মুক্তিযুদ্ধ ও মুজিব বাহিনী

মোস্তাফা জব্বার

এক ॥

এখন এই কথাটি বলা যাবে না যে আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার লড়াই বীর মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের অবদান নিয়ে আলোচনা করি না। বস্তুত প্রচুর আলাপ আলোচনা-টক শো-নিবন্ধ কোনটারই তেমন কোন অভাব নেই। বিশেষ করে ২০২০ সালের মুজিব বর্ষে এর ব্যাপক আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। টিভি চ্যানেলগুলো প্রতিদিনের ঘটনাবলীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরছে। ২১ সালের মুজিববর্ষ ও সুবর্ণজয়ন্তীতেও ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। আমার কাছে মনে হয় দিনে দিনে ইতিহাসের পাতা খুঁড়ে আমরা নিত্যনতুন তথ্য বের করছি। ২০ সাল পুরোটা কেটেছে আমার বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখতে। ২১ সালেও সেটি অব্যাহত আছে। যখনই কোন নতুন তথ্য পাই তখনই মূল লেখায় যুক্ত করি। জাতির জনকের তিনটি বই এবং সিক্রেটস ডকুমেন্টের কয়েকটি খণ্ড প্রকাশের ফলে বঙ্গবন্ধু, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রাপ্তি সহজ হয়েছে। সেই সুবাদে ডাক বিভাগ থেকে একটি অসাধারণ অ্যালবামও সম্পাদনা করেছি আমি।

এবার ২১ সালটাকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সংরক্ষণ করা যায়। কিন্তু খুব সত্যি কথা হচ্ছে এইসব আলোচনায় দুটি বিষয় অনুপস্থিত থাকে। প্রথমত ১ মার্চের আগে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি পর্ব বিশেষত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ত্বে কৃষক-শ্রমিক ছাত্র জনতার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের বীজ বপনের বিষয়গুলো তেমন আলোচিত হয়না। আমি ভাষা আন্দোলনকে বিত্তি করে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনটাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। দ্বিতীয়ত মুক্তিযুদ্ধের একটি বিশাল যোদ্ধাবাহিনী আলোচনায় আসেইনা। এমনকি সেই যোদ্ধাদের নামও কেউ ইচ্চারণ করেনি। তারা মুক্তিযোদ্ধা সনদও পায়নি। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীকে দ্বারপ্রান্তে রেখে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এই দুটি অনালোকিত বিষয়কে পাদপ্রদীপের আলোচনায় আনতেই হবে।

আমি অবশ্যই এটি মনে করি যে প্রথাগতভাবেই বাঙ্গালীর প্রবণতা হচ্ছে বিস্মৃতপরায়ণতা। যে কারণে আমরা পঁচাত্তরের কথা মনে রাখিনা, বা যে কারণে আমরা জিয়া-এরশাদের কুকীর্তির কথা ভুলে যাই, যে কারণে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বা বেগম খালেদা জিয়ার দুঃশাসন এবং তারেক রহমানের দুর্নীতি আমাদের স্মরণেই থাকে না অথবা গোলাম আজম-নিজামী-মুজাহিদ-সাকাদেরকে মর্যাদার আসনে বসাই, কিংবা যে কারণে আমরা ২০১৩ সালে জামায়াত-বিএনপি-হেফাজতের জঘন্য সন্ত্রাস মনে রাখি নাই, যে কারণে আমরা হয়তো ২০১৫ সালের আগুনে পোড়া মানুষগুলোকেও মনে রাখি নাই; সেই একই কারণে আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসের বিশাল ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলো প্রায় ভুলে রয়েছি। এমনও হতে পারে নাসিরনগর, জিকাতলা, বগুড়া, সুনামগঞ্জের শাল্লার নোয়াগাঁও এর লুটপাট-ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লুটপাট-অগ্নিসংযোগ বা হাটহাজারীর লঙ্কাকা-ও কেউই মনে রাখবে না। বিশেষ করে বিষয়গুলো যদি নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের সামনে ইতিহাসের পাতার অনালোকিত অধ্যায়গুলো তুলে ধরতে পারি তবে জাতি তার প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে না। এখন ৩০ বছরের নিচে যাদের বয়স, এমন অনেককেই আমি শুধু গেঞ্জি পরা জিয়াউর রহমানের ছবির কথা মনে করতে পারে বলে দেখে আসছি। এরশাদের কথা তারা একদম ভুলে না। কিন্তু যদি কেউ জয় বাংলার কথা বলে তাহলে ধরে নেয় এটি হলো আওয়ামী লীগের দলীয় সেøøাগান। এটি যে ঊনসত্তুর সালে জন্ম নিয়েছে এবং একাত্তর সালে পুরো জাতির সেøøাগান ছিল এবং বাংলাদেশের মানুষ যে সারা দুনিয়ায় জয় বাংলার লোক হিসেবে পরিচিত হতো সেটি তারা একেবারে জানেই না। খোদ জিয়াউর রহমান যে জয় বাংলা সেøাগান দিয়ে যুদ্ধ করেছেন সেটিও ওরা শুনেনি। তবে এবার এমন মন্তব্য করা দরকার যে ১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে পুরো দেশ আরও একবার একাত্তরের মতোই জয়বাংলা সেøাগান দিয়ে জেগে উঠেছিল। আমি খুব অবাক হই যখন আমাদের দেশের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা জয় বাংলা সেøাগান দিয়ে বক্তব্য রাখতে সংকোচ বোধ করেন। এটি যদি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সেøাগান হয়ে থাকে তবে সর্বত্র-সব সময়ে কেন আমরা সবাই জয় বাংলা সেøøাগান দিতে পারব না। প্রধানমন্ত্রী সম্প্র্রতি এই বিষয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

এমনিভাবে কেউ যদি বলে যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিব বাহিনী নামক একটি বাহিনী ছিল তবে তারা অবাক হয়ে যায়। মুজিব বাহিনীর যারা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছেন তারাও নিজেদের মুজিব বাহিনীর পরিচয় দেন না। আমার মতো অনেকেই মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটের জন্য আবেদনও করেননি। অথচ আমি লক্ষ্য করেছি যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে প্রধানত ছাত্রলীগের যেসব বীর যোদ্ধারা অংশগ্রহণ করেন তারা প্রায় সবাই মুজিব বাহিনীর সদস্য ছিলেন। প্রায় সবারই সাধারণ ধারণা শুধু মুক্তিবাহিনী নামক একটি বাহিনীই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ করেছে। আর ধারণা হলো মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যুদ্ধ করেছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। বেঙ্গল লিবারেশন ফোর্স বা বিএলএফের নাম শুনেছে এমন লোক হাতে গুনেও পাওয়া যায় না। মুজিব বাহিনী বা বিএলএফ যে একই বাহিনী সেটিও তারা জানে না। আমাদের মিডিয়াগুলোও পারতপক্ষে প্রচলিত ধারণা এবং হাতের কাছের ইতিহাসের বাইরে কিছুই তুলে ধরতে চায় না। আমার মনে আছে, কয়েক বছর আগে আমরা বিএলএফের একটি জাতীয় সম্মেলনের আয়োজন করতে সক্ষম হয়েছিলাম। একটি টিভি চ্যানেলের হয়ে সেই সম্মেলনের বক্তব্য একটি ডকুমেন্টারি আকারে তৈরি করে প্রচার করার জন্য প্রস্তুত করেছিলাম। কিন্তু সেই চ্যানেল ডকুমেন্টারিটি তখন প্রচার করেনি। তারা আমাদের জানিয়েছিলেন যে এসব বিষয় নাকি স্পর্শকাতর।

অথচ যদি কেউ কোন না কোনভাবে একাত্তরের ২৫ মার্চের আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের দুয়েকটি পাতারও সন্ধান করে তবে তাকে এটি খোঁজে পেতেই হবে যে, একাত্তরের যুদ্ধটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ এবং সশস্ত্র পর্ব মাত্র। আমরা ঐতিহাসিকভাবে ভাষা আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামগুলোকে মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি হিসেবে দেখলেও সেসব আন্দোলনে কোনভাবেই একটি স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রকাশ্য ঘোষণা বা সেসব আন্দোলনের লক্ষ্য তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিল না। সেসব আন্দোলন এটি প্রমাণ করেছে যে, আমরা পাকিস্তানে যে কারণে থাকতে চেয়েছিলাম সেই কারণগুলোতে পাকিস্তান বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমাদের স্বাধীন দেশের নাগরিক না বানিয়ে ঔপনিবেশিক দাসে পরিণত করেছিল তারা। আমাদের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি থেকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারকে ঔপনিবেশিক শাসনের যাঁতাকলে ফেলা হয়েছে। কিন্তু ষাটের দশকে ভাষা আন্দোলন, সত্তর দশকে আইয়ূববিরোধী আন্দোলন বা ছয় দফার স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন, ১১ দফা আন্দোলনই শুধু নয়, একেবারে খুব স্পষ্ট করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নেতৃত্বে রেখে একদল তরুণের হাতে জন্ম নিয়েছিল স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস নামক একটি অতি ক্ষুদ্র সংগঠন। সেই সংগঠন একটি অতি ক্ষুদ্র কাঠামো থেকে ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠে এবং কার্যত একটি সশস্ত্র লড়াই করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার মূল নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে। মুজিব বাহিনীর জন্ম হয়েছে সেই স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের নেতৃত্বে এবং সেই বিপ্লবী সংস্থাটি ষাটের দশক থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে, পরিকল্পনা করেছে এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার সব কাজই সফলতার সঙ্গে করতে পেরেছে। আমরা যদি একপেশে না হই এবং শুধু নয়মাসের লড়াইতেই বাঙালির মুক্তি সংগ্রামকে সীমিত না করি তবে স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের কথা আমাদের অবশ্যই জানতে হবে। এই বাহিনীটি প্রচলিত ধারণার বা সাধারণের যোদ্ধা দল ছিল না। এটি ছিল একটি রাজনৈতিক গেরিলা বাহিনী-তাত্ত্বিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ, লক্ষ্য স্থির ও প্রতিজ্ঞায় অটল।

এমনকি এই বাহিনীর অনেকেই মুক্তিবাহিনীর মতো সাধারণ বা অতি রাইফেল ট্রেনিং বা সরাসরি সম্মুখসমরের প্রশিক্ষণও নেয়নি। এই বাহিনীর পুরো বিষয়টি ছিল ভিন্ন মাত্রার। এই বাহিনীর প্রশিক্ষক মেজর জেনারেল (অব) এসএস ওবান মনে করেন, এমন একটি বাহিনীর প্রয়োজন ছিল ভীষণভাবে। তিনি এমন মত প্রকাশ করেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াইটা করার জন্য রাজনৈতিক সচেতনতা সম্পন্ন একটি বাহিনীর দরকার ছিল। ২৫ মার্চের পর পুরো দেশে যখন ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয় তখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার নামে যতো লোক মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয় তাদের বাছাই করার কোন ব্যবস্থা ছিল না। ওরা কারা, কেন মুক্তিযুদ্ধে এসেছে এবং তারা অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে কি করবে সেসব বিষয়ে কোন তথ্যই তৎকালীন সরকারের কাছে ছিল না। ভারত ও বাংলাদেশ উভয় সরকারের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল যে উগ্র ডান বা উগ্র বামপন্থিরা যেন যুদ্ধের সুযোগ না নিতে পারে। বিশেষ করে পিকিংপন্থি কমিউনিস্টরা যাতে প্রশিক্ষণ নিয়ে অস্ত্র হাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এখানে এটি উল্লেখ করা দরকার যে, এই পিকিংপন্থি রাজনীতিকরা আওয়ামী লীগকে আমেরিকা ও ভারতের দালাল হিসেবে গণ্য করে আসছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এদের কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছিল। অন্যদিকে ভারত তখন নকশালবাড়ী আন্দোলনে তটস্থ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান ছিল চীনের। বাংলাদেশের চীনপন্থিরা তাই পিকিংয়ের নীতিতে আস্থা রেখে পাকিস্তান-জামায়াত ও পাকিস্তানি বাহিনীর পাশে দাঁড়িয়েছিল। ওরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হলেও কোথাও কোথাও সরাসরি আওয়ামী লীগের বিপক্ষে লড়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যাটি ছিলÑমুক্তিযুদ্ধে জোগদানকারী হাজার হাজার তরুণদের কারও কারও জানাই ছিল না এই যুদ্ধের চূড়ান্ত পরিণতি কি হবে। প্রায় সবাই যুদ্ধে গেছে বঙ্গবন্ধুর ডাকে। এই ডাকের গভীরে কি ছিলÑ তা কতজনই খতিয়ে দেখেছে। সেজন্যই একটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ধারণাসমৃদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শ ও তার চূড়ান্ত লড়াই সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞান রাখে তেমন একটি বাহিনীর দরকার ছিল। মুজিব বাহিনী ছিল সেই বাহিনী।

আরও একটি বিষয় মুজিব বাহিনীর উদ্যোক্তাদের বিবেচনায় ছিল। সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধটি যদি প্রলম্বিত হয় তবে সেই প্রলম্বিত যুদ্ধটি কারা করবে? মুজিব বাহিনীর সংগঠকরা নিজেরা মনে করতেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ প্রলম্বিত হবে। তারা আরও ভেবেছেন, ২৫ মার্চের পর আকস্মিকভাবে যারা যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন তাদের দিয়ে কি প্রলম্বিত যুদ্ধ করা যাবে? এছাড়াও তারা চিন্তা করেছিলেন, ট্র্যাডিশনাল ওয়ারফেয়ার কি প্রলম্বিত যুদ্ধের সহায়ক বা যদি ভিয়েতনামের মতো গেরিলা যুদ্ধ করতে হয় তবে তার জন্য কি মুজিব বাহিনীর মতো একটি বাহিনী গড়ে তোলা উচিত নয়?

যারা ষাটের দশকে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন তারা তখন ভারত সরকারের কাছে পুরো বিষয়টি তুলে ধরেন এবং অনুরোধ করেন যেন এমন একটি সুনিয়ন্ত্রিত আদর্শিক গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলা হয়, যে বাহিনীটি পুরোপুরি রাজনৈতিক আদর্শকে আত্মস্থ করে যুদ্ধ করবে। শেখ ফজলুল হক মনি (মরহুম), সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক (মরহুম) এবং তোফায়েল আহমেদ ছিলেন এই বাহিনী গড়ে তোলার জন্য প্রথম চারজন উদ্যোক্তা। এর পরে ছিল একটি মধ্যপর্যায়ের নেতৃত্ব। এরপর ছিল আরও হাজার হাজার নেতাকর্মী। একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে ছিল লক্ষ লক্ষ রাজনৈতিক কর্মী। প্রধানত বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা গড়ে তুলেছিলেন এই বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের কথা বলতে গেলে এই বাহিনীর কথা না বলে পারা যাবে না।

আরও একটি বিষয় খুবই গুরুত্ব দিয়ে বুঝতে হবে যে, এটিই ছিল বস্তুত বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ বা তার ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নিজস্ব একটি বাহিনী। প্রাসঙ্গিকভাবে এই প্রশ্নটিও ওঠে আসতে পারে যে, কেউ কেন মুজিব বাহিনী নিয়ে কথা বলে না? এমনকি মুজিব বাহিনীর নেতারাও কেন প্রসঙ্গটি সামনে আনেন না? স্বাধীনতার এতো বছর পরও কি আমরা এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজব না?

মুজিব বাহিনীবিষয়ক নিবন্ধটির শুরুতে প্রথম পর্বে আমরা মুজিব বাহিনীর গঠন সম্পর্কে কোন আলোচনা করিনি। তবে মুজিব বাহিনী গঠন করার যেসব কারণগুলো আমরা উল্লেখ করেছি তার বাইরেও আরও কিছু বিষয় ছিল যার জন্য মুজিব বাহিনী গঠন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

ঢাকা। ২৬ মার্চ, ২০১৯। আপডেট: ২৭ জুন, ২০২১।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং বিজয় ডিজিটাল শিক্ষা সফটওয়্যারের উদ্ভাবক]

mustafajabbar@gmail.com

মঙ্গলবার, ২৯ জুন ২০২১ , ১৫ আষাঢ় ১৪২৮ ১৭ জিলক্বদ ১৪৪২

মুক্তিযুদ্ধ ও মুজিব বাহিনী

মোস্তাফা জব্বার

এক ॥

এখন এই কথাটি বলা যাবে না যে আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার লড়াই বীর মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের অবদান নিয়ে আলোচনা করি না। বস্তুত প্রচুর আলাপ আলোচনা-টক শো-নিবন্ধ কোনটারই তেমন কোন অভাব নেই। বিশেষ করে ২০২০ সালের মুজিব বর্ষে এর ব্যাপক আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। টিভি চ্যানেলগুলো প্রতিদিনের ঘটনাবলীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরছে। ২১ সালের মুজিববর্ষ ও সুবর্ণজয়ন্তীতেও ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। আমার কাছে মনে হয় দিনে দিনে ইতিহাসের পাতা খুঁড়ে আমরা নিত্যনতুন তথ্য বের করছি। ২০ সাল পুরোটা কেটেছে আমার বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখতে। ২১ সালেও সেটি অব্যাহত আছে। যখনই কোন নতুন তথ্য পাই তখনই মূল লেখায় যুক্ত করি। জাতির জনকের তিনটি বই এবং সিক্রেটস ডকুমেন্টের কয়েকটি খণ্ড প্রকাশের ফলে বঙ্গবন্ধু, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রাপ্তি সহজ হয়েছে। সেই সুবাদে ডাক বিভাগ থেকে একটি অসাধারণ অ্যালবামও সম্পাদনা করেছি আমি।

এবার ২১ সালটাকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সংরক্ষণ করা যায়। কিন্তু খুব সত্যি কথা হচ্ছে এইসব আলোচনায় দুটি বিষয় অনুপস্থিত থাকে। প্রথমত ১ মার্চের আগে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি পর্ব বিশেষত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ত্বে কৃষক-শ্রমিক ছাত্র জনতার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের বীজ বপনের বিষয়গুলো তেমন আলোচিত হয়না। আমি ভাষা আন্দোলনকে বিত্তি করে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনটাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। দ্বিতীয়ত মুক্তিযুদ্ধের একটি বিশাল যোদ্ধাবাহিনী আলোচনায় আসেইনা। এমনকি সেই যোদ্ধাদের নামও কেউ ইচ্চারণ করেনি। তারা মুক্তিযোদ্ধা সনদও পায়নি। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীকে দ্বারপ্রান্তে রেখে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এই দুটি অনালোকিত বিষয়কে পাদপ্রদীপের আলোচনায় আনতেই হবে।

আমি অবশ্যই এটি মনে করি যে প্রথাগতভাবেই বাঙ্গালীর প্রবণতা হচ্ছে বিস্মৃতপরায়ণতা। যে কারণে আমরা পঁচাত্তরের কথা মনে রাখিনা, বা যে কারণে আমরা জিয়া-এরশাদের কুকীর্তির কথা ভুলে যাই, যে কারণে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বা বেগম খালেদা জিয়ার দুঃশাসন এবং তারেক রহমানের দুর্নীতি আমাদের স্মরণেই থাকে না অথবা গোলাম আজম-নিজামী-মুজাহিদ-সাকাদেরকে মর্যাদার আসনে বসাই, কিংবা যে কারণে আমরা ২০১৩ সালে জামায়াত-বিএনপি-হেফাজতের জঘন্য সন্ত্রাস মনে রাখি নাই, যে কারণে আমরা হয়তো ২০১৫ সালের আগুনে পোড়া মানুষগুলোকেও মনে রাখি নাই; সেই একই কারণে আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসের বিশাল ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলো প্রায় ভুলে রয়েছি। এমনও হতে পারে নাসিরনগর, জিকাতলা, বগুড়া, সুনামগঞ্জের শাল্লার নোয়াগাঁও এর লুটপাট-ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লুটপাট-অগ্নিসংযোগ বা হাটহাজারীর লঙ্কাকা-ও কেউই মনে রাখবে না। বিশেষ করে বিষয়গুলো যদি নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের সামনে ইতিহাসের পাতার অনালোকিত অধ্যায়গুলো তুলে ধরতে পারি তবে জাতি তার প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে না। এখন ৩০ বছরের নিচে যাদের বয়স, এমন অনেককেই আমি শুধু গেঞ্জি পরা জিয়াউর রহমানের ছবির কথা মনে করতে পারে বলে দেখে আসছি। এরশাদের কথা তারা একদম ভুলে না। কিন্তু যদি কেউ জয় বাংলার কথা বলে তাহলে ধরে নেয় এটি হলো আওয়ামী লীগের দলীয় সেøøাগান। এটি যে ঊনসত্তুর সালে জন্ম নিয়েছে এবং একাত্তর সালে পুরো জাতির সেøøাগান ছিল এবং বাংলাদেশের মানুষ যে সারা দুনিয়ায় জয় বাংলার লোক হিসেবে পরিচিত হতো সেটি তারা একেবারে জানেই না। খোদ জিয়াউর রহমান যে জয় বাংলা সেøাগান দিয়ে যুদ্ধ করেছেন সেটিও ওরা শুনেনি। তবে এবার এমন মন্তব্য করা দরকার যে ১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে পুরো দেশ আরও একবার একাত্তরের মতোই জয়বাংলা সেøাগান দিয়ে জেগে উঠেছিল। আমি খুব অবাক হই যখন আমাদের দেশের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা জয় বাংলা সেøাগান দিয়ে বক্তব্য রাখতে সংকোচ বোধ করেন। এটি যদি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সেøাগান হয়ে থাকে তবে সর্বত্র-সব সময়ে কেন আমরা সবাই জয় বাংলা সেøøাগান দিতে পারব না। প্রধানমন্ত্রী সম্প্র্রতি এই বিষয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

এমনিভাবে কেউ যদি বলে যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিব বাহিনী নামক একটি বাহিনী ছিল তবে তারা অবাক হয়ে যায়। মুজিব বাহিনীর যারা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছেন তারাও নিজেদের মুজিব বাহিনীর পরিচয় দেন না। আমার মতো অনেকেই মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটের জন্য আবেদনও করেননি। অথচ আমি লক্ষ্য করেছি যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে প্রধানত ছাত্রলীগের যেসব বীর যোদ্ধারা অংশগ্রহণ করেন তারা প্রায় সবাই মুজিব বাহিনীর সদস্য ছিলেন। প্রায় সবারই সাধারণ ধারণা শুধু মুক্তিবাহিনী নামক একটি বাহিনীই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ করেছে। আর ধারণা হলো মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যুদ্ধ করেছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। বেঙ্গল লিবারেশন ফোর্স বা বিএলএফের নাম শুনেছে এমন লোক হাতে গুনেও পাওয়া যায় না। মুজিব বাহিনী বা বিএলএফ যে একই বাহিনী সেটিও তারা জানে না। আমাদের মিডিয়াগুলোও পারতপক্ষে প্রচলিত ধারণা এবং হাতের কাছের ইতিহাসের বাইরে কিছুই তুলে ধরতে চায় না। আমার মনে আছে, কয়েক বছর আগে আমরা বিএলএফের একটি জাতীয় সম্মেলনের আয়োজন করতে সক্ষম হয়েছিলাম। একটি টিভি চ্যানেলের হয়ে সেই সম্মেলনের বক্তব্য একটি ডকুমেন্টারি আকারে তৈরি করে প্রচার করার জন্য প্রস্তুত করেছিলাম। কিন্তু সেই চ্যানেল ডকুমেন্টারিটি তখন প্রচার করেনি। তারা আমাদের জানিয়েছিলেন যে এসব বিষয় নাকি স্পর্শকাতর।

অথচ যদি কেউ কোন না কোনভাবে একাত্তরের ২৫ মার্চের আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের দুয়েকটি পাতারও সন্ধান করে তবে তাকে এটি খোঁজে পেতেই হবে যে, একাত্তরের যুদ্ধটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ এবং সশস্ত্র পর্ব মাত্র। আমরা ঐতিহাসিকভাবে ভাষা আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামগুলোকে মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি হিসেবে দেখলেও সেসব আন্দোলনে কোনভাবেই একটি স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রকাশ্য ঘোষণা বা সেসব আন্দোলনের লক্ষ্য তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিল না। সেসব আন্দোলন এটি প্রমাণ করেছে যে, আমরা পাকিস্তানে যে কারণে থাকতে চেয়েছিলাম সেই কারণগুলোতে পাকিস্তান বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমাদের স্বাধীন দেশের নাগরিক না বানিয়ে ঔপনিবেশিক দাসে পরিণত করেছিল তারা। আমাদের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি থেকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারকে ঔপনিবেশিক শাসনের যাঁতাকলে ফেলা হয়েছে। কিন্তু ষাটের দশকে ভাষা আন্দোলন, সত্তর দশকে আইয়ূববিরোধী আন্দোলন বা ছয় দফার স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন, ১১ দফা আন্দোলনই শুধু নয়, একেবারে খুব স্পষ্ট করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নেতৃত্বে রেখে একদল তরুণের হাতে জন্ম নিয়েছিল স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস নামক একটি অতি ক্ষুদ্র সংগঠন। সেই সংগঠন একটি অতি ক্ষুদ্র কাঠামো থেকে ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠে এবং কার্যত একটি সশস্ত্র লড়াই করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার মূল নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে। মুজিব বাহিনীর জন্ম হয়েছে সেই স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের নেতৃত্বে এবং সেই বিপ্লবী সংস্থাটি ষাটের দশক থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে, পরিকল্পনা করেছে এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার সব কাজই সফলতার সঙ্গে করতে পেরেছে। আমরা যদি একপেশে না হই এবং শুধু নয়মাসের লড়াইতেই বাঙালির মুক্তি সংগ্রামকে সীমিত না করি তবে স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের কথা আমাদের অবশ্যই জানতে হবে। এই বাহিনীটি প্রচলিত ধারণার বা সাধারণের যোদ্ধা দল ছিল না। এটি ছিল একটি রাজনৈতিক গেরিলা বাহিনী-তাত্ত্বিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ, লক্ষ্য স্থির ও প্রতিজ্ঞায় অটল।

এমনকি এই বাহিনীর অনেকেই মুক্তিবাহিনীর মতো সাধারণ বা অতি রাইফেল ট্রেনিং বা সরাসরি সম্মুখসমরের প্রশিক্ষণও নেয়নি। এই বাহিনীর পুরো বিষয়টি ছিল ভিন্ন মাত্রার। এই বাহিনীর প্রশিক্ষক মেজর জেনারেল (অব) এসএস ওবান মনে করেন, এমন একটি বাহিনীর প্রয়োজন ছিল ভীষণভাবে। তিনি এমন মত প্রকাশ করেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াইটা করার জন্য রাজনৈতিক সচেতনতা সম্পন্ন একটি বাহিনীর দরকার ছিল। ২৫ মার্চের পর পুরো দেশে যখন ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয় তখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার নামে যতো লোক মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয় তাদের বাছাই করার কোন ব্যবস্থা ছিল না। ওরা কারা, কেন মুক্তিযুদ্ধে এসেছে এবং তারা অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে কি করবে সেসব বিষয়ে কোন তথ্যই তৎকালীন সরকারের কাছে ছিল না। ভারত ও বাংলাদেশ উভয় সরকারের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল যে উগ্র ডান বা উগ্র বামপন্থিরা যেন যুদ্ধের সুযোগ না নিতে পারে। বিশেষ করে পিকিংপন্থি কমিউনিস্টরা যাতে প্রশিক্ষণ নিয়ে অস্ত্র হাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এখানে এটি উল্লেখ করা দরকার যে, এই পিকিংপন্থি রাজনীতিকরা আওয়ামী লীগকে আমেরিকা ও ভারতের দালাল হিসেবে গণ্য করে আসছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এদের কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছিল। অন্যদিকে ভারত তখন নকশালবাড়ী আন্দোলনে তটস্থ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান ছিল চীনের। বাংলাদেশের চীনপন্থিরা তাই পিকিংয়ের নীতিতে আস্থা রেখে পাকিস্তান-জামায়াত ও পাকিস্তানি বাহিনীর পাশে দাঁড়িয়েছিল। ওরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হলেও কোথাও কোথাও সরাসরি আওয়ামী লীগের বিপক্ষে লড়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যাটি ছিলÑমুক্তিযুদ্ধে জোগদানকারী হাজার হাজার তরুণদের কারও কারও জানাই ছিল না এই যুদ্ধের চূড়ান্ত পরিণতি কি হবে। প্রায় সবাই যুদ্ধে গেছে বঙ্গবন্ধুর ডাকে। এই ডাকের গভীরে কি ছিলÑ তা কতজনই খতিয়ে দেখেছে। সেজন্যই একটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ধারণাসমৃদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শ ও তার চূড়ান্ত লড়াই সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞান রাখে তেমন একটি বাহিনীর দরকার ছিল। মুজিব বাহিনী ছিল সেই বাহিনী।

আরও একটি বিষয় মুজিব বাহিনীর উদ্যোক্তাদের বিবেচনায় ছিল। সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধটি যদি প্রলম্বিত হয় তবে সেই প্রলম্বিত যুদ্ধটি কারা করবে? মুজিব বাহিনীর সংগঠকরা নিজেরা মনে করতেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ প্রলম্বিত হবে। তারা আরও ভেবেছেন, ২৫ মার্চের পর আকস্মিকভাবে যারা যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন তাদের দিয়ে কি প্রলম্বিত যুদ্ধ করা যাবে? এছাড়াও তারা চিন্তা করেছিলেন, ট্র্যাডিশনাল ওয়ারফেয়ার কি প্রলম্বিত যুদ্ধের সহায়ক বা যদি ভিয়েতনামের মতো গেরিলা যুদ্ধ করতে হয় তবে তার জন্য কি মুজিব বাহিনীর মতো একটি বাহিনী গড়ে তোলা উচিত নয়?

যারা ষাটের দশকে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন তারা তখন ভারত সরকারের কাছে পুরো বিষয়টি তুলে ধরেন এবং অনুরোধ করেন যেন এমন একটি সুনিয়ন্ত্রিত আদর্শিক গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলা হয়, যে বাহিনীটি পুরোপুরি রাজনৈতিক আদর্শকে আত্মস্থ করে যুদ্ধ করবে। শেখ ফজলুল হক মনি (মরহুম), সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক (মরহুম) এবং তোফায়েল আহমেদ ছিলেন এই বাহিনী গড়ে তোলার জন্য প্রথম চারজন উদ্যোক্তা। এর পরে ছিল একটি মধ্যপর্যায়ের নেতৃত্ব। এরপর ছিল আরও হাজার হাজার নেতাকর্মী। একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে ছিল লক্ষ লক্ষ রাজনৈতিক কর্মী। প্রধানত বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা গড়ে তুলেছিলেন এই বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের কথা বলতে গেলে এই বাহিনীর কথা না বলে পারা যাবে না।

আরও একটি বিষয় খুবই গুরুত্ব দিয়ে বুঝতে হবে যে, এটিই ছিল বস্তুত বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ বা তার ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নিজস্ব একটি বাহিনী। প্রাসঙ্গিকভাবে এই প্রশ্নটিও ওঠে আসতে পারে যে, কেউ কেন মুজিব বাহিনী নিয়ে কথা বলে না? এমনকি মুজিব বাহিনীর নেতারাও কেন প্রসঙ্গটি সামনে আনেন না? স্বাধীনতার এতো বছর পরও কি আমরা এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজব না?

মুজিব বাহিনীবিষয়ক নিবন্ধটির শুরুতে প্রথম পর্বে আমরা মুজিব বাহিনীর গঠন সম্পর্কে কোন আলোচনা করিনি। তবে মুজিব বাহিনী গঠন করার যেসব কারণগুলো আমরা উল্লেখ করেছি তার বাইরেও আরও কিছু বিষয় ছিল যার জন্য মুজিব বাহিনী গঠন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

ঢাকা। ২৬ মার্চ, ২০১৯। আপডেট: ২৭ জুন, ২০২১।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং বিজয় ডিজিটাল শিক্ষা সফটওয়্যারের উদ্ভাবক]

mustafajabbar@gmail.com