ইউপিএল ও একজন প্রকাশকের সাধনা

বদিউদ্দিন নাজির

কোন গ্রন্থপ্রকাশনা বিশেষজ্ঞ বা ইউরোপ কী আমেরিকায় কর্মরত কোন একাডেমিশিয়ানকে যদি প্রশ্ন করেন, বাংলাদেশের মতো দেশে কোন ইউনিভার্সিটি প্রেস চলতে পারে কি, বা যদি প্রশ্ন করেন ইউনিভার্সিটি বা উচ্চতর গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ছত্রছায়ায় আর্থিক অনুদান বা সহায়তা (Subvention) ছাড়া কোন ইউনিভার্সিটি প্রেস বা ইউনিভার্সিটি প্রেসের মতো প্রকাশনা কার্যক্রম কোথাও আছে কি, তিনি দ্বিধা না করে একশব্দে উত্তর দেবেন না।

কেন নয়, সে কথায় আমি পরে আসব, তবে এখানে যা বলতে চেয়েছি, এ সত্যটি শতভাগ জানা সত্ত্বেও মহিউদ্দিন আহমেদ সেই অসাধ্য সাধন করতে চেয়েছিলেন দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএ) প্রতিষ্ঠা করেন সেই ১৯৭৫ সালে। ভেবে দেখুন তার সংকল্প কতটা দুঃসাহসী ছিল। তার বেড়ে ওঠা, বুনিয়াদী ও উচ্চতর শিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা এবং সর্বোপরি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, করাচিতে এডিটর হিসেবে দায়িত্ব পালন তাকে সেই সাহস জুগিয়েছিল। প্রচণ্ড মানসিক শক্তি, সামাজিক ও প্রশাসনিক দিক দিয়ে ওজনদার ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব ও শুভাকাক্সক্ষী এবং ওপর মহলে অবাধ যাতায়াত ও গ্রহণযোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি অনেক বড় কিছু করতে পারতেন, কিন্তু সেদিকে যাননি। কতিপয় অংশীদার নিয়ে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ঢাকা ব্র্যাঞ্চের দায়দেনা মিটিয়ে অতি সামান্য পুঁজি নিয়ে ইউপিএল প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং সারা জীবন সেই প্রতিষ্ঠানটিকে প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।

এ যেন এক তপস্যা। তিনি তাতে সিদ্ধপুরুষে পরিণত হয়েছেন। বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের অদ্বিতীয় ব্যক্তি ও প্রকাশক কমিউনিটির অভিভাবক হিসেবে সর্বমহলে গৃহীত হয়েছেন। ইউপিএলকে দিয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রকাশকদের মধ্যে এক ব্র্যান্ড নেম, আর নিজে হয়ে উঠেছিলেন বিদ্ব্যজনের কাছে একজন বাতিঘর। বাংলাদেশ সম্পর্কে ইংরেজিতে লেখা যেমন দেশি ও বিদেশির গ্রন্থরচনা প্রকাশের একমাত্র ভরসাস্থল। মহিউদ্দিন আহমেদ তাদের মুশকিল আসানের প্রথম ও শেষ জায়গা।

এ জায়গায় তিনি উঠে এসেছেন দীর্ঘদিনের ত্যাগ-তিতিক্ষা, কঠোর পরিশ্রম এবং নিজের সংকল্পে অঁটুট থাকার কারণে। সেই কাহিনীর আদি-অন্ত অনেক দীর্ঘ। অনেক চড়াই-উতরাই অতিক্রম করতে হয়েছে তাকে, চলার পথে তাকে প্রয়োজনে কৌশল ও অগ্রাধিকার বিষয় পরিবর্তন করতে হয়েছে। তিনি একটি আদর্শ ইউনিভার্সিটি প্রেস সৃষ্টি করতে পারেননি কিন্তু দেশের জ্ঞানভিত্তিক সমাজের জন্য একজন প্রকাশকের সাধ্যে যতটা কুলায় তার ষোলোআনা তাতে উপুড় করে দিয়েছেন।

প্রথমেই বলি ইউনিভার্সিটি প্রেস কী? আর কেনই এ দেশে ইউনিভার্সিটি প্রেস চালু করা সম্ভব নয়। Merrium-Webster দেয়া সংজ্ঞটি এই A press connected with a University and especially concerned with the scholarly works. আর থাকতে হবে কোন ইউনিভার্সিটির Imprint (ছাপ) এবং তার কাজ হবে Aid in the dissemination of knowledge to scholars and well informed lay readers. এই প্রেসের আরেকটি চারিত্র্য হচ্ছে সেটি নন-প্রফিট অর্থাৎ লাভের জন্য কর্মপরিচালনা করবে না, (Wikipedia)। ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল) বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান নয়। বাস্তব কারণে ইউপিএল তার কার্যক্রমকে শুধু স্কলারলি (পাণ্ডিত্যপূর্ণ) বইয়ে সীমিত রাখেনি। তার প্রকাশনায় কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমপ্রিন্ট (ছাপ) থাকে না, এটি শুধু সজ্ঞান ও সচেতন ব্যক্তিদেরই ক্লায়েন্ট মনে করে সেবা দিয়ে যাচ্ছে না। তাহলে দেশে-বিদেশে তাকে ইউনিভার্সিটি প্রেস হিসেবে বিজ্ঞজনেরা সম্মান করে আসছে কেন?

কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠান না হয়েও ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সব চারিত্র্য বজায় রেখেছে প্রকাশক মহিউদ্দিন আহমেদের প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার কারণে। অনেক ইউনিভার্সিটি প্রেস যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্কলারলি একাডেমিক বইয়ের বাইরেও জেনারেল বুকস, রেফারেন্স, পাঠ্যপুস্তক এবং ট্রেডবুকসও প্রকাশ করে আসছে। এর প্রধান কারণ স্কলারলি ও একাডেমিক বই প্রকাশ প্রধানত অলাভজনক। প্রকাশক ক্রমাগত ভর্তুকি দিয়ে তাদের স্পনসর প্রতিষ্ঠানগুলো আর কুলিয়ে উঠতে পারছে না, নন-প্রফিট অরগানাইজেশন হয়েও তাদের অন্য ধরনের লাভজনক বই প্রকাশ করে সেই ভর্তুকির জায়গায় পুঁজি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। পৃথিবীর প্রথম এ ধরনের প্রেস দি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস (ওইউপি) সেটাই করে আসছে দীর্ঘ প্রায় শতকব্যাপী। শুনে আশ্চর্য হবেন, খ্যাতনামা ইউনিভার্সিটি প্রেসগুলো এখন থিসিস ছাপে না। থিসিস অবলম্বনে তৈরি যেসব বইয়ের যথেষ্ট পাঠক আছে সেগুলোই ছাপে। তাও আবার প্রাতিষ্ঠানিক অর্থ সাহায্য বা Subvention নিয়ে।

ইউপিএল বাংলাদেশে নিজেকে পরিচালনার জন্য সেই কৌশলই অবলম্বন করে এসেছে। তাই বিদেশি গ্রন্থ বিশেষজ্ঞদের কাছে আজও একটি বিস্ময় যে, বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছত্রছায়ায় ও সরকারি অনুদান ব্যতীত একটি ইউনিভার্সিটি প্রেস কীভাবে চলছে? এ কারণেই বিদেশের স্কলারলি ও একাডেমিক মহলে প্রকাশক মহিউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের জন্য একমাত্র পরিচিত মুখ, প্রধান ব্যক্তিত্বের পরিচয় ও কালচারাল অ্যামবাসেডরের সম্মান কুড়িয়ে এসেছেন।

এ লড়াইটা ছিল তার একার লড়াই এবং সঙ্গী ছিল তার ধনুকভাঙ্গা পণ বা সংকল্প। পাঠকদেরই ভেবে দেখতে বলি, ইউপিএলের প্রতিষ্ঠাকালীন অর্থাৎ গত শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশের পরিচিতি স্কলার কয়জন ছিলেন। ইংরেজিতে লেখা স্কলারলি/একাডেমিক/ট্রেডবই কয়টি ছিল? আমাদের যে স্কলারলি কমিউনিটি বা একাডেমিয়া তার পরিসর কতটি ছিল? বিদেশে বাংলাদেশের পাণ্ডিত্যপূর্ণ বা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ইতিহাস ও সামাজিক বিষয়ে গবেষণাপূর্ণ রচনার ভাষা ইংরেজি মাধ্যম না হলে সংশ্লিষ্ট মহলে গৃহীত হবে না, স্কলার বা লেখকরাও পরিচিতি অর্জন করবেন না। ইংরেজি ছাড়া উপায় ছিল না, আজও নেই। বাংলাদেশে আধুনিক ইংরেজিতে সচ্ছন্দভাবে বিজ্ঞজনকে কমিউনিকেট করতে এই ২০২১ সালেই কয়জন যোগ্য লোক পাওয়া যায়। কয়জন ল্যাঙ্গুয়েজ এডিটর, কপি-এডিটর, ইনডেকসার, বিবলিওগ্রাফার এমনকি প্রুফ রিডার পাওয়া যায়। বই প্রকাশনা করে এই সীমিত বাজারে যে আয় করা যায়, তাতে ওইসব কাজের জন্য উচ্চপারিশ্রমিক আদৌ দেয়া সম্ভব কী? সুতরাং বুঝুন, মহিউদ্দিন আহমেদকে তার লক্ষ্যে পৌঁছতে কি লড়াইটাই না করতে হয়েছে। উপযুক্ত ব্যক্তিকে খুঁজে বের করে তাকে রাজি করানো, তাকে তার কাজে পারিশ্রমিক জোগাড় করতে মহিউদ্দিন আহমেদকে কি পরিশ্রম ও মাথা খাটাতে হয়েছে।

এবার প্রতিষ্ঠানটিকে নিজের পায়ে দাঁড় করাতে তার লড়াইয়ের সংক্ষিপ্ত একটি বর্ণনা দেই।

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ঢাকা ব্র্যাঞ্চের অবসায়ন ঘটিয়ে দু’জন অংশীদার নিয়ে সেই জায়গায় ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড প্রতিষ্ঠিত হয়। অক্সফোর্ডের কোন স্থাবর সম্পত্তি ছিল না, বিক্রির জন্য কিছু বই ব্যতীত সে সময় ওই প্রতিষ্ঠান স্কুলপর্যায়ের কয়েকটি বই পুনঃমুদ্রণের পারমিশন ছাড়া আর কিছু দিয়ে যেতে পারেনি। আর ছিল সেকালের বিখ্যাত চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ আবদুল বাসেতের বাংলায় লেখা খানচারেক বইয়ের পরিবেশনের অধিকার। সেই সঙ্গে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারী, যদিও সংখ্যায় ছিল কম।

তিনি পুঁজি হিসেবে পেরেছিলেন অংশীদারদের ১ লাখ ৪০ হাজার স্থায়ী আমানতের বিপরীতে ব্যাংক ঋণ। এই পর্যন্তই। শুরু থেকেই তিনি ইউপিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে সম্মুখসারিতে থেকে যুদ্ধ করে এসেছেন। আর কোন সময় গঠিত এই কোম্পানিতে নতুন কোন পুঁজি বিনিয়োগ হয়নি।

ফলে সিজন্যাল স্কুল বই প্রকাশের সময় তাকে বন্ধুদের কাছ থেকে সুদে টাকা ধার করতে হয়েছে, কাগজের দোকানে বাকি রাখতে হয়েছে। অবশ্য এক সময় তিনি জনতা ব্যাংক থেকে স্টকের বিপরীতে (এক অর্থে কো-ল্যাটারাল ছাড়াই) ঋণ সুবিধা পেলে পুঁজির সংকট কিছুটা হলেও কেটে যায়। তিনি প্রতি বছরই অর্থবছরের শেষের সপ্তাহে ব্যাংকের সম্পূর্ণ দেনা পরিশোধ করে নতুন করে ঋণ নিতেন। ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে এটাও একটি অনন্য নজির স্থাপন করে গেছেন।

তবে মূলত খুদ খেয়ে খুদ সঞ্চয় করার মতো তাকে অসীম ধৈর্যসহকারে এই প্রতিষ্ঠানটিকে আজকের অবস্থানে আনতে হয়েছে। তিনি এই প্র্রতিষ্ঠান থেকে নিজের বেতন বাবদে কখনও কিছু নেননি। তারপরও কোম্পানি প্রায় প্রতিবছরে অডিট শেষে প্রদানের পর নন-প্রফিটই থেকেছে। একটি ইউনিভার্সিটি প্রেস হিসেবে এটা কোন ব্যর্থতা নয়।

প্রফিট না হওয়ায় তার আফসোস ছিল না। তিনি ছিলেন সৃষ্টির আনন্দে। বাইন্ডারের কাছ থেকে নতুন কোন বই এলে নেড়ে-চেড়ে দেখার সময় তার মুখমণ্ডলে পরিতৃপ্তির আভাস ফুটে উঠত। কত বিচিত্র বিষয়েই না তিনি বই প্রকাশ করেছেন।

ইংরেজিতে, পরে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষাতেও ইউপিএলের বই কনটেন্টের দিক থেকে ও প্রকাশনা মানের বিচারে স্বাতত্র্যে অভিষিক্ত। আশির দশকে দেশের উন্নতমান প্রকাশনার মতো বেশ কয়েকবার পুরস্কার অর্জন করেছে এই প্রতিষ্ঠান। বিদেশে বাংলাদেশের অপ্রচলিত পণ্য রপ্তানির জন্যও অর্জন করেছে প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড। আর সেই ১৯৯০ সালে প্রকাশনা শিল্পে অবদানের জন্য মহিউদ্দিন আহমেদকে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র স্বর্ণপদকে সম্মানিতও করা হয়েছে।

তার প্রকাশনার কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কথা তুলে ধরব। বিদেশে বাংলাদেশের সাহিত্যকে তুলে ধরার জন্য তিনি আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করেও বাংলাদেশের লেখকদের রচিত বেশ কয়েকটি গল্প উপন্যাস কবিতার বইয়ের অনুবাদ প্রকাশ করেছেন। তিনি এমন সব বিষয়ে গবেষণামূলক ইংরেজি বই প্রকাশ করেছেন, যেসব বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষের অনাগ্রহ থাকলেও বিদেশে প্রচুরভাবে প্রশংসিত এবং কোন কোনটির পুরোপুরি বা অংশ বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্সে পঠিত হয়।

প্রদেশের প্রকাশনা শিল্পে তার দুটি প্রকাশনা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বিক্রি হবে কি হবে না, চিন্তা না করেই প্রথম তত্ত্বাধায়ক সরকারের আমলে অতি অল্প সময়ে প্রায় রয়্যাল সাইজে দুই হাজার পৃষ্ঠার টাস্কফোর্স রিপোর্ট মোট ৪ খণ্ডে প্রকাশ করা। এরকম আর একটি প্রকাশনা হলে বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ ভূ-বিজ্ঞানী হিউ ব্রামারের বাংলাদেশে ভূপ্রকৃতি নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে লেখা ১০ খণ্ডের সিরিজটি বাংলাদেশের মাটি সম্পর্কে এমন তথ্যপূর্ণ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাসম্পন্ন বই দুর্লভ। বাংলাদেশের কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি বিভাগসহ বিভিন্ন সংস্থা বই কিনে সহযোগিতা করবে না জেনেও তিনি এই সিরিজ গ্রন্থটি আর্থিক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা সত্ত্বেও প্রকাশ করে গেছেন।

মুক্তিযুদ্ধ ছিল তার প্যাশনের অংশ। তাই বাংলা ও ইংরেজিতে এ বিষয়ে অনেক উন্নয়নযোগ্য বই প্রকাশ করেছেন। তার রোড টু বাংলাদেশ সিরিজ এ লক্ষ্যে পরিকল্পিত। তিনি বাংলাদেশের পাশাপাশি পাকিস্তানের যারা এ বিষয়ে ক্রেডিবল বই লিখেছেন সেগুলো সরাসরি প্রকাশ অথবা পুনঃমুদ্রণের ব্যবস্থা করেছেন। যুদ্ধ সময়ে ঢাকায় নিয়োজিত আর্চার ব্লাডের রচিত ‘দ্য ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ’-এর মতো ঐতিহাসিক বইটি তার প্রকাশনার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। এই সূত্রেই আর্চার ব্লাডকে নিয়ে আমেরিকান প্রকাশনে ও বুদ্ধিজীবীমহলে নতুনভাবে কৌতূহল ও পুনমূর্ল্যায়ন হয়। যার ফলে ঢাকাস্থ আমেরিকান সেন্টারের আর্চার ব্লাড সেন্টার নামে নামকরণ করা হয় ও মার্কিন সাংবাদিক গ্যারিকে বাস দ্য ‘ব্লাড টেলিগ্রাম : নিকসন, কিসিঞ্জার অ্যান্ড এ ফরগটেন জেনোসাইড’ (২০১৩) বহুল আলোচিত বইটি লেখেন। মহিউদ্দিন আহমেদ মুনতাসীর মামুনকে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তান ভ্রমণ করে রাও ফরমান আলীসহ যুদ্ধে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পাশাপাশি, আমলা, রাজনীতিক বুদ্ধিজীবীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে পাকিস্তানিদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশ বইটি সম্পাদনা করে একটি ঐতিহাসিক দলিল জাতির জন্য রেখে গেছেন। এছাড়া তার সংগ্রহ ভাণ্ডারে আনতে পেরেছিলেন, বাসন্তীগুহ ঠাকুরতার একাত্তরের স্মৃতিকথা।

বঙ্গবন্ধুর বিষয়েও সম্ভবত তিনিই প্রথম আন্তর্জাতিক মানের বই প্রকাশ করা শুরু করেন। মওদুদ আহমেদের ‘এরা সব শেখ মুজিবুর রহমান’, প্রশংসা ও সমালোচনায় মিশ্রিত ছিল বইটি দিয়ে যর শুরু মফিজ চৌধুরীর বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায়, বিচারপতি কামালউদ্দিন আহমেদের বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি, জিল্লুর রহমান খানের দি থার্ডওর্য়াল্ড ক্যারিজম্যাট : শেখ মুজিব অ্যান্ড দি স্ট্রাগল ফর ফ্রিডম, ইংরেজিতে তার প্রথম বায়োগ্রাফি রাষ্ট্রদূত এসএ করীমের শেখ মুজিব : দি ট্রায়াম্প অ্যান্ড ট্রাজেডি- এক এক করে বেশ কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে। এই সব বই-ই প্রকাশিত হয়েছে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে দূরে থাকা দুর্দিনের সময়। আর শেখ মুজিবুর রহমান রচিত অসমাপ্ত আত্মজীবনীর সুসম্পাদনা করানোর পর তার ইংরেজি অনুবাদ এক যোগে ও একদিনে বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানে রিলিজ করেন। ভারতের প্রকাশক ছিল পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া ও পাকিস্তানের প্রকাশক ছিল অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস পাকিস্তান। একযোগে একইদিনে তিন দেশ থেকে বাংলাদেশের আর কোন বই প্রকাশিত হয়নি। এই আয়োজন তিনিই সম্পন্ন করে গেছেন। উল্লেখ্য, বইটির উর্দু অনুবাদ অক্সফোর্ড পাকিস্তান কর্তৃক পাকিস্তানে প্রকাশের ব্যবস্থাও তিনি করেছেন। মহিউদ্দিন আহমেদের সবচেয়ে বড়ো অর্জন দেশি ও বিদেশি খ্যাতনামা ব্যক্তি ও লেখকদের ইউপিএল’র কান্ট্রিবিউটরদের তালিকায় যুক্ত করা। একই সঙ্গে বই নির্মাণকালে প্রয়োজনীয় ভাষা সম্পাদক, কপি এডিটর, পিয়ার-রিভিউয়ার হিসেবে বিশেষজ্ঞ স্থানীয় ব্যক্তিদের সহযোগিতা নিশ্চিত করাও কম কথা নয়। এরা ইউপিএলের রিসোর্স পারসন হিসেবে তারা স্বেচ্ছাসেবির মতো বিভিন্ন সময় কাজ করেছেন, সেটা সম্ভব হয়েছে মহিউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগের কারণেই। কে যুক্ত হননি, তাতে অবসরপ্রাপ্ত শীর্ষ আমলা, অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকারসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। তিনি তার কর্মযজ্ঞে বিভিন্ন পেশার খ্যাতিমান এত মানুষের সমাবেশ ঘটাতে পেরেছেন, তাদের তালিকা দিলে আশ্চর্য না হয়ে পারবেন না। এদের অনেকেই কাজের জন্য সম্মাননা বা পারিশ্রমিক পর্যন্ত প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা তাদের কাজকে দেশের একটি কাজ মনে করেছেন।

বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতের একজন সম্মানিত প্রতিনিধি হিসেবে দেশের বাইরেও তিনি প্রচুর সমাদর পেয়েছেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ফোরামে, ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকে ইউপিএলএর বই প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছেন, বক্তৃতা করেছেন। তিনি আফ্রো-এশিয়ান পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশনের একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে সুদীর্ঘকাল সরকার মনোনীত প্রকাশক প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে দেশে আইএসবিএন প্রচলন, জাতীয় গ্রন্থনীতি ১৯৯৪ প্রণয়নে প্রচুর অবদান রেখেছেন। বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি পুনর্গঠিত ও নিবন্ধিত হলে তিনি তার প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি গঠনে তিনি অবদান রেখেছেন ও তার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে কাজ করেন। প্রকাশনা শিল্পে নিয়োজিত থেকে দেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি তাকে একজন ফেলো হিসেবে সম্মানিত করে।

তিনি প্রকাশনা জগতের কাউকেই তার প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতেন না। স্বীয় পেশার লোকজনকে সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে গেছেন আজীবন। দেশের বিভিন্ন স্তরের বুদ্ধিজীবী ও নবীন-প্রবীণ লেখক এমনকি সাধারণ পাঠকের সঙ্গেও ছিল সমধুর সম্পর্ক।

বাংলাদেশের গ্রন্থ প্রকাশনার আঙ্গিকগত ও কনটেন্টগত একটি মানদণ্ড তৈরি করে দেয়ার জন্য তিনি সর্বদা স্মরিত হবেন, আরও স্মরিত হবেন বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ বইকে বিশ্ব দরবারে মেলে ধরার জন্য।

[লেখক : জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক কর্মকর্তা এবং ইউপিএলের কনসাল্টিং এডিটর ও প্রকাশকের পরামর্শক হিসেবে দীর্ঘকাল নিয়োজিত ছিলেন]

মঙ্গলবার, ২৯ জুন ২০২১ , ১৫ আষাঢ় ১৪২৮ ১৭ জিলক্বদ ১৪৪২

ইউপিএল ও একজন প্রকাশকের সাধনা

বদিউদ্দিন নাজির

image

কোন গ্রন্থপ্রকাশনা বিশেষজ্ঞ বা ইউরোপ কী আমেরিকায় কর্মরত কোন একাডেমিশিয়ানকে যদি প্রশ্ন করেন, বাংলাদেশের মতো দেশে কোন ইউনিভার্সিটি প্রেস চলতে পারে কি, বা যদি প্রশ্ন করেন ইউনিভার্সিটি বা উচ্চতর গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ছত্রছায়ায় আর্থিক অনুদান বা সহায়তা (Subvention) ছাড়া কোন ইউনিভার্সিটি প্রেস বা ইউনিভার্সিটি প্রেসের মতো প্রকাশনা কার্যক্রম কোথাও আছে কি, তিনি দ্বিধা না করে একশব্দে উত্তর দেবেন না।

কেন নয়, সে কথায় আমি পরে আসব, তবে এখানে যা বলতে চেয়েছি, এ সত্যটি শতভাগ জানা সত্ত্বেও মহিউদ্দিন আহমেদ সেই অসাধ্য সাধন করতে চেয়েছিলেন দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএ) প্রতিষ্ঠা করেন সেই ১৯৭৫ সালে। ভেবে দেখুন তার সংকল্প কতটা দুঃসাহসী ছিল। তার বেড়ে ওঠা, বুনিয়াদী ও উচ্চতর শিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা এবং সর্বোপরি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, করাচিতে এডিটর হিসেবে দায়িত্ব পালন তাকে সেই সাহস জুগিয়েছিল। প্রচণ্ড মানসিক শক্তি, সামাজিক ও প্রশাসনিক দিক দিয়ে ওজনদার ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব ও শুভাকাক্সক্ষী এবং ওপর মহলে অবাধ যাতায়াত ও গ্রহণযোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি অনেক বড় কিছু করতে পারতেন, কিন্তু সেদিকে যাননি। কতিপয় অংশীদার নিয়ে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ঢাকা ব্র্যাঞ্চের দায়দেনা মিটিয়ে অতি সামান্য পুঁজি নিয়ে ইউপিএল প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং সারা জীবন সেই প্রতিষ্ঠানটিকে প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।

এ যেন এক তপস্যা। তিনি তাতে সিদ্ধপুরুষে পরিণত হয়েছেন। বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের অদ্বিতীয় ব্যক্তি ও প্রকাশক কমিউনিটির অভিভাবক হিসেবে সর্বমহলে গৃহীত হয়েছেন। ইউপিএলকে দিয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রকাশকদের মধ্যে এক ব্র্যান্ড নেম, আর নিজে হয়ে উঠেছিলেন বিদ্ব্যজনের কাছে একজন বাতিঘর। বাংলাদেশ সম্পর্কে ইংরেজিতে লেখা যেমন দেশি ও বিদেশির গ্রন্থরচনা প্রকাশের একমাত্র ভরসাস্থল। মহিউদ্দিন আহমেদ তাদের মুশকিল আসানের প্রথম ও শেষ জায়গা।

এ জায়গায় তিনি উঠে এসেছেন দীর্ঘদিনের ত্যাগ-তিতিক্ষা, কঠোর পরিশ্রম এবং নিজের সংকল্পে অঁটুট থাকার কারণে। সেই কাহিনীর আদি-অন্ত অনেক দীর্ঘ। অনেক চড়াই-উতরাই অতিক্রম করতে হয়েছে তাকে, চলার পথে তাকে প্রয়োজনে কৌশল ও অগ্রাধিকার বিষয় পরিবর্তন করতে হয়েছে। তিনি একটি আদর্শ ইউনিভার্সিটি প্রেস সৃষ্টি করতে পারেননি কিন্তু দেশের জ্ঞানভিত্তিক সমাজের জন্য একজন প্রকাশকের সাধ্যে যতটা কুলায় তার ষোলোআনা তাতে উপুড় করে দিয়েছেন।

প্রথমেই বলি ইউনিভার্সিটি প্রেস কী? আর কেনই এ দেশে ইউনিভার্সিটি প্রেস চালু করা সম্ভব নয়। Merrium-Webster দেয়া সংজ্ঞটি এই A press connected with a University and especially concerned with the scholarly works. আর থাকতে হবে কোন ইউনিভার্সিটির Imprint (ছাপ) এবং তার কাজ হবে Aid in the dissemination of knowledge to scholars and well informed lay readers. এই প্রেসের আরেকটি চারিত্র্য হচ্ছে সেটি নন-প্রফিট অর্থাৎ লাভের জন্য কর্মপরিচালনা করবে না, (Wikipedia)। ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল) বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান নয়। বাস্তব কারণে ইউপিএল তার কার্যক্রমকে শুধু স্কলারলি (পাণ্ডিত্যপূর্ণ) বইয়ে সীমিত রাখেনি। তার প্রকাশনায় কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমপ্রিন্ট (ছাপ) থাকে না, এটি শুধু সজ্ঞান ও সচেতন ব্যক্তিদেরই ক্লায়েন্ট মনে করে সেবা দিয়ে যাচ্ছে না। তাহলে দেশে-বিদেশে তাকে ইউনিভার্সিটি প্রেস হিসেবে বিজ্ঞজনেরা সম্মান করে আসছে কেন?

কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠান না হয়েও ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সব চারিত্র্য বজায় রেখেছে প্রকাশক মহিউদ্দিন আহমেদের প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার কারণে। অনেক ইউনিভার্সিটি প্রেস যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্কলারলি একাডেমিক বইয়ের বাইরেও জেনারেল বুকস, রেফারেন্স, পাঠ্যপুস্তক এবং ট্রেডবুকসও প্রকাশ করে আসছে। এর প্রধান কারণ স্কলারলি ও একাডেমিক বই প্রকাশ প্রধানত অলাভজনক। প্রকাশক ক্রমাগত ভর্তুকি দিয়ে তাদের স্পনসর প্রতিষ্ঠানগুলো আর কুলিয়ে উঠতে পারছে না, নন-প্রফিট অরগানাইজেশন হয়েও তাদের অন্য ধরনের লাভজনক বই প্রকাশ করে সেই ভর্তুকির জায়গায় পুঁজি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। পৃথিবীর প্রথম এ ধরনের প্রেস দি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস (ওইউপি) সেটাই করে আসছে দীর্ঘ প্রায় শতকব্যাপী। শুনে আশ্চর্য হবেন, খ্যাতনামা ইউনিভার্সিটি প্রেসগুলো এখন থিসিস ছাপে না। থিসিস অবলম্বনে তৈরি যেসব বইয়ের যথেষ্ট পাঠক আছে সেগুলোই ছাপে। তাও আবার প্রাতিষ্ঠানিক অর্থ সাহায্য বা Subvention নিয়ে।

ইউপিএল বাংলাদেশে নিজেকে পরিচালনার জন্য সেই কৌশলই অবলম্বন করে এসেছে। তাই বিদেশি গ্রন্থ বিশেষজ্ঞদের কাছে আজও একটি বিস্ময় যে, বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছত্রছায়ায় ও সরকারি অনুদান ব্যতীত একটি ইউনিভার্সিটি প্রেস কীভাবে চলছে? এ কারণেই বিদেশের স্কলারলি ও একাডেমিক মহলে প্রকাশক মহিউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের জন্য একমাত্র পরিচিত মুখ, প্রধান ব্যক্তিত্বের পরিচয় ও কালচারাল অ্যামবাসেডরের সম্মান কুড়িয়ে এসেছেন।

এ লড়াইটা ছিল তার একার লড়াই এবং সঙ্গী ছিল তার ধনুকভাঙ্গা পণ বা সংকল্প। পাঠকদেরই ভেবে দেখতে বলি, ইউপিএলের প্রতিষ্ঠাকালীন অর্থাৎ গত শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশের পরিচিতি স্কলার কয়জন ছিলেন। ইংরেজিতে লেখা স্কলারলি/একাডেমিক/ট্রেডবই কয়টি ছিল? আমাদের যে স্কলারলি কমিউনিটি বা একাডেমিয়া তার পরিসর কতটি ছিল? বিদেশে বাংলাদেশের পাণ্ডিত্যপূর্ণ বা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ইতিহাস ও সামাজিক বিষয়ে গবেষণাপূর্ণ রচনার ভাষা ইংরেজি মাধ্যম না হলে সংশ্লিষ্ট মহলে গৃহীত হবে না, স্কলার বা লেখকরাও পরিচিতি অর্জন করবেন না। ইংরেজি ছাড়া উপায় ছিল না, আজও নেই। বাংলাদেশে আধুনিক ইংরেজিতে সচ্ছন্দভাবে বিজ্ঞজনকে কমিউনিকেট করতে এই ২০২১ সালেই কয়জন যোগ্য লোক পাওয়া যায়। কয়জন ল্যাঙ্গুয়েজ এডিটর, কপি-এডিটর, ইনডেকসার, বিবলিওগ্রাফার এমনকি প্রুফ রিডার পাওয়া যায়। বই প্রকাশনা করে এই সীমিত বাজারে যে আয় করা যায়, তাতে ওইসব কাজের জন্য উচ্চপারিশ্রমিক আদৌ দেয়া সম্ভব কী? সুতরাং বুঝুন, মহিউদ্দিন আহমেদকে তার লক্ষ্যে পৌঁছতে কি লড়াইটাই না করতে হয়েছে। উপযুক্ত ব্যক্তিকে খুঁজে বের করে তাকে রাজি করানো, তাকে তার কাজে পারিশ্রমিক জোগাড় করতে মহিউদ্দিন আহমেদকে কি পরিশ্রম ও মাথা খাটাতে হয়েছে।

এবার প্রতিষ্ঠানটিকে নিজের পায়ে দাঁড় করাতে তার লড়াইয়ের সংক্ষিপ্ত একটি বর্ণনা দেই।

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ঢাকা ব্র্যাঞ্চের অবসায়ন ঘটিয়ে দু’জন অংশীদার নিয়ে সেই জায়গায় ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড প্রতিষ্ঠিত হয়। অক্সফোর্ডের কোন স্থাবর সম্পত্তি ছিল না, বিক্রির জন্য কিছু বই ব্যতীত সে সময় ওই প্রতিষ্ঠান স্কুলপর্যায়ের কয়েকটি বই পুনঃমুদ্রণের পারমিশন ছাড়া আর কিছু দিয়ে যেতে পারেনি। আর ছিল সেকালের বিখ্যাত চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ আবদুল বাসেতের বাংলায় লেখা খানচারেক বইয়ের পরিবেশনের অধিকার। সেই সঙ্গে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারী, যদিও সংখ্যায় ছিল কম।

তিনি পুঁজি হিসেবে পেরেছিলেন অংশীদারদের ১ লাখ ৪০ হাজার স্থায়ী আমানতের বিপরীতে ব্যাংক ঋণ। এই পর্যন্তই। শুরু থেকেই তিনি ইউপিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে সম্মুখসারিতে থেকে যুদ্ধ করে এসেছেন। আর কোন সময় গঠিত এই কোম্পানিতে নতুন কোন পুঁজি বিনিয়োগ হয়নি।

ফলে সিজন্যাল স্কুল বই প্রকাশের সময় তাকে বন্ধুদের কাছ থেকে সুদে টাকা ধার করতে হয়েছে, কাগজের দোকানে বাকি রাখতে হয়েছে। অবশ্য এক সময় তিনি জনতা ব্যাংক থেকে স্টকের বিপরীতে (এক অর্থে কো-ল্যাটারাল ছাড়াই) ঋণ সুবিধা পেলে পুঁজির সংকট কিছুটা হলেও কেটে যায়। তিনি প্রতি বছরই অর্থবছরের শেষের সপ্তাহে ব্যাংকের সম্পূর্ণ দেনা পরিশোধ করে নতুন করে ঋণ নিতেন। ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে এটাও একটি অনন্য নজির স্থাপন করে গেছেন।

তবে মূলত খুদ খেয়ে খুদ সঞ্চয় করার মতো তাকে অসীম ধৈর্যসহকারে এই প্রতিষ্ঠানটিকে আজকের অবস্থানে আনতে হয়েছে। তিনি এই প্র্রতিষ্ঠান থেকে নিজের বেতন বাবদে কখনও কিছু নেননি। তারপরও কোম্পানি প্রায় প্রতিবছরে অডিট শেষে প্রদানের পর নন-প্রফিটই থেকেছে। একটি ইউনিভার্সিটি প্রেস হিসেবে এটা কোন ব্যর্থতা নয়।

প্রফিট না হওয়ায় তার আফসোস ছিল না। তিনি ছিলেন সৃষ্টির আনন্দে। বাইন্ডারের কাছ থেকে নতুন কোন বই এলে নেড়ে-চেড়ে দেখার সময় তার মুখমণ্ডলে পরিতৃপ্তির আভাস ফুটে উঠত। কত বিচিত্র বিষয়েই না তিনি বই প্রকাশ করেছেন।

ইংরেজিতে, পরে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষাতেও ইউপিএলের বই কনটেন্টের দিক থেকে ও প্রকাশনা মানের বিচারে স্বাতত্র্যে অভিষিক্ত। আশির দশকে দেশের উন্নতমান প্রকাশনার মতো বেশ কয়েকবার পুরস্কার অর্জন করেছে এই প্রতিষ্ঠান। বিদেশে বাংলাদেশের অপ্রচলিত পণ্য রপ্তানির জন্যও অর্জন করেছে প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড। আর সেই ১৯৯০ সালে প্রকাশনা শিল্পে অবদানের জন্য মহিউদ্দিন আহমেদকে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র স্বর্ণপদকে সম্মানিতও করা হয়েছে।

তার প্রকাশনার কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কথা তুলে ধরব। বিদেশে বাংলাদেশের সাহিত্যকে তুলে ধরার জন্য তিনি আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করেও বাংলাদেশের লেখকদের রচিত বেশ কয়েকটি গল্প উপন্যাস কবিতার বইয়ের অনুবাদ প্রকাশ করেছেন। তিনি এমন সব বিষয়ে গবেষণামূলক ইংরেজি বই প্রকাশ করেছেন, যেসব বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষের অনাগ্রহ থাকলেও বিদেশে প্রচুরভাবে প্রশংসিত এবং কোন কোনটির পুরোপুরি বা অংশ বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্সে পঠিত হয়।

প্রদেশের প্রকাশনা শিল্পে তার দুটি প্রকাশনা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বিক্রি হবে কি হবে না, চিন্তা না করেই প্রথম তত্ত্বাধায়ক সরকারের আমলে অতি অল্প সময়ে প্রায় রয়্যাল সাইজে দুই হাজার পৃষ্ঠার টাস্কফোর্স রিপোর্ট মোট ৪ খণ্ডে প্রকাশ করা। এরকম আর একটি প্রকাশনা হলে বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ ভূ-বিজ্ঞানী হিউ ব্রামারের বাংলাদেশে ভূপ্রকৃতি নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে লেখা ১০ খণ্ডের সিরিজটি বাংলাদেশের মাটি সম্পর্কে এমন তথ্যপূর্ণ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাসম্পন্ন বই দুর্লভ। বাংলাদেশের কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি বিভাগসহ বিভিন্ন সংস্থা বই কিনে সহযোগিতা করবে না জেনেও তিনি এই সিরিজ গ্রন্থটি আর্থিক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা সত্ত্বেও প্রকাশ করে গেছেন।

মুক্তিযুদ্ধ ছিল তার প্যাশনের অংশ। তাই বাংলা ও ইংরেজিতে এ বিষয়ে অনেক উন্নয়নযোগ্য বই প্রকাশ করেছেন। তার রোড টু বাংলাদেশ সিরিজ এ লক্ষ্যে পরিকল্পিত। তিনি বাংলাদেশের পাশাপাশি পাকিস্তানের যারা এ বিষয়ে ক্রেডিবল বই লিখেছেন সেগুলো সরাসরি প্রকাশ অথবা পুনঃমুদ্রণের ব্যবস্থা করেছেন। যুদ্ধ সময়ে ঢাকায় নিয়োজিত আর্চার ব্লাডের রচিত ‘দ্য ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ’-এর মতো ঐতিহাসিক বইটি তার প্রকাশনার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। এই সূত্রেই আর্চার ব্লাডকে নিয়ে আমেরিকান প্রকাশনে ও বুদ্ধিজীবীমহলে নতুনভাবে কৌতূহল ও পুনমূর্ল্যায়ন হয়। যার ফলে ঢাকাস্থ আমেরিকান সেন্টারের আর্চার ব্লাড সেন্টার নামে নামকরণ করা হয় ও মার্কিন সাংবাদিক গ্যারিকে বাস দ্য ‘ব্লাড টেলিগ্রাম : নিকসন, কিসিঞ্জার অ্যান্ড এ ফরগটেন জেনোসাইড’ (২০১৩) বহুল আলোচিত বইটি লেখেন। মহিউদ্দিন আহমেদ মুনতাসীর মামুনকে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তান ভ্রমণ করে রাও ফরমান আলীসহ যুদ্ধে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পাশাপাশি, আমলা, রাজনীতিক বুদ্ধিজীবীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে পাকিস্তানিদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশ বইটি সম্পাদনা করে একটি ঐতিহাসিক দলিল জাতির জন্য রেখে গেছেন। এছাড়া তার সংগ্রহ ভাণ্ডারে আনতে পেরেছিলেন, বাসন্তীগুহ ঠাকুরতার একাত্তরের স্মৃতিকথা।

বঙ্গবন্ধুর বিষয়েও সম্ভবত তিনিই প্রথম আন্তর্জাতিক মানের বই প্রকাশ করা শুরু করেন। মওদুদ আহমেদের ‘এরা সব শেখ মুজিবুর রহমান’, প্রশংসা ও সমালোচনায় মিশ্রিত ছিল বইটি দিয়ে যর শুরু মফিজ চৌধুরীর বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায়, বিচারপতি কামালউদ্দিন আহমেদের বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি, জিল্লুর রহমান খানের দি থার্ডওর্য়াল্ড ক্যারিজম্যাট : শেখ মুজিব অ্যান্ড দি স্ট্রাগল ফর ফ্রিডম, ইংরেজিতে তার প্রথম বায়োগ্রাফি রাষ্ট্রদূত এসএ করীমের শেখ মুজিব : দি ট্রায়াম্প অ্যান্ড ট্রাজেডি- এক এক করে বেশ কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে। এই সব বই-ই প্রকাশিত হয়েছে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে দূরে থাকা দুর্দিনের সময়। আর শেখ মুজিবুর রহমান রচিত অসমাপ্ত আত্মজীবনীর সুসম্পাদনা করানোর পর তার ইংরেজি অনুবাদ এক যোগে ও একদিনে বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানে রিলিজ করেন। ভারতের প্রকাশক ছিল পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া ও পাকিস্তানের প্রকাশক ছিল অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস পাকিস্তান। একযোগে একইদিনে তিন দেশ থেকে বাংলাদেশের আর কোন বই প্রকাশিত হয়নি। এই আয়োজন তিনিই সম্পন্ন করে গেছেন। উল্লেখ্য, বইটির উর্দু অনুবাদ অক্সফোর্ড পাকিস্তান কর্তৃক পাকিস্তানে প্রকাশের ব্যবস্থাও তিনি করেছেন। মহিউদ্দিন আহমেদের সবচেয়ে বড়ো অর্জন দেশি ও বিদেশি খ্যাতনামা ব্যক্তি ও লেখকদের ইউপিএল’র কান্ট্রিবিউটরদের তালিকায় যুক্ত করা। একই সঙ্গে বই নির্মাণকালে প্রয়োজনীয় ভাষা সম্পাদক, কপি এডিটর, পিয়ার-রিভিউয়ার হিসেবে বিশেষজ্ঞ স্থানীয় ব্যক্তিদের সহযোগিতা নিশ্চিত করাও কম কথা নয়। এরা ইউপিএলের রিসোর্স পারসন হিসেবে তারা স্বেচ্ছাসেবির মতো বিভিন্ন সময় কাজ করেছেন, সেটা সম্ভব হয়েছে মহিউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগের কারণেই। কে যুক্ত হননি, তাতে অবসরপ্রাপ্ত শীর্ষ আমলা, অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকারসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। তিনি তার কর্মযজ্ঞে বিভিন্ন পেশার খ্যাতিমান এত মানুষের সমাবেশ ঘটাতে পেরেছেন, তাদের তালিকা দিলে আশ্চর্য না হয়ে পারবেন না। এদের অনেকেই কাজের জন্য সম্মাননা বা পারিশ্রমিক পর্যন্ত প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা তাদের কাজকে দেশের একটি কাজ মনে করেছেন।

বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতের একজন সম্মানিত প্রতিনিধি হিসেবে দেশের বাইরেও তিনি প্রচুর সমাদর পেয়েছেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ফোরামে, ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকে ইউপিএলএর বই প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছেন, বক্তৃতা করেছেন। তিনি আফ্রো-এশিয়ান পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশনের একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে সুদীর্ঘকাল সরকার মনোনীত প্রকাশক প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে দেশে আইএসবিএন প্রচলন, জাতীয় গ্রন্থনীতি ১৯৯৪ প্রণয়নে প্রচুর অবদান রেখেছেন। বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি পুনর্গঠিত ও নিবন্ধিত হলে তিনি তার প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি গঠনে তিনি অবদান রেখেছেন ও তার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে কাজ করেন। প্রকাশনা শিল্পে নিয়োজিত থেকে দেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি তাকে একজন ফেলো হিসেবে সম্মানিত করে।

তিনি প্রকাশনা জগতের কাউকেই তার প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতেন না। স্বীয় পেশার লোকজনকে সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে গেছেন আজীবন। দেশের বিভিন্ন স্তরের বুদ্ধিজীবী ও নবীন-প্রবীণ লেখক এমনকি সাধারণ পাঠকের সঙ্গেও ছিল সমধুর সম্পর্ক।

বাংলাদেশের গ্রন্থ প্রকাশনার আঙ্গিকগত ও কনটেন্টগত একটি মানদণ্ড তৈরি করে দেয়ার জন্য তিনি সর্বদা স্মরিত হবেন, আরও স্মরিত হবেন বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ বইকে বিশ্ব দরবারে মেলে ধরার জন্য।

[লেখক : জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক কর্মকর্তা এবং ইউপিএলের কনসাল্টিং এডিটর ও প্রকাশকের পরামর্শক হিসেবে দীর্ঘকাল নিয়োজিত ছিলেন]