বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ডুবছে বহু গ্রাম

=ভারি বর্ষণ ও উজান ঢলে নদ-নদীর পানি বেড়ে তলিয়ে যাচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। তিস্তার পানি বৃদ্ধিতে লালমনিরহাটে বাঁধে ধস ও উপকূলে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। একই কারণে নেত্রকোনার বাঁধ ভেঙে নিম্নাঞ্চল ডুবে গেছে। টানা বৃষ্টি ও উজান স্রোতে কুড়িগ্রামের নিম্নাঞ্চলও প্লাবিত হয়েছে। বাড়ছে নদী ভাঙন। এছাড়া সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধের ধসে যাওয়া অংশ পরিদর্শন করেছেন পানি সচিব। প্রতিনিধি ও জেলা বার্তা পরিবেশকের পাঠানো খবরে এ তথ্য জানা গেছে।

লালমনিরহাট : কয়েকদিনের ভারি বর্ষণ আর উজানের পাহাড়ি ঢলে তিস্তার পানি কিছুটা বেড়েছে। পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভাঙনের মুখে পড়েছে লালমনিরহাটের মহিষখোচার সলেডি স্প্যার বাঁধ-২ ও শতশত ঘরবাড়ি। এছাড়া তিস্তার উপকূলে দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় তিস্তার ভাঙনে ২৭টি ঘরবাড়ি বিলীন হয়েছে। তিস্তার উপকূলের ২৪টি পয়েন্টে দেখা দিয়েছে ভাঙন। ফলে বন্যা আসার আগেই তিস্তাপাড়ে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক।

পাউবো আরও জানায়, পানি বৃদ্ধির ফলে গত ২৪ ঘণ্টায় শুধুমাত্র আদিতমারির মহিষখোচা এলাকার সলেডি স্প্যার-২ এ ভাঙন দেখা দিয়েছে। সেই সঙ্গে উজানের চৌরাহা মাদ্রাসা এলাকায় ১৩টি বসতভিটা ও কয়েক একর ফসলি জমি বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের মুখে পড়েছে শতশত বসতবাড়ি। ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তরা খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এছাড়া সদর উপজেলার চর গোকুন্ডায় ভাঙন শুরু হয়েছে।

গতকাল দুপুরে ধসে যাওয়া স্প্যার বাঁধ-২ এবং নদী ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন জেলা প্রশাসক আবু জাফর। পরিদর্শন শেষে জেলা প্রশাসক আবু জাফর বলেন, স্প্যার বাঁধ রক্ষায় প্রয়োজনীয় জিও ব্যাগ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে জমা রয়েছে। জরুরি প্রয়োজন দেখা দিলেই ব্যবস্থা নিতে তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বর্ষাকাল নদীপাড়ের জেলা হিসেবে আমাদের বন্যা মোকাবিলা করতে হবে। বন্যা মোকাবিলায় আমরা প্রস্তুত রয়েছি। ভাঙনের মুখে পড়া বসতবাড়ি রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে নদীপাড়ের তথ্য সার্বক্ষণিক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হচ্ছে।

স্থানীয়রা জানান, কয়েক দিনের ভারি বর্ষণ ও উজানের পাহাড়ি ঢলে কয়েক দিন ধরে তিস্তার পানি প্রবাহ বেড়ে যায়। জন্মলগ্ন থেকে খনন না করায় পলি ও বালু জমে তিস্তা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। ফলে সামান্য পানি বাড়লে তিস্তা নদীর দুই কূল উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। এতে তিস্তার তীরবর্তী নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়ে বেশকিছু পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়ে।

চরাঞ্চলের সাজু মিয়া বলেন, প্রতিবছর তিস্তাপাড়ের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েন। কিন্তু সরকার তিস্তা পাড়ে বাঁধ নির্মাণ করার কোন চিন্তা করে না। আসছে আবারও বন্যা, এই বন্যায় তিস্তা ও ধরলা পাড়ের মানুষের যে কী হবে বলা মুশকিল হয়ে পড়েছে।

সদরের গোকুন্ডা ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা স্বপন বলেন, গত কয়েক দিনের ভারি বর্ষণে তার ইউনিয়নের ৪টি ওয়ার্ডের কয়েকশ’ পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিস্তায় দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙন।

গতকাল বিকেল ৩টায় দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প হাতীবান্ধা উপজেলার তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ৩৮ সেন্টিমিটার। যা স্বাভাবিকের (৫২ দশমিক ৬০ সেন্টিমিটার) চেয়ে ২২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সকাল ৯টায় পানি প্রবাহ ছিল ৫২ দশমিক ৪৫ সেন্টিমিটার। সামান্য পানি বৃদ্ধিতে তিস্তা নদীর বাম তীরের সলেডি স্প্যার বাঁধ-২ এবং শতশত বসত বাড়ি ভাঙনের মুখে পড়েছে।

লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, সলেডি স্প্যার-২ এ গতবছরের ক্ষতস্থানটি রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতন মহলে জানানো হয়েছে। যে কোন পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

তিস্তা ব্যারাজের পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রাশেদীন ইসলাম বলেন, তিস্তার পানি বিপদসীমার ২২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সকালের দিকে কিছুটা বাড়লেও দুপুরের পরে কমতে শুরু করে। তবে রাত পর্যন্ত পানি বাড়ার সম্ভবনা কম।

নেত্রকোনায় পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত, দুর্ভোগে মানুষ

নেত্রকোনা : ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে নেত্রকোনার সীমান্ত নদী সোমেশ^রীর পানি কিছুটা কমলেও অন্যসব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সেইসঙ্গেব জেলার কলমাকন্দা উপজেলার গোলাম খালি নদীর পানি বৃদ্ধিতে পোগলা ইউনিয়নের রানীগাও বাজার সংলগ্ন এলাকায় বাঁধের কিছু অংশ ভেঙে যাওয়ায় পানি ঢুকেছে লোকালয়ে।

এতে নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে চরম দুর্ভোগে দিন পাড় করছে এখানকার কয়েকশ’ পরিবার। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। অন্যদিকে জেলার খালিয়াজুরী-মোহনগঞ্জ-মদন হওরে দ্রুত পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় চরম দুশ্চিান্তায় দিন কাটছে হাওরবাসীর।

এছাড়া কলমাকান্দার উদাখালী, কংস, হাওরের ধনু ও নেত্রকোনা পৌর শহরের মগড়া নদীসহ প্রায় সবগুলো নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। তবে গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় জেলার নিম্নাঞ্চল থেকে পানি কিছুটা নামতে শুরু করেছে। কৃষি বিভাগ ও আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এ পর্যন্ত জেলায় ৮০.০৪ মিলিমিটার বৃষ্টপাত রেকর্ড করা হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এদিকে ভেঙে যাওয়া ডুবন্ত বাঁধটি মেরামতে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড বলে জানিয়েছেন নির্বাহী প্রকৌশলী মোহন লাল সৈতক।

কুড়িগ্রাম : টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে কুড়িগ্রামে বেশকিছু চরের নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বাড়ছে নদী ভাঙন। গতকাল বিকেলে তিস্তার পানি বিপদসীমার মাত্র ২৪ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

ধরলা ও তিস্তা অববাহিকার ৫০টি চরের নিচু এলাকা দু’দিন ধরে প্লাবিত রয়েছে। এসব এলাকার পাট, ভুট্টা, আউস ধান, বীজতলা ও সবজি খেত নিমজ্জিত হয়েছে। গ্রামীণ সড়ক ডুবে যাওয়ায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে যোগাযোগ। এছাড়া ধরলা নদী সদর উপজেলা হলোখানা, সারডোব ও ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের পাটেশ^রী এলাকাতে ভাঙন শুরু হয়েছে। তিস্তা নদী প্রবলভাবে ভাঙছে বজরা, হাতিয়া ও রাজারহাটের গাবুরহেলানে। অন্যদিকে বৃহ্মপূত্র নদ সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের নুরানী পাড়ায় ভাঙন আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।

ফুলবাড়ী উপজেলার ভাঙামোড় ইউপি চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান বাবু জানান, তার ইউনিয়নের রাঙামাটি ও খোঁচাবাড়ি গ্রাম দুটির বেশিরভাগ এলাকা প্লাবিত হওয়ায় ফসল নিমজ্জিত হওয়ার পাশাপাশি গ্রামীণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

যাত্রাপুর ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার এরশাদুল, আবুল হোসেন ও মমিনুল জানান, গত দুদিনের বৃষ্টিতে চর ফারাজিপাড়া গ্রামের নি¤œাঞ্চলে পানি প্রবেশ করছে। এরই সাথে ব্রহ্মপূত্রের শাখা ও দুধকুমর নদীর সংযোগস্থলে ভাঙন শুরু হয়েছে।

সদর উপজেলার হলোখানা ইউপি সদস্য মোক্তার হোসেন জানান, তার বাড়ির কাছে একটি রাস্তাসহ তিনটি রাস্তা বন্যার পানিতে ভেঙে গেছে। ফলে যাতায়াতের দুর্ভোগে পড়েছে মানুষ। তিনি আরও জানান, সারডোবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৬০ মিটার অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। গত ৩ দিনে এখানে ২০টি পরিবার ভিটা হারিয়েছে। বিকল্প বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে ১৫টি গ্রাম।

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম জানান, মধ্য জুলাইয়ের আগে বড় বন্যার আশঙ্কা নেই। যেসব এলাকায় নদী ভাঙন চলছে তা চিহ্নিত করে জিও ব্যাগ ও জিও টিউব ফেলে ভাঙন প্রতিরোধের চেষ্টা করা হচ্ছে।

জেলা বার্তা পরিবেশক, সিরাজগঞ্জ

সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধ (হার্ড পয়েন্টের পুরাতন জেলখানা ঘাট) এলাকায় ধসে যাওয়া স্থান পরিদর্শন করেছেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার। গতকাল দুপুরে তিনি ধসে যাওয়া স্থানসহ পুরো বাঁধ এলাকা ঘুরে দেখেন। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক ড. ফারুক আহম্মেদ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকতাসহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকতা-কর্মচারীরা।

পরিদর্শনের সময় পানিসম্পদ সচিব বাধের ধসে যাওয়া স্থানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকা- দেখেন। এ সময় তিনি বলেন, সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধে ধস নিয়ে শহরবাসীর আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ড ঘটনার পরপরই দিনরাত সেখানে জিও ব্যাগ, সিসি ব্লক ফেলে ভাঙন নিয়ন্ত্রণে এনেছে। এখনও ভাঙন স্থানে কাজ করা হচ্ছে।

উল্লেখ্য, গত মঙ্গলবার দুপুরে সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধের হার্ট পয়েন্ট জেলখানা ঘাটে হঠাৎ ১০০ মিটার বাঁধ ধসে যায়। সিরাজগঞ্জ শহরকে যমুনা নদীর ভাঙন থেকে রক্ষায় বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু প্রকল্পের আওতায় ১৯৯৮ সালে আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ এই বাঁধটি নির্মাণ করা হয়। ৩৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হুন্দাই লিমিটেড এই শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করে।

শনিবার, ০৩ জুলাই ২০২১ , ১৯ আষাঢ় ১৪২৮ ২১ জিলক্বদ ১৪৪২

বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ডুবছে বহু গ্রাম

সংবাদ ডেস্ক

image

কুড়িগ্রাম : টানা বৃষ্টির কারণে জেলার বেশ কিছু নিচু চর এলাকা প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি ভাঙন দেখা দিয়েছে। সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের সারডোব এলাকা থেকে তোলা ছবি -সংবাদ

=ভারি বর্ষণ ও উজান ঢলে নদ-নদীর পানি বেড়ে তলিয়ে যাচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। তিস্তার পানি বৃদ্ধিতে লালমনিরহাটে বাঁধে ধস ও উপকূলে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। একই কারণে নেত্রকোনার বাঁধ ভেঙে নিম্নাঞ্চল ডুবে গেছে। টানা বৃষ্টি ও উজান স্রোতে কুড়িগ্রামের নিম্নাঞ্চলও প্লাবিত হয়েছে। বাড়ছে নদী ভাঙন। এছাড়া সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধের ধসে যাওয়া অংশ পরিদর্শন করেছেন পানি সচিব। প্রতিনিধি ও জেলা বার্তা পরিবেশকের পাঠানো খবরে এ তথ্য জানা গেছে।

লালমনিরহাট : কয়েকদিনের ভারি বর্ষণ আর উজানের পাহাড়ি ঢলে তিস্তার পানি কিছুটা বেড়েছে। পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভাঙনের মুখে পড়েছে লালমনিরহাটের মহিষখোচার সলেডি স্প্যার বাঁধ-২ ও শতশত ঘরবাড়ি। এছাড়া তিস্তার উপকূলে দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় তিস্তার ভাঙনে ২৭টি ঘরবাড়ি বিলীন হয়েছে। তিস্তার উপকূলের ২৪টি পয়েন্টে দেখা দিয়েছে ভাঙন। ফলে বন্যা আসার আগেই তিস্তাপাড়ে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক।

পাউবো আরও জানায়, পানি বৃদ্ধির ফলে গত ২৪ ঘণ্টায় শুধুমাত্র আদিতমারির মহিষখোচা এলাকার সলেডি স্প্যার-২ এ ভাঙন দেখা দিয়েছে। সেই সঙ্গে উজানের চৌরাহা মাদ্রাসা এলাকায় ১৩টি বসতভিটা ও কয়েক একর ফসলি জমি বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের মুখে পড়েছে শতশত বসতবাড়ি। ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তরা খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এছাড়া সদর উপজেলার চর গোকুন্ডায় ভাঙন শুরু হয়েছে।

গতকাল দুপুরে ধসে যাওয়া স্প্যার বাঁধ-২ এবং নদী ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন জেলা প্রশাসক আবু জাফর। পরিদর্শন শেষে জেলা প্রশাসক আবু জাফর বলেন, স্প্যার বাঁধ রক্ষায় প্রয়োজনীয় জিও ব্যাগ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে জমা রয়েছে। জরুরি প্রয়োজন দেখা দিলেই ব্যবস্থা নিতে তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বর্ষাকাল নদীপাড়ের জেলা হিসেবে আমাদের বন্যা মোকাবিলা করতে হবে। বন্যা মোকাবিলায় আমরা প্রস্তুত রয়েছি। ভাঙনের মুখে পড়া বসতবাড়ি রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে নদীপাড়ের তথ্য সার্বক্ষণিক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হচ্ছে।

স্থানীয়রা জানান, কয়েক দিনের ভারি বর্ষণ ও উজানের পাহাড়ি ঢলে কয়েক দিন ধরে তিস্তার পানি প্রবাহ বেড়ে যায়। জন্মলগ্ন থেকে খনন না করায় পলি ও বালু জমে তিস্তা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। ফলে সামান্য পানি বাড়লে তিস্তা নদীর দুই কূল উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। এতে তিস্তার তীরবর্তী নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়ে বেশকিছু পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়ে।

চরাঞ্চলের সাজু মিয়া বলেন, প্রতিবছর তিস্তাপাড়ের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েন। কিন্তু সরকার তিস্তা পাড়ে বাঁধ নির্মাণ করার কোন চিন্তা করে না। আসছে আবারও বন্যা, এই বন্যায় তিস্তা ও ধরলা পাড়ের মানুষের যে কী হবে বলা মুশকিল হয়ে পড়েছে।

সদরের গোকুন্ডা ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা স্বপন বলেন, গত কয়েক দিনের ভারি বর্ষণে তার ইউনিয়নের ৪টি ওয়ার্ডের কয়েকশ’ পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিস্তায় দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙন।

গতকাল বিকেল ৩টায় দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প হাতীবান্ধা উপজেলার তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ৩৮ সেন্টিমিটার। যা স্বাভাবিকের (৫২ দশমিক ৬০ সেন্টিমিটার) চেয়ে ২২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সকাল ৯টায় পানি প্রবাহ ছিল ৫২ দশমিক ৪৫ সেন্টিমিটার। সামান্য পানি বৃদ্ধিতে তিস্তা নদীর বাম তীরের সলেডি স্প্যার বাঁধ-২ এবং শতশত বসত বাড়ি ভাঙনের মুখে পড়েছে।

লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, সলেডি স্প্যার-২ এ গতবছরের ক্ষতস্থানটি রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতন মহলে জানানো হয়েছে। যে কোন পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

তিস্তা ব্যারাজের পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রাশেদীন ইসলাম বলেন, তিস্তার পানি বিপদসীমার ২২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সকালের দিকে কিছুটা বাড়লেও দুপুরের পরে কমতে শুরু করে। তবে রাত পর্যন্ত পানি বাড়ার সম্ভবনা কম।

নেত্রকোনায় পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত, দুর্ভোগে মানুষ

নেত্রকোনা : ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে নেত্রকোনার সীমান্ত নদী সোমেশ^রীর পানি কিছুটা কমলেও অন্যসব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সেইসঙ্গেব জেলার কলমাকন্দা উপজেলার গোলাম খালি নদীর পানি বৃদ্ধিতে পোগলা ইউনিয়নের রানীগাও বাজার সংলগ্ন এলাকায় বাঁধের কিছু অংশ ভেঙে যাওয়ায় পানি ঢুকেছে লোকালয়ে।

এতে নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে চরম দুর্ভোগে দিন পাড় করছে এখানকার কয়েকশ’ পরিবার। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। অন্যদিকে জেলার খালিয়াজুরী-মোহনগঞ্জ-মদন হওরে দ্রুত পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় চরম দুশ্চিান্তায় দিন কাটছে হাওরবাসীর।

এছাড়া কলমাকান্দার উদাখালী, কংস, হাওরের ধনু ও নেত্রকোনা পৌর শহরের মগড়া নদীসহ প্রায় সবগুলো নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। তবে গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় জেলার নিম্নাঞ্চল থেকে পানি কিছুটা নামতে শুরু করেছে। কৃষি বিভাগ ও আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এ পর্যন্ত জেলায় ৮০.০৪ মিলিমিটার বৃষ্টপাত রেকর্ড করা হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এদিকে ভেঙে যাওয়া ডুবন্ত বাঁধটি মেরামতে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড বলে জানিয়েছেন নির্বাহী প্রকৌশলী মোহন লাল সৈতক।

কুড়িগ্রাম : টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে কুড়িগ্রামে বেশকিছু চরের নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বাড়ছে নদী ভাঙন। গতকাল বিকেলে তিস্তার পানি বিপদসীমার মাত্র ২৪ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

ধরলা ও তিস্তা অববাহিকার ৫০টি চরের নিচু এলাকা দু’দিন ধরে প্লাবিত রয়েছে। এসব এলাকার পাট, ভুট্টা, আউস ধান, বীজতলা ও সবজি খেত নিমজ্জিত হয়েছে। গ্রামীণ সড়ক ডুবে যাওয়ায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে যোগাযোগ। এছাড়া ধরলা নদী সদর উপজেলা হলোখানা, সারডোব ও ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের পাটেশ^রী এলাকাতে ভাঙন শুরু হয়েছে। তিস্তা নদী প্রবলভাবে ভাঙছে বজরা, হাতিয়া ও রাজারহাটের গাবুরহেলানে। অন্যদিকে বৃহ্মপূত্র নদ সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের নুরানী পাড়ায় ভাঙন আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।

ফুলবাড়ী উপজেলার ভাঙামোড় ইউপি চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান বাবু জানান, তার ইউনিয়নের রাঙামাটি ও খোঁচাবাড়ি গ্রাম দুটির বেশিরভাগ এলাকা প্লাবিত হওয়ায় ফসল নিমজ্জিত হওয়ার পাশাপাশি গ্রামীণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

যাত্রাপুর ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার এরশাদুল, আবুল হোসেন ও মমিনুল জানান, গত দুদিনের বৃষ্টিতে চর ফারাজিপাড়া গ্রামের নি¤œাঞ্চলে পানি প্রবেশ করছে। এরই সাথে ব্রহ্মপূত্রের শাখা ও দুধকুমর নদীর সংযোগস্থলে ভাঙন শুরু হয়েছে।

সদর উপজেলার হলোখানা ইউপি সদস্য মোক্তার হোসেন জানান, তার বাড়ির কাছে একটি রাস্তাসহ তিনটি রাস্তা বন্যার পানিতে ভেঙে গেছে। ফলে যাতায়াতের দুর্ভোগে পড়েছে মানুষ। তিনি আরও জানান, সারডোবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৬০ মিটার অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। গত ৩ দিনে এখানে ২০টি পরিবার ভিটা হারিয়েছে। বিকল্প বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে ১৫টি গ্রাম।

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম জানান, মধ্য জুলাইয়ের আগে বড় বন্যার আশঙ্কা নেই। যেসব এলাকায় নদী ভাঙন চলছে তা চিহ্নিত করে জিও ব্যাগ ও জিও টিউব ফেলে ভাঙন প্রতিরোধের চেষ্টা করা হচ্ছে।

জেলা বার্তা পরিবেশক, সিরাজগঞ্জ

সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধ (হার্ড পয়েন্টের পুরাতন জেলখানা ঘাট) এলাকায় ধসে যাওয়া স্থান পরিদর্শন করেছেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার। গতকাল দুপুরে তিনি ধসে যাওয়া স্থানসহ পুরো বাঁধ এলাকা ঘুরে দেখেন। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক ড. ফারুক আহম্মেদ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকতাসহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকতা-কর্মচারীরা।

পরিদর্শনের সময় পানিসম্পদ সচিব বাধের ধসে যাওয়া স্থানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকা- দেখেন। এ সময় তিনি বলেন, সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধে ধস নিয়ে শহরবাসীর আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ড ঘটনার পরপরই দিনরাত সেখানে জিও ব্যাগ, সিসি ব্লক ফেলে ভাঙন নিয়ন্ত্রণে এনেছে। এখনও ভাঙন স্থানে কাজ করা হচ্ছে।

উল্লেখ্য, গত মঙ্গলবার দুপুরে সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধের হার্ট পয়েন্ট জেলখানা ঘাটে হঠাৎ ১০০ মিটার বাঁধ ধসে যায়। সিরাজগঞ্জ শহরকে যমুনা নদীর ভাঙন থেকে রক্ষায় বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু প্রকল্পের আওতায় ১৯৯৮ সালে আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ এই বাঁধটি নির্মাণ করা হয়। ৩৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হুন্দাই লিমিটেড এই শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করে।