হতে হবে প্রান্তজনের সখা

শেখর ভট্টাচার্য

বাঙালি মনস্তত্ব বড়ই বিচিত্র। কিছুটা তুলনা করা যায় আকাশের রঙের সঙ্গে। স্থির কিংবা সরল কোন রূপ নেই। বাঙালির মনকে সাধারণিকরণ করা বড়ই কঠিন। বাঙালিকে বলা হয় আবেগপ্রবণ। এই একটি বিষয়ে সব বাঙালি একই সমতলে দাঁড়িয়ে। আবেগের কারণেই বাঙালি মনস্তত্ব পাঠের জন্য অত্যন্ত কঠিন বিষয়। তবে বাঙালি বেশিরভাগ সময় চরমপন্থি। মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে উচ্চলয়ে, চূড়ান্ত রায় দিয়ে বসে একসঙ্গে, না হলে মনে হয় মতামত প্রকাশ করা গেল না। শুধু মতামত কেন, অন্য যে কোন বিষয়েও এই চরমপন্থা আমরা লক্ষ্য করি। ভালোবাসাতেও চরম, ঘৃণা প্রকাশেও একই রকম চরমপন্থা। উদাহরণ দিতে যাচ্ছি না, আমাদের সবার অজস্র উদাহরণ জানা আছে। এই যে চরম পন্থা অবলম্বন এরও কারণ আবেগ। এই আবেগ যখন পবিত্র দেশপ্রেমের হয় তখন তা দুর্দমনীয়। আবার এই আবেগ কখনো কখনো হয়ে পড়ে দাসত্ব গ্রহণের জন্য। স্বাধীনতার জন্য মরণপণ লড়াই করে যে বাঙালি, সে বাঙালি ব্রিটিশ শাসনের উচ্চমানের প্রশংসায় বেহিসাবি। আইয়ূব খানের আমলের শাসন যে বাঙালির জন্য যথাযথ ছিল, এ রকম আলোচনাও বাঙালি রাখঢাক না করেই করে থাকে। বাঙালির মনের ভেতর স্বাধীনতার জন্য প্রবল আকাক্সক্ষা, একইভাবে ফেলে আসা উপনিবেশের প্রতি এক ধরনের আন্তরিক টানও লক্ষণীয়। বিস্ময়ের ঘোর কাটে না! বাঙালি মানসের অন্তর্গত রূপটা কী?

বাঙালি মানসের প্রকৃষ্ট উদাহরণ অসংখ্য। কত নাম বলব। সবাই আলোর পথের যাত্রী। খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা বাঙালি মানসের বিস্তীর্ণ আলোকময় প্রান্তরের অন্বেষায় ছিলেন জীবনভর। তাদের চিন্তা-চেতনা আমাদের দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। তবে তাদের কী আমরা আমাদের জাতীয়-মনস্তত্বের প্রতিনিধি বলতে পারি। তাদের চরিত্রের উচ্চমান, হৃদয়ের উদারতা, অসীম সৃষ্টিশীলতা, জ্ঞানবিজ্ঞানে দক্ষতার বিষয়ে কোন প্রশ্ন নাই। গড় বাঙালি মানস তাদের ধারে কাছেও অবস্থান করে না। বাঙালি মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত অবচেতন মনে নীল রক্তের অধিকারী হওয়ার কামনা যে করে না এ কথাটি আমরা হলফ করে বলতে পারি না। ব্রিটিশ আমলে একদল বাঙালি কৃত্রিম নীলরক্তধারী হওয়ার মরণপণ লড়াই করে যেতো। ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজ কলকাতা বন্দরে পৌঁছার পরই প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ব্রিটিশ বেনিয়াদের মালামাল খালাস করার জন্য অনেকেই কুলি জোগাড় করে মাল খালাস করেছেন, এর পর মাল খালাসের কন্ট্রাক্টর হয়েছেন। হঠাৎ করে কাঁচা টাকা হাতে এসেছে। অর্থ তাদের প্রতিপত্তি দিয়েছে। দিয়েছে সম্মান। ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার শাসন ভার হাতে নেয়ার পর কি হলো? আবার প্রতিযোগিতা। তোষামোদির প্রতিযোগিতা। তোষামোদি করে আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে প্রথমে বিশ্বস্থ হওয়ার প্রচেষ্টা। বিশ্বস্ততা থেকে নানা পদ, নানা খেতাব।

বিশ্বস্তদের বিশ্বস্ততার পরিমাণ অনুযায়ী ছোট বড় জমিদারির মালিক হওয়া। এ রকম জমিদারি এবং খেতাব যারা পেয়েছেন তারা মনে প্রাণে বাঙালি ছিলেন না। তারা অনন্য অভিজাত, ইংরেজের কাছাকাছি অলীক নীল রক্তধারী বাঙালি। তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল প্রজা নিপীড়নের। যারা নিপীড়নের মাধ্যমে ইংরেজ শাসকদের কাছে অধিক পরিমাণ কর জমা দিতে পারতেন তারা হতেন শাসকদের কাছে গ্রহণীয়। তাদের জমিদারির ব্যপ্তি বেড়ে যেত, অর্থ, সম্পদের পরিমাণ বাড়ত সমান তালে। তোষণ, শোষন, তাবেদারির জন্য দেয়া হতো, প্রিন্স, রায় বাহাদুর, খান বাহাদুর খেতাব। পরবর্তীতে তারাই বাংলার অভিজাত গোষ্ঠী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। ইতিহাসে বাঙালি সত্তা ও মননের নির্মোহ বিশ্লেষণের পাতায় পাতায় লেখা আছে তাদের তোষন ও শোষণের কাহিনী। বাঙালি মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত অনেকেই পছন্দ করেন খান বাহাদুর, রায় বাহাদুরদের আমলের কিসসা বলতে। মনের গহীনে মেকি নীল রক্ত ডাক দিয়ে যায়। অবচেতনে উত্তরাধিকারী হিসেবে অধিকাংশ মানুষ গর্ববোধ করেন এখনও। যারা খেতাবধারীদের উত্তরসূরি হিসাবে গর্ববোধ করেন তারা আবার নিজেদের বিবেচনা ও রুচিবোধ নিয়ে কিছুটা অহংকারও করে থাকেন, নিজেদের এখনও ভেবে থাকেন অনন্য। কী বিস্ময়কর?

বাঙালির বিশ্বস্ত হওয়ার প্রতিযোগিতা না থাকলে ব্রিটিশরা কি করে ২০০ বছর, এ’দেশকে শাসন করে? নীরদ সি চৌধুরীর মতো মানুষ তোষামোদি করেছেন প্রকাশ্যে। অবশ্য তিনি জমিদার ছিলেন না। প্রজা ছিলেন। তার কথায় আসছি পরে। পাকিস্তান আমলেও তাবেদারের সংখ্যা কম ছিল না। তবে তাবেদারদের মধ্যে সাধারণ মানুষ ছিল না। সাধারণ কৃষক, শ্রমিকদের ধর্মের দোহাই দিয়ে যা বোঝানো হয়েছে, সরল মনে তারা তাই বুঝেছেন। বাঙালি মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের বর্ম হলো ধর্ম। ধর্মকে সামনে ঢাল হিসাবে রেখে অনেক কুকর্ম করা সহজ। পাকিস্তান আমলে বাঙালিদের মধ্যে অনেকেই রাজাকার, আল বদর, আলশামস হতে দ্বিধা করেননি। তারা পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, জাতির আলোক বর্তিকা হাতে নিয়ে যারা হাঁটছিলেন সে সব মানুষদের বাড়িতে। শহীদ উল্লাহ কায়সার, গোবিন্দ চন্দ্র দেব, মুনীর চৌধুরীসহ অসংখ্য আলোকিত বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করে দেয় আমাদেরই কারো না কারো স্বজন। বাঙালি শিক্ষার্থীরাই শিক্ষকদের মধুর স্বরে মধ্যরাতে দরজায় কড়া নেড়ে জল্লাদ খানায় নিয়ে গেছে। কারা এই শিক্ষার্থীরা? আমাদেরই আত্মীয় স্বজন কিংবা বৃহত্তর পরিবারের কেউ না কেউ। তাদের সংখ্যা একেবারে কম ছিল না। স্বাধীনতার পর নামজাদা অনেকে গর্তে ঢোকে গেছেন, অনেকে পালিয়ে গেছেন। চুনো, পুঁটিরা বৃহত্তর সমাজের স্রোতে মিশে গিয়ে “স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন। “কিছু সংখ্যক মানুষকে কারাগারে নেয়া হয়েছিল। তাদের পরে ফুলের মালা গলায় দিয়ে মন্ত্রী, এমপি কিংবা লাভজনক পদে বসানো হয়েছে। সব সময় কিছু মানুষ তৈরি থাকেন যে কেউ এসে সংবিধানকে স্থগিত করা হলো বললেই অধস্তন হয়ে দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে জাতিকে উদ্ধার করার জন্য তারা প্রস্তুত।

এই অধস্তন হওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে কিংবা তারও আগে। দৃশ্যমান হয়েছে ব্রিটিশ আমলে। বিখ্যাত লেখক নীরদ সি. চৌধুরী মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত একজন সৃষ্টিশীল এবং স্বাধীনচেতা লেখক হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। তার মতো মানুষ নিজেকে পরিচয় দিতেন “আমি একাধারে বাঙালি ও ইংরেজ”। তার লেখা “আমার দেবোত্তর সম্পত্তি”তে (পৃষ্ঠা ১১৫-১১৬) তিনি মরণপণ যুক্তি তর্ক উপস্থাপন করেছেন তিনি কীভাবে “একাধারে বাঙালি ও ইংরেজ”। নীরদ চৌধুরী তার লেখনীতে ভারতবর্ষের যা কিছু ভালো, যা এ দেশের মানুষের জীবন-পদ্ধতিকে উন্নত করেছে, জীবনধারায় গতি এনেছে তার সব কিছুকেই ব্রিটিশ শাসনের সুফল বলে দাবি করেন। তার ইংরেজি লেখার দক্ষতা, সাম্রাজ্যবাদকে আশীর্বাদ মনে করা এবং অসাধারণ পান্ডিত্যের পুরস্কার হিসাবে তাকে ১৯৯২ সালে ডিলিট উপাধি প্রদান করা হয়। নিরদ সি’কে নিয়ে ভিন্ন সময়ে অনেক কিছু লেখার ইচ্ছা আছে। আজকের লেখায় তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের মুগ্ধ অধস্থনের উদাহরণ হিসেবেই থাকুন।

এই মুগ্ধ অধস্থন হওয়া এবং এর মাধ্যমে স্বার্থ উদ্ধার করার প্রতিযোগিতায় নামা বাঙালির সংখ্যা এখনও অগণন। শিক্ষিত কিংবা অর্থ ও প্রতিপত্তিশালী বাঙালিরা সেই ঐতিহ্যকে সগৌরবে ধারণ করে সফলতার বিজয় পতাকা পত পত করে উড়িয়ে যাচ্ছেন। সাধারণ বাঙালিরা আগের মতোই আছেন। তারা বৈশ্বিক এই মহামারির সময় আমাদের ফসলের মাঠে হাঁড় খাটা পরিশ্রম করে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকার উপকরণ জোগিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের ৪০ লাখ গার্মেন্ট শ্রমিক তাদের সমস্ত সৃষ্টিশীলতা এবং শ্রম দিয়ে দেশকে এক অন্য পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছেন। কাঁচা পাট দিয়ে বহুমুখী পাট পণ্য উৎপাদন করে আমাদের কুশলী শিল্পীরা পাটের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। অনাদিকাল থেকে এ রকমভাবে আমাদের সাধারণ মানুষেরা আমাদের সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন নানাভাবে।

হালের মুগ্ধ অধস্তনেরা কি করছেন? এখন তো ঔপনিবেশিক শাসন নেই। তাই তারা সবসময় ক্ষমতাসীনদের শাসনে মুগ্ধ। তারা ক্ষমতা কাঠামোয় আছেন অনেকে আবার ক্ষমতা কাঠামোর বাইরে থেকেও মুগ্ধতাকে নানা মাধ্যমে দৃশ্যমান করছেন। মুগ্ধতা দৃশ্যমান করার বিনিময় আছে। এই বাজার অর্থনীতির যুগে আমি মুগ্ধ হবো আপনি আমাকে পুরস্কার দেবেন না, তা কিন্তু হয় না। আমি মুগ্ধ হবো, এর বিনিময়ে আপনাকেও আমার ব্যাপারে মুগ্ধ হতে হবে। কীভাবে? নীরবে হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন করব আপনি আমাকে কিছু বলতে পারবেন না। ফাইল জিম্মি করব, ফাইলের মুক্তিপণ গ্রহণ করব অজস্র কোটি টাকা। চাঁদাবাজি করব, জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচনী এলাকায় নব্য জমিদারি স্থাপন করব, আপনাকে “নীরবতাই হীরণ্ময়” নীতি গ্রহণ করতে হবে। এই নীরবতা কিংবা কার্যকরভাবে সরব না হওয়ার প্রতিদান আছে। সেই প্রতিদান হলো, আপনাকে নির্বাচনী আসন দেব আমি। আপনার শাসনকালে নতুন কালাকানুন তৈরি করে আপনার মেয়াদকালকে মসৃণ করে দেব। এভাবেই পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে বিশ্বস্থতার মাধ্যমে ভালোবাসা স্থাপন করব। সাম্রাজ্যবাদ উত্তর নব্য অধস্তনতার প্রকৃতি হলো এরকম, দেয়া এবং নেয়া।

এই গোলক থেকে বের হতে হলে বিশ্বাসের জায়গাটা পরিবর্তন করতে হবে। বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে প্রান্তজনের ওপর। হতে হবে প্রান্তজনের সখা। বড় কঠিন কাজ। কেউ সাহস করে না। বঙ্গবন্ধুকে জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে এ কারণে। এখন এই সাহসী কাজটি করার সময় হয়েছে। বৃত্তের ভেতর কঠিন ব্যাসার্ধ দিয়ে আমাদের আটকানো হয়েছে। জহির রায়হানের “জীবন থেকে নেয়া” চলচ্চিত্রে শোষণ, শাসনের বেড়ি ভাঙার জন্য একটি অসাধারণ গান ছিল, “এ’ খাঁচা ভাঙতে হবে”। এই চক্র থেকে বের হতে হলে, সময় হয়েছে খাঁচা ভাঙার গান গাওয়ার।

[লেখক : উন্নয়ন গবেষক]

সোমবার, ২৮ জুন ২০২১ , ১৪ আষাঢ় ১৪২৮ ১৬ জিলক্বদ ১৪৪২

হতে হবে প্রান্তজনের সখা

শেখর ভট্টাচার্য

বাঙালি মনস্তত্ব বড়ই বিচিত্র। কিছুটা তুলনা করা যায় আকাশের রঙের সঙ্গে। স্থির কিংবা সরল কোন রূপ নেই। বাঙালির মনকে সাধারণিকরণ করা বড়ই কঠিন। বাঙালিকে বলা হয় আবেগপ্রবণ। এই একটি বিষয়ে সব বাঙালি একই সমতলে দাঁড়িয়ে। আবেগের কারণেই বাঙালি মনস্তত্ব পাঠের জন্য অত্যন্ত কঠিন বিষয়। তবে বাঙালি বেশিরভাগ সময় চরমপন্থি। মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে উচ্চলয়ে, চূড়ান্ত রায় দিয়ে বসে একসঙ্গে, না হলে মনে হয় মতামত প্রকাশ করা গেল না। শুধু মতামত কেন, অন্য যে কোন বিষয়েও এই চরমপন্থা আমরা লক্ষ্য করি। ভালোবাসাতেও চরম, ঘৃণা প্রকাশেও একই রকম চরমপন্থা। উদাহরণ দিতে যাচ্ছি না, আমাদের সবার অজস্র উদাহরণ জানা আছে। এই যে চরম পন্থা অবলম্বন এরও কারণ আবেগ। এই আবেগ যখন পবিত্র দেশপ্রেমের হয় তখন তা দুর্দমনীয়। আবার এই আবেগ কখনো কখনো হয়ে পড়ে দাসত্ব গ্রহণের জন্য। স্বাধীনতার জন্য মরণপণ লড়াই করে যে বাঙালি, সে বাঙালি ব্রিটিশ শাসনের উচ্চমানের প্রশংসায় বেহিসাবি। আইয়ূব খানের আমলের শাসন যে বাঙালির জন্য যথাযথ ছিল, এ রকম আলোচনাও বাঙালি রাখঢাক না করেই করে থাকে। বাঙালির মনের ভেতর স্বাধীনতার জন্য প্রবল আকাক্সক্ষা, একইভাবে ফেলে আসা উপনিবেশের প্রতি এক ধরনের আন্তরিক টানও লক্ষণীয়। বিস্ময়ের ঘোর কাটে না! বাঙালি মানসের অন্তর্গত রূপটা কী?

বাঙালি মানসের প্রকৃষ্ট উদাহরণ অসংখ্য। কত নাম বলব। সবাই আলোর পথের যাত্রী। খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা বাঙালি মানসের বিস্তীর্ণ আলোকময় প্রান্তরের অন্বেষায় ছিলেন জীবনভর। তাদের চিন্তা-চেতনা আমাদের দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। তবে তাদের কী আমরা আমাদের জাতীয়-মনস্তত্বের প্রতিনিধি বলতে পারি। তাদের চরিত্রের উচ্চমান, হৃদয়ের উদারতা, অসীম সৃষ্টিশীলতা, জ্ঞানবিজ্ঞানে দক্ষতার বিষয়ে কোন প্রশ্ন নাই। গড় বাঙালি মানস তাদের ধারে কাছেও অবস্থান করে না। বাঙালি মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত অবচেতন মনে নীল রক্তের অধিকারী হওয়ার কামনা যে করে না এ কথাটি আমরা হলফ করে বলতে পারি না। ব্রিটিশ আমলে একদল বাঙালি কৃত্রিম নীলরক্তধারী হওয়ার মরণপণ লড়াই করে যেতো। ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজ কলকাতা বন্দরে পৌঁছার পরই প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ব্রিটিশ বেনিয়াদের মালামাল খালাস করার জন্য অনেকেই কুলি জোগাড় করে মাল খালাস করেছেন, এর পর মাল খালাসের কন্ট্রাক্টর হয়েছেন। হঠাৎ করে কাঁচা টাকা হাতে এসেছে। অর্থ তাদের প্রতিপত্তি দিয়েছে। দিয়েছে সম্মান। ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার শাসন ভার হাতে নেয়ার পর কি হলো? আবার প্রতিযোগিতা। তোষামোদির প্রতিযোগিতা। তোষামোদি করে আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে প্রথমে বিশ্বস্থ হওয়ার প্রচেষ্টা। বিশ্বস্ততা থেকে নানা পদ, নানা খেতাব।

বিশ্বস্তদের বিশ্বস্ততার পরিমাণ অনুযায়ী ছোট বড় জমিদারির মালিক হওয়া। এ রকম জমিদারি এবং খেতাব যারা পেয়েছেন তারা মনে প্রাণে বাঙালি ছিলেন না। তারা অনন্য অভিজাত, ইংরেজের কাছাকাছি অলীক নীল রক্তধারী বাঙালি। তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল প্রজা নিপীড়নের। যারা নিপীড়নের মাধ্যমে ইংরেজ শাসকদের কাছে অধিক পরিমাণ কর জমা দিতে পারতেন তারা হতেন শাসকদের কাছে গ্রহণীয়। তাদের জমিদারির ব্যপ্তি বেড়ে যেত, অর্থ, সম্পদের পরিমাণ বাড়ত সমান তালে। তোষণ, শোষন, তাবেদারির জন্য দেয়া হতো, প্রিন্স, রায় বাহাদুর, খান বাহাদুর খেতাব। পরবর্তীতে তারাই বাংলার অভিজাত গোষ্ঠী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। ইতিহাসে বাঙালি সত্তা ও মননের নির্মোহ বিশ্লেষণের পাতায় পাতায় লেখা আছে তাদের তোষন ও শোষণের কাহিনী। বাঙালি মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত অনেকেই পছন্দ করেন খান বাহাদুর, রায় বাহাদুরদের আমলের কিসসা বলতে। মনের গহীনে মেকি নীল রক্ত ডাক দিয়ে যায়। অবচেতনে উত্তরাধিকারী হিসেবে অধিকাংশ মানুষ গর্ববোধ করেন এখনও। যারা খেতাবধারীদের উত্তরসূরি হিসাবে গর্ববোধ করেন তারা আবার নিজেদের বিবেচনা ও রুচিবোধ নিয়ে কিছুটা অহংকারও করে থাকেন, নিজেদের এখনও ভেবে থাকেন অনন্য। কী বিস্ময়কর?

বাঙালির বিশ্বস্ত হওয়ার প্রতিযোগিতা না থাকলে ব্রিটিশরা কি করে ২০০ বছর, এ’দেশকে শাসন করে? নীরদ সি চৌধুরীর মতো মানুষ তোষামোদি করেছেন প্রকাশ্যে। অবশ্য তিনি জমিদার ছিলেন না। প্রজা ছিলেন। তার কথায় আসছি পরে। পাকিস্তান আমলেও তাবেদারের সংখ্যা কম ছিল না। তবে তাবেদারদের মধ্যে সাধারণ মানুষ ছিল না। সাধারণ কৃষক, শ্রমিকদের ধর্মের দোহাই দিয়ে যা বোঝানো হয়েছে, সরল মনে তারা তাই বুঝেছেন। বাঙালি মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের বর্ম হলো ধর্ম। ধর্মকে সামনে ঢাল হিসাবে রেখে অনেক কুকর্ম করা সহজ। পাকিস্তান আমলে বাঙালিদের মধ্যে অনেকেই রাজাকার, আল বদর, আলশামস হতে দ্বিধা করেননি। তারা পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, জাতির আলোক বর্তিকা হাতে নিয়ে যারা হাঁটছিলেন সে সব মানুষদের বাড়িতে। শহীদ উল্লাহ কায়সার, গোবিন্দ চন্দ্র দেব, মুনীর চৌধুরীসহ অসংখ্য আলোকিত বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করে দেয় আমাদেরই কারো না কারো স্বজন। বাঙালি শিক্ষার্থীরাই শিক্ষকদের মধুর স্বরে মধ্যরাতে দরজায় কড়া নেড়ে জল্লাদ খানায় নিয়ে গেছে। কারা এই শিক্ষার্থীরা? আমাদেরই আত্মীয় স্বজন কিংবা বৃহত্তর পরিবারের কেউ না কেউ। তাদের সংখ্যা একেবারে কম ছিল না। স্বাধীনতার পর নামজাদা অনেকে গর্তে ঢোকে গেছেন, অনেকে পালিয়ে গেছেন। চুনো, পুঁটিরা বৃহত্তর সমাজের স্রোতে মিশে গিয়ে “স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন। “কিছু সংখ্যক মানুষকে কারাগারে নেয়া হয়েছিল। তাদের পরে ফুলের মালা গলায় দিয়ে মন্ত্রী, এমপি কিংবা লাভজনক পদে বসানো হয়েছে। সব সময় কিছু মানুষ তৈরি থাকেন যে কেউ এসে সংবিধানকে স্থগিত করা হলো বললেই অধস্তন হয়ে দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে জাতিকে উদ্ধার করার জন্য তারা প্রস্তুত।

এই অধস্তন হওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে কিংবা তারও আগে। দৃশ্যমান হয়েছে ব্রিটিশ আমলে। বিখ্যাত লেখক নীরদ সি. চৌধুরী মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত একজন সৃষ্টিশীল এবং স্বাধীনচেতা লেখক হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। তার মতো মানুষ নিজেকে পরিচয় দিতেন “আমি একাধারে বাঙালি ও ইংরেজ”। তার লেখা “আমার দেবোত্তর সম্পত্তি”তে (পৃষ্ঠা ১১৫-১১৬) তিনি মরণপণ যুক্তি তর্ক উপস্থাপন করেছেন তিনি কীভাবে “একাধারে বাঙালি ও ইংরেজ”। নীরদ চৌধুরী তার লেখনীতে ভারতবর্ষের যা কিছু ভালো, যা এ দেশের মানুষের জীবন-পদ্ধতিকে উন্নত করেছে, জীবনধারায় গতি এনেছে তার সব কিছুকেই ব্রিটিশ শাসনের সুফল বলে দাবি করেন। তার ইংরেজি লেখার দক্ষতা, সাম্রাজ্যবাদকে আশীর্বাদ মনে করা এবং অসাধারণ পান্ডিত্যের পুরস্কার হিসাবে তাকে ১৯৯২ সালে ডিলিট উপাধি প্রদান করা হয়। নিরদ সি’কে নিয়ে ভিন্ন সময়ে অনেক কিছু লেখার ইচ্ছা আছে। আজকের লেখায় তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের মুগ্ধ অধস্থনের উদাহরণ হিসেবেই থাকুন।

এই মুগ্ধ অধস্থন হওয়া এবং এর মাধ্যমে স্বার্থ উদ্ধার করার প্রতিযোগিতায় নামা বাঙালির সংখ্যা এখনও অগণন। শিক্ষিত কিংবা অর্থ ও প্রতিপত্তিশালী বাঙালিরা সেই ঐতিহ্যকে সগৌরবে ধারণ করে সফলতার বিজয় পতাকা পত পত করে উড়িয়ে যাচ্ছেন। সাধারণ বাঙালিরা আগের মতোই আছেন। তারা বৈশ্বিক এই মহামারির সময় আমাদের ফসলের মাঠে হাঁড় খাটা পরিশ্রম করে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকার উপকরণ জোগিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের ৪০ লাখ গার্মেন্ট শ্রমিক তাদের সমস্ত সৃষ্টিশীলতা এবং শ্রম দিয়ে দেশকে এক অন্য পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছেন। কাঁচা পাট দিয়ে বহুমুখী পাট পণ্য উৎপাদন করে আমাদের কুশলী শিল্পীরা পাটের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। অনাদিকাল থেকে এ রকমভাবে আমাদের সাধারণ মানুষেরা আমাদের সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন নানাভাবে।

হালের মুগ্ধ অধস্তনেরা কি করছেন? এখন তো ঔপনিবেশিক শাসন নেই। তাই তারা সবসময় ক্ষমতাসীনদের শাসনে মুগ্ধ। তারা ক্ষমতা কাঠামোয় আছেন অনেকে আবার ক্ষমতা কাঠামোর বাইরে থেকেও মুগ্ধতাকে নানা মাধ্যমে দৃশ্যমান করছেন। মুগ্ধতা দৃশ্যমান করার বিনিময় আছে। এই বাজার অর্থনীতির যুগে আমি মুগ্ধ হবো আপনি আমাকে পুরস্কার দেবেন না, তা কিন্তু হয় না। আমি মুগ্ধ হবো, এর বিনিময়ে আপনাকেও আমার ব্যাপারে মুগ্ধ হতে হবে। কীভাবে? নীরবে হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন করব আপনি আমাকে কিছু বলতে পারবেন না। ফাইল জিম্মি করব, ফাইলের মুক্তিপণ গ্রহণ করব অজস্র কোটি টাকা। চাঁদাবাজি করব, জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচনী এলাকায় নব্য জমিদারি স্থাপন করব, আপনাকে “নীরবতাই হীরণ্ময়” নীতি গ্রহণ করতে হবে। এই নীরবতা কিংবা কার্যকরভাবে সরব না হওয়ার প্রতিদান আছে। সেই প্রতিদান হলো, আপনাকে নির্বাচনী আসন দেব আমি। আপনার শাসনকালে নতুন কালাকানুন তৈরি করে আপনার মেয়াদকালকে মসৃণ করে দেব। এভাবেই পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে বিশ্বস্থতার মাধ্যমে ভালোবাসা স্থাপন করব। সাম্রাজ্যবাদ উত্তর নব্য অধস্তনতার প্রকৃতি হলো এরকম, দেয়া এবং নেয়া।

এই গোলক থেকে বের হতে হলে বিশ্বাসের জায়গাটা পরিবর্তন করতে হবে। বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে প্রান্তজনের ওপর। হতে হবে প্রান্তজনের সখা। বড় কঠিন কাজ। কেউ সাহস করে না। বঙ্গবন্ধুকে জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে এ কারণে। এখন এই সাহসী কাজটি করার সময় হয়েছে। বৃত্তের ভেতর কঠিন ব্যাসার্ধ দিয়ে আমাদের আটকানো হয়েছে। জহির রায়হানের “জীবন থেকে নেয়া” চলচ্চিত্রে শোষণ, শাসনের বেড়ি ভাঙার জন্য একটি অসাধারণ গান ছিল, “এ’ খাঁচা ভাঙতে হবে”। এই চক্র থেকে বের হতে হলে, সময় হয়েছে খাঁচা ভাঙার গান গাওয়ার।

[লেখক : উন্নয়ন গবেষক]