সাঁওতাল বিদ্রোহ : অধিকার আদায়ের লড়াই

মিথুশিলাক মুরমু

সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল- অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যের লড়াই, সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে বিশ^বাসী দেখেছে এক অসম যুদ্ধ। একদিকে জমিদার-মহাজন, স্থানীয় প্রশাসন ও পরবর্তী ব্রিটিশ সরকারের প্রশিক্ষিত সৈন্যসামন্ত এবং তাদের অত্যাধুনিক বুলেট-বন্দুক-কামান; অপরদিকে সত্যের সিপাহী অরণ্যচারী সাঁওতাল নারী-পুরুষ, হাতে তাদের তীর-ধুনক, টাঙ্গি, লাঠি; মনে অমিত সাহস। সাঁওতালরা মৃত্যুকে বেছে নিয়েছে কিন্তু অস্ত্রের কাছে, মিথ্যের দাপাটের আওতাধীন হননি।

সিধু-কানুর বিদ্রোহের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে তাদের সহিযুক্ত একটা ইস্তেহারের নকল স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নিকট পাঠানো হয়েছিল। এই ইস্তেহারটিতে আবেদন জানানো হয়েছিল ‘গরিব জনসাধারণের কাছে’। ইস্তেহারে লেখা ছিল- ‘যুবা ঠাকুর নিজে যুদ্ধ করবে, কেষ্ট ঠাকুর ও রামচন্দ্র সহযোগী হবে। ঠাকুরের নির্দেশে কৃষকরা ভেরী বাজাবে এবং ঠাকুর ইউরোপীয় সৈনিক-ফিরিঙ্গিদের মস্তক ছেদন করবে। সাহেবরা যদি বন্দুক ও বুলেট নিয়ে যুদ্ধ করে তাহলে সেই বন্দুক ও বুলেট ঠাকুরের ইচ্ছায় নিষ্ফল হবে’ (বাংলার বিদ্রোহ, হোসেন উদ্দীন হোসেন, পৃষ্ঠা-১৩৫)। বিদ্রোহ চলাকালীন সময়েও কোন কোন সময় সাঁওতালরা উপলব্ধি থেকে বলেছেন, ‘ঠাকুর থাকেন, দূরে দূরে বহুদূরে’। তিনি সাঁওতালদের আর্জি শ্রবণ থেকে মুখ ফিরিয়েছেন। হয়তো সত্যি, হয়তো নয়! অতঃপরও ঠাকুরের আশির্বাদ মাথায় নিয়ে সাঁওতালেরা গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে দিয়েছিল। মানুষের মুখে মুখে শোনা যেত একটি গান-

‘সিধু, সিধু ভাই তোর কিসের তরে রক্ত ঝরে/কি কথা রইল গাঁথা, ও কানু তোর হুল হুল স্বরে/দেশের লেগে অঙ্গে মোদের রক্ত রাঙা বেশ/জান না কি দস্যুবণিক লুটলো সোনার দেশ’ (সাঁওতালী থেকে বঙ্গানুবাদ)।

সিধু-কানু’রা ঘোষণা দিয়েছিল- তাদের রাজ্যে কাউকে খাজনা দিতে হবে না। প্রত্যেকে সাধ্যমতো জমি চাষ করার অধিকার পাবে। সব ঋণ মওকুফ করে দেয়া হবে। বলদচালিত লাঙলের ওপর দু’পয়সা আর মহিষচালিত লাঙলের ওপর দু’আনা খাজনা

ধার্য হবে। সিধু-কানু’দের স্বপ্ন অধরায় থেকে গেছে কিন্তু জে¦লে দিয়ে গেছে চেতনার মশাল, স্বাধীনতার পথে ইট-সুরকী-বালি।

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহ, যা প্রথম স্বধীনতা যুদ্ধ বলে পরিচিতি লাভ করেছে, তার অনেক আগে থেকেই কোম্পনি রাজের বিরুদ্ধে অসংখ্য বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছে ভারতবর্ষেও বিভিন্ন প্রান্তে নানা কারণে। বস্তুত ১৭৫৭’র পলাশির যুদ্ধের পর থেকেই একটানা কোনো না কোনো সশস্ত্র অসন্তোষ সামাল দিতে হয়েছে কোম্পানির-রাজকে এবং পরে ব্রিটিশ সরকারকে। আর তীব্র এই প্রতিবাদী আন্দোলনের প্রথম সারিতে ছিল ভারতের আদিম জনগণ-আদিবাসীরা। আদিবাসী বিদ্রোহ ঘটেছে অগণ্য এবং ব্রিটিশ শাসকদের যা সবচেয়ে বেশি বেগ দিয়েছিল সিধু-কানু, চাদ ও ভৈরবের নেতৃত্বাধীন সেই সাঁওতাল বিদ্রোহ-১৮৫৫ এবং মুন্ডা বিদ্রোহ-১৮৫৭।

সাঁওতাল বিদ্রোহের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা থেকে বিদ্রোহের ব্যাপ্তি ও গভীরতা সম্বন্ধে কিছুটা উপলব্ধি করা যায়-

১৭ জানুয়ারী, ১৭৮৪ : ভাগলপুর ও রাজমহলের কালেক্টর ক্লিভল্যা- হত্যা। তিলকা মুরমু’র নেতৃত্বে প্রথম সশস্ত্র সাঁওতাল বিদ্রোহ।

১৭৮৫ : তিলকা মুরমু’র ফাঁসি।

৩০ জুন, ১৮৫৫ : ভগনাডিহি গ্রামে (বর্তমান সাঁওতাল পরগনার অন্তর্গত) বিশাল সমাবেশ সিধু-কানুর ভাষণ এবং শোষণহীন স্বরাজ প্রতিষ্ঠা করার জন্য দশ হাজার সাঁওতালের শপথ গ্রহণ এবং কোলকাতা অভিমুখে প্রথম গণ-পদযাত্রা।

৭ জুলাই, ১৮৫৫ : দিঘি থানার অত্যাচারী দারোগা মহেশলাল দত্ত, দুইজন বরকন্দাজ, কয়েকজন চৌকিদার এবং কুখ্যাত মহাজন মাণিকরাম ভকত সিধু-কানু ও তাদের ১৯ জন সহযোগীর হাতে মৃত্যুবরণ। সাঁওতাল বিদ্রোহের আগুন প্রজ্জ্বলিত হয়।

১১ জুলাই, ১৮৫৫ : বিদ্রোহ দমনের জন্য সেনাবহিনীসহ মেজর F.W. Burroughs- এর কলগাঁ আক্রমণ।

১২ জুলাই, ১৮৫৫: সিধু-কানু, চাদ-ভাইরো’র নেতৃত্বে বিদ্রোহীদের পাকুড়ে প্রবেশ এবং রাজবাড়ি আক্রমণ।

১৩ জুলাই, ১৮৫৫ : কদমসায়েরে সেভেন্থ রেজিমেন্ট বাহিনীর আগমণ, বৃহত্তর সামগ্রিক সংগ্রামের সূত্রপাত।

১৫ জুলাই, ১৮৫৫ : পুকুড়ের কাছে তারই নদী তীরে সাঁওতাল বিদ্রোহীদের সঙ্গে সেভেন্থ রেজিমেন্টের সামনা-সামনি যুদ্ধ। যুদ্ধে সাঁওতাল বাহিনীর চরম বিপর্যয়।

১৬ জুলাই, ১৮৫৫: বিদ্রোহীদের কাছে Major Burrough –র পরিচালিত ব্রিটিশ সৈন্যের পিয়ালাপুরের যুদ্ধে পরাজয়।

২৪ জুলাই, ১৮৫৫: বারহাওয়া বারহাইত রাস্তায় রঘুনাথপুর অঞ্চলে মুর্শিদাবাদের ম্যাজিস্ট্রেট ঞড়ড়মড়ড়ফ-র পরিচালিত ইংরেজ সৈন্যের কাছে চাদ-কানুর পরাজয়।

২৭ জুলাই ১৮৫৫: Lieutenant Taulmain এবং ১৩ জন সিপাহী বিদ্রোহীদের হাতে মারা যান।

১৭ আগস্ট, ১৮৫৫ : ইংরেজ সরকার কর্তৃক আত্মসমর্পণের ঘোষণা পত্র প্রচার ও সাঁওতালদের এই ঘোষণা প্রত্যাখান।

১৬ সেপ্টেম্বর, ১৮৫৫: মোচিয়া কাঁসজোলা, রাম ও স্বন্দ্রা মাজহীর নেতৃত্বে ওপরবাঁধ থানা ও গ্রাম লুঠ।

২ সপ্তাহ অক্টোবর, ১৮৫৫: সিধু-কানু কর্তৃক অম্বা হানা মৌজা লুট।

১০ নভেম্বর, ১৮৫৫: ইংরেজ সরকার কর্তৃক সামরিক আইন জারি।

৩০ নভেম্বর, ১৮৫৫ : কানু ও তার দুই ভাই চাদ-ভাইরো তাদের সঙ্গীসহ জারোয়ার সিং নামে ঘাটোয়াল সর্দারের তৎপরতায় ধরা পড়ে।

১৪, ১৫, ১৬ জানুয়ারি, ১৮৫৬ : কানুর বিচার স্পেশাল কমিশনার এলিয়টের এজলাসে।

২৭ জানুয়ারি, ১৮৫৬ : Leutenant Fagan পরিচালিত ভাগলপুর হিল রেঞ্জার্স বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি সংগ্রামে সাঁওতালদের পরাজয়।

দ্বিতীয় সপ্তাহ ফেব্রুয়ারি, ১৮৫৬ : সিধুর ফাঁসি অথবা এক সম্মুখ সংঘর্ষে সিধুর প্রাণত্যাগ।

২১/২২ ফেব্রুয়ারি, ১৮৫৬ : বীরভূমের সাঁওতালরা করুকাতারা পরগনার বেশ কিছু মহাজনের সম্পত্তি আটক করেন।

২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৮৫৬ : ভগনাডিহিতে বেলা পৌনে ২টার সময় কানুর ফাঁসি হয়।

সাঁওতাল বিদ্রোহে শুধু সাঁওতালরাই যুক্ত ছিল না; ছিল- কামার-কুমার, তেলী, চামার, ডোম এবং মুসলমান তাঁতিরা। সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল জনযুদ্ধ, ঐতিহাসিক যুদ্ধ। আমার বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানের প্রস্তাবনায় লেখা হয়েছে-‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের’। ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান সহজ পাঠ’ গ্রন্থে বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী উক্ত অংশটির বর্ণনা করেছেন-“... অত্যাচার-উৎপীড়ন, শোষণ-লুণ্ঠন প্রতিরোধে বাংলার কৃষকদের অত্যুজ্জ্বল ইতিহাস আমরা পড়ি। সে ইতিহাসের সূচিপত্র এই: ... গারো বিদ্রোহ (১৭৭৫-১৮০২), চাকমা বিদ্রোহ (১৭৭৬-৮৭), ... সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৭) ... তেভাগার দাবিতে কৃষক বিদ্রোহ (১৯৪৬-৪৭) ...। উপরিউক্ত প্রত্যেকটি বিদ্রোহের ফলাফল আদৌ বিবেচ্য নয়, আসল বিবেচ্য হচ্ছে এগুলোর চরিত্র এবং তা হলো- অসম অথচ সাহসিক বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ সংগ্রামগুলোর ধারাবাহিকতাতেই ১৯৭১ সালের সশস্ত্র প্রতিরোধ ও যুদ্ধ- যা সার্বিক অর্থে ছিল ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম।’ তাই শুধু যুদ্ধ হিসেবে উল্লেখ করলে ১৯৭১ সালে মুক্তির জন্য সংগ্রাম দুই শতাধিক বছরের সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, ঐতিহাসিক ধারাকে ভুলে যেতে হয়” (পৃষ্ঠা- ৩০)। সাঁওতাল বিদ্রোহকে সামনে রেখে গীতিকার লিখেছেন-

‘আমরা প্রজা, সাহেব রাজা, দুঃখ দেবার যম/তাদের ভয়ে হটবো মোরা এমনি নরাধম?/মোরা শুধু ভুগবো?/না, না মোরা রুখবো।

বৃহস্পতিবার, ০১ জুলাই ২০২১ , ১৭ আষাঢ় ১৪২৮ ১৯ জিলক্বদ ১৪৪২

সাঁওতাল বিদ্রোহ : অধিকার আদায়ের লড়াই

মিথুশিলাক মুরমু

সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল- অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যের লড়াই, সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে বিশ^বাসী দেখেছে এক অসম যুদ্ধ। একদিকে জমিদার-মহাজন, স্থানীয় প্রশাসন ও পরবর্তী ব্রিটিশ সরকারের প্রশিক্ষিত সৈন্যসামন্ত এবং তাদের অত্যাধুনিক বুলেট-বন্দুক-কামান; অপরদিকে সত্যের সিপাহী অরণ্যচারী সাঁওতাল নারী-পুরুষ, হাতে তাদের তীর-ধুনক, টাঙ্গি, লাঠি; মনে অমিত সাহস। সাঁওতালরা মৃত্যুকে বেছে নিয়েছে কিন্তু অস্ত্রের কাছে, মিথ্যের দাপাটের আওতাধীন হননি।

সিধু-কানুর বিদ্রোহের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে তাদের সহিযুক্ত একটা ইস্তেহারের নকল স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নিকট পাঠানো হয়েছিল। এই ইস্তেহারটিতে আবেদন জানানো হয়েছিল ‘গরিব জনসাধারণের কাছে’। ইস্তেহারে লেখা ছিল- ‘যুবা ঠাকুর নিজে যুদ্ধ করবে, কেষ্ট ঠাকুর ও রামচন্দ্র সহযোগী হবে। ঠাকুরের নির্দেশে কৃষকরা ভেরী বাজাবে এবং ঠাকুর ইউরোপীয় সৈনিক-ফিরিঙ্গিদের মস্তক ছেদন করবে। সাহেবরা যদি বন্দুক ও বুলেট নিয়ে যুদ্ধ করে তাহলে সেই বন্দুক ও বুলেট ঠাকুরের ইচ্ছায় নিষ্ফল হবে’ (বাংলার বিদ্রোহ, হোসেন উদ্দীন হোসেন, পৃষ্ঠা-১৩৫)। বিদ্রোহ চলাকালীন সময়েও কোন কোন সময় সাঁওতালরা উপলব্ধি থেকে বলেছেন, ‘ঠাকুর থাকেন, দূরে দূরে বহুদূরে’। তিনি সাঁওতালদের আর্জি শ্রবণ থেকে মুখ ফিরিয়েছেন। হয়তো সত্যি, হয়তো নয়! অতঃপরও ঠাকুরের আশির্বাদ মাথায় নিয়ে সাঁওতালেরা গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে দিয়েছিল। মানুষের মুখে মুখে শোনা যেত একটি গান-

‘সিধু, সিধু ভাই তোর কিসের তরে রক্ত ঝরে/কি কথা রইল গাঁথা, ও কানু তোর হুল হুল স্বরে/দেশের লেগে অঙ্গে মোদের রক্ত রাঙা বেশ/জান না কি দস্যুবণিক লুটলো সোনার দেশ’ (সাঁওতালী থেকে বঙ্গানুবাদ)।

সিধু-কানু’রা ঘোষণা দিয়েছিল- তাদের রাজ্যে কাউকে খাজনা দিতে হবে না। প্রত্যেকে সাধ্যমতো জমি চাষ করার অধিকার পাবে। সব ঋণ মওকুফ করে দেয়া হবে। বলদচালিত লাঙলের ওপর দু’পয়সা আর মহিষচালিত লাঙলের ওপর দু’আনা খাজনা

ধার্য হবে। সিধু-কানু’দের স্বপ্ন অধরায় থেকে গেছে কিন্তু জে¦লে দিয়ে গেছে চেতনার মশাল, স্বাধীনতার পথে ইট-সুরকী-বালি।

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহ, যা প্রথম স্বধীনতা যুদ্ধ বলে পরিচিতি লাভ করেছে, তার অনেক আগে থেকেই কোম্পনি রাজের বিরুদ্ধে অসংখ্য বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছে ভারতবর্ষেও বিভিন্ন প্রান্তে নানা কারণে। বস্তুত ১৭৫৭’র পলাশির যুদ্ধের পর থেকেই একটানা কোনো না কোনো সশস্ত্র অসন্তোষ সামাল দিতে হয়েছে কোম্পানির-রাজকে এবং পরে ব্রিটিশ সরকারকে। আর তীব্র এই প্রতিবাদী আন্দোলনের প্রথম সারিতে ছিল ভারতের আদিম জনগণ-আদিবাসীরা। আদিবাসী বিদ্রোহ ঘটেছে অগণ্য এবং ব্রিটিশ শাসকদের যা সবচেয়ে বেশি বেগ দিয়েছিল সিধু-কানু, চাদ ও ভৈরবের নেতৃত্বাধীন সেই সাঁওতাল বিদ্রোহ-১৮৫৫ এবং মুন্ডা বিদ্রোহ-১৮৫৭।

সাঁওতাল বিদ্রোহের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা থেকে বিদ্রোহের ব্যাপ্তি ও গভীরতা সম্বন্ধে কিছুটা উপলব্ধি করা যায়-

১৭ জানুয়ারী, ১৭৮৪ : ভাগলপুর ও রাজমহলের কালেক্টর ক্লিভল্যা- হত্যা। তিলকা মুরমু’র নেতৃত্বে প্রথম সশস্ত্র সাঁওতাল বিদ্রোহ।

১৭৮৫ : তিলকা মুরমু’র ফাঁসি।

৩০ জুন, ১৮৫৫ : ভগনাডিহি গ্রামে (বর্তমান সাঁওতাল পরগনার অন্তর্গত) বিশাল সমাবেশ সিধু-কানুর ভাষণ এবং শোষণহীন স্বরাজ প্রতিষ্ঠা করার জন্য দশ হাজার সাঁওতালের শপথ গ্রহণ এবং কোলকাতা অভিমুখে প্রথম গণ-পদযাত্রা।

৭ জুলাই, ১৮৫৫ : দিঘি থানার অত্যাচারী দারোগা মহেশলাল দত্ত, দুইজন বরকন্দাজ, কয়েকজন চৌকিদার এবং কুখ্যাত মহাজন মাণিকরাম ভকত সিধু-কানু ও তাদের ১৯ জন সহযোগীর হাতে মৃত্যুবরণ। সাঁওতাল বিদ্রোহের আগুন প্রজ্জ্বলিত হয়।

১১ জুলাই, ১৮৫৫ : বিদ্রোহ দমনের জন্য সেনাবহিনীসহ মেজর F.W. Burroughs- এর কলগাঁ আক্রমণ।

১২ জুলাই, ১৮৫৫: সিধু-কানু, চাদ-ভাইরো’র নেতৃত্বে বিদ্রোহীদের পাকুড়ে প্রবেশ এবং রাজবাড়ি আক্রমণ।

১৩ জুলাই, ১৮৫৫ : কদমসায়েরে সেভেন্থ রেজিমেন্ট বাহিনীর আগমণ, বৃহত্তর সামগ্রিক সংগ্রামের সূত্রপাত।

১৫ জুলাই, ১৮৫৫ : পুকুড়ের কাছে তারই নদী তীরে সাঁওতাল বিদ্রোহীদের সঙ্গে সেভেন্থ রেজিমেন্টের সামনা-সামনি যুদ্ধ। যুদ্ধে সাঁওতাল বাহিনীর চরম বিপর্যয়।

১৬ জুলাই, ১৮৫৫: বিদ্রোহীদের কাছে Major Burrough –র পরিচালিত ব্রিটিশ সৈন্যের পিয়ালাপুরের যুদ্ধে পরাজয়।

২৪ জুলাই, ১৮৫৫: বারহাওয়া বারহাইত রাস্তায় রঘুনাথপুর অঞ্চলে মুর্শিদাবাদের ম্যাজিস্ট্রেট ঞড়ড়মড়ড়ফ-র পরিচালিত ইংরেজ সৈন্যের কাছে চাদ-কানুর পরাজয়।

২৭ জুলাই ১৮৫৫: Lieutenant Taulmain এবং ১৩ জন সিপাহী বিদ্রোহীদের হাতে মারা যান।

১৭ আগস্ট, ১৮৫৫ : ইংরেজ সরকার কর্তৃক আত্মসমর্পণের ঘোষণা পত্র প্রচার ও সাঁওতালদের এই ঘোষণা প্রত্যাখান।

১৬ সেপ্টেম্বর, ১৮৫৫: মোচিয়া কাঁসজোলা, রাম ও স্বন্দ্রা মাজহীর নেতৃত্বে ওপরবাঁধ থানা ও গ্রাম লুঠ।

২ সপ্তাহ অক্টোবর, ১৮৫৫: সিধু-কানু কর্তৃক অম্বা হানা মৌজা লুট।

১০ নভেম্বর, ১৮৫৫: ইংরেজ সরকার কর্তৃক সামরিক আইন জারি।

৩০ নভেম্বর, ১৮৫৫ : কানু ও তার দুই ভাই চাদ-ভাইরো তাদের সঙ্গীসহ জারোয়ার সিং নামে ঘাটোয়াল সর্দারের তৎপরতায় ধরা পড়ে।

১৪, ১৫, ১৬ জানুয়ারি, ১৮৫৬ : কানুর বিচার স্পেশাল কমিশনার এলিয়টের এজলাসে।

২৭ জানুয়ারি, ১৮৫৬ : Leutenant Fagan পরিচালিত ভাগলপুর হিল রেঞ্জার্স বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি সংগ্রামে সাঁওতালদের পরাজয়।

দ্বিতীয় সপ্তাহ ফেব্রুয়ারি, ১৮৫৬ : সিধুর ফাঁসি অথবা এক সম্মুখ সংঘর্ষে সিধুর প্রাণত্যাগ।

২১/২২ ফেব্রুয়ারি, ১৮৫৬ : বীরভূমের সাঁওতালরা করুকাতারা পরগনার বেশ কিছু মহাজনের সম্পত্তি আটক করেন।

২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৮৫৬ : ভগনাডিহিতে বেলা পৌনে ২টার সময় কানুর ফাঁসি হয়।

সাঁওতাল বিদ্রোহে শুধু সাঁওতালরাই যুক্ত ছিল না; ছিল- কামার-কুমার, তেলী, চামার, ডোম এবং মুসলমান তাঁতিরা। সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল জনযুদ্ধ, ঐতিহাসিক যুদ্ধ। আমার বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানের প্রস্তাবনায় লেখা হয়েছে-‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের’। ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান সহজ পাঠ’ গ্রন্থে বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী উক্ত অংশটির বর্ণনা করেছেন-“... অত্যাচার-উৎপীড়ন, শোষণ-লুণ্ঠন প্রতিরোধে বাংলার কৃষকদের অত্যুজ্জ্বল ইতিহাস আমরা পড়ি। সে ইতিহাসের সূচিপত্র এই: ... গারো বিদ্রোহ (১৭৭৫-১৮০২), চাকমা বিদ্রোহ (১৭৭৬-৮৭), ... সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৭) ... তেভাগার দাবিতে কৃষক বিদ্রোহ (১৯৪৬-৪৭) ...। উপরিউক্ত প্রত্যেকটি বিদ্রোহের ফলাফল আদৌ বিবেচ্য নয়, আসল বিবেচ্য হচ্ছে এগুলোর চরিত্র এবং তা হলো- অসম অথচ সাহসিক বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ সংগ্রামগুলোর ধারাবাহিকতাতেই ১৯৭১ সালের সশস্ত্র প্রতিরোধ ও যুদ্ধ- যা সার্বিক অর্থে ছিল ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম।’ তাই শুধু যুদ্ধ হিসেবে উল্লেখ করলে ১৯৭১ সালে মুক্তির জন্য সংগ্রাম দুই শতাধিক বছরের সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, ঐতিহাসিক ধারাকে ভুলে যেতে হয়” (পৃষ্ঠা- ৩০)। সাঁওতাল বিদ্রোহকে সামনে রেখে গীতিকার লিখেছেন-

‘আমরা প্রজা, সাহেব রাজা, দুঃখ দেবার যম/তাদের ভয়ে হটবো মোরা এমনি নরাধম?/মোরা শুধু ভুগবো?/না, না মোরা রুখবো।