কৃত্রিমভাবে গরু মোটাতাজা করার ঝুঁকি

জিল্লুর রহমান

সামনের পবিত্র ঈদুল আজহা। এই ঈদের প্রধান আকর্ষণ হলো কোরবানি। কোরবানি উপলক্ষে ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে পশুর হাট বসতে শুরু করেছে। প্রস্তুত রাজধানীর পশুরহাটগুলোও। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা বেচাকেনা শুরু হয়েছে। অনেক ব্যাপারী রাজধানীর হাটগুলোতে গবাদিপশু নিয়ে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

আমাদের দেশে কোরবানিতে গরু প্রাধান্য পায়। গরু দিয়েই কোরবানির চাহিদা মিটে থাকে। এই সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী গো খাদ্যের সঙ্গে মোটাতাজাকরণ সামগ্রী মিশিয়ে খাইয়ে গরু ফুলিয়ে ফাপিয়ে বড় করে তোলো। তারা বাড়তি মুনাফার আশায় অল্পদিনের মধ্যে গরু মোটাতাজা করতে গো-খাদ্যের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ট্যাবলেট ব্যবহার করে। মাংসপেশীতে প্রয়োগ করে নিষিদ্ধ ইনজেকশন, যা গরু ও জনস্বাস্থ্য উভয়ের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

কৃত্রিমভাবে মোটাতাজা করা গরুর মাংসপেশীতে ভারতীয় ডেক্সামেথাসন ইনজেকশন প্রয়োগ করা হয় এবং খাওয়ানো হয় স্টেরয়েড গ্রুপের বিভিন্ন ট্যাবলেট। মূলত স্টেরয়েড গ্রুপের ট্যাবলেট খাওয়ানো বা ডেক্সামেথাসন জাতীয় ইনজেকশন দেয়া হলে গরু খুব শান্ত হয়। ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারে না। গরুর ঊরু অনেক বেশি মাংসল মনে হয়। অতিরিক্ত হরমোনের কারণে পুরো শরীরে পানি জমে মোটা দেখায়। আঙুল দিয়ে গরুর শরীরে চাপ দিলে দেবে গিয়ে গর্ত হয়ে যায়। গরুর শ্বাস-প্রশ্বাস দেখেও গরুকে ট্যাবলেট খাওয়ানো হয়েছে কি না-তা নিশ্চিত হওয়া সম্ভব। ট্যাবলেট খাওয়ানো হলে গরু দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলে। গরুকে খুব ক্লান্ত দেখা যায় আর সারাক্ষণ হাঁপাতে থাকে। গরুর মুখে অতিরিক্ত লালা বা ফেনা লেগে থাকাও কৃত্রিম উপায়ে গরুকে মোটা করার আরেকটি লক্ষণ।

অনেক খামারি ইদানীং বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে গরু মোটাতাজা করেছেন, যদিও এ সংখ্যা চাহিদার তুলনায় খুব কম। গরু মোটাতাজাকরণের ক্ষেত্রে খামারি ও সাধারণ মানুষকে সচেতন করা খুবই জরুরি। প্রাণিসম্পদ বিভাগ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যদি কোরবানির ঈদের দু’তিন মাস আগ থেকে নজরদারি বৃদ্ধি করে তবে অসাধু চাষিরা গরু মোটাতাজাকরণের সুযোগ কম পাবে।

সারাদেশে কোরবানি দেয়ার জন্য প্রতি বছর প্রায এক কোটি ২০ লাখ গবাদি পশুর চাহিদা রয়েছে, যা প্রতি বছর পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ৫-১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। দেশের চাহিদা অনুযায়ী যদি পরিকল্পিতভাবে গবাদিপশু প্রস্তুত করা যায়, তাহলে কৃত্রিম উপায়ে গরু মোটাতাজা করার প্রয়োজন হয় না। এক্ষেত্রে গরু চাষিদের প্রণোদনা দেয়া যেতে পারে।

স্টেরয়েড গ্রুপের ট্যাবলেট খাওয়ালে গরুর প্রস্র্রাব বন্ধ হয়ে যায় এবং এর ফলে শরীরে পানি জমতে শুরু করে। ফলে গরু মোটাতাজা দেখায়। এ গরু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জবাই না করলে মারা যেতে পারে অথবা এর গোশত কমতে পারে। এমন গরুর গোশত খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। কৃত্রিমভাবে মোটাতাজা করা গরুর মাংস মানব শরীরে নানা ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে। ক্ষতিকারক ওষুধ খাওয়ানো হলে গরুর মাংস রান্নার পরও তার অবশেষ রয়ে যায়। ফলে ওষুধের অবশেষ অংশ মানবদেহে জমা হওয়ায় মানুষের বিপাক ক্রিয়া কমে যায়। ক্ষতিকারক ওষুধ ব্যবহার করে মোটাতাজা করা গরুর মাংস খেলে মানুষের কিডনি, লিভারসহ বিভিন্ন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত ও রোগ দেখা দেয়ার আশঙ্কা থাকে। এসব ওষুধ তীব্র তাপেও নষ্ট হয় না। ফলে মানবদেহে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়া যাদের রক্তচাপ ও রক্তে সুগারের মাত্রা বিপদসীমার কাছাকাছি, তাদেরও স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায়। এগুলো খেলে নিজেদের স্বাস্থ্য নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়।

গো-খাদ্যে স্টেরয়েড ও রাসায়নিক মেশানো প্রতিরোধে যদি সব পশুর হাটে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ভেটেরিনারি মেডিকেল টিম মনিটর করে কৃত্রিমভাবে মোটাতাজা গরু চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয, তবে ভবিষ্যতে ঈদকে সামনে রেখে অসাধু উপায়ে কেউ গরু হৃষ্টপুষ্ট করতে স্টেরয়েড মেশাতে সাহস পাবে না। সেজন্য মনিটরিংয়ের পাশাপাশি আইন ও বিধি অনুযায়ী জেল জরিমানা করাও জরুরি।

[লেখক : ব্যাংকার]

বৃহস্পতিবার, ০১ জুলাই ২০২১ , ১৭ আষাঢ় ১৪২৮ ১৯ জিলক্বদ ১৪৪২

কৃত্রিমভাবে গরু মোটাতাজা করার ঝুঁকি

জিল্লুর রহমান

সামনের পবিত্র ঈদুল আজহা। এই ঈদের প্রধান আকর্ষণ হলো কোরবানি। কোরবানি উপলক্ষে ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে পশুর হাট বসতে শুরু করেছে। প্রস্তুত রাজধানীর পশুরহাটগুলোও। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা বেচাকেনা শুরু হয়েছে। অনেক ব্যাপারী রাজধানীর হাটগুলোতে গবাদিপশু নিয়ে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

আমাদের দেশে কোরবানিতে গরু প্রাধান্য পায়। গরু দিয়েই কোরবানির চাহিদা মিটে থাকে। এই সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী গো খাদ্যের সঙ্গে মোটাতাজাকরণ সামগ্রী মিশিয়ে খাইয়ে গরু ফুলিয়ে ফাপিয়ে বড় করে তোলো। তারা বাড়তি মুনাফার আশায় অল্পদিনের মধ্যে গরু মোটাতাজা করতে গো-খাদ্যের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ট্যাবলেট ব্যবহার করে। মাংসপেশীতে প্রয়োগ করে নিষিদ্ধ ইনজেকশন, যা গরু ও জনস্বাস্থ্য উভয়ের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

কৃত্রিমভাবে মোটাতাজা করা গরুর মাংসপেশীতে ভারতীয় ডেক্সামেথাসন ইনজেকশন প্রয়োগ করা হয় এবং খাওয়ানো হয় স্টেরয়েড গ্রুপের বিভিন্ন ট্যাবলেট। মূলত স্টেরয়েড গ্রুপের ট্যাবলেট খাওয়ানো বা ডেক্সামেথাসন জাতীয় ইনজেকশন দেয়া হলে গরু খুব শান্ত হয়। ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারে না। গরুর ঊরু অনেক বেশি মাংসল মনে হয়। অতিরিক্ত হরমোনের কারণে পুরো শরীরে পানি জমে মোটা দেখায়। আঙুল দিয়ে গরুর শরীরে চাপ দিলে দেবে গিয়ে গর্ত হয়ে যায়। গরুর শ্বাস-প্রশ্বাস দেখেও গরুকে ট্যাবলেট খাওয়ানো হয়েছে কি না-তা নিশ্চিত হওয়া সম্ভব। ট্যাবলেট খাওয়ানো হলে গরু দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলে। গরুকে খুব ক্লান্ত দেখা যায় আর সারাক্ষণ হাঁপাতে থাকে। গরুর মুখে অতিরিক্ত লালা বা ফেনা লেগে থাকাও কৃত্রিম উপায়ে গরুকে মোটা করার আরেকটি লক্ষণ।

অনেক খামারি ইদানীং বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে গরু মোটাতাজা করেছেন, যদিও এ সংখ্যা চাহিদার তুলনায় খুব কম। গরু মোটাতাজাকরণের ক্ষেত্রে খামারি ও সাধারণ মানুষকে সচেতন করা খুবই জরুরি। প্রাণিসম্পদ বিভাগ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যদি কোরবানির ঈদের দু’তিন মাস আগ থেকে নজরদারি বৃদ্ধি করে তবে অসাধু চাষিরা গরু মোটাতাজাকরণের সুযোগ কম পাবে।

সারাদেশে কোরবানি দেয়ার জন্য প্রতি বছর প্রায এক কোটি ২০ লাখ গবাদি পশুর চাহিদা রয়েছে, যা প্রতি বছর পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ৫-১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। দেশের চাহিদা অনুযায়ী যদি পরিকল্পিতভাবে গবাদিপশু প্রস্তুত করা যায়, তাহলে কৃত্রিম উপায়ে গরু মোটাতাজা করার প্রয়োজন হয় না। এক্ষেত্রে গরু চাষিদের প্রণোদনা দেয়া যেতে পারে।

স্টেরয়েড গ্রুপের ট্যাবলেট খাওয়ালে গরুর প্রস্র্রাব বন্ধ হয়ে যায় এবং এর ফলে শরীরে পানি জমতে শুরু করে। ফলে গরু মোটাতাজা দেখায়। এ গরু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জবাই না করলে মারা যেতে পারে অথবা এর গোশত কমতে পারে। এমন গরুর গোশত খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। কৃত্রিমভাবে মোটাতাজা করা গরুর মাংস মানব শরীরে নানা ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে। ক্ষতিকারক ওষুধ খাওয়ানো হলে গরুর মাংস রান্নার পরও তার অবশেষ রয়ে যায়। ফলে ওষুধের অবশেষ অংশ মানবদেহে জমা হওয়ায় মানুষের বিপাক ক্রিয়া কমে যায়। ক্ষতিকারক ওষুধ ব্যবহার করে মোটাতাজা করা গরুর মাংস খেলে মানুষের কিডনি, লিভারসহ বিভিন্ন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত ও রোগ দেখা দেয়ার আশঙ্কা থাকে। এসব ওষুধ তীব্র তাপেও নষ্ট হয় না। ফলে মানবদেহে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়া যাদের রক্তচাপ ও রক্তে সুগারের মাত্রা বিপদসীমার কাছাকাছি, তাদেরও স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায়। এগুলো খেলে নিজেদের স্বাস্থ্য নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়।

গো-খাদ্যে স্টেরয়েড ও রাসায়নিক মেশানো প্রতিরোধে যদি সব পশুর হাটে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ভেটেরিনারি মেডিকেল টিম মনিটর করে কৃত্রিমভাবে মোটাতাজা গরু চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয, তবে ভবিষ্যতে ঈদকে সামনে রেখে অসাধু উপায়ে কেউ গরু হৃষ্টপুষ্ট করতে স্টেরয়েড মেশাতে সাহস পাবে না। সেজন্য মনিটরিংয়ের পাশাপাশি আইন ও বিধি অনুযায়ী জেল জরিমানা করাও জরুরি।

[লেখক : ব্যাংকার]