মগবাজারে বিস্ফোরণ মিথেন গ্যাস থেকেই পুলিশ

মগবাজারে বিস্ফোরণে ভবন ধসের কারণ ‘জমে থাকা মিথেন গ্যাস’ বলছে পুলিশের গঠিত তদন্ত কমিটি। বিস্ফোরিত ভবনে ১২ শতাংশ মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি পেয়েছে পুলিশ। তিতাসের ব্যবস্থাপনায় লাইনের মাধ্যমে যে গ্যাস সরবরাহ হয় সেটি মূলত মিথেন গ্যাস।

এ বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ মেজর (অব.) শাকিল আহমেদ বলছেন, ৫ থেকে ১৭ পার্সেন্ট মিথেন গ্যাস বাতাসে বা বন্ধ ঘরে জমে থাকলে যে কোন স্পুলিং থেকে বিস্ফোরণ হয় এবং তা খুবই শক্তিশালী হয় । এটি প্রেসার এবং কম্পনও তৈরি করে অনেক শক্তি নিয়ে।

এদিকে ভবন ধসের ঘটনায় অবেহলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এনে একটি মামলা করেছে পুলিশ। গতকাল ভবন থেকে আরও একজনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। উদ্ধার হওয়া ব্যক্তির নাম হারুন অর রশিদ যিনি ওই ভবনের নিরাপত্তাকর্মী এবং ঘটনার পর থেকে নিখোঁজ ছিলেন। এ ঘটনায় পুলিশের হিসাব অনুযায়ী মৃত্যুর সংখ্যা ৮ জনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এর আগে চিকিৎাসীন অবস্থায় মারা গেছেন শর্মা হাউজের একজন কর্মী।

গতকালও ধসে যাওয়া ভবনে তল্লাশি কার্যক্রম চালিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। বিস্ফোরণের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা গতকালও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বিভিন্ন ধরনের আলামত সংগ্রহ করেছেন। তারা জানার চেষ্টা করছেন ঠিক কোথা থেকে বিস্ফোরণের সূত্রপাত এবং সেটি জমে থাকা গ্যাসের কারণেই কিনা। এ বিষয়ে গঠিত ফায়ার সার্ভিস এবং বিস্ফোরক পরিদপ্তর এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে বিস্ফোরণের কারণ নিয়ে কোন কথা বলেননি।

মগবাজার বিস্ফোরণ তদন্তে পুলিশের ৭ সদস্যের কমিটির প্রধান কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) অতিরিক্ত কমিশনার আসাদুজ্জামাব বলেছেন, বিস্ফোরিত ভবনের বিভিন্ন আলামত ‘পরীক্ষা করে ১২ শতাংশ মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তবে এই মিথেন গ্যাসের উৎস কী সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। শুধু এটুকুই বলা যাচ্ছে মিথেন গ্যাস থেকেই এ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। ‘বিস্ফোরিত ভবনের নিচ তলায় ভয়াবহ মাত্রার মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে বলেন তিনি।’

তিনি বলেন, পুলিশের ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি গতকাল সকাল থেকে ঘটনাস্থলে নানা আলামত সংগ্রহ করে। এ সময় উদ্বেগজনক মাত্রার মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়। বিস্ফোরণ ভয়াবহ হলেও কোন অগ্নিকা- না ঘটার কারণ নিয়ে আসাদুজ্জামান বলেন, ‘বিস্ফোরণস্থল একদিকে ফাঁকা ছিল, সে কারণে বিস্ফোরণের প্রকটতা একদিকে লক্ষ্য করা গেছে। যদি আবদ্ধ অবস্থায় থাকত তাহলে চারপাশ দিয়েই ব্যাপকতা থাকত।’

কোন ধরনের ইলেকট্রনিক বিস্ফোরক (আইডি) ডিভাইস দিয়ে এ বিস্ফোরণ ঘটনা হয়ে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘কী কারণে এত বড় পরিসরের বিস্ফোরণ ঘটল সে বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। আলামত সংগ্রহ করছি। তবে এখানে কোন আইইডি (বিস্ফোরক জাতীয় পদার্থ) বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেনি।’

বিস্ফোরক অধিদপ্তরে প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ টেলিফোনে সংবাদকে বলেন, তারা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। তদন্ত কমিটির সদস্যরা গতকালও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তবে তারা এখনও নিশ্চিত নয় মিথেন গ্যাস থেকে এ বিস্ফোরণ ঘটেছে কিনা। মিথেন গ্যাস মূলত সরকারি লাইনের গ্যাস।

আবুল কালাম আজাদ বলেন, তিতাস বলেছে, ওই ভবনে তাদের কোন গ্যাস সংযোগ নেই। কিন্তু ভবনের সামনে আমরা তিতাস গ্যাসের লাইনের অস্তিত্ব পেয়েছি। এখন সামনে যেহেতু রাস্তা খোড়া হয়েছে সেখানে গ্যাসের লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অথবা আগ থেকে লিক থাকার কারণে লাইনের গ্যাস বের হতো কিনা এসব বিষয় দেখা হচ্ছে। এছাড়া বিস্ফোরিত ভবনে শর্মা হাউজ এবং বেঙ্গল মিটের ফ্রিজ এবং এসি চালু ছিল। মিথেনের সঙ্গে ফ্রিজ বা এসি বা বায়ো গ্যাসের মিশ্রন থেকেও হয়েছে কিনা তাও দেখা হচ্ছে।

তিনি বলেন, অতীতে দেখা গেছে, গ্যাসের বিস্ফোরণে ভবন ধসেছে। তার সঙ্গে মিল থাকলেও বিকট শব্দ এবং কম্পন তৈরি হওয়ার বিষয়টি তাদের কাছে রহস্যজনক মনে হচ্ছে। সব মিলিয়ে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর বিস্ফোরণের মূল কারণ নিশ্চিতভাবে বলা যাবে।

৫ থেকে ১৭ পার্সেন্ট মিথেন গ্যাস থেকে বড় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে

ফায়ার সার্ভিসের সাবেক পরিচালক (অপারেশন্স অ্যান্ড মেনটেইন্যান্স) ডিজাস্টার ম্যানেজম্যান্ট বিশেষজ্ঞ মেজর (অব.) শাকিল আহমেদ গতকাল টেলিফোনে সংবাদকে জানান, মগবাজারের বিস্ফোরণের ঘটনার নেপথ্যে লাইনের গ্যাসের কোন না কোন যোগসূত্র রয়েছে। ওই ভবনের আশপাশে অথবা ভবনের সামনে গ্যাসের লাইন লিক হয়ে অথবা কাটা পড়ে সুয়ারেজের মধ্যে জমা হয়েছে অথবা বাতাসে জমে ছিল যা মিথেন গ্যাসে পরিণত হয়েছে। বাতাসে মিথেন ৯৯ পার্সেন্ট থাকার পাশাপাশি প্রপেন এবং বিউটেনও তৈরি করে। যা অন্যান্য গ্যাসের সংস্পর্শে এসে কোন ধরনের স্পার্কিং থেকে বড় বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।

বিস্ফোরণে মিথেন প্রতিসেকেন্ডে ৩৮৩ মিটার প্রেসার তৈরি করে। ঘণ্টায় হিসাব করলে প্রতিঘণ্টায় ১২শ’ কিলোমিটার প্রেসার তৈরি করে। পাশাপাশি বড় কম্পনও তৈরি করতে পারে। মগবাজারের ঘটনায় যেটি দেখা গেছে, এটি মিথেনের চরিত্রের সঙ্গে মিলে যায়।

মেজর শাকিল বলছেন, সরকারিভাবে তিতাস যে গ্যাস লাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করে সেটি মিথেন গ্যাস। মিথেনের সঙ্গে প্রপেন এবং বিউটনও থাকে। এর আগেও এ ধরনের বিস্ফোরণের তদন্ত করতে গিয়ে কারণ হিসেবে মিথেন গ্যাসের যোগসূত্র পাওয়া গেছে।

এ ধরনের বিস্ফোরণ অনেক সময় আগুন ধরে না তবে আগুনের মতো করে ফ্লাস তৈরি করে এবং তা ১০ থেকে ১৫ সেকেন্ড স্থায়ী হয়। মগবাজারের ঘটনায় এমনটিই দেখা গেছে। আগুন না থাকলেও আগুনের মতো ফ্লাস তৈরি করেছে যা ১০ থেকে ১৫ সেকেন্ড স্থায়ী ছিল।

তিনি বলেন, নিশ্চই ওই এলাকায় তিতাসের লাইন কোথায় কোথায় আছে সেটির একটি রোডম্যাপ তিতাসের কাছে আছে। সেই রোডম্যাপ ধরে তারা খুঁজে বের করতে পারে তাদের কোন সংযোগে ত্রুটির কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে কিনা।

নিখোঁজ নিরাপত্তাকর্মীর লাশ উদ্ধার

মৃতের সংখ্যা ৮

মগবাজার বিস্ফোরণের ঘটনায় ৭৯ নম্বর বাড়ির নিখোঁজ ম্যানেজার হারুনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। ঘটনার দিন থেকে খোঁজ মিলছিল না ৭০ বছর বয়সী এ ব্যক্তির। গতকাল বিস্ফোরিত ভবনের ধ্বংসাবশেষ থেকে হারুনের লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের রেসকিউ টিম। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা ৮ জনে দাঁড়িয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, বিকেল ৩টা ৩৩ মিনিটে বিধ্বস্ত ভবনের ধ্বংসাবশেষ অপসারণের সময় হারুনের লাশ উদ্ধার করা হয়। দুর্ঘটনার পর থেকে ফায়ার সার্ভিসের তল্লাশি কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। তারই অংশ হিসেবে গতকাল তল্লাশি করতে গিয়ে এ নিরাপত্তাকর্মীর লাশ পাওয়া যায়। পরে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

হারুন অর রশিদ ভবনের নিচতলার একটি ছোট ঘরে থাকতেন। তার বয়স ৭০। গ্রামের বাড়ি বরিশাল। ‘ঘটনার দিন বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে মেয়ের সঙ্গে ফোনে শেষ কথা হয় হারুনের। এরপর তার মোবাইল বন্ধ ছিল। হারুন বাড়িটি দেখাশুনা করার পাশাপাশি ভাড়া তোলার দায়িত্বে ছিলেন। হারুন যে রুমটিতে থাকতেন তার সামনে বেঙ্গল মিট নামের ফ্রিজে সংরক্ষণ করে মাংস বিক্রির প্রতিষ্ঠান ছিল।

পুলিশ জানিয়েছে, এ নিয়ে ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। ঘটনার দিন নারী ও শিশুসহ ৬ জন মারা গেছেন। রাতে ঢাকা মেডিকেল থেকে অন্য হাসপাতালে নেওয়ার সময় সরমা হাউজের এক কর্মচারীর মৃত্যু হয়েছে। ওই কর্মচারীর মৃত্যুর হিসাব পুলিশ পরে জানতে পেরেছে। গতকাল একজনের মৃত্যু হওয়াসহ মোট ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে ৩ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের ৯০ ভাগ বার্ন হয়েছে।

অবহেলাজনিত কারণে পুলিশের মৃত্যু

বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রাণহানি এবং আহত হওয়ার ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে একটি মামলা হয়েছে।

রমনা বিভাগের উপকমিশনার সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ভবনটি অনেক পুরাতন, কাঠামোও দুর্বল। তাছাড়া প্রাথমিক তদন্তে এই দুর্ঘটনার পেছনে অনেক গাফিলতির বিষয়ও জড়িত বলে তাদের মনে হয়েছে। মামলায় কয়েকজনের মৃত্যুর ঘটনায় অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ আনা হয়েছে।

পুলিশের রমনা থানার ওসি বলেন, মামলায় কাউকে আসামি করা হয়নি। এ ঘটনায় তারা বাড়ির মালিক, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকসহ সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। ঘটনা নিয়ে তারা তদন্ত চালাচ্ছেন। গ্যাসের কারণে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে তার জন্য কার কার দায় রয়েছে সেগুলো তদন্ত চলছে। তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে পুলিশ।

গত রোববার সন্ধ্যায় ৭৯ আউটার সার্কুলার রোডের একটি ৩ তলা পুরোনো বাড়িতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। বিষ্ফোরণে বাড়িটি ধসে পড়ে। আশপাশের ৫শ’ গজের মধ্যে ১৮ ভবন ও মার্কেট ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ব্যাপক কম্পন তৈরি করে। রাস্তায় ৩টি যাত্রীবাহী বাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বুধবার, ৩০ জুন ২০২১ , ১৬ আষাঢ় ১৪২৮ ১৮ জিলক্বদ ১৪৪২

মগবাজারে বিস্ফোরণ মিথেন গ্যাস থেকেই পুলিশ

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

মগবাজারে বিস্ফোরণে ভবন ধসের কারণ ‘জমে থাকা মিথেন গ্যাস’ বলছে পুলিশের গঠিত তদন্ত কমিটি। বিস্ফোরিত ভবনে ১২ শতাংশ মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি পেয়েছে পুলিশ। তিতাসের ব্যবস্থাপনায় লাইনের মাধ্যমে যে গ্যাস সরবরাহ হয় সেটি মূলত মিথেন গ্যাস।

এ বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ মেজর (অব.) শাকিল আহমেদ বলছেন, ৫ থেকে ১৭ পার্সেন্ট মিথেন গ্যাস বাতাসে বা বন্ধ ঘরে জমে থাকলে যে কোন স্পুলিং থেকে বিস্ফোরণ হয় এবং তা খুবই শক্তিশালী হয় । এটি প্রেসার এবং কম্পনও তৈরি করে অনেক শক্তি নিয়ে।

এদিকে ভবন ধসের ঘটনায় অবেহলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এনে একটি মামলা করেছে পুলিশ। গতকাল ভবন থেকে আরও একজনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। উদ্ধার হওয়া ব্যক্তির নাম হারুন অর রশিদ যিনি ওই ভবনের নিরাপত্তাকর্মী এবং ঘটনার পর থেকে নিখোঁজ ছিলেন। এ ঘটনায় পুলিশের হিসাব অনুযায়ী মৃত্যুর সংখ্যা ৮ জনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এর আগে চিকিৎাসীন অবস্থায় মারা গেছেন শর্মা হাউজের একজন কর্মী।

গতকালও ধসে যাওয়া ভবনে তল্লাশি কার্যক্রম চালিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। বিস্ফোরণের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা গতকালও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বিভিন্ন ধরনের আলামত সংগ্রহ করেছেন। তারা জানার চেষ্টা করছেন ঠিক কোথা থেকে বিস্ফোরণের সূত্রপাত এবং সেটি জমে থাকা গ্যাসের কারণেই কিনা। এ বিষয়ে গঠিত ফায়ার সার্ভিস এবং বিস্ফোরক পরিদপ্তর এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে বিস্ফোরণের কারণ নিয়ে কোন কথা বলেননি।

মগবাজার বিস্ফোরণ তদন্তে পুলিশের ৭ সদস্যের কমিটির প্রধান কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) অতিরিক্ত কমিশনার আসাদুজ্জামাব বলেছেন, বিস্ফোরিত ভবনের বিভিন্ন আলামত ‘পরীক্ষা করে ১২ শতাংশ মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তবে এই মিথেন গ্যাসের উৎস কী সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। শুধু এটুকুই বলা যাচ্ছে মিথেন গ্যাস থেকেই এ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। ‘বিস্ফোরিত ভবনের নিচ তলায় ভয়াবহ মাত্রার মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে বলেন তিনি।’

তিনি বলেন, পুলিশের ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি গতকাল সকাল থেকে ঘটনাস্থলে নানা আলামত সংগ্রহ করে। এ সময় উদ্বেগজনক মাত্রার মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়। বিস্ফোরণ ভয়াবহ হলেও কোন অগ্নিকা- না ঘটার কারণ নিয়ে আসাদুজ্জামান বলেন, ‘বিস্ফোরণস্থল একদিকে ফাঁকা ছিল, সে কারণে বিস্ফোরণের প্রকটতা একদিকে লক্ষ্য করা গেছে। যদি আবদ্ধ অবস্থায় থাকত তাহলে চারপাশ দিয়েই ব্যাপকতা থাকত।’

কোন ধরনের ইলেকট্রনিক বিস্ফোরক (আইডি) ডিভাইস দিয়ে এ বিস্ফোরণ ঘটনা হয়ে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘কী কারণে এত বড় পরিসরের বিস্ফোরণ ঘটল সে বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। আলামত সংগ্রহ করছি। তবে এখানে কোন আইইডি (বিস্ফোরক জাতীয় পদার্থ) বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেনি।’

বিস্ফোরক অধিদপ্তরে প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ টেলিফোনে সংবাদকে বলেন, তারা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। তদন্ত কমিটির সদস্যরা গতকালও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তবে তারা এখনও নিশ্চিত নয় মিথেন গ্যাস থেকে এ বিস্ফোরণ ঘটেছে কিনা। মিথেন গ্যাস মূলত সরকারি লাইনের গ্যাস।

আবুল কালাম আজাদ বলেন, তিতাস বলেছে, ওই ভবনে তাদের কোন গ্যাস সংযোগ নেই। কিন্তু ভবনের সামনে আমরা তিতাস গ্যাসের লাইনের অস্তিত্ব পেয়েছি। এখন সামনে যেহেতু রাস্তা খোড়া হয়েছে সেখানে গ্যাসের লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অথবা আগ থেকে লিক থাকার কারণে লাইনের গ্যাস বের হতো কিনা এসব বিষয় দেখা হচ্ছে। এছাড়া বিস্ফোরিত ভবনে শর্মা হাউজ এবং বেঙ্গল মিটের ফ্রিজ এবং এসি চালু ছিল। মিথেনের সঙ্গে ফ্রিজ বা এসি বা বায়ো গ্যাসের মিশ্রন থেকেও হয়েছে কিনা তাও দেখা হচ্ছে।

তিনি বলেন, অতীতে দেখা গেছে, গ্যাসের বিস্ফোরণে ভবন ধসেছে। তার সঙ্গে মিল থাকলেও বিকট শব্দ এবং কম্পন তৈরি হওয়ার বিষয়টি তাদের কাছে রহস্যজনক মনে হচ্ছে। সব মিলিয়ে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর বিস্ফোরণের মূল কারণ নিশ্চিতভাবে বলা যাবে।

৫ থেকে ১৭ পার্সেন্ট মিথেন গ্যাস থেকে বড় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে

ফায়ার সার্ভিসের সাবেক পরিচালক (অপারেশন্স অ্যান্ড মেনটেইন্যান্স) ডিজাস্টার ম্যানেজম্যান্ট বিশেষজ্ঞ মেজর (অব.) শাকিল আহমেদ গতকাল টেলিফোনে সংবাদকে জানান, মগবাজারের বিস্ফোরণের ঘটনার নেপথ্যে লাইনের গ্যাসের কোন না কোন যোগসূত্র রয়েছে। ওই ভবনের আশপাশে অথবা ভবনের সামনে গ্যাসের লাইন লিক হয়ে অথবা কাটা পড়ে সুয়ারেজের মধ্যে জমা হয়েছে অথবা বাতাসে জমে ছিল যা মিথেন গ্যাসে পরিণত হয়েছে। বাতাসে মিথেন ৯৯ পার্সেন্ট থাকার পাশাপাশি প্রপেন এবং বিউটেনও তৈরি করে। যা অন্যান্য গ্যাসের সংস্পর্শে এসে কোন ধরনের স্পার্কিং থেকে বড় বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।

বিস্ফোরণে মিথেন প্রতিসেকেন্ডে ৩৮৩ মিটার প্রেসার তৈরি করে। ঘণ্টায় হিসাব করলে প্রতিঘণ্টায় ১২শ’ কিলোমিটার প্রেসার তৈরি করে। পাশাপাশি বড় কম্পনও তৈরি করতে পারে। মগবাজারের ঘটনায় যেটি দেখা গেছে, এটি মিথেনের চরিত্রের সঙ্গে মিলে যায়।

মেজর শাকিল বলছেন, সরকারিভাবে তিতাস যে গ্যাস লাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করে সেটি মিথেন গ্যাস। মিথেনের সঙ্গে প্রপেন এবং বিউটনও থাকে। এর আগেও এ ধরনের বিস্ফোরণের তদন্ত করতে গিয়ে কারণ হিসেবে মিথেন গ্যাসের যোগসূত্র পাওয়া গেছে।

এ ধরনের বিস্ফোরণ অনেক সময় আগুন ধরে না তবে আগুনের মতো করে ফ্লাস তৈরি করে এবং তা ১০ থেকে ১৫ সেকেন্ড স্থায়ী হয়। মগবাজারের ঘটনায় এমনটিই দেখা গেছে। আগুন না থাকলেও আগুনের মতো ফ্লাস তৈরি করেছে যা ১০ থেকে ১৫ সেকেন্ড স্থায়ী ছিল।

তিনি বলেন, নিশ্চই ওই এলাকায় তিতাসের লাইন কোথায় কোথায় আছে সেটির একটি রোডম্যাপ তিতাসের কাছে আছে। সেই রোডম্যাপ ধরে তারা খুঁজে বের করতে পারে তাদের কোন সংযোগে ত্রুটির কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে কিনা।

নিখোঁজ নিরাপত্তাকর্মীর লাশ উদ্ধার

মৃতের সংখ্যা ৮

মগবাজার বিস্ফোরণের ঘটনায় ৭৯ নম্বর বাড়ির নিখোঁজ ম্যানেজার হারুনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। ঘটনার দিন থেকে খোঁজ মিলছিল না ৭০ বছর বয়সী এ ব্যক্তির। গতকাল বিস্ফোরিত ভবনের ধ্বংসাবশেষ থেকে হারুনের লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের রেসকিউ টিম। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা ৮ জনে দাঁড়িয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, বিকেল ৩টা ৩৩ মিনিটে বিধ্বস্ত ভবনের ধ্বংসাবশেষ অপসারণের সময় হারুনের লাশ উদ্ধার করা হয়। দুর্ঘটনার পর থেকে ফায়ার সার্ভিসের তল্লাশি কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। তারই অংশ হিসেবে গতকাল তল্লাশি করতে গিয়ে এ নিরাপত্তাকর্মীর লাশ পাওয়া যায়। পরে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

হারুন অর রশিদ ভবনের নিচতলার একটি ছোট ঘরে থাকতেন। তার বয়স ৭০। গ্রামের বাড়ি বরিশাল। ‘ঘটনার দিন বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে মেয়ের সঙ্গে ফোনে শেষ কথা হয় হারুনের। এরপর তার মোবাইল বন্ধ ছিল। হারুন বাড়িটি দেখাশুনা করার পাশাপাশি ভাড়া তোলার দায়িত্বে ছিলেন। হারুন যে রুমটিতে থাকতেন তার সামনে বেঙ্গল মিট নামের ফ্রিজে সংরক্ষণ করে মাংস বিক্রির প্রতিষ্ঠান ছিল।

পুলিশ জানিয়েছে, এ নিয়ে ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। ঘটনার দিন নারী ও শিশুসহ ৬ জন মারা গেছেন। রাতে ঢাকা মেডিকেল থেকে অন্য হাসপাতালে নেওয়ার সময় সরমা হাউজের এক কর্মচারীর মৃত্যু হয়েছে। ওই কর্মচারীর মৃত্যুর হিসাব পুলিশ পরে জানতে পেরেছে। গতকাল একজনের মৃত্যু হওয়াসহ মোট ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে ৩ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের ৯০ ভাগ বার্ন হয়েছে।

অবহেলাজনিত কারণে পুলিশের মৃত্যু

বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রাণহানি এবং আহত হওয়ার ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে একটি মামলা হয়েছে।

রমনা বিভাগের উপকমিশনার সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ভবনটি অনেক পুরাতন, কাঠামোও দুর্বল। তাছাড়া প্রাথমিক তদন্তে এই দুর্ঘটনার পেছনে অনেক গাফিলতির বিষয়ও জড়িত বলে তাদের মনে হয়েছে। মামলায় কয়েকজনের মৃত্যুর ঘটনায় অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ আনা হয়েছে।

পুলিশের রমনা থানার ওসি বলেন, মামলায় কাউকে আসামি করা হয়নি। এ ঘটনায় তারা বাড়ির মালিক, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকসহ সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। ঘটনা নিয়ে তারা তদন্ত চালাচ্ছেন। গ্যাসের কারণে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে তার জন্য কার কার দায় রয়েছে সেগুলো তদন্ত চলছে। তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে পুলিশ।

গত রোববার সন্ধ্যায় ৭৯ আউটার সার্কুলার রোডের একটি ৩ তলা পুরোনো বাড়িতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। বিষ্ফোরণে বাড়িটি ধসে পড়ে। আশপাশের ৫শ’ গজের মধ্যে ১৮ ভবন ও মার্কেট ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ব্যাপক কম্পন তৈরি করে। রাস্তায় ৩টি যাত্রীবাহী বাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়।