বিধিনিষেধের প্রথম দিন

রাজধানী ও জেলা শহরে কড়াকড়ি কোথাও ঢিলেঢালা

‘কঠোর লকডাউনের’ প্রথম দিন গতকাল রাজধানীর ভেতরে ছিল ব্যাপক কড়াকড়ি। তবে ঢাকা থেকে বের হওয়ার পথে অনেকটাই শিথিল ছিল বিধিনিষেধ। এছাড়া জেলা শহরে কঠোর অবস্থানে ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

ঘরে-বাইরে বের হলেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রশ্নের মুখামুখী হতে হয়েছে। কোন কারণ ছাড়া বাইরে বের হয়ে অনেকেই শাস্তি ও জরিমানা ভোগ করতে হয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে গতকাল প্রায় ৫ শতাধিক লোক আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

তবে শহরের বাইরে বিভিন্ন ঢাকার প্রবেশমুখে সড়ক ও মহাসড়কে সিএনজি অটোরিকশা, মোটরসাইকেল, লেগুনা ও মাইক্রোবাসে যাত্রী পরিবহন করতে দেখা গেছে। অনেক স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সামনে চলাচল করেছে এসব যানবাহন। এক্ষেত্রে গাড়ি প্রতি ৫০০-১০০০ টাকা ঘুষ দিয়ে চলাচল করতে হয়েছে বলে চালকরা জানান।

সরেজমিনে ঢাকার বিভিন্ন প্রবেশমুখ ঘুরে দেখা গেছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর বিধিনিষেধেও মানুষের চলাচল বন্ধ হয়নি। গতকালও ঢাকার বিভিন্ন প্রবেশ মুখেছিল মানুষের জটলা। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা, কুতুবখালীর মোড়, শনিরআখড়া ও সাইনবোর্ড থেকে রিকশা ও লেগুনাসহ ছোট যানবাহনে যাত্রী পরিবহন করতে দেখা গেছে। এসব স্থান থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের অনেক যাত্রী যাতায়াত করতে দেখা গেছে।

এছাড়া জুরাইন ও পোস্তগোলা বুড়িগঙ্গা সেতুর ওপারে সিএনজি অটোরিকশা এবং ব্যাটারিচালিত রিকশায় যাত্রী পরিবহন করতে দেখা গেছে। এসব স্থান থেকে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক ও শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ফেরিঘাটের অনেক যাত্রী চলাচল করতে দেখা গেছে। করোনার ভয়ে দুই-একজন মুখে মাস্ক থাকলেও বেশিভাগ যাত্রী ছোট যানবাহনে গাদাগাদি করে যাতায়াত করতে দেখা গেছে। তবে স্বাভাবিক ভাড়ার চেয়ে অনেক গুণ বেশি ভাড়া গুনতে হচ্ছে বলে যাত্রীরা জানান।

শহরের বাইরে অবস্থা

গতকাল বিকেল ৩টা। ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ মোড়ে। যানবাহনের অপেক্ষায় ছিলেন অনেকজন যাত্রী। কাছে গিয়ে জানতে চাইলে কাদের নামের এক যাত্রী সংবাদকে বলেন, ‘জরুরি প্রয়োজনে গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর যাব। ঢাকার রামপুরা থেকে ভেঙে ভেঙে এ পর্যন্ত আসলাম। রামপুরা থেকে জুরাইন পর্যন্ত রিকশায় ভাড়া নিয়ে ২০০ টাকা। পোস্তগোলা ব্রিজ হেঁটে পার হয়েছি। মাওয়ায় ফেরিঘাটের যাওয়ার জন্য সিএনজির অপেক্ষা করছি। হাসনাবাদ থেকে মাওয়া ঘাটের সিএনজি ভাড়া চাচ্ছে ১৫০০ টাকা। তাই ৪-৫ জন এক সঙ্গে যাব সেজন্য অপেক্ষা করছি।’

আনিস নামের এক সিএনজি চালক সংবাদকে বলেন, ‘মাওয়া ঘাটে যেতে হলে ভেতরের অনেক পথ ঘুরে যেতে হবে। মহাসড়কে আর্মি ও পুলিশের চেকপোস্ট আছে। কোন গাড়ি যেতে দেয় না। তাই ভাড়া বেশি নেয়া হচ্ছে। দুই-একদিন পর এত কড়াকড়ি থাকবে না। তখন ভাড়া কম হবে।’

যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তার মোড়ে শাহীন নামের এক যাত্রী বলেন, ‘কুমিল্লা যাওয়ার জন্য রিকশা সাইনবোর্ড যাচ্ছি। যাত্রাবাড়ী থেকে সাইনবোর্ডের রিকশায় ভাড়া নিচ্ছে ১০০ টাকা। সাইনবোর্ড প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস ও অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায়। কুমিল্লা বিশ^রোডে জনপ্রতি ভাড়া নেয়া হয় ৫০০ টাকা। ঢাকায় পুলিশ বাঁধা দেয়। তাই সাইনবোর্ড থেকে এসব গাড়ি চলাচল করছে।’

রাজধানীতে কড়াকড়ি

‘কঠোর লকডাউনের’ প্রথম দিনে গতকাল ঢাকার বিভিন্ন সড়ক ছিল অনেকটাই ফাঁকা। সকাল থেকেই বিভিন্ন সড়কে আনসার, পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনী সদস্যদের টহল দিতে দেখা গেছে। সরকারি ও বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের গাড়ি, পণ্যবাহী বাহন ছাড়া কিছু রিকশা-রিকশাভ্যান চলাচল করতে দেখা গেছে। কিছু প্রাইভেটকার দেখা গেলেও বিভিন্ন স্থানে পুলিশ তা আটকে দিয়েছে।

সড়কের মোড়ে মোড়ে চেকপোস্ট, কাঁটাতার ও বাঁশের ব্যারিকেড যানবাহন আটকে দিতে দেখা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কাউকে রাস্তায় চলাচল করতে দেয়া হয়নি। রাজধানীর পুরানা পল্টন, গুলিস্তান, গুলশান, রামপুরা ও হাতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী গাড়ির টহল দিতে দেখা গেছে।

সরকারি বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করতে সারাদেশেই সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় ১০৬ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে মাঠে রাখা হয়েছে। অফিস-আদালত, গণপরিবহন, শপিংমল বন্ধ রাখা হয়েছে। জনসাধারণকে অনুরোধ জানানো হয়েছে ঘরে থাকার। রাস্তায় বেরিয়ে যথাযথ কারণ দেখাতে না পারায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আটক করা হয়েছে ৫ শতাধিক মানুষকে।

মানুষকে বিধিনিষেধ মানাতে গতকাল সকাল থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে মাইকের মাধ্যমে প্রচারণা চালিয়ে সবাইকে ঘরে থাকার অনুরোধ করছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। লকডাউনের প্রথম দিন গতকাল রাজধানীর মগবাজার মৌচাক, শান্তিনগর, কাকরাইল, নয়াপল্টন, ফকিরাপুল, বিজয়নগর, মিরপুর, আজিমপুর, বাড্ডা, রামপুরা, শাহবাগ, ধানম-ি, হাতিরপুল, যাত্রাবাড়ী, পোস্তগোলাসহ বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট বসিয়ে যানবাহন আটকে জিজ্ঞাস করতে দেখা পুলিশ সদস্যদের।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় ওবায়দুল নামের এক ট্রাফিক পুলিশ সংবাদকে বলেন, ‘যারা সড়কে বের হচ্ছেন সবাইকে জিজ্ঞাস করা হচ্ছে। কেন বের হয়েছে। ঘর থেকে বের হওয়ার যুক্তসঙ্গত কারণ না দেখালে মামলা, জেল-জরিমান মুখে পড়তে হবে। কোন ছাড় দেয়া হচ্ছে না, কড়াকড়ি করছি। সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে তল্লাশি করা হচ্ছে। ‘অতি প্রয়োজন’ ছাড়া কাউকে যেতে দেয়া হচ্ছে না। মোটরসাইকেলে দুজন যাত্রী দেখলে একজনকে নামিয়ে দেয়া হচ্ছে, কেন তারা বের হয়েছেন তাও জানতে চাওয়া হচ্ছে।’

লকডাউনে যান্ত্রিক যানবাহন চলাচলে নিষেধ থাকলেও রিকশায় বাধা নেই। তাই গতকাল সকাল থেকে বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে রিকশা চালকরা বসে থাকলেও যাত্রী পাচ্ছেন না বলে জানান রিকশা চালকরা। দয়াগঞ্জ এলাকায় সুরুজ মিয়া নামের এক রিকশাচালক সংবাদকে বলেন, ‘ঢাকা মানুষ নেই। পুলিশি বাধার কারণে অনেকেই বের হয়নি। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ৫ জন যাত্রী পেয়েছি।’

হেঁটে কর্মস্থলে গার্মেন্ট শ্রমিকরা

অফিস-আদালত বন্ধ থাকলেও শিল্পকারখানাগুলো ‘নিজস্ব ব্যবস্থায়’ চালু রাখার অনুমতি দিয়েছে সরকার। গতকাল সকালে পোশাক শ্রমিকদের অনেককে হেঁটে কর্মস্থলে যতে দেখা গেছে। তাদেরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জিজ্ঞাসার মুখে পড়তে হয়েছে জানান শ্রমিকরা।

দোলাইপাড় এলাকায় মিল্টন নামের এক গার্মেন্ট শ্রমিক বলেন, ‘লকডাউনে গার্মেন্টস বন্ধ হয়নি। আমাদের কাজের যেতে বলেছে। কিন্তু কোন গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়নি। তাই হেঁটেই যাচ্ছি। রিকশা ভাড়া দিয়ে তো পোষাবে না।’

রাজধানীর বিভিন্ন অলি-গলি ফুটপাতে কিছু দোকানপাট খোলা ছিল। কিন্তু ক্রেতা কিছু খুবেই কম। খাবারের দোকাল খোলা থাকলেও বিক্রিতা নেই বলে জানান দোকানদাররা। দোকানে ও সড়কের পাশে তরকারি-শাক-সবজি করতে দেখা গেছে অনেক স্থানে। তবে ক্রেতা ছিল খুবেই কম।

সরেজমিন : নারায়ণগঞ্জ সাইনবোর্ড মোড়

কঠোর লকডাউনে নির্দিষ্ট কিছু যানবাহন ছাড়া অন্য যানবাহন চলাচলে সরকারের কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও প্রথম দিন গতকাল নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড মোড় এলাকায় বেশ সংখ্যক ব্যক্তিগত গাড়ি, মোটরসাইকেল, বড় আকারের ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, অটোরিকশা, মিশুক চলাচল করতে দেখা গেছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দুপুর ১২টার সময় কম যানবাহন চললেও বেলা ৩টার পর সাইনবোর্ড মোড় এলাকায় চলাচলকারী যানবাহনের ভিড় বেড়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের চলাচলকারী যানবাহন নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে দেখা যায়। লকডাউনে সরকারি নিষেধাজ্ঞা না মানায় নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সাইনবোর্ড মোড়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেল, পিকআপ ভ্যানকে জরিমানা করেছে। নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের দায়িত্বরত সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল মতিন খান লকডাউনের বিধিনিষেধ না মানায় এক মোটরসাইকেল চালককে আটক করলেও মুহ’র্তের মধ্যে সে ম্যাজিস্ট্রেটের চোখ ফাঁকি দিয়ে চিটাগাংরোডের দিকে চলে যায়। এছাড়া উক্ত এলাকায় টহলরত সেনাবাহিনী ও বিজিবির সদস্যরা সাইনবোর্ড এলাকায় চলাচলকারী মোটরসাইকেল, মাইক্রোবাস, পিকআপসহ অন্য যানবাহনকে চেক করতে দেখা যায়।

লকডাউনে সাইনবোর্ড মোড় এলাকায় দুর্ভোগে পড়েছেন কিছু রোগী। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে সাইনবোর্ড মোড় এলাকায় আসা সুমী নামে এক রোগীকে তার স্বামী পাজাকোলে করে হাঁটছিলেন আর রিকশা খুঁজছিলেন । অসুস্থ সুমীর স্বামী জানান, রিকশা ভাড়া পাঁচশত টাকা নিয়েছে ঢাকা মেডিকেল থেকে সাইনবোর্ড আসতে। এখন যে, কিভাবে যাব মুন্সীগঞ্জে।

এভাবে সাইনবোর্ড মোড়ে বিল্লাল নামে এক রোগী তার নবজাতক বাচ্চা ও স্ত্রীসহ অনেকক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন রিকশার জন্য। তিনি জানান, ভাই আমি টিভি রোগে আক্রান্ত। ডাক্তার দেখাতে যেতে হবে মুন্সীগঞ্জে। রিকশার ড্রাইভার দুইশত টাকা ভাড়া ছাড়া চাষাড়া যাবে না। আমি তাকে দেড়শ’ টাকা পর্যন্ত বলেছি। অল্প টাকার বেতনে গুলিস্তানে চাকরি করি। কিভাবে বেশি ভাড়া দিয়ে মুন্সীগঞ্জ যাব।

এছাড়া পথচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রিকশা, মিশুক চালকগণ ভাড়া বেশি চাওয়ায় অনেক পথচারী মানুষ হেঁটে সাইনবোর্ড মোড় থেকে চিটাগাংরোড, সানারপাড়, চাষাঢ়াসহ আশপাশের এলাকায় নিজ নিজ গন্তব্যে দিকে হেঁটে যেতে দেখা যায়।

শুক্রবার, ০২ জুলাই ২০২১ , ১৮ আষাঢ় ১৪২৮ ২০ জিলক্বদ ১৪৪২

বিধিনিষেধের প্রথম দিন

রাজধানী ও জেলা শহরে কড়াকড়ি কোথাও ঢিলেঢালা

ইবরাহীম মাহমুদ আকাশ

image

‘কঠোর লকডাউনের’ প্রথম দিন গতকাল রাজধানীর ভেতরে ছিল ব্যাপক কড়াকড়ি। তবে ঢাকা থেকে বের হওয়ার পথে অনেকটাই শিথিল ছিল বিধিনিষেধ। এছাড়া জেলা শহরে কঠোর অবস্থানে ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

ঘরে-বাইরে বের হলেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রশ্নের মুখামুখী হতে হয়েছে। কোন কারণ ছাড়া বাইরে বের হয়ে অনেকেই শাস্তি ও জরিমানা ভোগ করতে হয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে গতকাল প্রায় ৫ শতাধিক লোক আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

তবে শহরের বাইরে বিভিন্ন ঢাকার প্রবেশমুখে সড়ক ও মহাসড়কে সিএনজি অটোরিকশা, মোটরসাইকেল, লেগুনা ও মাইক্রোবাসে যাত্রী পরিবহন করতে দেখা গেছে। অনেক স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সামনে চলাচল করেছে এসব যানবাহন। এক্ষেত্রে গাড়ি প্রতি ৫০০-১০০০ টাকা ঘুষ দিয়ে চলাচল করতে হয়েছে বলে চালকরা জানান।

সরেজমিনে ঢাকার বিভিন্ন প্রবেশমুখ ঘুরে দেখা গেছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর বিধিনিষেধেও মানুষের চলাচল বন্ধ হয়নি। গতকালও ঢাকার বিভিন্ন প্রবেশ মুখেছিল মানুষের জটলা। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা, কুতুবখালীর মোড়, শনিরআখড়া ও সাইনবোর্ড থেকে রিকশা ও লেগুনাসহ ছোট যানবাহনে যাত্রী পরিবহন করতে দেখা গেছে। এসব স্থান থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের অনেক যাত্রী যাতায়াত করতে দেখা গেছে।

এছাড়া জুরাইন ও পোস্তগোলা বুড়িগঙ্গা সেতুর ওপারে সিএনজি অটোরিকশা এবং ব্যাটারিচালিত রিকশায় যাত্রী পরিবহন করতে দেখা গেছে। এসব স্থান থেকে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক ও শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ফেরিঘাটের অনেক যাত্রী চলাচল করতে দেখা গেছে। করোনার ভয়ে দুই-একজন মুখে মাস্ক থাকলেও বেশিভাগ যাত্রী ছোট যানবাহনে গাদাগাদি করে যাতায়াত করতে দেখা গেছে। তবে স্বাভাবিক ভাড়ার চেয়ে অনেক গুণ বেশি ভাড়া গুনতে হচ্ছে বলে যাত্রীরা জানান।

শহরের বাইরে অবস্থা

গতকাল বিকেল ৩টা। ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ মোড়ে। যানবাহনের অপেক্ষায় ছিলেন অনেকজন যাত্রী। কাছে গিয়ে জানতে চাইলে কাদের নামের এক যাত্রী সংবাদকে বলেন, ‘জরুরি প্রয়োজনে গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর যাব। ঢাকার রামপুরা থেকে ভেঙে ভেঙে এ পর্যন্ত আসলাম। রামপুরা থেকে জুরাইন পর্যন্ত রিকশায় ভাড়া নিয়ে ২০০ টাকা। পোস্তগোলা ব্রিজ হেঁটে পার হয়েছি। মাওয়ায় ফেরিঘাটের যাওয়ার জন্য সিএনজির অপেক্ষা করছি। হাসনাবাদ থেকে মাওয়া ঘাটের সিএনজি ভাড়া চাচ্ছে ১৫০০ টাকা। তাই ৪-৫ জন এক সঙ্গে যাব সেজন্য অপেক্ষা করছি।’

আনিস নামের এক সিএনজি চালক সংবাদকে বলেন, ‘মাওয়া ঘাটে যেতে হলে ভেতরের অনেক পথ ঘুরে যেতে হবে। মহাসড়কে আর্মি ও পুলিশের চেকপোস্ট আছে। কোন গাড়ি যেতে দেয় না। তাই ভাড়া বেশি নেয়া হচ্ছে। দুই-একদিন পর এত কড়াকড়ি থাকবে না। তখন ভাড়া কম হবে।’

যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তার মোড়ে শাহীন নামের এক যাত্রী বলেন, ‘কুমিল্লা যাওয়ার জন্য রিকশা সাইনবোর্ড যাচ্ছি। যাত্রাবাড়ী থেকে সাইনবোর্ডের রিকশায় ভাড়া নিচ্ছে ১০০ টাকা। সাইনবোর্ড প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস ও অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায়। কুমিল্লা বিশ^রোডে জনপ্রতি ভাড়া নেয়া হয় ৫০০ টাকা। ঢাকায় পুলিশ বাঁধা দেয়। তাই সাইনবোর্ড থেকে এসব গাড়ি চলাচল করছে।’

রাজধানীতে কড়াকড়ি

‘কঠোর লকডাউনের’ প্রথম দিনে গতকাল ঢাকার বিভিন্ন সড়ক ছিল অনেকটাই ফাঁকা। সকাল থেকেই বিভিন্ন সড়কে আনসার, পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনী সদস্যদের টহল দিতে দেখা গেছে। সরকারি ও বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের গাড়ি, পণ্যবাহী বাহন ছাড়া কিছু রিকশা-রিকশাভ্যান চলাচল করতে দেখা গেছে। কিছু প্রাইভেটকার দেখা গেলেও বিভিন্ন স্থানে পুলিশ তা আটকে দিয়েছে।

সড়কের মোড়ে মোড়ে চেকপোস্ট, কাঁটাতার ও বাঁশের ব্যারিকেড যানবাহন আটকে দিতে দেখা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কাউকে রাস্তায় চলাচল করতে দেয়া হয়নি। রাজধানীর পুরানা পল্টন, গুলিস্তান, গুলশান, রামপুরা ও হাতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী গাড়ির টহল দিতে দেখা গেছে।

সরকারি বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করতে সারাদেশেই সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় ১০৬ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে মাঠে রাখা হয়েছে। অফিস-আদালত, গণপরিবহন, শপিংমল বন্ধ রাখা হয়েছে। জনসাধারণকে অনুরোধ জানানো হয়েছে ঘরে থাকার। রাস্তায় বেরিয়ে যথাযথ কারণ দেখাতে না পারায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আটক করা হয়েছে ৫ শতাধিক মানুষকে।

মানুষকে বিধিনিষেধ মানাতে গতকাল সকাল থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে মাইকের মাধ্যমে প্রচারণা চালিয়ে সবাইকে ঘরে থাকার অনুরোধ করছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। লকডাউনের প্রথম দিন গতকাল রাজধানীর মগবাজার মৌচাক, শান্তিনগর, কাকরাইল, নয়াপল্টন, ফকিরাপুল, বিজয়নগর, মিরপুর, আজিমপুর, বাড্ডা, রামপুরা, শাহবাগ, ধানম-ি, হাতিরপুল, যাত্রাবাড়ী, পোস্তগোলাসহ বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট বসিয়ে যানবাহন আটকে জিজ্ঞাস করতে দেখা পুলিশ সদস্যদের।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় ওবায়দুল নামের এক ট্রাফিক পুলিশ সংবাদকে বলেন, ‘যারা সড়কে বের হচ্ছেন সবাইকে জিজ্ঞাস করা হচ্ছে। কেন বের হয়েছে। ঘর থেকে বের হওয়ার যুক্তসঙ্গত কারণ না দেখালে মামলা, জেল-জরিমান মুখে পড়তে হবে। কোন ছাড় দেয়া হচ্ছে না, কড়াকড়ি করছি। সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে তল্লাশি করা হচ্ছে। ‘অতি প্রয়োজন’ ছাড়া কাউকে যেতে দেয়া হচ্ছে না। মোটরসাইকেলে দুজন যাত্রী দেখলে একজনকে নামিয়ে দেয়া হচ্ছে, কেন তারা বের হয়েছেন তাও জানতে চাওয়া হচ্ছে।’

লকডাউনে যান্ত্রিক যানবাহন চলাচলে নিষেধ থাকলেও রিকশায় বাধা নেই। তাই গতকাল সকাল থেকে বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে রিকশা চালকরা বসে থাকলেও যাত্রী পাচ্ছেন না বলে জানান রিকশা চালকরা। দয়াগঞ্জ এলাকায় সুরুজ মিয়া নামের এক রিকশাচালক সংবাদকে বলেন, ‘ঢাকা মানুষ নেই। পুলিশি বাধার কারণে অনেকেই বের হয়নি। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ৫ জন যাত্রী পেয়েছি।’

হেঁটে কর্মস্থলে গার্মেন্ট শ্রমিকরা

অফিস-আদালত বন্ধ থাকলেও শিল্পকারখানাগুলো ‘নিজস্ব ব্যবস্থায়’ চালু রাখার অনুমতি দিয়েছে সরকার। গতকাল সকালে পোশাক শ্রমিকদের অনেককে হেঁটে কর্মস্থলে যতে দেখা গেছে। তাদেরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জিজ্ঞাসার মুখে পড়তে হয়েছে জানান শ্রমিকরা।

দোলাইপাড় এলাকায় মিল্টন নামের এক গার্মেন্ট শ্রমিক বলেন, ‘লকডাউনে গার্মেন্টস বন্ধ হয়নি। আমাদের কাজের যেতে বলেছে। কিন্তু কোন গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়নি। তাই হেঁটেই যাচ্ছি। রিকশা ভাড়া দিয়ে তো পোষাবে না।’

রাজধানীর বিভিন্ন অলি-গলি ফুটপাতে কিছু দোকানপাট খোলা ছিল। কিন্তু ক্রেতা কিছু খুবেই কম। খাবারের দোকাল খোলা থাকলেও বিক্রিতা নেই বলে জানান দোকানদাররা। দোকানে ও সড়কের পাশে তরকারি-শাক-সবজি করতে দেখা গেছে অনেক স্থানে। তবে ক্রেতা ছিল খুবেই কম।

সরেজমিন : নারায়ণগঞ্জ সাইনবোর্ড মোড়

কঠোর লকডাউনে নির্দিষ্ট কিছু যানবাহন ছাড়া অন্য যানবাহন চলাচলে সরকারের কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও প্রথম দিন গতকাল নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড মোড় এলাকায় বেশ সংখ্যক ব্যক্তিগত গাড়ি, মোটরসাইকেল, বড় আকারের ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, অটোরিকশা, মিশুক চলাচল করতে দেখা গেছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দুপুর ১২টার সময় কম যানবাহন চললেও বেলা ৩টার পর সাইনবোর্ড মোড় এলাকায় চলাচলকারী যানবাহনের ভিড় বেড়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের চলাচলকারী যানবাহন নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে দেখা যায়। লকডাউনে সরকারি নিষেধাজ্ঞা না মানায় নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সাইনবোর্ড মোড়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেল, পিকআপ ভ্যানকে জরিমানা করেছে। নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের দায়িত্বরত সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল মতিন খান লকডাউনের বিধিনিষেধ না মানায় এক মোটরসাইকেল চালককে আটক করলেও মুহ’র্তের মধ্যে সে ম্যাজিস্ট্রেটের চোখ ফাঁকি দিয়ে চিটাগাংরোডের দিকে চলে যায়। এছাড়া উক্ত এলাকায় টহলরত সেনাবাহিনী ও বিজিবির সদস্যরা সাইনবোর্ড এলাকায় চলাচলকারী মোটরসাইকেল, মাইক্রোবাস, পিকআপসহ অন্য যানবাহনকে চেক করতে দেখা যায়।

লকডাউনে সাইনবোর্ড মোড় এলাকায় দুর্ভোগে পড়েছেন কিছু রোগী। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে সাইনবোর্ড মোড় এলাকায় আসা সুমী নামে এক রোগীকে তার স্বামী পাজাকোলে করে হাঁটছিলেন আর রিকশা খুঁজছিলেন । অসুস্থ সুমীর স্বামী জানান, রিকশা ভাড়া পাঁচশত টাকা নিয়েছে ঢাকা মেডিকেল থেকে সাইনবোর্ড আসতে। এখন যে, কিভাবে যাব মুন্সীগঞ্জে।

এভাবে সাইনবোর্ড মোড়ে বিল্লাল নামে এক রোগী তার নবজাতক বাচ্চা ও স্ত্রীসহ অনেকক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন রিকশার জন্য। তিনি জানান, ভাই আমি টিভি রোগে আক্রান্ত। ডাক্তার দেখাতে যেতে হবে মুন্সীগঞ্জে। রিকশার ড্রাইভার দুইশত টাকা ভাড়া ছাড়া চাষাড়া যাবে না। আমি তাকে দেড়শ’ টাকা পর্যন্ত বলেছি। অল্প টাকার বেতনে গুলিস্তানে চাকরি করি। কিভাবে বেশি ভাড়া দিয়ে মুন্সীগঞ্জ যাব।

এছাড়া পথচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রিকশা, মিশুক চালকগণ ভাড়া বেশি চাওয়ায় অনেক পথচারী মানুষ হেঁটে সাইনবোর্ড মোড় থেকে চিটাগাংরোড, সানারপাড়, চাষাঢ়াসহ আশপাশের এলাকায় নিজ নিজ গন্তব্যে দিকে হেঁটে যেতে দেখা যায়।