আমের দরপতন, বরেন্দ্র অঞ্চলে ৫০০ কোটি টাকা ঘাটতির শঙ্কা­

রাজশাহীর সবচেয়ে বড় আমের হাট বানেশ্বর। জেলার হাটটিতে এবার সেই চিরচেনা কোলাহল নেই। হাসি আনন্দে মাতোয়ারা থাকত ব্যবসায়ীরা, কিন্তু এবার আম বাগানি ও ব্যবসায়ীদের মুখে হাসি নেই। তাদের থেকে শুধুই হতাশার গল্প শোনা যাচ্ছে। কেউ বলছেন এ বছরের লোনের টাকা শোধ করতে পারব না। আবার কেউ মাথায় হাত দিয়ে বলছেন এবার কর্মচারীদের মজুরি দিতে পারবো না। হাটে সারি সারি ভ্যানে আম নিয়ে বসে আছে চাষি ও ব্যবসায়ীরা।

করোনায় এবারও মাথায় হাত পড়েছে রাজশাহী অঞ্চলের আম চাষি ও ব্যবসায়ীদের। বাজারে এখন বিক্রি হওয়া আমের যেন ক্রেতা খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। আবার এই সময়ের সর্বোচ্চ আকষণীয় আম্রপালিরও চাহিদা কম। ল্যাংড়া বিক্রি হচ্ছে পানির দামে। আমের ইতিহাসে সর্বনিম্ন দামে বিক্রি হচ্ছে এবার এমনটিই বলেছেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা।

তারা এও বলছেন, আমের এমন দরপতন কখনও দেখেননি তারা। এর আগে কখনওই আমের শেষ সময়ে এসে দাম কমেনি। বরং দিনের পর দিন দাম বেড়েছে। প্রতিটি জাতের আমের শেষদিকে গিয়ে সেটি আকাশচুম্বি হয়েছে। ফজলি, গোপাল ভোগ, ল্যাংড়া, হিমসাগর থেকে শুরু করে নানা জাতের আমগুলোর দাম শেষদিকে গিয়ে ৪-৫ হাজার টাকা মণ পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে। কিন্তু এখন কোন ব্যাপারীও নেই এই আম কেনার ।

আম বাগানীরা বলছেন, ল্যাংড়া শেষের দিকে। আম্রপালি ও ফজলি উঠছে। আশ্বিনা ও বারি-৪ মাত্র পরিপক্ব হচ্ছে। এমন অবস্থায় সারাদেশে ঘোষিত লকডাউন আর ঈদের ছুটি আম ব্যবসায়ীদের দুঃচিন্তার শেষ নেই ।

এদিকে রাজশাহীতে বিক্রির অপেক্ষায় ল্যাংড়া, আম্রপালি, ফজলির মত ৪০ ভাগ আম এখনও গাছে। করোনা প্রকোপ কমাতে গত বৃহস্পতিবার থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে কঠোর লকডাউনের। আম বাণিজ্য সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মৌসুমের শুরু থেকেই বাজার নি¤œমুখী। লকডাউনে আম ব্যবসা নিয়ে দুঃচিন্তার শেষ নেই তাদের। ব্যবসায়ীরা আরও বলছেন, লকডাউনে ঘরবন্দী থাকে বেশিরভাগ ভোক্তারা। সে কারণে বিশেষ ব্যবস্থায় বাজার কিম্বা আম পরিবহন চালু থাকলেও তাতে খুব বেশি সুবিধা হয় না। কৃষি বিভাগ ও ফল গবেষকরা বলছেন, এখনও বাগানে ৪০ ভাগ আম। সরকার নিশ্চয় এ বিক্রিতে উদ্যোগী হবেন। রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আলীম উদ্দীন জানান, এখনও বাগানে প্রায় ৪০ ভাগ আম রয়েছে। অনেক আম গাছে পেকে যাচ্ছে। লকডাউন হওয়ায় গাছে পাকলেও চাষিরা লকডাউনের পরে আম নামাবেন। এতে তো কিছুটা ক্ষতি হবেই। কিন্তু জাতীয় স্বার্থে আমাদের তা মেনে নিতে হবে। এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে দেড় হাজার কোটি টাকার আম উৎপাদন হলেও এক হাজার কোটি টাকা আসতে পারে। করোনায় লকডাউন পরিস্থিতির কারণে বাইরের আম চাষিরা আসতে পারেনি, যার কারণে অন্তত ৫০০ কোটি টাকা ঘাটতি থেকেই যাবে।

বলছিলেন বাংলাদেশ ম্যাংগো প্রডিউসার মার্চেট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুল ওয়াহেদ। তিনি আরও বলেন, সরকার যদি বাগান মালিক আর আম ব্যবসায়ীদের বিকল্প কোন ব্যবস্থা না করতে পারে তাহলে লোকসানের কারণে আম চাষিদের দুঃখের শেষ থাকবে না। আম চাষে বিমুখ হবেন তারা। শিবগঞ্জর কালুপুর

এলাকার মুনিরুল ইসলামের কেনা আছে ১২টি আমের বাগান।

তিনি হতাশা নিয়ে বললেন, এবার আমের দাম না থাকার কারণে খুব হতাশায় ভুগছি। কিন্তু এবার আমের যে দাম কী করব? এখন অনিশ্চয়তায় ভুগছি। তিনি বলেন, আমের মৌসুমের প্রথম থেকেই আমার বাগানে নিয়মিত ১৫ জন কর্মচারী কাজ করছে। তাদের দৈনিক মজুরি ৪০০-৪৫০ টাকা। গত বছরের আমের মৌসুমে তাদের প্রতিদিনের মজুরি সন্ধ্যা হলেই দিয়ে দিতাম।

কিন্তু এ বছর আমের দরের অবস্থা খারাপের কারণে তাদের সম্পূর্ণ মজুরি বুঝিয়ে দিতে পারিনি। নিজের কাছেই খারাপ লাগছে।

তিনি বলেন, প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ মণ আম পেরে বাজারে নিয়ে আসি। যাতায়াত খরচ, কর্মচারীর মজুরি আর দুই বেলার হোটেলে খাবার খেলেই সব টাকা শেষ। তিনি জানান, বর্তমান বাজারে ফজলি আমের মণ ২০০-৪০০ টাকা, বোম্বাই আমের মণ ৪০০-৬০০ টাকা, ক্ষিরশাপাত আমের মণ ১৪০০ থেকে ২০০০ টাকা, আম্রপালি রকম ভেদে ১৫০০ টাকা থেকে ২২০০ টাকা, ল্যাংড়া আমের মণ রকমভেদে ১১০০-১৫০০ টাকা, লক্ষণভোগ আমের মণ ৪০০-৬০০ টাকা এবং গুটি জাতের আম ২০০-৪০০ টাকা। আমের আড়তদার জাকির হোসেন বলেন, করোনায় আমের বাজারে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। যদি এমন চলতে থাকে তাহলে আমের বাজারে আর আম নাও নামতে পারে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নজরুল ইসলাম বলেন, এ বছর জেলায় আমবাগানের পরিমাণ ৩৪ হাজার ৭৩৮ হেক্টর। আম গাছের সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ। গত বছরের চেয়ে এবার জেলায় ৩ হাজার ৩৬০ হেক্টর বেশি জমিতে আমের আবাদ হয়েছে। এ আমের মৌসুমে আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল আড়াই লাখ মে.টন, তবে এবার রেকর্ড ছাড়িয়ে প্রায় ৩ লাখ মে.টন আম উৎপাদন হয়েছে।

শনিবার, ০৩ জুলাই ২০২১ , ১৯ আষাঢ় ১৪২৮ ২১ জিলক্বদ ১৪৪২

আমের দরপতন, বরেন্দ্র অঞ্চলে ৫০০ কোটি টাকা ঘাটতির শঙ্কা­

জেলা বার্তা পরিবেশক, রাজশাহী

image

রাজশাহীর সবচেয়ে বড় আমের হাট বানেশ্বর। জেলার হাটটিতে এবার সেই চিরচেনা কোলাহল নেই। হাসি আনন্দে মাতোয়ারা থাকত ব্যবসায়ীরা, কিন্তু এবার আম বাগানি ও ব্যবসায়ীদের মুখে হাসি নেই। তাদের থেকে শুধুই হতাশার গল্প শোনা যাচ্ছে। কেউ বলছেন এ বছরের লোনের টাকা শোধ করতে পারব না। আবার কেউ মাথায় হাত দিয়ে বলছেন এবার কর্মচারীদের মজুরি দিতে পারবো না। হাটে সারি সারি ভ্যানে আম নিয়ে বসে আছে চাষি ও ব্যবসায়ীরা।

করোনায় এবারও মাথায় হাত পড়েছে রাজশাহী অঞ্চলের আম চাষি ও ব্যবসায়ীদের। বাজারে এখন বিক্রি হওয়া আমের যেন ক্রেতা খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। আবার এই সময়ের সর্বোচ্চ আকষণীয় আম্রপালিরও চাহিদা কম। ল্যাংড়া বিক্রি হচ্ছে পানির দামে। আমের ইতিহাসে সর্বনিম্ন দামে বিক্রি হচ্ছে এবার এমনটিই বলেছেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা।

তারা এও বলছেন, আমের এমন দরপতন কখনও দেখেননি তারা। এর আগে কখনওই আমের শেষ সময়ে এসে দাম কমেনি। বরং দিনের পর দিন দাম বেড়েছে। প্রতিটি জাতের আমের শেষদিকে গিয়ে সেটি আকাশচুম্বি হয়েছে। ফজলি, গোপাল ভোগ, ল্যাংড়া, হিমসাগর থেকে শুরু করে নানা জাতের আমগুলোর দাম শেষদিকে গিয়ে ৪-৫ হাজার টাকা মণ পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে। কিন্তু এখন কোন ব্যাপারীও নেই এই আম কেনার ।

আম বাগানীরা বলছেন, ল্যাংড়া শেষের দিকে। আম্রপালি ও ফজলি উঠছে। আশ্বিনা ও বারি-৪ মাত্র পরিপক্ব হচ্ছে। এমন অবস্থায় সারাদেশে ঘোষিত লকডাউন আর ঈদের ছুটি আম ব্যবসায়ীদের দুঃচিন্তার শেষ নেই ।

এদিকে রাজশাহীতে বিক্রির অপেক্ষায় ল্যাংড়া, আম্রপালি, ফজলির মত ৪০ ভাগ আম এখনও গাছে। করোনা প্রকোপ কমাতে গত বৃহস্পতিবার থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে কঠোর লকডাউনের। আম বাণিজ্য সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মৌসুমের শুরু থেকেই বাজার নি¤œমুখী। লকডাউনে আম ব্যবসা নিয়ে দুঃচিন্তার শেষ নেই তাদের। ব্যবসায়ীরা আরও বলছেন, লকডাউনে ঘরবন্দী থাকে বেশিরভাগ ভোক্তারা। সে কারণে বিশেষ ব্যবস্থায় বাজার কিম্বা আম পরিবহন চালু থাকলেও তাতে খুব বেশি সুবিধা হয় না। কৃষি বিভাগ ও ফল গবেষকরা বলছেন, এখনও বাগানে ৪০ ভাগ আম। সরকার নিশ্চয় এ বিক্রিতে উদ্যোগী হবেন। রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আলীম উদ্দীন জানান, এখনও বাগানে প্রায় ৪০ ভাগ আম রয়েছে। অনেক আম গাছে পেকে যাচ্ছে। লকডাউন হওয়ায় গাছে পাকলেও চাষিরা লকডাউনের পরে আম নামাবেন। এতে তো কিছুটা ক্ষতি হবেই। কিন্তু জাতীয় স্বার্থে আমাদের তা মেনে নিতে হবে। এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে দেড় হাজার কোটি টাকার আম উৎপাদন হলেও এক হাজার কোটি টাকা আসতে পারে। করোনায় লকডাউন পরিস্থিতির কারণে বাইরের আম চাষিরা আসতে পারেনি, যার কারণে অন্তত ৫০০ কোটি টাকা ঘাটতি থেকেই যাবে।

বলছিলেন বাংলাদেশ ম্যাংগো প্রডিউসার মার্চেট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুল ওয়াহেদ। তিনি আরও বলেন, সরকার যদি বাগান মালিক আর আম ব্যবসায়ীদের বিকল্প কোন ব্যবস্থা না করতে পারে তাহলে লোকসানের কারণে আম চাষিদের দুঃখের শেষ থাকবে না। আম চাষে বিমুখ হবেন তারা। শিবগঞ্জর কালুপুর

এলাকার মুনিরুল ইসলামের কেনা আছে ১২টি আমের বাগান।

তিনি হতাশা নিয়ে বললেন, এবার আমের দাম না থাকার কারণে খুব হতাশায় ভুগছি। কিন্তু এবার আমের যে দাম কী করব? এখন অনিশ্চয়তায় ভুগছি। তিনি বলেন, আমের মৌসুমের প্রথম থেকেই আমার বাগানে নিয়মিত ১৫ জন কর্মচারী কাজ করছে। তাদের দৈনিক মজুরি ৪০০-৪৫০ টাকা। গত বছরের আমের মৌসুমে তাদের প্রতিদিনের মজুরি সন্ধ্যা হলেই দিয়ে দিতাম।

কিন্তু এ বছর আমের দরের অবস্থা খারাপের কারণে তাদের সম্পূর্ণ মজুরি বুঝিয়ে দিতে পারিনি। নিজের কাছেই খারাপ লাগছে।

তিনি বলেন, প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ মণ আম পেরে বাজারে নিয়ে আসি। যাতায়াত খরচ, কর্মচারীর মজুরি আর দুই বেলার হোটেলে খাবার খেলেই সব টাকা শেষ। তিনি জানান, বর্তমান বাজারে ফজলি আমের মণ ২০০-৪০০ টাকা, বোম্বাই আমের মণ ৪০০-৬০০ টাকা, ক্ষিরশাপাত আমের মণ ১৪০০ থেকে ২০০০ টাকা, আম্রপালি রকম ভেদে ১৫০০ টাকা থেকে ২২০০ টাকা, ল্যাংড়া আমের মণ রকমভেদে ১১০০-১৫০০ টাকা, লক্ষণভোগ আমের মণ ৪০০-৬০০ টাকা এবং গুটি জাতের আম ২০০-৪০০ টাকা। আমের আড়তদার জাকির হোসেন বলেন, করোনায় আমের বাজারে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। যদি এমন চলতে থাকে তাহলে আমের বাজারে আর আম নাও নামতে পারে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নজরুল ইসলাম বলেন, এ বছর জেলায় আমবাগানের পরিমাণ ৩৪ হাজার ৭৩৮ হেক্টর। আম গাছের সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ। গত বছরের চেয়ে এবার জেলায় ৩ হাজার ৩৬০ হেক্টর বেশি জমিতে আমের আবাদ হয়েছে। এ আমের মৌসুমে আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল আড়াই লাখ মে.টন, তবে এবার রেকর্ড ছাড়িয়ে প্রায় ৩ লাখ মে.টন আম উৎপাদন হয়েছে।