থামছে না ঢাকা ছাড়ার ঢল

জাকির হোসেন ঢাকা-মাওয়া রুটের বাস চালাতেন। করোনা সংক্রমণে তিনি যতটা না শঙ্কিত। তার চাইতে অনেক বেশি চিন্তিত বিধিনিষেধ নিয়ে। গাড়ি বন্ধ, বিধিনিষেধের কারণে বাস চালাতে পারছেন না। এর মধ্যে আবার কঠোর লকডাউনের ঘোষণা। তাই পরিবার নিয়ে গ্রামে চলে যাচ্ছেন জাকির।

তিনি বলেন, ‘বৃহস্পতিবার থেকে কঠোর লকডাউন। জানি না, বাস কবে চালু হয়? তাই পরিবার নিয়ে গ্রামের বাড়ি কুমিল্লাতে চলে যাচ্ছি। ঢাকা থেকে কুমিল্লা বিশ^রোড পর্যন্ত জনপ্রতি ১০০০ টাকা মাইক্রোবাসের ভাড়া। গাড়ি বন্ধ থাকলে আমাদের সংসার চলে না। সরকারের পক্ষ থেকে কোন সাহায্যও পাই না।’ গতকাল রাজধানীর দোলাইপাড় এলাকায় মাইক্রোবাসে উঠার সময় এভাবে কথাগুলো বললেন গাড়িচালক জাকির হোসেন।

স্ত্রী ও ৩ সন্তান নিয়ে ৫ জনের সংসার তার। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী তিনি। ঢাকা-মাওয়া রুটে ইলিশ পরিবহনের বাস চালান। গত ২২ জুন থেকে ঢাকা-মাওয়া রুটের বাস বন্ধ। ঢাকার জুরাইন এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় পরিবার নিয়ে থাকেন। গত সাতদিনে বাসায় বসে কাটিয়েছেন। বাস মালিকের কাছ কিছু টাকা ধার নিয়ে পরিবার নিয়ে গ্রামে যাচ্ছেন বলে জানান তিনি।

কঠোর লকডাউন ঘোষণায় এভাবেই ঢাকা ছাড়ছেন স্বল্প আয়ের মানুষ। যারা গ্রামের যাচ্ছেন এদের বেশিরভাগই খেটে খাওয়া নি¤œআয়ের মানুষ। যারা দৈনন্দিন আয়-রোজগারের ওপর নির্ভরশীল। তারা বলছেন, লকডাউনে তাদের আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে। আয় বন্ধ হলে তারা খেতেও পারবেন না। এই আশঙ্কায় তারা ঢাকা ছাড়ছেন। সে কারণে বাধ্য হয়েই বাড়িতে যাচ্ছেন। গ্রামে গেলেও যে তারা ভালো থাকবেন তেমন নয়। যেহেতু লকডাউন ঘোষণা হয়েছে তাই ঈদে গাড়ি চালু হয় কিনা সন্দেহ তাদের।

রাজধানীর দয়াগঞ্জ এলাকায় ভ্যানে বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি করেন রিপন নামের এক হকার। লকডাউন ঘোষণা হওয়ায় তার বেচা-বিক্রি অনেক কমে গেছে। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘লকডাউনের কারণে কোন বেচা-বিক্রি নেই। আগে প্রতিদিন ৫০০-১০০০ টাকা বিক্রি হতো। এখন কোন বিক্রি নেই। একদিন ২০০ টাকা বিক্রি করতে পারি না। গত সপ্তাহে কিছু মালামাল এনেছিলাম। সেগুলোই রয়েছে। বুধবার গ্রামের বাড়ি মাদারীপুর যাব। গাড়ি বন্ধ তাই ভেঙে ভেঙে যেতে হবে।’

একই কথা বললেন সাইদুর নামের এক নির্মাণ শ্রমিক। গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুর যাবেন তিনি। মাওয়া ঘাটে যাওয়ার জন্য ৫০০ টাকা দিয়ে মোটরসাইকেল ভাড়া করেন। গতকাল যাত্রাবাড়ী এলাকায় তিনি সংবাদকে বলেন, ‘গাজীপুরে রাজমিস্ত্রির কাজ করি। লকডাউনের কারণে এক সপ্তাহ ধরে কোন কাজকর্ম নেই। তাই গ্রামে চলে যাচ্ছি। গাজীপুর থেকে ভেঙে ভেঙে এ পর্যন্ত এসেছি। প্রায় ১০০০ টাকা খরচ হয়েছে। লকডাউনের কারণে গরিব মানুষের বিপদ হয়।’

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ঢাকার আশপাশে ৭ জেলায় গত ২২ জুন থেকে বিধিনিষেধ ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে ঢাকার সঙ্গে দূরপাল্লার বাস, ট্রেন ও লঞ্চ সার্ভিস বন্ধ করে দেয়া হয়। গত সোমবার থেকে সীমিত লকডাউনে বন্ধ রয়েছে সারাদেশের গণপরিবহন। কিন্তু বন্ধ নেই মানুষের চলাচল। প্রতিদিনেই অসংখ্য মানুষ বিভিন্ন পথদিয়ে ঢাকার প্রবেশ করছেন এবং বের হয়ে যাচ্ছেন। যাত্রাপথে দুই-তিন গুণ বেশি ভাড়া ও হয়রনিসহ নানা দুর্ভোগ-ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে বলে যাত্রীরা জানান। এ সময় করোনার ভয়ে দুই-এক জন মুখে মাস্ক থাকলেও বেশিরভাগ যাত্রীদের স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা যায়নি বলে স্থানীয়রা জানান।

ফেরিঘাটে যাত্রীদের ভোগান্তি

প্রতিনিধি শিবচর (মাদারীপুর)

গতকাল সকাল থেকে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুটে দক্ষিণাঞ্চলমুখী যাত্রীদের চাপ কিছুটা কম থাকলেও বৃষ্টির কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে বলে যাত্রীরা জানান। কঠোর লকডাউন বাস্তবায়নে মহাসড়ক ও অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোতে বেরিকেড দিয়ে প্রশাসনের কঠোর তৎপরতার কারণে ফেরিতে যাত্রী ও যানবাহনের চাপ গত কয়েকদিনের চেয়ে গতকাল কম ছিল। ফেরিতে পণ্যবাহী ও জরুরি গাড়ি স্বভাবিকভাবেই পারাপার হতে দেখা গেছে।

তবে বৃষ্টির কারণে যাত্রীদের অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। অনেকেই বৃষ্টিতে ভিজেই ফেরি পার হতে দেখা গেছে। দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকায় গতকালও যাত্রীরা মোটরসাইকেল, থ্রি হুইলার, ইজিবাইকসহ বিভিন্ন ছোট যানবাহনে ৩-৪ গুণ ভাড়া দিয়ে গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে।

এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিসি বাংলাবাজার ঘাট ম্যানেজার মো. সালাউদ্দিন বলেন, ‘আমাদের সব ফেরি চালু রয়েছে। ফেরিতে জরুরি ও পণ্যবাহী গাড়ি পারাপার করা হচ্ছে। যাত্রীদের স্বাস্থ্যবিধি মানতে অনুরোধ করা হচ্ছে।’

বুধবার, ৩০ জুন ২০২১ , ১৬ আষাঢ় ১৪২৮ ১৮ জিলক্বদ ১৪৪২

থামছে না ঢাকা ছাড়ার ঢল

ইবরাহীম মাহমুদ আকাশ

জাকির হোসেন ঢাকা-মাওয়া রুটের বাস চালাতেন। করোনা সংক্রমণে তিনি যতটা না শঙ্কিত। তার চাইতে অনেক বেশি চিন্তিত বিধিনিষেধ নিয়ে। গাড়ি বন্ধ, বিধিনিষেধের কারণে বাস চালাতে পারছেন না। এর মধ্যে আবার কঠোর লকডাউনের ঘোষণা। তাই পরিবার নিয়ে গ্রামে চলে যাচ্ছেন জাকির।

তিনি বলেন, ‘বৃহস্পতিবার থেকে কঠোর লকডাউন। জানি না, বাস কবে চালু হয়? তাই পরিবার নিয়ে গ্রামের বাড়ি কুমিল্লাতে চলে যাচ্ছি। ঢাকা থেকে কুমিল্লা বিশ^রোড পর্যন্ত জনপ্রতি ১০০০ টাকা মাইক্রোবাসের ভাড়া। গাড়ি বন্ধ থাকলে আমাদের সংসার চলে না। সরকারের পক্ষ থেকে কোন সাহায্যও পাই না।’ গতকাল রাজধানীর দোলাইপাড় এলাকায় মাইক্রোবাসে উঠার সময় এভাবে কথাগুলো বললেন গাড়িচালক জাকির হোসেন।

স্ত্রী ও ৩ সন্তান নিয়ে ৫ জনের সংসার তার। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী তিনি। ঢাকা-মাওয়া রুটে ইলিশ পরিবহনের বাস চালান। গত ২২ জুন থেকে ঢাকা-মাওয়া রুটের বাস বন্ধ। ঢাকার জুরাইন এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় পরিবার নিয়ে থাকেন। গত সাতদিনে বাসায় বসে কাটিয়েছেন। বাস মালিকের কাছ কিছু টাকা ধার নিয়ে পরিবার নিয়ে গ্রামে যাচ্ছেন বলে জানান তিনি।

কঠোর লকডাউন ঘোষণায় এভাবেই ঢাকা ছাড়ছেন স্বল্প আয়ের মানুষ। যারা গ্রামের যাচ্ছেন এদের বেশিরভাগই খেটে খাওয়া নি¤œআয়ের মানুষ। যারা দৈনন্দিন আয়-রোজগারের ওপর নির্ভরশীল। তারা বলছেন, লকডাউনে তাদের আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে। আয় বন্ধ হলে তারা খেতেও পারবেন না। এই আশঙ্কায় তারা ঢাকা ছাড়ছেন। সে কারণে বাধ্য হয়েই বাড়িতে যাচ্ছেন। গ্রামে গেলেও যে তারা ভালো থাকবেন তেমন নয়। যেহেতু লকডাউন ঘোষণা হয়েছে তাই ঈদে গাড়ি চালু হয় কিনা সন্দেহ তাদের।

রাজধানীর দয়াগঞ্জ এলাকায় ভ্যানে বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি করেন রিপন নামের এক হকার। লকডাউন ঘোষণা হওয়ায় তার বেচা-বিক্রি অনেক কমে গেছে। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘লকডাউনের কারণে কোন বেচা-বিক্রি নেই। আগে প্রতিদিন ৫০০-১০০০ টাকা বিক্রি হতো। এখন কোন বিক্রি নেই। একদিন ২০০ টাকা বিক্রি করতে পারি না। গত সপ্তাহে কিছু মালামাল এনেছিলাম। সেগুলোই রয়েছে। বুধবার গ্রামের বাড়ি মাদারীপুর যাব। গাড়ি বন্ধ তাই ভেঙে ভেঙে যেতে হবে।’

একই কথা বললেন সাইদুর নামের এক নির্মাণ শ্রমিক। গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুর যাবেন তিনি। মাওয়া ঘাটে যাওয়ার জন্য ৫০০ টাকা দিয়ে মোটরসাইকেল ভাড়া করেন। গতকাল যাত্রাবাড়ী এলাকায় তিনি সংবাদকে বলেন, ‘গাজীপুরে রাজমিস্ত্রির কাজ করি। লকডাউনের কারণে এক সপ্তাহ ধরে কোন কাজকর্ম নেই। তাই গ্রামে চলে যাচ্ছি। গাজীপুর থেকে ভেঙে ভেঙে এ পর্যন্ত এসেছি। প্রায় ১০০০ টাকা খরচ হয়েছে। লকডাউনের কারণে গরিব মানুষের বিপদ হয়।’

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ঢাকার আশপাশে ৭ জেলায় গত ২২ জুন থেকে বিধিনিষেধ ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে ঢাকার সঙ্গে দূরপাল্লার বাস, ট্রেন ও লঞ্চ সার্ভিস বন্ধ করে দেয়া হয়। গত সোমবার থেকে সীমিত লকডাউনে বন্ধ রয়েছে সারাদেশের গণপরিবহন। কিন্তু বন্ধ নেই মানুষের চলাচল। প্রতিদিনেই অসংখ্য মানুষ বিভিন্ন পথদিয়ে ঢাকার প্রবেশ করছেন এবং বের হয়ে যাচ্ছেন। যাত্রাপথে দুই-তিন গুণ বেশি ভাড়া ও হয়রনিসহ নানা দুর্ভোগ-ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে বলে যাত্রীরা জানান। এ সময় করোনার ভয়ে দুই-এক জন মুখে মাস্ক থাকলেও বেশিরভাগ যাত্রীদের স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা যায়নি বলে স্থানীয়রা জানান।

ফেরিঘাটে যাত্রীদের ভোগান্তি

প্রতিনিধি শিবচর (মাদারীপুর)

গতকাল সকাল থেকে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুটে দক্ষিণাঞ্চলমুখী যাত্রীদের চাপ কিছুটা কম থাকলেও বৃষ্টির কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে বলে যাত্রীরা জানান। কঠোর লকডাউন বাস্তবায়নে মহাসড়ক ও অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোতে বেরিকেড দিয়ে প্রশাসনের কঠোর তৎপরতার কারণে ফেরিতে যাত্রী ও যানবাহনের চাপ গত কয়েকদিনের চেয়ে গতকাল কম ছিল। ফেরিতে পণ্যবাহী ও জরুরি গাড়ি স্বভাবিকভাবেই পারাপার হতে দেখা গেছে।

তবে বৃষ্টির কারণে যাত্রীদের অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। অনেকেই বৃষ্টিতে ভিজেই ফেরি পার হতে দেখা গেছে। দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকায় গতকালও যাত্রীরা মোটরসাইকেল, থ্রি হুইলার, ইজিবাইকসহ বিভিন্ন ছোট যানবাহনে ৩-৪ গুণ ভাড়া দিয়ে গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে।

এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিসি বাংলাবাজার ঘাট ম্যানেজার মো. সালাউদ্দিন বলেন, ‘আমাদের সব ফেরি চালু রয়েছে। ফেরিতে জরুরি ও পণ্যবাহী গাড়ি পারাপার করা হচ্ছে। যাত্রীদের স্বাস্থ্যবিধি মানতে অনুরোধ করা হচ্ছে।’