মনজুরুল হক
করোনাভাইরাসের ভয়াবহ দ্বিতীয় ঢেউয়ে পুরো দেশ যখন জেরবার তখন সরকার হঠাৎ করেই দেশে থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে। সরকারের ভাষ্য টাস্কফোর্সের সভায় বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মধ্যে প্যাডেলচালিত রিকশা-ভ্যানের মধ্যে ইঞ্জিন লাগিয়ে যারা চালাচ্ছে, সেটি বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘রিকশার সামনের চাকায় ব্রেক আছে। পেছনের চাকায় ব্রেক নেই। এগুলোতে ইঞ্জিন লাগিয়ে চালানোর কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সারা দেশে ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে আদেশ জারি হবে। পেছনের চাকায় কোন ব্রেক নেই কিংবা ব্রেকের ব্যবস্থা থাকলেও অপ্রতুল, সেগুলো যখন ব্রেক করে প্যাসেঞ্জারসহ গাড়ি উল্টে যায়। এ দৃশ্য আমরা দেখেছি। আমরা দেখেছি হাইওয়েতেও এ রিকশা চলে এসেছে। সে জন্য সারা দেশে, এ ধরনের ব্যাটারিচালিত রিকশাকে যারা ইঞ্জিন দিয়ে রূপান্তর করেছে, সেই সব রিকশা-ভ্যান বন্ধ করার সিদ্ধান্ত আজকের সভায় হয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন- ‘পেছনের চাকায় কোন ব্রেক নেই কিংবা ব্রেকের ব্যবস্থা থাকলেও অপ্রতুল, সেগুলো যখন ব্রেক করে প্যাসেঞ্জারসহ গাড়ি উল্টে যায়। এ দৃশ্য আমরা দেখেছি।’ তো খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে; আপনারা কী সড়কপথে দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে ২৫-৩০টি মানুষের মৃত্যু দেখেননি? শোনেননি? সড়কের বাস-ট্রাক এবং অন্যান্য মোটরযান তো সামনে-পেছনে ব্রেকসহই চলাচল করে। তাদের হাইড্রোলিক ব্রেক চাপলে তো জায়গায় থেমে যাওয়ার কথা। তারপরও দুর্ঘটনা কেন ঘটে? লঞ্চে কেন ঘটে? লঞ্চে তো ব্রেকই নেই! ট্রেনের তো মুখোমুখি ক্রস করতে হয় না। আলাদা লাইন। তারপরও কেন মুখোমুখি দুর্ঘটনা ঘটে? মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে কি কোন খতিয়ান আছে যে ব্যাটারিচালিত রিকশায় প্রতিদিন কতজন মারা যান? না, নেই। আমরা পত্র-পত্রিকা পড়ে জানি এসব রিকশা দুর্ঘটনায় যাত্রী আহত হন। কদাচিৎ সেই উল্টে যাওয়া রিকশাকে বাস-ট্রাক চাপা দিলে সেটা ভিন্ন ব্যাপার।
তাহলে কেন ব্যাটারিচালিত রিকশাকে ভিকটিম বানানো হচ্ছে? এর উত্তরও সাধারণ মানুষ জানে। কারণ রিকশাচালকরা সড়ক পরিবহন শ্রমিকদের মতো দেশ অচল করে দেয়ার হুমকি দিতে এবং বাস্তবায়ন করতে পারে না। তাদের এমপি, মন্ত্রী, নেতা নেই। তারা রাজপথ অবরোধ করে ‘দেশ অচল’ করে দিতে পারে না। সুতরাং নরম মাটিতে তো আঙুল ঢুকিয়ে মজা।
অথচ চরম বিস্ময়কর হলো- হাইকোর্ট তিন তিনবার রিট পিটিশনের রায়ে যানবাহনের হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধ করতে নির্দেশ জারি করেছিলেন। সরকারের পেষক ব্যক্তিদের সময়ও বেঁধে দিয়েছিলেন। আপনারা কি তা প্রতিপালন করেছিলেন? না। করেননি। এই শহরটা শব্দদূষনে এখন বিশ্বের অন্যতম। স্বাভাবিক মাত্রায় শহরাঞ্চলে ৫০ থেকে ৬০ ডেসিবেল পর্যন্ত শব্দই যেখানে চরম ক্ষতিকর, সেখানে ঢাকায় কোথাও কোথাও ১০০ থেকে ১১০ ডেসিবেল পর্যন্ত শব্দদূষণ ঘটে। আকসার ঘটছে। এই শহরের প্রায় অর্ধেক মানুষ শ্রুতিপ্রতিবন্ধী! আপনাদের মুরোদ হলো না সড়ক পরিবহনের কেশাগ্র স্পর্শ করার। তার বদলে কী করলেন? সচিবালয়ের আশপাশে হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ করলেন। যেন সচিবালয়ে অবস্থানকারীদেরই শুধু শব্দদূষণে শান্তি বিঘিœত হয়! শহরের বা দেশের আর কারও কানও নেই, শব্দদূষণে শ্রবণশক্তি নষ্ট হওয়ারও বিপদ নেই!
কখনও কখনও বলা হয় ব্যাটারিচালিত রিকশা অত্যাধিক বিদ্যুৎ খরচ করে ব্যাটারি চার্জ করে। তাই যদি সত্যি হয়, তাহলে তো সারা দেশ অন্ধকারে ডুবে যাওয়ার কথা! এবার দেখুন আপনাদের বিদ্যুতের পরিসংখ্যান- পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, দিনের শুরুতে বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা সর্বোচ্চ সাড়ে ৮ হাজার থেকে ৯ হাজার মেগাওয়াট। আর দিনের শেষ ভাগে (সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত, যা পিক আওয়ার নামে পরিচিত) বিদ্যুতের চাহিদা গিয়ে দাঁড়ায় সর্বোচ্চ ১১ হাজার থেকে সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াট। অথচ দেশে ১৮ হাজার ৯৬১ মেগাওয়াট ক্ষমতার স্থাপিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। তাই দিন-রাত মিলিয়ে ১৪-১৬ ঘণ্টা গড়ে ৮ হাজার থেকে ৯ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র অলস বসে থাকছে। শীতকালে এ চাহিদা নেমে ৬ হাজার মেগাওয়াটে চলে আসে।
তাহলে? এই অজুহাতও টিকছে না। বেশি দামে বেসরকারি বিদ্যুৎ কিনতে বাধ্য হয়েও আপনাদের কোন অনুশোচনা নেই। জ্বালানি, কেন্দ্রভাড়া (ক্যাপাসিটি পেমেন্ট) ও বিদ্যুতের মূল্য বাবদ বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে অর্থ দেয় সরকার। এর ফলে অলস বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকেও কেন্দ্রের ভাড়া দিতে হয়। ১০০ মেগাওয়াট একটি কেন্দ্রের ক্ষেত্রে বছরে গড়ে শুধু কেন্দ্র ভাড়াই দিতে হয় ৯০ কোটি টাকার বেশি। ফলে কোন বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদন না করে বসিয়ে রাখলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কেন্দ্র ভাড়া দিতে গিয়ে সরকারের লোকসান বাড়ে। তাতেও আপনাদের সমস্যা নেই। এই লোকসানের বোঝা তো জনগণই বইবে! আপনারা জনগণের ঘাড়ে পাড়া দিয়ে সেসব আদায় করেন।
অস্বীকার করা যাবে না, এ যানগুলোর ব্রেক ব্যবস্থা নিরাপদ নয়। সেটা তো নিরাপদ করা যায়। খুব সহজেই যায়। বুয়েটকে দিলেই তো তারা বিকল্প ব্রেকের ব্যবস্থা করে দিতে পারে। তারা দিয়েছিলও। আপনারা সেটার বাস্তবায়ন করেননি। এটাও স্বীকার করতে কুণ্ঠা নেই যে একটা আধুনিক শহরে রিকশা থাকতে নেই। রিকশা অনেক সমস্যা তৈরি করে। তার বিকল্পও তো সোজা ছিল। গণপরিবহন চালু করতে পারতেন। এটাকে গণপরিবহন বলে? বিশ্বের আর কোন দেশে শহরের মধ্যে এত টাকা ভাড়া দিয়ে এত নিকৃষ্ট বাস-মিনিবাসে মানুষ যাতায়াত করে না। আপনাদের শক্তিশালী অঙুলি তাদের দিকে ভুলেও উঠবে না। কারণ সেই ভয়! ওরা আপনাদের থোড়াই কেয়ার করে।
ব্যাটারিচালিত রিকশা মাত্রই দুর্ঘটনাপ্রবণ নয়। সমস্যা হলো তিন চাকার যানে যদি ব্রেকটা সামনে থাকে তাহলে নিয়ন্ত্রণ করাটা কঠিন। যদি ব্রেকটা পেছনে থাকে তাহলে যান অনেকটা নিয়ন্ত্রণে থাকবে। তাছাড়া সরকারের অনুমতি আছে রিকশাতে ৩০ অ্যাম্পিয়ার পর্যন্ত ব্যাটারি সক্ষমতা সংযুক্ত করা, এতে গতি কিছুটা ধীর হয়। কিন্তু রিকশা মালিকরা বেশি জমার আশায় সেখানে ৯০ থেকে ১২০ অ্যাম্পিয়ার পর্যন্ত ব্যাটারি সক্ষমতা সংযুক্ত করে। আর এতেই দুর্ঘটনাগুলো ঘটে। এটা ঠেকাতে পারেননি কেন? এই যে অতি লোভী রিকশামালিক, তাদের নিয়ন্ত্রণ করেননি কেন?
ইতোমধ্যে করোনা মহামারীতে নতুন করে প্রায় ২.৫ কোটি মানুষ বেকার হয়েছেন। বেসরকারি চাকরিজীবীরা অর্ধেক বা সিকি বেতন পান। এই ঢাকা শহর থেকে অন্তত ৫০ হাজার দরিদ্র পরিবার শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে। তার ওপর দেশের ৫০ শতাংশের ওপরে মানুষ যখন দারিদ্র্যসীমার নিচে (যদিও সেটা আপনারা বিশ্বাস করেন না), সেই সময় এমন অমানবিক সিদ্ধান্তে কর্মরত ৫০ লাখ ব্যাটারি রিকশা, ভ্যান, ইজিবাইক চালক যদি কর্মহীন হয়ে পড়েন তাহলে সারাদেশে এক ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে। আজকে যে হাবাগোবা রিকশাচালক রাজপথ অবরোধের কথা ভাবছে না, কালকেই তার পেটে টান পড়লে ভাবতে বাধ্য হবে। তারা যদি হাজার হাজার রিকশা দিয়ে ঢাকার রাজপথ অবরোধ করে দেয়, কয়টাকে মারবেন? গুলি চালাতে পারবেন, লাঠি দিয়ে হাড়গোড় ভাঙতে পারবেন। কিন্তু প্রশ্নটা যখন জীবন-মরণের তখন ওইসব লাঠি-গুলি-টিয়ার শেলে আটকাতে পারবেন না। তাই ‘ভাত দেবার মুরোদ নেই, কিল মারার গোসাই’ না হয়ে বাস্তবসম্মত চিন্তা করুন। সেইমত সিদ্ধান্ত নিন।
[ লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ]
বৃহস্পতিবার, ০১ জুলাই ২০২১ , ১৭ আষাঢ় ১৪২৮ ১৯ জিলক্বদ ১৪৪২
মনজুরুল হক
করোনাভাইরাসের ভয়াবহ দ্বিতীয় ঢেউয়ে পুরো দেশ যখন জেরবার তখন সরকার হঠাৎ করেই দেশে থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে। সরকারের ভাষ্য টাস্কফোর্সের সভায় বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মধ্যে প্যাডেলচালিত রিকশা-ভ্যানের মধ্যে ইঞ্জিন লাগিয়ে যারা চালাচ্ছে, সেটি বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘রিকশার সামনের চাকায় ব্রেক আছে। পেছনের চাকায় ব্রেক নেই। এগুলোতে ইঞ্জিন লাগিয়ে চালানোর কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সারা দেশে ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে আদেশ জারি হবে। পেছনের চাকায় কোন ব্রেক নেই কিংবা ব্রেকের ব্যবস্থা থাকলেও অপ্রতুল, সেগুলো যখন ব্রেক করে প্যাসেঞ্জারসহ গাড়ি উল্টে যায়। এ দৃশ্য আমরা দেখেছি। আমরা দেখেছি হাইওয়েতেও এ রিকশা চলে এসেছে। সে জন্য সারা দেশে, এ ধরনের ব্যাটারিচালিত রিকশাকে যারা ইঞ্জিন দিয়ে রূপান্তর করেছে, সেই সব রিকশা-ভ্যান বন্ধ করার সিদ্ধান্ত আজকের সভায় হয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন- ‘পেছনের চাকায় কোন ব্রেক নেই কিংবা ব্রেকের ব্যবস্থা থাকলেও অপ্রতুল, সেগুলো যখন ব্রেক করে প্যাসেঞ্জারসহ গাড়ি উল্টে যায়। এ দৃশ্য আমরা দেখেছি।’ তো খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে; আপনারা কী সড়কপথে দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে ২৫-৩০টি মানুষের মৃত্যু দেখেননি? শোনেননি? সড়কের বাস-ট্রাক এবং অন্যান্য মোটরযান তো সামনে-পেছনে ব্রেকসহই চলাচল করে। তাদের হাইড্রোলিক ব্রেক চাপলে তো জায়গায় থেমে যাওয়ার কথা। তারপরও দুর্ঘটনা কেন ঘটে? লঞ্চে কেন ঘটে? লঞ্চে তো ব্রেকই নেই! ট্রেনের তো মুখোমুখি ক্রস করতে হয় না। আলাদা লাইন। তারপরও কেন মুখোমুখি দুর্ঘটনা ঘটে? মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে কি কোন খতিয়ান আছে যে ব্যাটারিচালিত রিকশায় প্রতিদিন কতজন মারা যান? না, নেই। আমরা পত্র-পত্রিকা পড়ে জানি এসব রিকশা দুর্ঘটনায় যাত্রী আহত হন। কদাচিৎ সেই উল্টে যাওয়া রিকশাকে বাস-ট্রাক চাপা দিলে সেটা ভিন্ন ব্যাপার।
তাহলে কেন ব্যাটারিচালিত রিকশাকে ভিকটিম বানানো হচ্ছে? এর উত্তরও সাধারণ মানুষ জানে। কারণ রিকশাচালকরা সড়ক পরিবহন শ্রমিকদের মতো দেশ অচল করে দেয়ার হুমকি দিতে এবং বাস্তবায়ন করতে পারে না। তাদের এমপি, মন্ত্রী, নেতা নেই। তারা রাজপথ অবরোধ করে ‘দেশ অচল’ করে দিতে পারে না। সুতরাং নরম মাটিতে তো আঙুল ঢুকিয়ে মজা।
অথচ চরম বিস্ময়কর হলো- হাইকোর্ট তিন তিনবার রিট পিটিশনের রায়ে যানবাহনের হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধ করতে নির্দেশ জারি করেছিলেন। সরকারের পেষক ব্যক্তিদের সময়ও বেঁধে দিয়েছিলেন। আপনারা কি তা প্রতিপালন করেছিলেন? না। করেননি। এই শহরটা শব্দদূষনে এখন বিশ্বের অন্যতম। স্বাভাবিক মাত্রায় শহরাঞ্চলে ৫০ থেকে ৬০ ডেসিবেল পর্যন্ত শব্দই যেখানে চরম ক্ষতিকর, সেখানে ঢাকায় কোথাও কোথাও ১০০ থেকে ১১০ ডেসিবেল পর্যন্ত শব্দদূষণ ঘটে। আকসার ঘটছে। এই শহরের প্রায় অর্ধেক মানুষ শ্রুতিপ্রতিবন্ধী! আপনাদের মুরোদ হলো না সড়ক পরিবহনের কেশাগ্র স্পর্শ করার। তার বদলে কী করলেন? সচিবালয়ের আশপাশে হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ করলেন। যেন সচিবালয়ে অবস্থানকারীদেরই শুধু শব্দদূষণে শান্তি বিঘিœত হয়! শহরের বা দেশের আর কারও কানও নেই, শব্দদূষণে শ্রবণশক্তি নষ্ট হওয়ারও বিপদ নেই!
কখনও কখনও বলা হয় ব্যাটারিচালিত রিকশা অত্যাধিক বিদ্যুৎ খরচ করে ব্যাটারি চার্জ করে। তাই যদি সত্যি হয়, তাহলে তো সারা দেশ অন্ধকারে ডুবে যাওয়ার কথা! এবার দেখুন আপনাদের বিদ্যুতের পরিসংখ্যান- পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, দিনের শুরুতে বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা সর্বোচ্চ সাড়ে ৮ হাজার থেকে ৯ হাজার মেগাওয়াট। আর দিনের শেষ ভাগে (সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত, যা পিক আওয়ার নামে পরিচিত) বিদ্যুতের চাহিদা গিয়ে দাঁড়ায় সর্বোচ্চ ১১ হাজার থেকে সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াট। অথচ দেশে ১৮ হাজার ৯৬১ মেগাওয়াট ক্ষমতার স্থাপিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। তাই দিন-রাত মিলিয়ে ১৪-১৬ ঘণ্টা গড়ে ৮ হাজার থেকে ৯ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র অলস বসে থাকছে। শীতকালে এ চাহিদা নেমে ৬ হাজার মেগাওয়াটে চলে আসে।
তাহলে? এই অজুহাতও টিকছে না। বেশি দামে বেসরকারি বিদ্যুৎ কিনতে বাধ্য হয়েও আপনাদের কোন অনুশোচনা নেই। জ্বালানি, কেন্দ্রভাড়া (ক্যাপাসিটি পেমেন্ট) ও বিদ্যুতের মূল্য বাবদ বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে অর্থ দেয় সরকার। এর ফলে অলস বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকেও কেন্দ্রের ভাড়া দিতে হয়। ১০০ মেগাওয়াট একটি কেন্দ্রের ক্ষেত্রে বছরে গড়ে শুধু কেন্দ্র ভাড়াই দিতে হয় ৯০ কোটি টাকার বেশি। ফলে কোন বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদন না করে বসিয়ে রাখলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কেন্দ্র ভাড়া দিতে গিয়ে সরকারের লোকসান বাড়ে। তাতেও আপনাদের সমস্যা নেই। এই লোকসানের বোঝা তো জনগণই বইবে! আপনারা জনগণের ঘাড়ে পাড়া দিয়ে সেসব আদায় করেন।
অস্বীকার করা যাবে না, এ যানগুলোর ব্রেক ব্যবস্থা নিরাপদ নয়। সেটা তো নিরাপদ করা যায়। খুব সহজেই যায়। বুয়েটকে দিলেই তো তারা বিকল্প ব্রেকের ব্যবস্থা করে দিতে পারে। তারা দিয়েছিলও। আপনারা সেটার বাস্তবায়ন করেননি। এটাও স্বীকার করতে কুণ্ঠা নেই যে একটা আধুনিক শহরে রিকশা থাকতে নেই। রিকশা অনেক সমস্যা তৈরি করে। তার বিকল্পও তো সোজা ছিল। গণপরিবহন চালু করতে পারতেন। এটাকে গণপরিবহন বলে? বিশ্বের আর কোন দেশে শহরের মধ্যে এত টাকা ভাড়া দিয়ে এত নিকৃষ্ট বাস-মিনিবাসে মানুষ যাতায়াত করে না। আপনাদের শক্তিশালী অঙুলি তাদের দিকে ভুলেও উঠবে না। কারণ সেই ভয়! ওরা আপনাদের থোড়াই কেয়ার করে।
ব্যাটারিচালিত রিকশা মাত্রই দুর্ঘটনাপ্রবণ নয়। সমস্যা হলো তিন চাকার যানে যদি ব্রেকটা সামনে থাকে তাহলে নিয়ন্ত্রণ করাটা কঠিন। যদি ব্রেকটা পেছনে থাকে তাহলে যান অনেকটা নিয়ন্ত্রণে থাকবে। তাছাড়া সরকারের অনুমতি আছে রিকশাতে ৩০ অ্যাম্পিয়ার পর্যন্ত ব্যাটারি সক্ষমতা সংযুক্ত করা, এতে গতি কিছুটা ধীর হয়। কিন্তু রিকশা মালিকরা বেশি জমার আশায় সেখানে ৯০ থেকে ১২০ অ্যাম্পিয়ার পর্যন্ত ব্যাটারি সক্ষমতা সংযুক্ত করে। আর এতেই দুর্ঘটনাগুলো ঘটে। এটা ঠেকাতে পারেননি কেন? এই যে অতি লোভী রিকশামালিক, তাদের নিয়ন্ত্রণ করেননি কেন?
ইতোমধ্যে করোনা মহামারীতে নতুন করে প্রায় ২.৫ কোটি মানুষ বেকার হয়েছেন। বেসরকারি চাকরিজীবীরা অর্ধেক বা সিকি বেতন পান। এই ঢাকা শহর থেকে অন্তত ৫০ হাজার দরিদ্র পরিবার শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে। তার ওপর দেশের ৫০ শতাংশের ওপরে মানুষ যখন দারিদ্র্যসীমার নিচে (যদিও সেটা আপনারা বিশ্বাস করেন না), সেই সময় এমন অমানবিক সিদ্ধান্তে কর্মরত ৫০ লাখ ব্যাটারি রিকশা, ভ্যান, ইজিবাইক চালক যদি কর্মহীন হয়ে পড়েন তাহলে সারাদেশে এক ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে। আজকে যে হাবাগোবা রিকশাচালক রাজপথ অবরোধের কথা ভাবছে না, কালকেই তার পেটে টান পড়লে ভাবতে বাধ্য হবে। তারা যদি হাজার হাজার রিকশা দিয়ে ঢাকার রাজপথ অবরোধ করে দেয়, কয়টাকে মারবেন? গুলি চালাতে পারবেন, লাঠি দিয়ে হাড়গোড় ভাঙতে পারবেন। কিন্তু প্রশ্নটা যখন জীবন-মরণের তখন ওইসব লাঠি-গুলি-টিয়ার শেলে আটকাতে পারবেন না। তাই ‘ভাত দেবার মুরোদ নেই, কিল মারার গোসাই’ না হয়ে বাস্তবসম্মত চিন্তা করুন। সেইমত সিদ্ধান্ত নিন।
[ লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ]