ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : প্রতিষ্ঠাকালীন বিরোধিতা

আবু মুহাম্মাদ মুকাম্মেল

ভূমিকা : ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ ঘোষণার পর শিক্ষান্নোয়ন নিয়ে পূর্ববঙ্গের মুসলিম নেতৃবৃন্দ পৃথকভাবে ভাবা শুরু করলেও ১৯১২ সালের জানুয়ারি মাসে লর্ড হার্ডিঞ্জ কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত তারা মূলত আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন কার্যক্রমে জড়িত থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণার পর দ্রুত দৃশ্যপট পরিবর্তিত হয়। পূর্ববঙ্গের মুসলিম নেতৃবৃন্দ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্কিম বাস্তবায়নে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অপরদিকে প্রধানত কলকাতাকেন্দ্রিক উচ্চবর্গীয় হিন্দু সমাজ বিরোধিতা শুরু করেন।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা : বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষিত হওয়ার পর স্যার সলিমুল্লাহ লর্ড হার্ডিঞ্জকে চিঠি দিয়ে তার হতাশার কথা জানান। চিঠি পাওয়ার পর লর্ড হার্ডিঞ্জ তার দাপ্তরিক কাগজপত্রে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আগ্রহ প্রকাশ করলে কাউন্সিলের শিক্ষা সদস্য স্টুয়ার্ট বাটলার ও ভারত সচিবের পূর্ণ সমর্থন পান। তিনি মুসলিমদের কথা শোনার জন্য তিন দিনের সফরে ১৯১২ সালের ২৯ জানুয়ারি ঢাকায় আসলে ৩১ জানুয়ারি সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের মুসলিম দল তাকে মানপত্র প্রদান করেন। মানপত্রে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় যে, বঙ্গভঙ্গের কারণে পূর্ববঙ্গে শিক্ষা ক্ষেত্রে যে উন্নয়ন হচ্ছিল তা রদের ফলে এর ধারাবাহিকতা বিঘিœত হবে। লর্ড হার্ডিঞ্জ দাবির যৌক্তিকতা স্বীকার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশের ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন।

বিরোধিতা : কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীসহ উভয়বঙ্গের হিন্দু নেতৃবৃন্দ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত বানচালের চেষ্টা চালান। ফেব্রুয়ারি ও মার্চজুড়ে বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ‘ঢাকা উকিল সমিতি’র ৫ ও ১০ ফেব্রুয়ারির দুটি সভার প্রস্তাবে বলা হয় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে শিক্ষার অবনতি হবে। তাই প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন আবশ্যকতা নেই।’ ১১ ফেব্রুয়ারি কলকাতার বিডন স্কোয়ারে প্রতিবাদ সভায় সুরেন্দ্রনাথ সমাজপতি জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে বাংলা সাহিত্য বিভক্ত হবে, আর সাহিত্য এক না হলে একতার আশা করা যায় না। এতে বাঙালি জাতি বিভক্ত হয়ে পড়বে।’

মোহাম্মদী পত্রিকার সম্পাদক মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে গরিব মুসলমানরা আর কলেজে পড়তে পারবে না। অধিকাংশ মুসলমান ছাত্র পরের বাড়িতে খেয়েই পড়ে। ছাত্রদের যদি কলেজে বাস করতে হয় তবে অধিকাংশ মুসলমান ছাত্র অর্থাভাবে কলেজে বাস করতে পারবে না।’ মৌলভী আবুল কাসেম বলেন, ‘যদিও মুসলিম লীগ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সমর্থন করেছে, তবু মুসলমানগণ এর ঘোরবিরোধী।’

মুহাম্মদ আবদুস সালাম তার এক প্রবন্ধে জানিয়েছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ১৯১২ সালের ২৮ মার্চ কলকাতার গড়ের মাঠে যে সভা অনুষ্ঠিত হয় তাতে সভাপতিত্ব করেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’ তবে লেখক রাশেদ রাহম এক পর্যালোচনা নিবন্ধে জানাচ্ছেন- ‘রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছেন, এখনও পর্যন্ত কোন গবেষণায় তা প্রমাণিত হয়নি। ’

১৯১২ সালের ১৬ ফেরুয়ারি স্যার রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধিদল লর্ড হার্ডিঞ্জের সঙ্গে দেখা করে বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হবে ‘অভ্যন্তরীণ বঙ্গ-বিভাগ’-এর সমার্থক। তাছাড়া পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা প্রধানত কৃষক, তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তারা কোন মতেই উপকৃত হবে না।’’ স্যার আশুতোষ লর্ড হার্ডিঞ্জের দৃঢতা দেখে তিনি বিরোধিতা থেকে সরে এসে সরকারের চারটি পূর্ণ অধ্যাপক পদ আদায় করে নেন, যাকে তখন বলা হতো ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি প্যাক্ট’। স্যার আশুতোষ এর ভূমিকা বিষয়ে জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘ভাস্ট মেজরিটি অব দি মিডল ক্লাস হিন্দুস অপোসড দি রিজোল্যুশন। দে অপোসড ইট টুথ অ্যান্ড নেইল, স্যার আশুতোষ ইনক্লুডেড।

স্যার আশুতোষের আপত্তির কারণ, দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হলে তার জমিদারি খাটো হয়ে যাবে।’ স্যার আশুতোষ ১৯১৭ সালের ১৫ নভেম্বর কমিশনের কাছে গোপন প্রতিবেদনে বলেন ‘... ঢাকার জন্য আমরা যাই করি না কেন, বাংলায় কলকাতার স্থান সর্বাগ্রে এবং ভবিষ্যতেও তা থাকবে।’

১৯১২ সালের ৩-৪ মার্চ কলকাতায় অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের ৫ম অধিবেশনে সলিমুল্লাহ বলেন যে, একজন সম্মানিত বাঙালি নেতা এই বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘ঝগড়ার ফল’ বলেছেন। তারা এমনভাবে স্কিমের বিরোধিতা করছেন, যা দুটি সম্প্রদায়কে নিশ্চিতভাবে মুখোমুখি দাঁড় করাবে। পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরুদ্ধে ছিল। মওলানা মুহাম্মদ আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপক্ষে প্রবন্ধ লিখেছিলেন। মওলানা আকরাম খাঁ বলেছিলেন যে, মুসলিমদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় অপেক্ষা স্কুল বেশি প্রয়োজন। নিরবিচ্ছিন্ন প্রতিবাদের মধ্যে কংগ্রেসের প্রভাবশালী সদস্য গোপাল কৃষ্ণ গোখলে সুপারিশ করেন, কলেজগুলোকে অধিভুক্ত করতে একটি আবাসিক ও বিদ্যায়তনিক বিশ্ববিদ্যালয় পরবর্তীতে বাংলার বাধাগুলো দূর করতে পারে।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. হিরালাল হালদার বলেন, ঢাকায় একটি শিক্ষা-কাম-অধিভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে তা স্বস্তি দেবে। বাংলার মতো প্রদেশের প্রয়োজনে একটি একক বিশ্ববিদ্যালয় এখন পর্যাপ্ত নয়।’ ১৯১৯ সালে বাংলা সরকারের শিক্ষামন্ত্রী হয়ে পশ্চিমবঙ্গের প্রভাষচন্দ্র মিত্র শিক্ষকদের প্রস্তাবিত বেতন কমিয়ে দেন। ১৯২০ সালের ২৩ মার্চ ভাইসরয়ের ব্যবস্থাপক পরিষদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ্যাক্ট পাস হয়। এখানেও হিন্দু সদস্যগণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করেন। এ প্রসঙ্গে খান সাহেব মুহাম্মদ আযম বলেন, ‘ভাইসরয় কাউন্সিলের বেশ কয়েকজন হিন্দু সদস্য মুসলিমদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করেছেন এবং বিলটি পাসের সময় তাদের প্রতি নির্দয়তা দেখিয়েছিলেন তা দেখে আমরা দুঃখিত। আমরা তাদের কাছ থেকে এ জাতীয় আচরণ আশা করিনি।’ ১৯৭৪ সালে কলকাতায় ‘আমাদের সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে স্মরণিকা বের হয়। সেখানে রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেন- ‘এই সমুদয় গোলমালের মূল কারণ হিন্দুরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধী এবং শিক্ষামন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গের লোক হওয়ায় তার প্রতি সহানুভূতির যথেষ্ট অভাব ছিল।’

বিরোধিতার কারণ : কলকাতায় বঙ্গভঙ্গবিরোধী নেতারা দুটি কারণে ঢাকায় দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধী ছিলেন, প্রথমত পূর্ববাংলার ওঠতি প্রজন্মের ওপর তারা যে রাজনৈতিক প্রভাব ফেলতো তা হারাবার ভয়। দ্বিতীয়ত পূর্ব বাংলার যুবকরা কলকাতার কলেজগুলো থেকে ঢাকার দিকে দৃষ্টি সরাচ্ছে যা বিশেষ ক্ষতির কারণ হবে। এর ফলস্বরূপ পরেরটা বিরোধীদের সহ্য করতে হবে।’ কলকাতার রিপন কলেজে পূর্ববঙ্গ ও আসামের অধিকাংশ ছাত্র ভর্তি হতো।

‘দি বাঙালি’ পত্রিকার সম্পাদক সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির আয়ের উৎস ছিল এই রিপন কলেজ। ভুপেন্দ্রনাথ বসু কলকাতায় আবাসন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পূর্ববঙ্গের প্রচুর ছাত্র তার মালিকানাধীন বর্ডিং হাউসগুলোতে বাস করত। এখান থেকে তিনি ভাড়া বাবদ প্রচুর আয় করতেন। এ প্রসঙ্গে পূর্ববঙ্গ ও আসামের লেফটিন্যান্ট গভর্নর স্টুয়ার্ট বেইলির মূল্যায়ন হচ্ছে- এদের মধ্যে কেউ কেউ বাঙালি নেতৃত্বাধীন নিছক অসন্তুষ্ট বিরোধিতাকারী।

কিন্তু অন্যরা ভালো স্বভাবের এবং বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। তাদের বিরোধিতা মূলত ভুল ধারণা থেকে প্রসূত। আর তা হচ্ছে ঢাকায় কলকাতার আদলে পরীক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। দীনেশচন্দ্র সিংহ দেশ পত্রিকায় লিখছেন- ‘... বাংলার মুসলমানদের জন্য যখন একটা আলাদা প্রদেশ গড়া হলো সে প্রদেশের জন্য কি একটা নতুন বিশ্ববিদ্যালয় গড়া হবে না? এই সম্ভাবনায় স্বভাবতই বাংলার সমাজ বিচলিত হয়ে ওঠে। কারণ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে হাইস্কুলগুলোর দুই-তৃতীয়াংশই ছিল পূর্ববঙ্গে। ... শিক্ষার উন্নতি সাধনে যেখানে হিন্দুদের অবদান ৯০ শতাংশের ওপর, সেখানে সংখ্যাগুরু মুসলমানদের অবদান ১০ শতাংশের কম। তাই নতুন প্রদেশ পূর্ববঙ্গ ও আসামের এলাকাধীন স্কুল ও কলেজগুলোকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পূর্ববঙ্গে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় গড়া হলে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিব্যি ভাতে মারা যেতে হবে। হিন্দুদের বিরোধিতা সেই কারণে।’

শেষ কথা : নানা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষ পূরণ করল। ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস অব্যাহত সংগ্রামের ইতিহাস। লড়তে হয়েছে তাকে দুই ফ্রন্টে-একটি জ্ঞানের, অন্যটি সামাজিকতার।’ জন্মের প্রাক্কালে বিরোধিতার মূলে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় উপাদান যাই থাকুক না কেন শুরু থেকে চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ‘জ্ঞান বিতরণ’ ও ‘সামাজিকতা’য় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে পরিপূর্ণতা পায়, প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাতি অর্জন করে তা প্রধানত এক ঝাঁক নিবেদিতপ্রাণ হিন্দু পণ্ডিতসহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর উদার প্রাণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল।

[লেখক : সিনিয়র সহকারী রেজিস্ট্রার,

গণ বিশ্ববিদ্যালয়]

বৃহস্পতিবার, ০১ জুলাই ২০২১ , ১৭ আষাঢ় ১৪২৮ ১৯ জিলক্বদ ১৪৪২

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : প্রতিষ্ঠাকালীন বিরোধিতা

আবু মুহাম্মাদ মুকাম্মেল

image

ভূমিকা : ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ ঘোষণার পর শিক্ষান্নোয়ন নিয়ে পূর্ববঙ্গের মুসলিম নেতৃবৃন্দ পৃথকভাবে ভাবা শুরু করলেও ১৯১২ সালের জানুয়ারি মাসে লর্ড হার্ডিঞ্জ কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত তারা মূলত আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন কার্যক্রমে জড়িত থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণার পর দ্রুত দৃশ্যপট পরিবর্তিত হয়। পূর্ববঙ্গের মুসলিম নেতৃবৃন্দ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্কিম বাস্তবায়নে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অপরদিকে প্রধানত কলকাতাকেন্দ্রিক উচ্চবর্গীয় হিন্দু সমাজ বিরোধিতা শুরু করেন।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা : বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষিত হওয়ার পর স্যার সলিমুল্লাহ লর্ড হার্ডিঞ্জকে চিঠি দিয়ে তার হতাশার কথা জানান। চিঠি পাওয়ার পর লর্ড হার্ডিঞ্জ তার দাপ্তরিক কাগজপত্রে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আগ্রহ প্রকাশ করলে কাউন্সিলের শিক্ষা সদস্য স্টুয়ার্ট বাটলার ও ভারত সচিবের পূর্ণ সমর্থন পান। তিনি মুসলিমদের কথা শোনার জন্য তিন দিনের সফরে ১৯১২ সালের ২৯ জানুয়ারি ঢাকায় আসলে ৩১ জানুয়ারি সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের মুসলিম দল তাকে মানপত্র প্রদান করেন। মানপত্রে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় যে, বঙ্গভঙ্গের কারণে পূর্ববঙ্গে শিক্ষা ক্ষেত্রে যে উন্নয়ন হচ্ছিল তা রদের ফলে এর ধারাবাহিকতা বিঘিœত হবে। লর্ড হার্ডিঞ্জ দাবির যৌক্তিকতা স্বীকার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশের ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন।

বিরোধিতা : কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীসহ উভয়বঙ্গের হিন্দু নেতৃবৃন্দ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত বানচালের চেষ্টা চালান। ফেব্রুয়ারি ও মার্চজুড়ে বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ‘ঢাকা উকিল সমিতি’র ৫ ও ১০ ফেব্রুয়ারির দুটি সভার প্রস্তাবে বলা হয় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে শিক্ষার অবনতি হবে। তাই প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন আবশ্যকতা নেই।’ ১১ ফেব্রুয়ারি কলকাতার বিডন স্কোয়ারে প্রতিবাদ সভায় সুরেন্দ্রনাথ সমাজপতি জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে বাংলা সাহিত্য বিভক্ত হবে, আর সাহিত্য এক না হলে একতার আশা করা যায় না। এতে বাঙালি জাতি বিভক্ত হয়ে পড়বে।’

মোহাম্মদী পত্রিকার সম্পাদক মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে গরিব মুসলমানরা আর কলেজে পড়তে পারবে না। অধিকাংশ মুসলমান ছাত্র পরের বাড়িতে খেয়েই পড়ে। ছাত্রদের যদি কলেজে বাস করতে হয় তবে অধিকাংশ মুসলমান ছাত্র অর্থাভাবে কলেজে বাস করতে পারবে না।’ মৌলভী আবুল কাসেম বলেন, ‘যদিও মুসলিম লীগ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সমর্থন করেছে, তবু মুসলমানগণ এর ঘোরবিরোধী।’

মুহাম্মদ আবদুস সালাম তার এক প্রবন্ধে জানিয়েছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ১৯১২ সালের ২৮ মার্চ কলকাতার গড়ের মাঠে যে সভা অনুষ্ঠিত হয় তাতে সভাপতিত্ব করেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’ তবে লেখক রাশেদ রাহম এক পর্যালোচনা নিবন্ধে জানাচ্ছেন- ‘রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছেন, এখনও পর্যন্ত কোন গবেষণায় তা প্রমাণিত হয়নি। ’

১৯১২ সালের ১৬ ফেরুয়ারি স্যার রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধিদল লর্ড হার্ডিঞ্জের সঙ্গে দেখা করে বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হবে ‘অভ্যন্তরীণ বঙ্গ-বিভাগ’-এর সমার্থক। তাছাড়া পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা প্রধানত কৃষক, তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তারা কোন মতেই উপকৃত হবে না।’’ স্যার আশুতোষ লর্ড হার্ডিঞ্জের দৃঢতা দেখে তিনি বিরোধিতা থেকে সরে এসে সরকারের চারটি পূর্ণ অধ্যাপক পদ আদায় করে নেন, যাকে তখন বলা হতো ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি প্যাক্ট’। স্যার আশুতোষ এর ভূমিকা বিষয়ে জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘ভাস্ট মেজরিটি অব দি মিডল ক্লাস হিন্দুস অপোসড দি রিজোল্যুশন। দে অপোসড ইট টুথ অ্যান্ড নেইল, স্যার আশুতোষ ইনক্লুডেড।

স্যার আশুতোষের আপত্তির কারণ, দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হলে তার জমিদারি খাটো হয়ে যাবে।’ স্যার আশুতোষ ১৯১৭ সালের ১৫ নভেম্বর কমিশনের কাছে গোপন প্রতিবেদনে বলেন ‘... ঢাকার জন্য আমরা যাই করি না কেন, বাংলায় কলকাতার স্থান সর্বাগ্রে এবং ভবিষ্যতেও তা থাকবে।’

১৯১২ সালের ৩-৪ মার্চ কলকাতায় অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের ৫ম অধিবেশনে সলিমুল্লাহ বলেন যে, একজন সম্মানিত বাঙালি নেতা এই বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘ঝগড়ার ফল’ বলেছেন। তারা এমনভাবে স্কিমের বিরোধিতা করছেন, যা দুটি সম্প্রদায়কে নিশ্চিতভাবে মুখোমুখি দাঁড় করাবে। পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরুদ্ধে ছিল। মওলানা মুহাম্মদ আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপক্ষে প্রবন্ধ লিখেছিলেন। মওলানা আকরাম খাঁ বলেছিলেন যে, মুসলিমদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় অপেক্ষা স্কুল বেশি প্রয়োজন। নিরবিচ্ছিন্ন প্রতিবাদের মধ্যে কংগ্রেসের প্রভাবশালী সদস্য গোপাল কৃষ্ণ গোখলে সুপারিশ করেন, কলেজগুলোকে অধিভুক্ত করতে একটি আবাসিক ও বিদ্যায়তনিক বিশ্ববিদ্যালয় পরবর্তীতে বাংলার বাধাগুলো দূর করতে পারে।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. হিরালাল হালদার বলেন, ঢাকায় একটি শিক্ষা-কাম-অধিভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে তা স্বস্তি দেবে। বাংলার মতো প্রদেশের প্রয়োজনে একটি একক বিশ্ববিদ্যালয় এখন পর্যাপ্ত নয়।’ ১৯১৯ সালে বাংলা সরকারের শিক্ষামন্ত্রী হয়ে পশ্চিমবঙ্গের প্রভাষচন্দ্র মিত্র শিক্ষকদের প্রস্তাবিত বেতন কমিয়ে দেন। ১৯২০ সালের ২৩ মার্চ ভাইসরয়ের ব্যবস্থাপক পরিষদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ্যাক্ট পাস হয়। এখানেও হিন্দু সদস্যগণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করেন। এ প্রসঙ্গে খান সাহেব মুহাম্মদ আযম বলেন, ‘ভাইসরয় কাউন্সিলের বেশ কয়েকজন হিন্দু সদস্য মুসলিমদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করেছেন এবং বিলটি পাসের সময় তাদের প্রতি নির্দয়তা দেখিয়েছিলেন তা দেখে আমরা দুঃখিত। আমরা তাদের কাছ থেকে এ জাতীয় আচরণ আশা করিনি।’ ১৯৭৪ সালে কলকাতায় ‘আমাদের সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে স্মরণিকা বের হয়। সেখানে রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেন- ‘এই সমুদয় গোলমালের মূল কারণ হিন্দুরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধী এবং শিক্ষামন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গের লোক হওয়ায় তার প্রতি সহানুভূতির যথেষ্ট অভাব ছিল।’

বিরোধিতার কারণ : কলকাতায় বঙ্গভঙ্গবিরোধী নেতারা দুটি কারণে ঢাকায় দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধী ছিলেন, প্রথমত পূর্ববাংলার ওঠতি প্রজন্মের ওপর তারা যে রাজনৈতিক প্রভাব ফেলতো তা হারাবার ভয়। দ্বিতীয়ত পূর্ব বাংলার যুবকরা কলকাতার কলেজগুলো থেকে ঢাকার দিকে দৃষ্টি সরাচ্ছে যা বিশেষ ক্ষতির কারণ হবে। এর ফলস্বরূপ পরেরটা বিরোধীদের সহ্য করতে হবে।’ কলকাতার রিপন কলেজে পূর্ববঙ্গ ও আসামের অধিকাংশ ছাত্র ভর্তি হতো।

‘দি বাঙালি’ পত্রিকার সম্পাদক সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির আয়ের উৎস ছিল এই রিপন কলেজ। ভুপেন্দ্রনাথ বসু কলকাতায় আবাসন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পূর্ববঙ্গের প্রচুর ছাত্র তার মালিকানাধীন বর্ডিং হাউসগুলোতে বাস করত। এখান থেকে তিনি ভাড়া বাবদ প্রচুর আয় করতেন। এ প্রসঙ্গে পূর্ববঙ্গ ও আসামের লেফটিন্যান্ট গভর্নর স্টুয়ার্ট বেইলির মূল্যায়ন হচ্ছে- এদের মধ্যে কেউ কেউ বাঙালি নেতৃত্বাধীন নিছক অসন্তুষ্ট বিরোধিতাকারী।

কিন্তু অন্যরা ভালো স্বভাবের এবং বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। তাদের বিরোধিতা মূলত ভুল ধারণা থেকে প্রসূত। আর তা হচ্ছে ঢাকায় কলকাতার আদলে পরীক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। দীনেশচন্দ্র সিংহ দেশ পত্রিকায় লিখছেন- ‘... বাংলার মুসলমানদের জন্য যখন একটা আলাদা প্রদেশ গড়া হলো সে প্রদেশের জন্য কি একটা নতুন বিশ্ববিদ্যালয় গড়া হবে না? এই সম্ভাবনায় স্বভাবতই বাংলার সমাজ বিচলিত হয়ে ওঠে। কারণ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে হাইস্কুলগুলোর দুই-তৃতীয়াংশই ছিল পূর্ববঙ্গে। ... শিক্ষার উন্নতি সাধনে যেখানে হিন্দুদের অবদান ৯০ শতাংশের ওপর, সেখানে সংখ্যাগুরু মুসলমানদের অবদান ১০ শতাংশের কম। তাই নতুন প্রদেশ পূর্ববঙ্গ ও আসামের এলাকাধীন স্কুল ও কলেজগুলোকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পূর্ববঙ্গে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় গড়া হলে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিব্যি ভাতে মারা যেতে হবে। হিন্দুদের বিরোধিতা সেই কারণে।’

শেষ কথা : নানা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষ পূরণ করল। ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস অব্যাহত সংগ্রামের ইতিহাস। লড়তে হয়েছে তাকে দুই ফ্রন্টে-একটি জ্ঞানের, অন্যটি সামাজিকতার।’ জন্মের প্রাক্কালে বিরোধিতার মূলে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় উপাদান যাই থাকুক না কেন শুরু থেকে চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ‘জ্ঞান বিতরণ’ ও ‘সামাজিকতা’য় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে পরিপূর্ণতা পায়, প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাতি অর্জন করে তা প্রধানত এক ঝাঁক নিবেদিতপ্রাণ হিন্দু পণ্ডিতসহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর উদার প্রাণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল।

[লেখক : সিনিয়র সহকারী রেজিস্ট্রার,

গণ বিশ্ববিদ্যালয়]