জীবনবৃত্ত নয়, জাতীয় জীবনের প্রামাণ্য বৃত্তান্ত

এম আবদুল আলীম

কিছু মানুষ সূর্যের মতো পোড়েন এবং জাতির চিত্তে আলো ও শক্তি সঞ্চার করেন। বলছি বাংলাদেশের সংস্কৃতি-জগতের মহীরুহ সন্জীদা খাতুনের কথা; যাঁর জীবনে বাস্তব হয়ে দেখা দিয়েছে এ পি জে আবুল কালামের সেই অমিয় বাণী- ‘তুমি যদি সূর্যের মতো আলো ছড়াতে চাও, তাহলে আগে সূর্যের মতো পুড়তে শেখো।’ পৃথিবীর আলো-বাতাসে আসা থেকে কৈশোর-যৌবন পেরিয়ে তাঁর অপরাহ্ণের সৃষ্টিমুখর দিনগুলোর কর্মযজ্ঞ থেকে এ বাণীর যথার্থতা নিরূপণ করা যায়। ছকবাঁধা বৃত্তে আবদ্ধ না থেকে আজীবন তিনি যে বৃত্ত ভাঙার গান গেয়েছেন, জীবনবৃত্ত নামক ছোট্ট এ গ্রন্থ তারই আলেখ্য। ইতিপূর্বে সহজ কঠিন দ্বন্দ্ব ছন্দে নামক গ্রন্থ ও স্মৃতিচারণমূলক বিভিন্ন লেখায় তিনি নিজের জীবনের কথা তুলে ধরলেও এ বইয়ের বৃত্তান্ত অভিনব। নয় দশকের জীবন-পরিক্রমায় জড়াজড়ি করে থাকা সুখ-দুঃখের বয়ান তিনি অকপটে তুলে ধরেছেন। তাতে কোনোপ্রকার লুকোচুরি নয়, জীবনাভিজ্ঞতার সঞ্চিত ভাণ্ডারের প্রিয়-অপ্রিয় নানা প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। জন্মের মাহেন্দ্রক্ষণ, শৈশব-কৈাশোরের আনন্দ-কোলাহল-ভরা প্রহর, শিক্ষাজীবন, কর্মজীবন এবং সাংস্কৃতিক জীবনের বিচিত্র কহনের পাশাপাশি সৃষ্টি ও সাধনার কথা এবং সেগুলোর স্বীকৃতি-স্বরূপ যেসব পুরস্কার এবং সম্মাননা লাভ করেছেন, তাও তুলে ধরেছেন। প্রাসঙ্গিকভাবে এসেছে দেশ, কাল, সমাজ এবং রাষ্ট্রের ভেতর-বাইরের নানা ঘটনার চিত্র। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও কর্মজীবনের এমন সব ঘটনা তিনি তুলে ধরেছেন, যা রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের মতো ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা, ছোট ছোট দুঃখ-কথার সহজ-সরল জীবনালেখ্য হয়ে উঠেছে।

০২.

সন্জীদা খাতুনের জন্ম ১৯৩৩ সালের ৪ এপ্রিল। লেখাপড়া করেছেন কামরুন্নেসা স্কুল, ইডেন কলেজ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় এবং বিশ^ভারতী বিশ^বিদ্যালয়ে। সবচেয়ে বড় শিক্ষা গ্রহণ করেছেন প্রকৃতি ও জীবনের পাঠশালা থেকে। কর্মজীবন অতিবাহিত করেছেন বিভিন্ন সরকারি কলেজ, টেক্সটবুক বোর্ড ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে। প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন ছায়ানট ও রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ প্রতিষ্ঠা ও গড়ার কাজে। রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার এবং রবীন্দ্র-সাহিত্যচর্চা বন্ধের বিরুদ্ধে আন্দোলন, রবীন্দ্র-জন্ম-শতবর্ষ উদযাপন এবং রমনার বটমূলে বর্ষবরণের মতো মহাকর্মযজ্ঞ দ্বারা তিনি বাঙালি সংস্কৃতির গৌরব উচ্চে তুলে ধরেছেন। সাহিত্য-সমালোচনা, প্রবন্ধ-রচনা, আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথামূলক বহু গ্রন্থেরও প্রণেতা তিনি। জীবনবৃত্ত-র শুরু হয়েছে সন্জীদা খাতুনের জীবনের বয়ান দিয়ে। বলেছেন, জন্মের পর মাতামহ আঁতুড়ঘরে ঢুকে তাঁর মুখ দেখেই মন্তব্য করেছিলেন, ‘অ্যাঃ কয়লালতা’। কিছুদিন পরেই ছোট্ট মুখ আর টানা টানা চোখ দেখে তিনি নাম রাখেন মীনাক্ষী, যা পরে দাঁড়ায় মিনা কিংবা মিনুতে। সন্জীদা আরও একটি নাম পেয়েছিলেন, সেটি ছিলো পেঁচী। শরীরের রং নিয়ে পরিবারের সদস্যরা সময় সময় এমন রসিকতা করলেও তিনি মনঃকষ্ট পননি। চাচা-চাচি, ফুপু-ফুপা, আত্মীয়-স্বজন আর নিজেদের এগারো ভাই-বোন নিয়ে গড়া যৌথ পরিবারে তাঁর বেড়ে ওঠা। গ্রাম-শহর মিলে বাড়িতে ছিল আরও নানা মানুষের আনাগোনা। পরবর্তীকালে সকলকে আপন করে নেওয়ার যে গুণ সন্জীদা খাতুন অর্জন করেন, তার শুরু পরিবার থেকে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে তাঁর মায়ের কাছে পেয়েছিলেন। নিজের সন্ধানদেরও একই শিক্ষা দিয়েছিলেন, যে কারণে ছায়ানটের কর্মীদের তাঁরা নিজের আত্মীয়দের মতোই পরমাত্মীয় জ্ঞান করেছে।

স্কুলে ভর্তি হয়ে প্রকৃতি ও সংস্কৃতির অবারিত প্রান্তরে ছুটে চলার সুযোগ পান। লিখেছেন : ‘নারীশিক্ষা মন্দিরের গাছপালা ফুলের শোভা মনটাকে ঘিরে রাখত।’ স্কুলের সা্কংৃতিক অনুষ্ঠানগুলো তাঁর শিশুমনে স্বপ্নের বীজ বপন করে। শৈশবে মুক্ত পরিবেশে শিক্ষাগ্রহণে তিনি যতটা আগ্রহী ছিলেন, একাডেমিক পড়ালেখায় ছিলেন ততটাই ‘ডাব’। গায়ের রঙের পাশাপাশি ঠোঁট দুটো কালো হওয়ায় সহপাঠীদের কেউ একজন প্রশ্ন করেছিলো, সে বিড়ি খায় কিনা। এতে সময় সময় মনের আকাশে কালো মেঘ জমলেও, স্কুলশিক্ষক হীরণদির দুটি উপদেশ তাঁকে আত্মবিশ^াসী করে তোলে। সেই উপদেশ দুটি ছিলো : নিজের চেহারাকে খারাপ না ভাবা; এবং দিনের ভালো-মন্দ কাজ নিয়ে প্রতিরাতে ঘুমোবার আগে আত্মবিশ্লেষণ। এই পন্থা দুটি তাঁকে আত্মোন্নতির পথ দেখায় এবং নিজেকে গড়ে তুলতে সহায়তা করে। কলেজে পড়ার সময়ই উজান ¯্রােতে হাঁটা শুরু করেন; গান, নাটক, পড়াশোনার পাশাপাশি নিজেকে নারী নয়, মানুষ ভাবতে শেখেন। ঘোমটা না দেওয়া তখনই তাঁর একটি জিদে পরিণত হয়; মেয়েদের পত্রিকা, মেয়েদের প্রতিষ্ঠান এসবের বিরুদ্ধেও তোলেন প্রশ্ন। সেই স্কুলে পড়ার সময় নারী-পুরুষ একসঙ্গে সকল কাজ করতে পারার যে যাত্রা শুরু করেছিলেন, শেষজীবনেও তা অটুট থাকে। বিশ^বিদ্যালয়ের ভর্তির সময় ফরমে লেখা দেখলেন, ছাত্রীদের ঘোমটা দিতে হবে এবং ছেলেদের সঙ্গে কথা বলা যাবে না! মৌন সম্মতি জানিয়ে ফরমে স্বাক্ষর করলেও, বাস্তবে এ নিয়ম মানেননি। ঐ সময় যুক্ত হয়েছিলেন শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের নানা সংগ্রাম এবং রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের তো ছিলেন অগ্রভাগে। যুক্ত হন মুকুল ফৌজ-এর সঙ্গে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে পাড়ি জমান শান্তিনিকেতনে। সেখানকার শিক্ষালাভের আনন্দময় সুযোগকে নিজের পরম সৌভাগ্য বলে অভিহিত করেছেন।

০৩.

সন্জীদা খাতুন কর্মজীবন শুরু করেন সরকারি কলেজের প্রভাষক হিসেবে। পাকিস্তান আমলে বাঙালিয়ানার কারণে পদে পদে হয়রানির শিকার হয়েছেন। অতি সাধারণ বিষয় সামনে এনে তাঁকে হেনস্তা করা হয়েছে। এমনকী, সন্তানের নাম ‘পার্থ’ রাখার কারণেও গোয়েন্দা সংস্থার কর্তাব্যক্তিদের দ্বারা হয়রানির শিকার হয়েছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অল্প কিছুদিন টেক্সট বুক বোর্ডে এবং পরে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগ দেন। অনার্সে স্বর্ণপদক এবং এমএ-তে ফার্স্টক্লাস থাকলেও বিভাগীয় প্রধানের পক্ষপাতিত্বে তাঁকে সিনিয়রিটি হারাতে হয় এমন একজন প্রার্থীর কাছে, যাঁর ইন্টারমিডিয়েটে ছিলো থার্ড ডিভিশন এবং ছিলেন পাস কোর্সের বিএ। এ কর্মস্থলে তাঁকে নানা দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে; বলেছেন, বিভাগের শিক্ষকরা তো বটেই; কেরানি পর্যন্ত তাঁর নামে যা-তা বলে বেড়াতো। তবে তাতে তিনি মনোবল হারাননি বা হতাশ হননি; বরং জ্ঞান আর বোধ বাড়িয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের ঘায়েল করেছেন। লিখেছেন : ‘যতই বিরুদ্ধতা ততই আত্মোন্নয়নের সাধনা- এই তো জীবনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার যথার্থ পথ।’

তিনি সংসার বেঁধেছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ওয়াহিদুল হকের সঙ্গে, নানা টানাপোড়েনে সংসার টেকেনি। বৈষ্ণব পদাবলী পড়ে স্বর্গীয় প্রেমের যে দীক্ষা নিয়েছিলেন, বাস্তব সংসারে তার অস্তিত্ব খুঁজে পাননি। এ গ্রন্থে সে-সব কথা তুলে ধরেছেন। নিজের দাম্পত্যজীবন তো বটেই, পুত্র-কন্যাদের বিয়ে-সংসারের অনেক রসিকতাপূর্ণ এবং ‘রসকষহীন’ ঘটনার বিবরণ তুলে ধরেছেন। মীর মশাররফ হোসেনের আমার জীবনী থেকে তাঁর সন্তানদের বাংলা নামের কথা জানা যায়; সন্জীদা খাতুনের জীবনবৃত্ত থেকেও একইভাবে জানা যায় পুত্র-কন্যা এবং নাতি-নাতনিদের অর্থব্যঞ্জনাপূর্ণ বাংলা নাম; যেমন- পার্থ, রুচিরা, অপলা, প্রকৃতি মনোলিনা, প্রীতা অনিনিন্দিতা, সূর্য অনিবার, সায়ন্তনী ত্বিষা প্রভৃতি। দীর্ঘ জীবনে জীবনে সন্জীদা খাতুন হেঁটেছেন দীর্ঘ পথ। খ্যাতিমান পিতা কাজী মোতাহার হোসেনের আলোয় জীবনের পথ অনেকটা আলোকিত হলেও, আপন কর্মে ও সাধনায় তাঁকে ছাড়িয়ে গেছেন। নানা প্রতিকূলতা উজিয়ে মুঠি মুঠি সাফল্যে জীবনের ভাঁড়ার পূর্ণ করেছেন; দেশবাসীর ভালোবাসা, নানা পুরস্কার-সম্মাননা এবং স্বীকৃতি ভুলিয়ে দিয়েছে সকল অপূর্ণতা। জীবনবৃত্ত সে-সবের বৃত্তান্তে ঠাসা। নিজেকে কোথাও আড়াল করেননি; কপটতার বেড়াজালে আটকাতে চাননি জীবনের স্বভাবিক প্রবাহকে; বরং আঁধারের গিরিপথ কেটে, কঠোর সাধনা ও শ্রমে তৈরি করেছেন সুদীর্ঘ পথ; এবং সেই পথে আলো এনে নিজের জীবনে যেমন, তেমনি জাতির জীবনকেও ভরে দিয়েছেন নিয়ন আলোর ধারায়।

৯৪ পৃষ্ঠার বইটি প্রকাশ করেছে কথাপ্রকাশ। প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০২১। প্রচ্ছদ সব্যসাচী হাজরা। মূল্য ২০০টাকা। বইটি কেবল ব্যক্তি সন্জীদা খাতুনের জীবনবৃত্ত নয়, এটি হয়ে উঠেছে ঔপনিবেশিক ভারত, পরাধীন পাকিস্তান এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রায় এক শতাব্দীর ইতিহাসের উত্থান-পতন ও জাগরণের প্রামাণ্য দলিল। এটি পাঠে পাঠকের নানা কৌতূহল যে নিবৃত্ত হবে, তা নিঃসন্দেহে বল যায়।

বৃহস্পতিবার, ২৪ জুন ২০২১ , ১০ আষাঢ় ১৪২৮ ১২ জিলকদ ১৪৪২

জীবনবৃত্ত নয়, জাতীয় জীবনের প্রামাণ্য বৃত্তান্ত

এম আবদুল আলীম

image

কিছু মানুষ সূর্যের মতো পোড়েন এবং জাতির চিত্তে আলো ও শক্তি সঞ্চার করেন। বলছি বাংলাদেশের সংস্কৃতি-জগতের মহীরুহ সন্জীদা খাতুনের কথা; যাঁর জীবনে বাস্তব হয়ে দেখা দিয়েছে এ পি জে আবুল কালামের সেই অমিয় বাণী- ‘তুমি যদি সূর্যের মতো আলো ছড়াতে চাও, তাহলে আগে সূর্যের মতো পুড়তে শেখো।’ পৃথিবীর আলো-বাতাসে আসা থেকে কৈশোর-যৌবন পেরিয়ে তাঁর অপরাহ্ণের সৃষ্টিমুখর দিনগুলোর কর্মযজ্ঞ থেকে এ বাণীর যথার্থতা নিরূপণ করা যায়। ছকবাঁধা বৃত্তে আবদ্ধ না থেকে আজীবন তিনি যে বৃত্ত ভাঙার গান গেয়েছেন, জীবনবৃত্ত নামক ছোট্ট এ গ্রন্থ তারই আলেখ্য। ইতিপূর্বে সহজ কঠিন দ্বন্দ্ব ছন্দে নামক গ্রন্থ ও স্মৃতিচারণমূলক বিভিন্ন লেখায় তিনি নিজের জীবনের কথা তুলে ধরলেও এ বইয়ের বৃত্তান্ত অভিনব। নয় দশকের জীবন-পরিক্রমায় জড়াজড়ি করে থাকা সুখ-দুঃখের বয়ান তিনি অকপটে তুলে ধরেছেন। তাতে কোনোপ্রকার লুকোচুরি নয়, জীবনাভিজ্ঞতার সঞ্চিত ভাণ্ডারের প্রিয়-অপ্রিয় নানা প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। জন্মের মাহেন্দ্রক্ষণ, শৈশব-কৈাশোরের আনন্দ-কোলাহল-ভরা প্রহর, শিক্ষাজীবন, কর্মজীবন এবং সাংস্কৃতিক জীবনের বিচিত্র কহনের পাশাপাশি সৃষ্টি ও সাধনার কথা এবং সেগুলোর স্বীকৃতি-স্বরূপ যেসব পুরস্কার এবং সম্মাননা লাভ করেছেন, তাও তুলে ধরেছেন। প্রাসঙ্গিকভাবে এসেছে দেশ, কাল, সমাজ এবং রাষ্ট্রের ভেতর-বাইরের নানা ঘটনার চিত্র। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও কর্মজীবনের এমন সব ঘটনা তিনি তুলে ধরেছেন, যা রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের মতো ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা, ছোট ছোট দুঃখ-কথার সহজ-সরল জীবনালেখ্য হয়ে উঠেছে।

০২.

সন্জীদা খাতুনের জন্ম ১৯৩৩ সালের ৪ এপ্রিল। লেখাপড়া করেছেন কামরুন্নেসা স্কুল, ইডেন কলেজ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় এবং বিশ^ভারতী বিশ^বিদ্যালয়ে। সবচেয়ে বড় শিক্ষা গ্রহণ করেছেন প্রকৃতি ও জীবনের পাঠশালা থেকে। কর্মজীবন অতিবাহিত করেছেন বিভিন্ন সরকারি কলেজ, টেক্সটবুক বোর্ড ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে। প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন ছায়ানট ও রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ প্রতিষ্ঠা ও গড়ার কাজে। রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার এবং রবীন্দ্র-সাহিত্যচর্চা বন্ধের বিরুদ্ধে আন্দোলন, রবীন্দ্র-জন্ম-শতবর্ষ উদযাপন এবং রমনার বটমূলে বর্ষবরণের মতো মহাকর্মযজ্ঞ দ্বারা তিনি বাঙালি সংস্কৃতির গৌরব উচ্চে তুলে ধরেছেন। সাহিত্য-সমালোচনা, প্রবন্ধ-রচনা, আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথামূলক বহু গ্রন্থেরও প্রণেতা তিনি। জীবনবৃত্ত-র শুরু হয়েছে সন্জীদা খাতুনের জীবনের বয়ান দিয়ে। বলেছেন, জন্মের পর মাতামহ আঁতুড়ঘরে ঢুকে তাঁর মুখ দেখেই মন্তব্য করেছিলেন, ‘অ্যাঃ কয়লালতা’। কিছুদিন পরেই ছোট্ট মুখ আর টানা টানা চোখ দেখে তিনি নাম রাখেন মীনাক্ষী, যা পরে দাঁড়ায় মিনা কিংবা মিনুতে। সন্জীদা আরও একটি নাম পেয়েছিলেন, সেটি ছিলো পেঁচী। শরীরের রং নিয়ে পরিবারের সদস্যরা সময় সময় এমন রসিকতা করলেও তিনি মনঃকষ্ট পননি। চাচা-চাচি, ফুপু-ফুপা, আত্মীয়-স্বজন আর নিজেদের এগারো ভাই-বোন নিয়ে গড়া যৌথ পরিবারে তাঁর বেড়ে ওঠা। গ্রাম-শহর মিলে বাড়িতে ছিল আরও নানা মানুষের আনাগোনা। পরবর্তীকালে সকলকে আপন করে নেওয়ার যে গুণ সন্জীদা খাতুন অর্জন করেন, তার শুরু পরিবার থেকে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে তাঁর মায়ের কাছে পেয়েছিলেন। নিজের সন্ধানদেরও একই শিক্ষা দিয়েছিলেন, যে কারণে ছায়ানটের কর্মীদের তাঁরা নিজের আত্মীয়দের মতোই পরমাত্মীয় জ্ঞান করেছে।

স্কুলে ভর্তি হয়ে প্রকৃতি ও সংস্কৃতির অবারিত প্রান্তরে ছুটে চলার সুযোগ পান। লিখেছেন : ‘নারীশিক্ষা মন্দিরের গাছপালা ফুলের শোভা মনটাকে ঘিরে রাখত।’ স্কুলের সা্কংৃতিক অনুষ্ঠানগুলো তাঁর শিশুমনে স্বপ্নের বীজ বপন করে। শৈশবে মুক্ত পরিবেশে শিক্ষাগ্রহণে তিনি যতটা আগ্রহী ছিলেন, একাডেমিক পড়ালেখায় ছিলেন ততটাই ‘ডাব’। গায়ের রঙের পাশাপাশি ঠোঁট দুটো কালো হওয়ায় সহপাঠীদের কেউ একজন প্রশ্ন করেছিলো, সে বিড়ি খায় কিনা। এতে সময় সময় মনের আকাশে কালো মেঘ জমলেও, স্কুলশিক্ষক হীরণদির দুটি উপদেশ তাঁকে আত্মবিশ^াসী করে তোলে। সেই উপদেশ দুটি ছিলো : নিজের চেহারাকে খারাপ না ভাবা; এবং দিনের ভালো-মন্দ কাজ নিয়ে প্রতিরাতে ঘুমোবার আগে আত্মবিশ্লেষণ। এই পন্থা দুটি তাঁকে আত্মোন্নতির পথ দেখায় এবং নিজেকে গড়ে তুলতে সহায়তা করে। কলেজে পড়ার সময়ই উজান ¯্রােতে হাঁটা শুরু করেন; গান, নাটক, পড়াশোনার পাশাপাশি নিজেকে নারী নয়, মানুষ ভাবতে শেখেন। ঘোমটা না দেওয়া তখনই তাঁর একটি জিদে পরিণত হয়; মেয়েদের পত্রিকা, মেয়েদের প্রতিষ্ঠান এসবের বিরুদ্ধেও তোলেন প্রশ্ন। সেই স্কুলে পড়ার সময় নারী-পুরুষ একসঙ্গে সকল কাজ করতে পারার যে যাত্রা শুরু করেছিলেন, শেষজীবনেও তা অটুট থাকে। বিশ^বিদ্যালয়ের ভর্তির সময় ফরমে লেখা দেখলেন, ছাত্রীদের ঘোমটা দিতে হবে এবং ছেলেদের সঙ্গে কথা বলা যাবে না! মৌন সম্মতি জানিয়ে ফরমে স্বাক্ষর করলেও, বাস্তবে এ নিয়ম মানেননি। ঐ সময় যুক্ত হয়েছিলেন শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের নানা সংগ্রাম এবং রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের তো ছিলেন অগ্রভাগে। যুক্ত হন মুকুল ফৌজ-এর সঙ্গে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে পাড়ি জমান শান্তিনিকেতনে। সেখানকার শিক্ষালাভের আনন্দময় সুযোগকে নিজের পরম সৌভাগ্য বলে অভিহিত করেছেন।

০৩.

সন্জীদা খাতুন কর্মজীবন শুরু করেন সরকারি কলেজের প্রভাষক হিসেবে। পাকিস্তান আমলে বাঙালিয়ানার কারণে পদে পদে হয়রানির শিকার হয়েছেন। অতি সাধারণ বিষয় সামনে এনে তাঁকে হেনস্তা করা হয়েছে। এমনকী, সন্তানের নাম ‘পার্থ’ রাখার কারণেও গোয়েন্দা সংস্থার কর্তাব্যক্তিদের দ্বারা হয়রানির শিকার হয়েছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অল্প কিছুদিন টেক্সট বুক বোর্ডে এবং পরে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগ দেন। অনার্সে স্বর্ণপদক এবং এমএ-তে ফার্স্টক্লাস থাকলেও বিভাগীয় প্রধানের পক্ষপাতিত্বে তাঁকে সিনিয়রিটি হারাতে হয় এমন একজন প্রার্থীর কাছে, যাঁর ইন্টারমিডিয়েটে ছিলো থার্ড ডিভিশন এবং ছিলেন পাস কোর্সের বিএ। এ কর্মস্থলে তাঁকে নানা দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে; বলেছেন, বিভাগের শিক্ষকরা তো বটেই; কেরানি পর্যন্ত তাঁর নামে যা-তা বলে বেড়াতো। তবে তাতে তিনি মনোবল হারাননি বা হতাশ হননি; বরং জ্ঞান আর বোধ বাড়িয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের ঘায়েল করেছেন। লিখেছেন : ‘যতই বিরুদ্ধতা ততই আত্মোন্নয়নের সাধনা- এই তো জীবনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার যথার্থ পথ।’

তিনি সংসার বেঁধেছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ওয়াহিদুল হকের সঙ্গে, নানা টানাপোড়েনে সংসার টেকেনি। বৈষ্ণব পদাবলী পড়ে স্বর্গীয় প্রেমের যে দীক্ষা নিয়েছিলেন, বাস্তব সংসারে তার অস্তিত্ব খুঁজে পাননি। এ গ্রন্থে সে-সব কথা তুলে ধরেছেন। নিজের দাম্পত্যজীবন তো বটেই, পুত্র-কন্যাদের বিয়ে-সংসারের অনেক রসিকতাপূর্ণ এবং ‘রসকষহীন’ ঘটনার বিবরণ তুলে ধরেছেন। মীর মশাররফ হোসেনের আমার জীবনী থেকে তাঁর সন্তানদের বাংলা নামের কথা জানা যায়; সন্জীদা খাতুনের জীবনবৃত্ত থেকেও একইভাবে জানা যায় পুত্র-কন্যা এবং নাতি-নাতনিদের অর্থব্যঞ্জনাপূর্ণ বাংলা নাম; যেমন- পার্থ, রুচিরা, অপলা, প্রকৃতি মনোলিনা, প্রীতা অনিনিন্দিতা, সূর্য অনিবার, সায়ন্তনী ত্বিষা প্রভৃতি। দীর্ঘ জীবনে জীবনে সন্জীদা খাতুন হেঁটেছেন দীর্ঘ পথ। খ্যাতিমান পিতা কাজী মোতাহার হোসেনের আলোয় জীবনের পথ অনেকটা আলোকিত হলেও, আপন কর্মে ও সাধনায় তাঁকে ছাড়িয়ে গেছেন। নানা প্রতিকূলতা উজিয়ে মুঠি মুঠি সাফল্যে জীবনের ভাঁড়ার পূর্ণ করেছেন; দেশবাসীর ভালোবাসা, নানা পুরস্কার-সম্মাননা এবং স্বীকৃতি ভুলিয়ে দিয়েছে সকল অপূর্ণতা। জীবনবৃত্ত সে-সবের বৃত্তান্তে ঠাসা। নিজেকে কোথাও আড়াল করেননি; কপটতার বেড়াজালে আটকাতে চাননি জীবনের স্বভাবিক প্রবাহকে; বরং আঁধারের গিরিপথ কেটে, কঠোর সাধনা ও শ্রমে তৈরি করেছেন সুদীর্ঘ পথ; এবং সেই পথে আলো এনে নিজের জীবনে যেমন, তেমনি জাতির জীবনকেও ভরে দিয়েছেন নিয়ন আলোর ধারায়।

৯৪ পৃষ্ঠার বইটি প্রকাশ করেছে কথাপ্রকাশ। প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০২১। প্রচ্ছদ সব্যসাচী হাজরা। মূল্য ২০০টাকা। বইটি কেবল ব্যক্তি সন্জীদা খাতুনের জীবনবৃত্ত নয়, এটি হয়ে উঠেছে ঔপনিবেশিক ভারত, পরাধীন পাকিস্তান এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রায় এক শতাব্দীর ইতিহাসের উত্থান-পতন ও জাগরণের প্রামাণ্য দলিল। এটি পাঠে পাঠকের নানা কৌতূহল যে নিবৃত্ত হবে, তা নিঃসন্দেহে বল যায়।