। বর্তমান সম্রাটের থেকে আপনার মর্যাদা বেশি বলে আমরা সবাই মনে করি।
মাত্র দু’বছরে মনে রাখার মতো আর কী করেছি, তাও আবার প্রায় ত্রিশ বছর আগে।
স্বেচ্ছায় সিংহাসন ত্যাগ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, এরকম নজির কি আছে? না নেই।
এখন বল আগমনের কারণ কী?
আপনাকে দেখতে এসেছি।
রেইঝেই মনে মনে বললেন, কোনো কারণ ছাড়া তুমি আমাকে দেখতে আসার মানুষ। মুখে বললেন, সৌভাগ্য আমার। সাধারণত ফুজিওয়ারাগণ গেঞ্জি গোত্রের লোকদের অতটা গুরুত্ব দেয় না। রেইঝেই গেঞ্জিগোত্র থেকে এসেছেন। অবশ্য তাঁর মা ফুজিওয়ারা। তার পাঁচ স্ত্রীও ফুজিওয়ারা গোত্রের। মনে হয় এই গোত্রগত সম্পর্কই তাকে ফুজিওয়ারাদের কাছে মূল্যহীন করে দেয়নি।
তবে মিচিনাগা এসেছেন আসলেই একটা উদ্দেশ্য নিয়ে। প্রাক্তন সম্রাটের কাছে কিছুটা এগিয়ে এসে বসে কিমোনো ঠিকঠাক করে বললেন, মহামান্য, প্রিন্স তামেতাকা-
মুখ থেকে কথা টেনে নিয়ে রেইঝেই বললেন, আমি বুঝতে পেরেছি তুমি কী বলতে এসেছ। হেইয়ান কিউতে এটা নতুন কিছু নয়। মেয়েটা সব ছেড়েছুড়ে চলে এসেছে। বাবাও ত্যাজ্য করে দিয়েছে। এই অবস্থায় সে যাবে কোথায়?
কেন, সম্রাজ্ঞী শোশির দরবারে, তার প্রাসাদে।
ওটা তার চাকরির স্থল, স্বামীর সংসার নয়।
সম্রাট তার সম্পর্কে বাজে ধারণা নিয়ে বসে আছেন।
তোমার মেয়ের জন্য তো তা আরো বাজে হতে পারে।
তা পারে। সমস্যাটা অন্য জায়গায়।
তাও আমি জানি।
তাহলে সমাধান?
কিছুদিন যেতে দাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।
সম্রাজ্ঞী এত সময় ধৈর্য ধরবেন বলে মনে হয় না।
সে তো তোমার মেয়ে তুমি বুঝাও।
এমন গুণবতী কবি কোথায় পাব বলুন।
একটা মধ্যস্থতা হতে পারে।
মিচিনাগা উৎসাহী হয়ে বললেন, কী?
রেইঝেই বললেন, একজন প্রিন্সের সঙ্গিনী সম্রাজ্ঞীর সহকারী হতে পারে না। তার মর্যাদা তা অনুমোদন করে না।
তুমি বরং তাকে চাকরি থেকে মুক্ত করে দাও। সে সম্রাজ্ঞী শোশির দরবারে প্রিন্সেস হিসেবে যাবে, মাঝে মধ্যে সময় দেবে এবং প্রয়োজন হলে সম্রাটের অনুষ্ঠানে কবিতা পড়ে আসবে।
তাহলে তো সে সম্রাজ্ঞী শোশির লেডি বলে বাইরে স্বীকৃত হবে না।
তা হবে না। কিন্তু শোশির প্রিয়ভাজন বলে তো স্বীকৃত হবে। তা কম কী?
মিচিনাগার ক্ষমতা অনেক। কিন্তু এখানে কোনো হস্তক্ষেপ করা যাবে না। এই ব্যাপারটা তিনি ভালোভাবেই জানেন। তাই প্রায় অনুনয় করে বললেন, আপনি চাইলে সবই হয়। আমি কি তামেতাকার সঙ্গে কথা বলব?
আমি যা বলেছি, সেও একই কথা বলবে। কোনো লাভ হবে না, সে এতে আরো ক্ষিপ্ত হবে। তোমার সম্মানহানি ঘটবে। তুমি কি জানো আমি তোমাকে কেন পছন্দ করি? এ জন্য যে, তুমি ব্যাপারটা নিয়ে আমার কাছে এসেছ। তামেতাকার কাছে নয়। তোমার এটুকু বুঝবার ক্ষমতা আছে যে, তোমার কোথায় যাওয়া উচিত।
এই প্রাক্তন সম্রাটের কাছে যুক্তিতে হেরে মিচিনাগা প্রাসাদে ফিরে গেলেন, এবং বুঝতে পারলেন যে, নিজের মেয়ের গৌরবের জন্য যা করছেন, অন্যায় জেনেও আরেকজন পুত্রকে রক্ষার (প্রটেক্ট) জন্য তা করছেন। কন্যার জন্য দুঃখ হচ্ছে।
দুঃখ হচ্ছে ইঝোমির বাবারও তিনি বুঝতে পারছেন না ইঝোমি এমন হয়ে গেলেন কেন? তিনি মেয়েকে সামলাতেও কি ভুল পথ ধরেছেন? তা করে তার গৌরব বাড়েনি, পরিবার থেকে পরিত্যাগ করায় যেমন নিজে কষ্ট পেয়েছেন, তেমনি সমালোচিতও হয়েছেন প্রচুর। সামাজিকভাবে খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তামেতোকির সঙ্গেই বেশি ভাব। কিন্তু তিনি আছেন ইচিঝেনে। কারও সঙ্গে পরামর্শ করবেন সে অবস্থা নেই। শ্বশুরও চলে গেছেন তার প্রদেশে, যেখানে গভর্নর তিনি।
সেখানেও সংবাদটা গেছে। খারাপ খবর গোপন থাকে না। যেন মাছির পায়ে পাখায় গন্ধ ছড়ায়। ফলে তাকেও মনমরা হয়ে ঘরে বসেই থাকতে হয় বেশি সময়।
সবচেয়ে বেশি সমস্যায় ইঝোমির প্রাক্তন স্বামী মিচিসাদা। কোনো কাজে মন বসাতে পারছেন না। প্রাসাদেই কাটে দীর্ঘ সময়। কন্যাকে প্রবোধ এবং সান্ত¡না দেয়া এখন তার প্রধান কাজ। সহকর্মীদের মনে নানা প্রশ্ন। কেমন করে যেন সবাই তাকায়। রাগের মাথায় মনে হয় মেয়েটার ক্ষতি করে ফেলেছেন। পরক্ষণেই ভাবেন বিকল্প কি ছিল? মনের ভেতর থেকেই উত্তর আসে, ছিল, নানা বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া যেত। তা ছিল মেয়ের যথার্থ ঠিকানা। রাগের মাথায় কোনো কাজ করা ঠিক না, সিদ্ধান্ত সঠিক হয় না।
আরো সমস্যা হচ্ছে, প্রদেশটার নামে নাম ইঝোমি। সবসময় তাকে এ নামটা উচ্চারণ করতে হয় এবং মেয়ের কাছে বিব্রত অবস্থায় পড়তে হয়। তা এমন এক সমস্যা যে সমস্যার শেষ নেই।
ইঝোমি এখন তামেতাকাকে নিয়ে বেশ আছেন। কোনো পিছুটান নেই। তামেতাকা অন্য প্রিন্সদের মতো এতটা স্বার্থপর নন। যথেষ্ট মানবিক এবং বিবেচনাবোধসম্পন্ন। প্রাক্তন সম্রাট রেইঝেই তাই তার এই থার্ড প্রিন্স বা তৃতীয় যুবরাজকে পছন্দ করেন। তার সম্রাজ্ঞী এবং অন্যান্য পুত্রকন্যারা সম্রাটের পদ ছেড়ে দেয়ায় তাদের স্বার্থ নষ্ট হওয়ায় অনেক কথাই বলেছেন। কিন্তু এই প্রিন্স একটি প্রশ্নও করেননি। আজও না। তখনই রেইঝেই বুঝেছেন এই ছেলে হয় বোকা, না হয় অতিমাত্রায় বুদ্ধিমান। বুদ্ধিমানই। তবে অভাব আছে। কিন্তু তা ইঝোমিকে বুঝতে দেন না। কবি ইঝোমি ছন্নছাড়া কবি না, ভোগ করতে যেমন পছন্দ করেন, সাজসজ্জা এবং জীবনযাত্রায়ও উচ্চমার্গীয় ফ্যাশন সচেতন। দামি পোশাকও একবারের বেশি পরিধান করেন না।
প্রাক্তন সম্রাট রেইঝেই এর তা অপছন্দ করার কথা, না তা তিনি বরং পছন্দই করেন। কবি মেয়েটাকে তার ভালো লেগে গেছে।
এই সম্রাটের সুবিধাবঞ্চিত অন্য ছেলেমেয়েরা ধরেই নিয়েছেন তাদের পিতা বদ্ধপাগল, না হয় কেউ সিংহাসন ছেড়ে দিয়ে আসে। অবশ্য তার উত্তরাধিকারীরা ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেনি, ছিটকে গেছেন। তারা এখন সকলেই ভাবছেন, ইঝোমি এবং তামেতাকাকে প্রশ্রয় দেয়া আরেকটা পাগলামি।
কবি ইঝোমিকে যারা প্রেমপাগলী বলে কলঙ্ক লেপন করতে চাইছেন, তারা দেখছেন ইঝোমি বেশ সুখেই আছেন। এখন বোধ হয় ঈর্ষাই হচ্ছে তাদের।
তবে ইঝোমির সাহিত্য চর্চাটা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। প্রিয়জন অতি নিকটে, কণ্ঠলগ্ন। কবিতাপত্র কাকে লিখবেন, দিন যায়, রাত যায়।
হঠাৎ একদিন প্রাক্তন সম্রাট রেইঝেই সংবাদ পাঠালেন দুজনকে। ভয়ে ভয়ে গেলেন তার কাছে। রেইঝেই বললেন, ইঝোমি, তুমি শোশির জন্য কবিতা লিখবে এবং মাঝে মধ্যে তার কাছে যাবে। কবিতা শোনাবে। লোকজন যেন মনে করে তুমি তার দরবারের সম্মানিত কেউ, তোমার উপস্থিতি তার দরবারের গৌরব বাড়াবে। আমি মিচিনাগাকে কথা দিয়েছি।
তাই হবে মহামান্য। বললেন, তামেতাকা।
ইঝোমি বললেন, আমি লিখতে ভুলে গেছি, মহামান্য। ভুললে চলবে কেন? আমি জানি তোমার দুঃখ আছে। তুমি মেয়েটাকে এনে নিজের সঙ্গে রাখো, এখানে কোনো অসুবিধে হবে না। আমি তামেতাকার সামনেই বলছি।
হ্যাঁ, বাবার কথাই আমার কথা। তোমার সন্তান প্রাসাদে বড় হলে আমাদেরও গর্বই হবে।
বুঝলে, গেঞ্জি গোত্রের মানুষ আমরা। ফুজিওয়ারাদের মতো গোত্র-গোষ্ঠী বিচার করি না, মানুষ মনে করে তার সহচর্য পেলে আর কিছু চাই না। নারী-পুরুষ সকলেরই জীবনযাত্রায় নিজস্ব পছন্দ অপছন্দ থাকবে, তার সমালোচনা করার, বাধা দেয়ার আমি কে। এখন তোমরা যেতে পারো।
ইঝোমি যেতে যেতে বললেন, ঠিক বাবার মতোই কথা। আমি তাকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করি, প্রিন্স। ক্রমশ...
বৃহস্পতিবার, ২৪ জুন ২০২১ , ১০ আষাঢ় ১৪২৮ ১২ জিলকদ ১৪৪২
আবুল কাসেম
(পূর্ব প্রকাশের পর)
পনেরো.
সম্রাজ্ঞী তেইশেই সেই শোনাগনকে বললেন, তুমি সব কিছুকে এত হালকাভাবে নাও কেন? তোমাকে সম্রাটের সামনে কবিতা পড়তে হবে, তুমি ডায়েরিটাই ফেলে গেছো। ইঝোমির নাম তো আগে শুনিনি এত। আমাদেরকে কী বেকায়দায়ই না ফেলেছে। ভাগ্য ভালো সম্রাট আর সময় দিতে পারেননি, তাহলে আরো সর্বনাশ হতো।
সেই শোনাগন বললেন, ক্ষমা করবেন মহামান্যা, এমন ভুল আর হবে না। আপনার স্তুতিমূলক একটি নিবন্ধ ছিল হাতে। সম্রাটের প্রশংসা করে তা শুনিয়ে দিতাম। সম্রাট তার জ্যেষ্ঠ সম্রাজ্ঞীর গুণের প্রশংসা শুনে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠবেন।
তিনি সেদিন বৃষ্টির কবিতা শুনতে চেয়েছিলেন।
হ্যাঁ, মহামান্যা তাই ছিল চিন্তার বিষয়। ইঝোমি উপস্থিত কবিতা লিখতে পারে, তা জানা ছিল না। ভালো লেখে সে।
এদিকে ঘন হয়ে এসো। সম্রাটের কানে তুলে দিয়েছি, ইঝোমির সময় ফুরোলো বলে।
তাকে নিয়ে আসলেই ভাবনা হচ্ছে।
আর ভাবতে হবে না তোমাকে। শোশির বিষদাঁত ভেঙে দেব আমি। তার অহংকার চূর্ণ না করে আমার শান্তি নেই।
প্রিন্স মিচিনাগা তাঁর পেছনে আছেন।
হ্যাঁ, আমার চাচা। তিনি আমার সর্বনাশই চান। প্রাসাদ থেকে আমার ভাইকে পর্যন্ত তাড়িয়েছেন।
সম্রাটকে আপনার হাতে রাখতে হবে, আমার সম্রাজ্ঞী।
তাই করছি আমি। অন্য তিন স্রীকেও দলে টানতে চাচ্ছি। সমস্যা হচ্ছে এরা মিচিনাগাকে ভয় পায়। কিন্তু শোশিকে নিয়ে যে সন্তুষ্ট তা কিন্তু নয়।
আপনাকে প্রাসাদ এবং সম্রাটের লোকজন শ্রদ্ধা করে।
তোমার জন্যও আমার সম্মান মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। এখানকার বনেদী এবং অভিজাত মানুষেরা তোমার লেখা পছন্দ করছে। আমার সঙ্গে তুমি আছো বলে আমাকেও শ্রদ্ধা করছে। সম্রাটও শ্রেষ্ঠ সম্রাজ্ঞীর সম্মান দিচ্ছেন।
আপনি এ আস্থাই রাখুন মহামান্যা।
আমার আস্থা আছে। এতক্ষণ তুমি কি করছিলে!
কবিতা লিখছিলাম সম্রাজ্ঞী।
শেষ করেছ?
একটু সময় লাগবে।
আমি শুনব তোমার কবিতা, শেষ কর।
সেই শোনাগন কবিতা লিখছিলেন সত্য, তবে তা একটি পত্র কবিতা। আগে থেকেই চলছিল কবিতা পত্র দেয়া নেয়া। এখানে এগুলোর পরিচয় দেয়া যেতে পারে।
সময়মত প্রিয়জন আসেননি। পরে এলে সাক্ষাৎ দেননি। তাই প্রিয়জন পত্রে তাঁকে ‘পাষাণ হৃদয়’ বলেছেন। তার প্রত্যুত্তরে সেই শোনাগন লিখেছেন :
‘অবাক কাণ্ড!
কীভাবে পাষাণ হৃদয় বললে?
আমাকে এই তুমি জেনে ছিলে?
ওয়াদা রক্ষা করনি তুমি
কে তোমার শিখিয়েছে? অবাকই হচ্ছি আমি!’
প্রিয়জন ক্ষোভে, অভিমানে আসছেন না। এবারে কবিতাপত্রে লিখলেন :
‘পরিত্যক্ত হওয়া
নিয়তি আমার
আমি তা ভালোভাবেই জানি
তবুও বুঝে উঠতে অক্ষমতা মানি
ফল: অশ্রুতে ভেসে যাওয়া।’
সেই শোনাগন প্রিয়জনকে গোপন করেছেন। অন্য তিনজন, বিশেষ করে কবি ইঝোমি কিছুই গোপন করেননি।
সম্রাজ্ঞী তেইশেই ডাকলেন আবার তার লেডি-ইন-ওয়েটিংকে। বললেন, কী লিখেছ শোনাও।
সেই শোনাগন আগের লেখা একটি কবিতা শুনিয়ে দিলেন। কবিতাটি এ রকম:
‘ঢেউ যখন তলানিতে
তলদেশে মৎস্য ঝাঁক
কাউকে বলো না যেন
সমুদ্র শৈবাল খেয়ে কেন
খোঁজ তুমি চিহ্ন তার, অবাক ব্যাপার।’
সম্রাজ্ঞী খুশি হয়ে গেলেন কবিতা শুনে। ভাবলেন, এবারে ইঝোমি বা ইমন কেউই সেই শোনাগনকে হারাতে পারবে না।
ইমন আবারো সমস্যায় পড়েছেন। সম্রাজ্ঞী শোশি তার যোদ্ধা লেডি-ইন-ওয়েটিংকে হারিয়ে ফেলে দিক-বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ইমনের ওপর রাগ ঝাড়ছেন। ইমন বললেন, মহামান্যা, সে আর আসবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে।
কেন আসবে না? তার সমস্যা কী?
সাংসারিক ঝামেলা হয়েছে। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।
তা হলে তো এখন আরো বেশি আসার কথা, পিছুটান নেই।
তাকে খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না এখন। শেষ বার এসেছিল দরবারে আসবে না একথা জানাতে। তখন উ™£ান্ত মনে হয়েছিল তাকে।
তুমি লোক লাগাও। তাকে আমার খুব প্রয়োজন।
ইঝোমি আছেন প্রিন্স তামেতাকার প্রাসাদে। আনন্দেই আছেন। প্রিন্স তাকে প্রেমদেবী বলে মেনে নিয়েছেন। তার পূজাই করছেন।
এ সময় সম্রাজ্ঞী শোশির দূত এসে হাজির। ইঝোমি খুব বিরক্ত হয়ে কথা বলতে যাচ্ছিলেন। তামেতাকা তাকে থামালেন। বললেন,
আমি কথা বলছি। তুমি ভেতরে যাও। দূতকে বললেন, ইঝোমি খুব অসুস্থ। কী বলতে কী বলে তার ঠিক নেই। সে সুস্থ হলে যাবে। তুমি গিয়ে বুঝিয়ে বলো। নাও, এ প্যাকেটটা রাখো। বুঝিয়ে বলবে কিন্তু। ভুল করবে না।
দূত চলে গেলে ইঝোমি বললেন, ভুল বললেন কেন? আমি তো সুস্থই আছি। আমি সম্রাজ্ঞীর দরবারে আর যাব না বলেই তো দিয়েছি।
আমাকে ভুল বুঝো না লক্ষ্মীটি। তুমি জেঁদ করলে সম্রাজ্ঞী শোশি জোর করবেন। তার বাবা মিচিনাগাকে তোমার পেছনে লাগাবেন। ব্যাপারটা অশান্তিকর হতে পারে। সম্রাট নাকি মিচিনাগাকে প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছেন। এটিই বাকী ছিল। তিনি এত শক্তিধর যে, চাইলে আমাদের জীবন অতীষ্ঠ করে তুলতে পারেন। তাই আমাদের কৌশলী হতে হবে।
ইঝোমি বললেন, কতদিন মিথ্যে অভিনয় করতে হবে?
হয়ত বেশি দিন না। দেখা যাক।
তাৎক্ষণিকভাবে ইঝোমি একটি কবিতা লিখে ফেলেন।
কবিতাটি এরকম:
‘এটা তো ভ্রমণ অযোগ্য পথ নয়
যদিও কিছু অজুহাত আছে
ইতাদা সাঁকোর ওপর
উঠেছি আমি অনেকবার
পা রাখতে হবে আরেকবার। এই যা।’
মুরাসাকির সংসার ‘ভালো’ লাগছে। স্বামী নোবুতাকা মাঝে মাঝে আসেন। বাবা চলে গেছেন। নোবুনোরিকে নিয়ে গেছেন। একা একা সময় কাটতে চায় না মুরাসাকির। স্বামীকে আসার জন্য মাঝে মধ্যে তাগিদপত্র পাঠান। কিন্তু তা কোনো দূরবর্তী ইশারায় রূপক প্রতীকে।
‘আমি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবই’।
তিনি অন্তরে তা অনুভব করেন।
মাতসুরায় কাটে দিন
আয়নার দেবতা কি
দেখতে পান সেই সব আকাশ, অবাক আমি
কলির কৃষ্ণ নোবুতাকা। কথা দিয়ে কথা রাখেন না। তাতে মুরাসাকির বিরহ বাড়ে। একা ছিলেন সেই ভালো ছিলেন, মাঝে-মধ্যে এ কথা মনে হয়। সঙ্গে সঙ্গে হাজারো চিন্তা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা মনের মধ্যে ভিড় করে। নৃত্যে-নটরাজ নোবুতাকার প্রতি বহু নারীর আগ্রহ, কৃষ্ণলীলায় মত্ত? তিনি শপথ করেছেন। কিন্তু পুরুষ শপথ করে শপথ ভাঙ্গার জন্য। এসব ভেবে অস্থির লাগছে তার।
ইচিঝেনের কথা মনে করার চেষ্টা করলেন। ভালো ভালো মুহূর্তগুলো, স্মৃতিগুলোও এখন ভালো লাগছে না। বই নিয়ে বসলেন। মনোসংযোগ হচ্ছে না। সুন্দর সুন্দর ক্যালিগ্রাফির লেখাগুলো যেন দৃষ্টির সীমা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। উদাস হয়ে যাচ্ছেন তিনি।
এ সময় দরজার টোকা পড়ল। ভাবলেন তাহলে এসেছেন আয়নার দেবতা। দরজা খুলে দিল দাস দাসীদের একজন। মুরাসাকি সাজপোষাক ঠিকঠাক করলেন। মাথার লম্বা চুল আঁচড়ে নিয়ে নিজেকে আয়নায় দেখলেন, প্রেমদেবী আফ্রোদিতের মতোই লাগছে।
কিন্তু হায়! মেয়েটি সংবাদ দিল আকাঝোমি ইমন এসেছেন।
বসতে বলো। বলে একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস গোপন করলেন। মনের দুঃখমেঘ তাড়িয়ে হাসি-খুশি এসে ইমনকে স্বাগত জানালেন মাথা নত করে।
ইমন বললেন, বিয়ের পর তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে। নোবুতাকা সান ব্যস্ত মানুষ। আর এই সম্রাটের দরবারে অনুষ্ঠানাদি লেগেই থাকে। ঐতিহ্যবাহী উৎসবগুলো তো আছেই।
সম্রাজ্ঞী মোশি কেমন আছেন?
তিনি ইঝোমিকে নিয়ে সমস্যায় আছেন।
ইঝোমির কী হয়েছে?
তুমি তা হলে কিছুই জানো না? তার তো স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। বাবা-মা ত্যাজ্যকন্যা করে দিয়েছেন।
কেন?
প্রিন্স তামেতাকার সঙ্গে
একটু শুনেছিলাম।
শোশির দরবারে আসাও বন্ধ করে দিয়েছে।
মেয়েটা কোথায়?
তার স্বামী নিয়ে গেছে।
সে সামলে নেবে সবকিছু, সাহস আছে।
সমস্যা আরো আছে। সম্রাজ্ঞী তেইশি সম্রাটের কানে তার বিরুদ্ধে বলে তার অবস্থানটা খারাপ করে দিয়েছেন। সম্রাট তার কবিতা পছন্দ করতেন।
সেদিন তো দেখলাম।
তোমার কবিতাটি যেমন ভালো ছিল, পড়েছও চমৎকার।
মুরাসাকি হাসি দিয়ে বললেন, ধন্যবাদ। আপনি কিন্তু সেদিন আমাদেরকে ফাঁকি দিয়েছেন।
সুযোগ পেলাম কোথায়? এখন শুনবে?
কী সৌভাগ্য আমার।
ইমন পাঠ করলেন :
‘অতএব, তখন, তাই হবে।
নারুমিতে যখন, ভুলে গেছ?
আমি কি আমার ঘর বানাবই!
নাকি দূর থেকে দূরে হারাবই?
যন্ত্রণার শীর্ষে থাকা ব্যাকুল প্রতীক্ষায়’
অসাধারণ, অদ্ভুত! বললেন মুরাসাকি।
কাগেরো নিক্কি পড়ে লিখেছিলাম। তোমার জন্য নিয়ে আসতে পারতাম। এনেছি অন্য বই, রোমান্টিক প্রেমের কবিতা। ভালো করিনি?
মুরাসাকি ইমনের কথায় শুধু হাসলেন।
ষোলো
মিচিনাগা প্রাক্তন সম্রাট রেইঝেই এর প্রাসাদে গেছেন। প্রাক্তন সম্রাট রাশভারী মানুষ। বয়সও হয়েছে। মাত্র দুই বছর সম্রাট ছিলেন। তারপরই সিংহাসন ছেড়ে দেন। সিংহাসন ছেড়ে অবসরে আছেন প্রায় ত্রিশ বছর হলো। শরীর স্বাস্থ্য ভালোই আছে।
মিচিনাগার আসার কথা শুনে ভেতর থেকে বের হয়ে এলেন। বললেন, এত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এখানে?
আপনার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ না। বর্তমান সম্রাটের থেকে আপনার মর্যাদা বেশি বলে আমরা সবাই মনে করি।
মাত্র দু’বছরে মনে রাখার মতো আর কী করেছি, তাও আবার প্রায় ত্রিশ বছর আগে।
স্বেচ্ছায় সিংহাসন ত্যাগ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, এরকম নজির কি আছে? না নেই।
এখন বল আগমনের কারণ কী?
আপনাকে দেখতে এসেছি।
রেইঝেই মনে মনে বললেন, কোনো কারণ ছাড়া তুমি আমাকে দেখতে আসার মানুষ। মুখে বললেন, সৌভাগ্য আমার। সাধারণত ফুজিওয়ারাগণ গেঞ্জি গোত্রের লোকদের অতটা গুরুত্ব দেয় না। রেইঝেই গেঞ্জিগোত্র থেকে এসেছেন। অবশ্য তাঁর মা ফুজিওয়ারা। তার পাঁচ স্ত্রীও ফুজিওয়ারা গোত্রের। মনে হয় এই গোত্রগত সম্পর্কই তাকে ফুজিওয়ারাদের কাছে মূল্যহীন করে দেয়নি।
তবে মিচিনাগা এসেছেন আসলেই একটা উদ্দেশ্য নিয়ে। প্রাক্তন সম্রাটের কাছে কিছুটা এগিয়ে এসে বসে কিমোনো ঠিকঠাক করে বললেন, মহামান্য, প্রিন্স তামেতাকা-
মুখ থেকে কথা টেনে নিয়ে রেইঝেই বললেন, আমি বুঝতে পেরেছি তুমি কী বলতে এসেছ। হেইয়ান কিউতে এটা নতুন কিছু নয়। মেয়েটা সব ছেড়েছুড়ে চলে এসেছে। বাবাও ত্যাজ্য করে দিয়েছে। এই অবস্থায় সে যাবে কোথায়?
কেন, সম্রাজ্ঞী শোশির দরবারে, তার প্রাসাদে।
ওটা তার চাকরির স্থল, স্বামীর সংসার নয়।
সম্রাট তার সম্পর্কে বাজে ধারণা নিয়ে বসে আছেন।
তোমার মেয়ের জন্য তো তা আরো বাজে হতে পারে।
তা পারে। সমস্যাটা অন্য জায়গায়।
তাও আমি জানি।
তাহলে সমাধান?
কিছুদিন যেতে দাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।
সম্রাজ্ঞী এত সময় ধৈর্য ধরবেন বলে মনে হয় না।
সে তো তোমার মেয়ে তুমি বুঝাও।
এমন গুণবতী কবি কোথায় পাব বলুন।
একটা মধ্যস্থতা হতে পারে।
মিচিনাগা উৎসাহী হয়ে বললেন, কী?
রেইঝেই বললেন, একজন প্রিন্সের সঙ্গিনী সম্রাজ্ঞীর সহকারী হতে পারে না। তার মর্যাদা তা অনুমোদন করে না।
তুমি বরং তাকে চাকরি থেকে মুক্ত করে দাও। সে সম্রাজ্ঞী শোশির দরবারে প্রিন্সেস হিসেবে যাবে, মাঝে মধ্যে সময় দেবে এবং প্রয়োজন হলে সম্রাটের অনুষ্ঠানে কবিতা পড়ে আসবে।
তাহলে তো সে সম্রাজ্ঞী শোশির লেডি বলে বাইরে স্বীকৃত হবে না।
তা হবে না। কিন্তু শোশির প্রিয়ভাজন বলে তো স্বীকৃত হবে। তা কম কী?
মিচিনাগার ক্ষমতা অনেক। কিন্তু এখানে কোনো হস্তক্ষেপ করা যাবে না। এই ব্যাপারটা তিনি ভালোভাবেই জানেন। তাই প্রায় অনুনয় করে বললেন, আপনি চাইলে সবই হয়। আমি কি তামেতাকার সঙ্গে কথা বলব?
আমি যা বলেছি, সেও একই কথা বলবে। কোনো লাভ হবে না, সে এতে আরো ক্ষিপ্ত হবে। তোমার সম্মানহানি ঘটবে। তুমি কি জানো আমি তোমাকে কেন পছন্দ করি? এ জন্য যে, তুমি ব্যাপারটা নিয়ে আমার কাছে এসেছ। তামেতাকার কাছে নয়। তোমার এটুকু বুঝবার ক্ষমতা আছে যে, তোমার কোথায় যাওয়া উচিত।
এই প্রাক্তন সম্রাটের কাছে যুক্তিতে হেরে মিচিনাগা প্রাসাদে ফিরে গেলেন, এবং বুঝতে পারলেন যে, নিজের মেয়ের গৌরবের জন্য যা করছেন, অন্যায় জেনেও আরেকজন পুত্রকে রক্ষার (প্রটেক্ট) জন্য তা করছেন। কন্যার জন্য দুঃখ হচ্ছে।
দুঃখ হচ্ছে ইঝোমির বাবারও তিনি বুঝতে পারছেন না ইঝোমি এমন হয়ে গেলেন কেন? তিনি মেয়েকে সামলাতেও কি ভুল পথ ধরেছেন? তা করে তার গৌরব বাড়েনি, পরিবার থেকে পরিত্যাগ করায় যেমন নিজে কষ্ট পেয়েছেন, তেমনি সমালোচিতও হয়েছেন প্রচুর। সামাজিকভাবে খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তামেতোকির সঙ্গেই বেশি ভাব। কিন্তু তিনি আছেন ইচিঝেনে। কারও সঙ্গে পরামর্শ করবেন সে অবস্থা নেই। শ্বশুরও চলে গেছেন তার প্রদেশে, যেখানে গভর্নর তিনি।
সেখানেও সংবাদটা গেছে। খারাপ খবর গোপন থাকে না। যেন মাছির পায়ে পাখায় গন্ধ ছড়ায়। ফলে তাকেও মনমরা হয়ে ঘরে বসেই থাকতে হয় বেশি সময়।
সবচেয়ে বেশি সমস্যায় ইঝোমির প্রাক্তন স্বামী মিচিসাদা। কোনো কাজে মন বসাতে পারছেন না। প্রাসাদেই কাটে দীর্ঘ সময়। কন্যাকে প্রবোধ এবং সান্ত¡না দেয়া এখন তার প্রধান কাজ। সহকর্মীদের মনে নানা প্রশ্ন। কেমন করে যেন সবাই তাকায়। রাগের মাথায় মনে হয় মেয়েটার ক্ষতি করে ফেলেছেন। পরক্ষণেই ভাবেন বিকল্প কি ছিল? মনের ভেতর থেকেই উত্তর আসে, ছিল, নানা বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া যেত। তা ছিল মেয়ের যথার্থ ঠিকানা। রাগের মাথায় কোনো কাজ করা ঠিক না, সিদ্ধান্ত সঠিক হয় না।
আরো সমস্যা হচ্ছে, প্রদেশটার নামে নাম ইঝোমি। সবসময় তাকে এ নামটা উচ্চারণ করতে হয় এবং মেয়ের কাছে বিব্রত অবস্থায় পড়তে হয়। তা এমন এক সমস্যা যে সমস্যার শেষ নেই।
ইঝোমি এখন তামেতাকাকে নিয়ে বেশ আছেন। কোনো পিছুটান নেই। তামেতাকা অন্য প্রিন্সদের মতো এতটা স্বার্থপর নন। যথেষ্ট মানবিক এবং বিবেচনাবোধসম্পন্ন। প্রাক্তন সম্রাট রেইঝেই তাই তার এই থার্ড প্রিন্স বা তৃতীয় যুবরাজকে পছন্দ করেন। তার সম্রাজ্ঞী এবং অন্যান্য পুত্রকন্যারা সম্রাটের পদ ছেড়ে দেয়ায় তাদের স্বার্থ নষ্ট হওয়ায় অনেক কথাই বলেছেন। কিন্তু এই প্রিন্স একটি প্রশ্নও করেননি। আজও না। তখনই রেইঝেই বুঝেছেন এই ছেলে হয় বোকা, না হয় অতিমাত্রায় বুদ্ধিমান। বুদ্ধিমানই। তবে অভাব আছে। কিন্তু তা ইঝোমিকে বুঝতে দেন না। কবি ইঝোমি ছন্নছাড়া কবি না, ভোগ করতে যেমন পছন্দ করেন, সাজসজ্জা এবং জীবনযাত্রায়ও উচ্চমার্গীয় ফ্যাশন সচেতন। দামি পোশাকও একবারের বেশি পরিধান করেন না।
প্রাক্তন সম্রাট রেইঝেই এর তা অপছন্দ করার কথা, না তা তিনি বরং পছন্দই করেন। কবি মেয়েটাকে তার ভালো লেগে গেছে।
এই সম্রাটের সুবিধাবঞ্চিত অন্য ছেলেমেয়েরা ধরেই নিয়েছেন তাদের পিতা বদ্ধপাগল, না হয় কেউ সিংহাসন ছেড়ে দিয়ে আসে। অবশ্য তার উত্তরাধিকারীরা ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেনি, ছিটকে গেছেন। তারা এখন সকলেই ভাবছেন, ইঝোমি এবং তামেতাকাকে প্রশ্রয় দেয়া আরেকটা পাগলামি।
কবি ইঝোমিকে যারা প্রেমপাগলী বলে কলঙ্ক লেপন করতে চাইছেন, তারা দেখছেন ইঝোমি বেশ সুখেই আছেন। এখন বোধ হয় ঈর্ষাই হচ্ছে তাদের।
তবে ইঝোমির সাহিত্য চর্চাটা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। প্রিয়জন অতি নিকটে, কণ্ঠলগ্ন। কবিতাপত্র কাকে লিখবেন, দিন যায়, রাত যায়।
হঠাৎ একদিন প্রাক্তন সম্রাট রেইঝেই সংবাদ পাঠালেন দুজনকে। ভয়ে ভয়ে গেলেন তার কাছে। রেইঝেই বললেন, ইঝোমি, তুমি শোশির জন্য কবিতা লিখবে এবং মাঝে মধ্যে তার কাছে যাবে। কবিতা শোনাবে। লোকজন যেন মনে করে তুমি তার দরবারের সম্মানিত কেউ, তোমার উপস্থিতি তার দরবারের গৌরব বাড়াবে। আমি মিচিনাগাকে কথা দিয়েছি।
তাই হবে মহামান্য। বললেন, তামেতাকা।
ইঝোমি বললেন, আমি লিখতে ভুলে গেছি, মহামান্য। ভুললে চলবে কেন? আমি জানি তোমার দুঃখ আছে। তুমি মেয়েটাকে এনে নিজের সঙ্গে রাখো, এখানে কোনো অসুবিধে হবে না। আমি তামেতাকার সামনেই বলছি।
হ্যাঁ, বাবার কথাই আমার কথা। তোমার সন্তান প্রাসাদে বড় হলে আমাদেরও গর্বই হবে।
বুঝলে, গেঞ্জি গোত্রের মানুষ আমরা। ফুজিওয়ারাদের মতো গোত্র-গোষ্ঠী বিচার করি না, মানুষ মনে করে তার সহচর্য পেলে আর কিছু চাই না। নারী-পুরুষ সকলেরই জীবনযাত্রায় নিজস্ব পছন্দ অপছন্দ থাকবে, তার সমালোচনা করার, বাধা দেয়ার আমি কে। এখন তোমরা যেতে পারো।
ইঝোমি যেতে যেতে বললেন, ঠিক বাবার মতোই কথা। আমি তাকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করি, প্রিন্স। ক্রমশ...