চট্টগ্রামে পাহাড়ে মৃত্যুঝুঁকিতে ৮৩৫ পরিবার

চট্টগ্রামে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিম্ন শ্রেণীর মানুষ পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছেন। তবে পাহাড় ধসে প্রাণহানি না ঘটতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন উচ্ছেদ থেকে শুরু করে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে গতকাল ৪৭টি স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। তবুও এক শ্রেণীর মানুষ ভাড়ায় চালানোর জন্য নির্বিচারে পাহাড় কেটে বসতঘর তৈরি করে ভাড়া উত্তোলন করে আসছে। ফলে বৃষ্টি হলেই পাহাড়ের মাটি ধসে দুর্ঘটনা ঘটছে।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন ১৭টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ৮৩৫টি পরিবার বসবাস করছে।

অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণভাবে ব্যক্তিমালিকানাধীন ১০টি পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৫৩১টি। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মালিকানাধীন সাতটি পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৩০৪টি। ২০০৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে পাহাড়ধসে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় ২০০৭ সালে। ওই বছরের ১১ জুন টানা বর্ষণের ফলে চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে ১২৭ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৭ সালে মারা যান ৩০ জন।

গত তিনদিন সরেজমিন দেখা গেছে, রেলওয়ের লেকসিটি আবাসিক এলাকা-সংলগ্ন পাহাড়ে ২২টি পরিবার, পূর্ব ফিরোজ শাহ ১ নম্বর ঝিল-সংলগ্ন পাহাড়ে ২৮টি পরিবার, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন কৈবল্যধাম বিশ্ব কলোনি পাহাড়ে ২৮টি পরিবার, পরিবেশ অধিদপ্তর-সংলগ্ন সিটি করপোরেশন পাহাড়ে ১০টি পরিবার, রেলওয়ে, সওজ, গণপূর্ত অধিদপ্তর ও ওয়াসার মালিকানাধীন মতিঝর্ণা ও বাটালি হিলে ১৬২টি পরিবার, ব্যক্তিমালিকানাধীন একে খান পাহাড়ে ২৬টি পরিবার, হারুন খানের পাহাড়ে ৩৩টি পরিবার, পলিটেকনিক কলেজ-সংলগ্ন পাহাড়ে ৪৩টি পরিবার, মধুশাহ পাহাড়ে ৩৪টি পরিবার, ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট-সংলগ্ন পাহাড়ে ৩৩টি পরিবার, মিয়ার পাহাড়ে ৩২টি পরিবার, আকবর শাহ আবাসিক এলাকা-সংলগ্ন পাহাড়ে ২৮টি পরিবার, আমিন কলোনি-সংলগ্ন ট্যাংকির পাহাড়ে ১৬টি পরিবার, লালখান বাজার জামেয়াতুল উলুম মাদ্রাসা-সংলগ্ন পাহাড়ে ১১টি পরিবার, ভেড়া ফকিরের পাহাড়ে ১১টি পরিবার, ফয়’স লেক আবাসিক এলাকা-সংলগ্ন পাহাড়ে নয়টি পরিবার এবং এমআর সিদ্দিকী পাহাড়ে আটটি পরিবার বসবাস করছে। এর বাইরেও ঝুঁকিপূর্ণভাবে অনেকে পাহাড়ে বসবাস করছে।

অভিযোগ রয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে প্রভাবশালীরা পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন করলেও প্রশাসনের এ বিষয়ে তেমন নজর নেই। বিশেষ করে সীতাকু-ের জঙ্গল ছলিমপুর এলাকায় পাহাড় কেটে স্থাপনা তৈরি করে বসবাস করছেন বহু মানুষ। সেখানে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী লিটন মজুমদার বলেন, ২০০৪ সাল থেকে এখানে বসবাস করছি। আমাদের এখানে কোন পাহাড়ধসের ঘটনা নেই। স্বল্প বেতনে চাকরি করি। এখানে বাসা ভাড়া কম, তাই থাকি।

ডেইজি দাশ নামে একজন বলেন, মনিকা রানী নামের একজনকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়ে ছলিমপুর এলাকার পাহাড়ে বসবাস শুরু করি। প্রশাসন একবার উচ্ছেদও করে। পরে আবার এখানে ঘর তৈরি করে থাকা শুরু করি। মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, তাই বাধ্য হয়ে এখানে থাকতে হচ্ছে।

জোছনা বেগম নামে আরেকজন বলেন, বৃষ্টি হলেই ভয়ে থাকি। যাওয়ার জায়গা নেই। কেউ পুনর্বাসনেরও ব্যবস্থা করে না। এ কারণে এখানে থাকা। পরিমল নামের একজন পরিবারের ছয় সদস্য নিয়ে থাকেন বায়েজিদ থেকে সীতাকু-ে যাওয়া সিডিএ লিংক রোডের পাশের পাহাড়ে। তিনি বলেন, মাসে যা আয় করি, এখানে থাকা ছাড়া তো উপায় নেই। ধস হলে বিপদ হবে জেনেও এখানে থাকতে বাধ্য হচ্ছি। সরকার পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করলে চলে যাব।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরীতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাহাড়ে বসবাস করছেন কমপক্ষে ২০ হাজার মানুষ। পুরো জেলায় পাহাড়ে বসবাসকারীর সংখ্যা এক লাখের ওপরে। এ বছরও যদি বেশি পরিমাণে বৃষ্টি হয় তাহলে পাহাড়ধস হতে পারে। প্রাণহানিও ঘটতে পারে। পাহাড়ের আরেক বাসিন্দা মায়া আক্তার বলেন, পুনর্বাসনের জন্য প্রশাসন থেকে আমাদের তালিকা করে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ঝুঁকি নিয়েও আমাদের এখানে বসবাস করতে হচ্ছে।

এ বিষয়ে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ নাজমুল আহসান বলেন, পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারীদের সরে যেতে মাইকিং করছি। ব্যক্তিগত ও সরকারি পাহাড় যেসব সংস্থার মালিকানায় আছে তাদের অবৈধ বসবাসকারীদের তালিকা করার জন্য বলেছি। ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের পাহাড় ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার জন্য মাইকিং হচ্ছে। এর মধ্যে আমাদের উচ্ছেদ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরীতে পাহাড় কাটার দায়ে ৪৪ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। যার মধ্যে সরকারি সংস্থা ও ব্যক্তি রয়েছেন। এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল্লাহ নুরী গত মঙ্গলবার এ প্রতিবেদকে বলেন, পাহাড় কাটা রোধে নিয়মিত মামলা করা হয়। পাশাপাশি জরিমানাও করা হয়। কিন্তু এসব করেও পাহাড় কাটা ঠেকানো যাচ্ছে না। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে, যারা পাহাড়ের মালিক তাদেরই পাহাড় রক্ষা করতে হবে। পাহাড় কাটার জন্য শুধু পরিবেশ অধিদপ্তরের ওপর দায় চাপানো উচিত হবে না। যার পাহাড় তারই সেটা রক্ষার প্রাথমিক দায়িত্ব।

পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সরকারি হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী বলেন, চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোতে বালি মাটি বেশি। ফলে ২০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হলে পাহাড়ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রামে এক শ্রেণীর চিহ্নিত ভূমিদস্যু পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িত। যারা পাহাড় দখল করে স্থাপনা তৈরির মাধ্যমে ভাড়া আদায় করে। তারা বিভিন্ন দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তিনি আরও বলেন, প্রশাসনের লোকজনকে দেখি বছরের ১০ মাস পাহাড় নিয়ে নীরব থাকেন।

শুধু মে-জুন এলে পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারীদের নিয়ে কথা বলেন। পাহাড়ে যারা অবৈধভাবে বসবাস করেন তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। একটা শ্রেণী চায়না অবৈধ বসবাসকারীরা পাহাড় থেকে নেমে আসুক। নেমে আসলে পাহাড় দখলের প্রক্রিয়াটা থেমে যাবে। এ কারণে পাহাড়ে যারা অবৈধ স্থাপনা তৈরির সঙ্গে জড়িত তাদের নিবৃত করতে হবে। তা না করা গেলে পাহাড় কাটা অব্যাহত থাকবে। আর পাহাড়ধসে মারা যাবে নিম্নআয়ের মানুষ।

পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারীদের বিষয়ে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমান বলেন, পাহাড়ে অবৈধ দখলদার ও ভূমিদস্যু কেউ থাকলে তাদের উচ্ছেদ করা হবে। যারা ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় বসবাস করছেন, বৃষ্টি হলে পাহাড়ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারে এমন স্থানে বসবাসকারীদের সরিয়ে আনা হবে। এ বছর কোন প্রাণহানির ঘটনা যাতে না ঘটে সে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। অবৈধভাবে পাহাড় দখলকারীদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারি জায়গা কেউ বিক্রি করতে পারে না।

যে কোন মুহূর্তে সরকার এসব জায়গা উদ্ধার করতে পারে। জঙ্গল ছলিমপুরকে নিয়ে আমাদের বিশেষ পরিকল্পনা আছে। একটি রিপোর্ট তৈরি হচ্ছে। সরকারি অনেক স্থাপনা জঙ্গল ছলিমপুরে স্থানান্তরের চিন্তাভাবনা চলছে। সুতরাং যারা অবৈধ দখলদার তাদের উচ্ছেদ করতে আমাদের সময় লাগবে না। সরকারের চেয়ে শক্তিশালী কেউ নেই।

এদিকে গতকাল নগরের লালখান বাজার সংলগ্ন একেখান পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারীদের উচ্ছেদে অভিযান পরিচালনা করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।

সকাল ৯টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত এ অভিযান পরিচালিত হয়। এ সময় ৪৭টি পরিবারের স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

অভিযানে নেতৃত্ব দেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ ইনামুল হাছান ও কাট্টলী সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফাহমিদা আফরোজ। পরিবেশ অধিদপ্তর, পিডিবি, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ ইনামুল হাছান বলেন, লালখান বাজার সংলগ্ন একে খান পাহাড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধভাবে বসবাসরত ৪৭টি পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। আমাদের এ অভিযান চলমান থাকবে।

বৃহস্পতিবার, ২৪ জুন ২০২১ , ১০ আষাঢ় ১৪২৮ ১২ জিলকদ ১৪৪২

চট্টগ্রামে পাহাড়ে মৃত্যুঝুঁকিতে ৮৩৫ পরিবার

নিরুপম দাশগুপ্ত, চট্টগ্রাম

image

চট্টগ্রাম : পাহাড়ে বসতি উচ্ছেদ করা হয় -সংবাদ

চট্টগ্রামে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিম্ন শ্রেণীর মানুষ পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছেন। তবে পাহাড় ধসে প্রাণহানি না ঘটতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন উচ্ছেদ থেকে শুরু করে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে গতকাল ৪৭টি স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। তবুও এক শ্রেণীর মানুষ ভাড়ায় চালানোর জন্য নির্বিচারে পাহাড় কেটে বসতঘর তৈরি করে ভাড়া উত্তোলন করে আসছে। ফলে বৃষ্টি হলেই পাহাড়ের মাটি ধসে দুর্ঘটনা ঘটছে।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন ১৭টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ৮৩৫টি পরিবার বসবাস করছে।

অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণভাবে ব্যক্তিমালিকানাধীন ১০টি পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৫৩১টি। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মালিকানাধীন সাতটি পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৩০৪টি। ২০০৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে পাহাড়ধসে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় ২০০৭ সালে। ওই বছরের ১১ জুন টানা বর্ষণের ফলে চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে ১২৭ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৭ সালে মারা যান ৩০ জন।

গত তিনদিন সরেজমিন দেখা গেছে, রেলওয়ের লেকসিটি আবাসিক এলাকা-সংলগ্ন পাহাড়ে ২২টি পরিবার, পূর্ব ফিরোজ শাহ ১ নম্বর ঝিল-সংলগ্ন পাহাড়ে ২৮টি পরিবার, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন কৈবল্যধাম বিশ্ব কলোনি পাহাড়ে ২৮টি পরিবার, পরিবেশ অধিদপ্তর-সংলগ্ন সিটি করপোরেশন পাহাড়ে ১০টি পরিবার, রেলওয়ে, সওজ, গণপূর্ত অধিদপ্তর ও ওয়াসার মালিকানাধীন মতিঝর্ণা ও বাটালি হিলে ১৬২টি পরিবার, ব্যক্তিমালিকানাধীন একে খান পাহাড়ে ২৬টি পরিবার, হারুন খানের পাহাড়ে ৩৩টি পরিবার, পলিটেকনিক কলেজ-সংলগ্ন পাহাড়ে ৪৩টি পরিবার, মধুশাহ পাহাড়ে ৩৪টি পরিবার, ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট-সংলগ্ন পাহাড়ে ৩৩টি পরিবার, মিয়ার পাহাড়ে ৩২টি পরিবার, আকবর শাহ আবাসিক এলাকা-সংলগ্ন পাহাড়ে ২৮টি পরিবার, আমিন কলোনি-সংলগ্ন ট্যাংকির পাহাড়ে ১৬টি পরিবার, লালখান বাজার জামেয়াতুল উলুম মাদ্রাসা-সংলগ্ন পাহাড়ে ১১টি পরিবার, ভেড়া ফকিরের পাহাড়ে ১১টি পরিবার, ফয়’স লেক আবাসিক এলাকা-সংলগ্ন পাহাড়ে নয়টি পরিবার এবং এমআর সিদ্দিকী পাহাড়ে আটটি পরিবার বসবাস করছে। এর বাইরেও ঝুঁকিপূর্ণভাবে অনেকে পাহাড়ে বসবাস করছে।

অভিযোগ রয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে প্রভাবশালীরা পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন করলেও প্রশাসনের এ বিষয়ে তেমন নজর নেই। বিশেষ করে সীতাকু-ের জঙ্গল ছলিমপুর এলাকায় পাহাড় কেটে স্থাপনা তৈরি করে বসবাস করছেন বহু মানুষ। সেখানে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী লিটন মজুমদার বলেন, ২০০৪ সাল থেকে এখানে বসবাস করছি। আমাদের এখানে কোন পাহাড়ধসের ঘটনা নেই। স্বল্প বেতনে চাকরি করি। এখানে বাসা ভাড়া কম, তাই থাকি।

ডেইজি দাশ নামে একজন বলেন, মনিকা রানী নামের একজনকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়ে ছলিমপুর এলাকার পাহাড়ে বসবাস শুরু করি। প্রশাসন একবার উচ্ছেদও করে। পরে আবার এখানে ঘর তৈরি করে থাকা শুরু করি। মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, তাই বাধ্য হয়ে এখানে থাকতে হচ্ছে।

জোছনা বেগম নামে আরেকজন বলেন, বৃষ্টি হলেই ভয়ে থাকি। যাওয়ার জায়গা নেই। কেউ পুনর্বাসনেরও ব্যবস্থা করে না। এ কারণে এখানে থাকা। পরিমল নামের একজন পরিবারের ছয় সদস্য নিয়ে থাকেন বায়েজিদ থেকে সীতাকু-ে যাওয়া সিডিএ লিংক রোডের পাশের পাহাড়ে। তিনি বলেন, মাসে যা আয় করি, এখানে থাকা ছাড়া তো উপায় নেই। ধস হলে বিপদ হবে জেনেও এখানে থাকতে বাধ্য হচ্ছি। সরকার পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করলে চলে যাব।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরীতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাহাড়ে বসবাস করছেন কমপক্ষে ২০ হাজার মানুষ। পুরো জেলায় পাহাড়ে বসবাসকারীর সংখ্যা এক লাখের ওপরে। এ বছরও যদি বেশি পরিমাণে বৃষ্টি হয় তাহলে পাহাড়ধস হতে পারে। প্রাণহানিও ঘটতে পারে। পাহাড়ের আরেক বাসিন্দা মায়া আক্তার বলেন, পুনর্বাসনের জন্য প্রশাসন থেকে আমাদের তালিকা করে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ঝুঁকি নিয়েও আমাদের এখানে বসবাস করতে হচ্ছে।

এ বিষয়ে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ নাজমুল আহসান বলেন, পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারীদের সরে যেতে মাইকিং করছি। ব্যক্তিগত ও সরকারি পাহাড় যেসব সংস্থার মালিকানায় আছে তাদের অবৈধ বসবাসকারীদের তালিকা করার জন্য বলেছি। ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের পাহাড় ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার জন্য মাইকিং হচ্ছে। এর মধ্যে আমাদের উচ্ছেদ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরীতে পাহাড় কাটার দায়ে ৪৪ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। যার মধ্যে সরকারি সংস্থা ও ব্যক্তি রয়েছেন। এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল্লাহ নুরী গত মঙ্গলবার এ প্রতিবেদকে বলেন, পাহাড় কাটা রোধে নিয়মিত মামলা করা হয়। পাশাপাশি জরিমানাও করা হয়। কিন্তু এসব করেও পাহাড় কাটা ঠেকানো যাচ্ছে না। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে, যারা পাহাড়ের মালিক তাদেরই পাহাড় রক্ষা করতে হবে। পাহাড় কাটার জন্য শুধু পরিবেশ অধিদপ্তরের ওপর দায় চাপানো উচিত হবে না। যার পাহাড় তারই সেটা রক্ষার প্রাথমিক দায়িত্ব।

পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সরকারি হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী বলেন, চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোতে বালি মাটি বেশি। ফলে ২০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হলে পাহাড়ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রামে এক শ্রেণীর চিহ্নিত ভূমিদস্যু পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িত। যারা পাহাড় দখল করে স্থাপনা তৈরির মাধ্যমে ভাড়া আদায় করে। তারা বিভিন্ন দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তিনি আরও বলেন, প্রশাসনের লোকজনকে দেখি বছরের ১০ মাস পাহাড় নিয়ে নীরব থাকেন।

শুধু মে-জুন এলে পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারীদের নিয়ে কথা বলেন। পাহাড়ে যারা অবৈধভাবে বসবাস করেন তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। একটা শ্রেণী চায়না অবৈধ বসবাসকারীরা পাহাড় থেকে নেমে আসুক। নেমে আসলে পাহাড় দখলের প্রক্রিয়াটা থেমে যাবে। এ কারণে পাহাড়ে যারা অবৈধ স্থাপনা তৈরির সঙ্গে জড়িত তাদের নিবৃত করতে হবে। তা না করা গেলে পাহাড় কাটা অব্যাহত থাকবে। আর পাহাড়ধসে মারা যাবে নিম্নআয়ের মানুষ।

পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারীদের বিষয়ে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমান বলেন, পাহাড়ে অবৈধ দখলদার ও ভূমিদস্যু কেউ থাকলে তাদের উচ্ছেদ করা হবে। যারা ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় বসবাস করছেন, বৃষ্টি হলে পাহাড়ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারে এমন স্থানে বসবাসকারীদের সরিয়ে আনা হবে। এ বছর কোন প্রাণহানির ঘটনা যাতে না ঘটে সে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। অবৈধভাবে পাহাড় দখলকারীদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারি জায়গা কেউ বিক্রি করতে পারে না।

যে কোন মুহূর্তে সরকার এসব জায়গা উদ্ধার করতে পারে। জঙ্গল ছলিমপুরকে নিয়ে আমাদের বিশেষ পরিকল্পনা আছে। একটি রিপোর্ট তৈরি হচ্ছে। সরকারি অনেক স্থাপনা জঙ্গল ছলিমপুরে স্থানান্তরের চিন্তাভাবনা চলছে। সুতরাং যারা অবৈধ দখলদার তাদের উচ্ছেদ করতে আমাদের সময় লাগবে না। সরকারের চেয়ে শক্তিশালী কেউ নেই।

এদিকে গতকাল নগরের লালখান বাজার সংলগ্ন একেখান পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারীদের উচ্ছেদে অভিযান পরিচালনা করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।

সকাল ৯টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত এ অভিযান পরিচালিত হয়। এ সময় ৪৭টি পরিবারের স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

অভিযানে নেতৃত্ব দেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ ইনামুল হাছান ও কাট্টলী সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফাহমিদা আফরোজ। পরিবেশ অধিদপ্তর, পিডিবি, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ ইনামুল হাছান বলেন, লালখান বাজার সংলগ্ন একে খান পাহাড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধভাবে বসবাসরত ৪৭টি পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। আমাদের এ অভিযান চলমান থাকবে।