পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা

মোহাম্মদ আতিকুজ্জামান

কথায় আছে- স্বাস্থ্যই সম্পদ। বলা হয়- স্বাস্থ্যই সুখ। ২০২০-এর বিশ্ব বিষময় হয়ে একুশে এসে হলো হুশময়। আদিকাল থেকেই মানুষ প্রকৃতির বিরূপ আচরণের মোকাবিলায় বিজ্ঞানের সব কলাকৌশলে বিচরণ করে আসছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আবিষ্কার করছে বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক টিকা বা ভ্যাকসিন।

রোগ মূলত দু ধরনের। সংক্রামক রোগ এবং অসংক্রামক রোগ। সংক্রামক রোগ জীবাণু ঘটিত অর্থাৎ জীবাণু দ্বারা সৃষ্ট এবং এক জীব থেকে অন্য জীবে সংক্রমিত হয়। সংক্রামক রোগ বায়ুবাহিত, পানিবাহিত এবং তা একদেহ আরেক দেহে সংক্রমিত হতে পারে। বায়ুবাহিত সংক্রামক রোগসমূহ সাধারণভাবে ‘ফ্লো’ হিসেবে পরিচিত। এগুলো সবই ভাইরাসের মাধ্যমে ঘটে। পানিবাহিত সংক্রামক রোগ বেশিরভাগই ব্যাকটেরিয়া দ্বারা হয়ে থাকে। তবে এসব ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া জলেস্থলে সর্বত্রই বিরাজ করে থাকে। এ ছাড়া ফাঙ্গাস, বিভিন্ন পরজীবীর মাধ্যমেও সংক্রামক রোগ ঘটে খাকে। এ সব ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস, পরজীবী পরিবেশের এক উপাদান খেকে অন্য উপাদানে, এক জীব থেকে অন্য জীবে সংক্রামিত হয় এবং দ্রত বংশবিস্তার করে জীবদেহকে অসার করে ফেলে। অপরদিকে অসংক্রামক রোগ হলো শরীরের বিভিন্ন ব্যাধি, যা বংশগত বা ব্যক্তিগত খাদ্যাভ্যাস বা নিয়মশৃঙ্খলার ত্রুটির কারণে ঘটে খাকে। যেমন ডায়েবেটিকস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি।

সংক্রামক রোগের চিকিৎসায় জীবাণুকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে ওষুধ সেবন করা হয় এবং প্রতিরোধের জন্য টিকা বা ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়। আর অন্যদিকে অসংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে কিছু ওষুধের পাশাপাশি ব্যক্তির খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মশৃঙ্খলাকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। তবে দুই ক্ষেত্রেই শরীর তার নিজস্ব ইমিউনিটি বা প্রতিরোধ ক্ষমতা দিয়ে রোগ মোকাবিলা করে খাকে। আর এই ইমিউনিটির প্রধান ভিত্তি হচ্ছে- খাদ্য ও পুষ্টি। অর্থাৎ প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পুষ্টি উপাদান শরীরের বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কার্যাবালির মাধ্যমে শরীরকে কর্মক্ষম করে তোলে এবং শরীরে ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে।

বর্তমান বিশ্বের মহামারি করোনাভাইরাস একটি সংক্রামক রোগ। অর্থাৎ এটি পরিবেশের এক জীব থেকে অন্য জীবে সংক্রামিত হয়। সংক্রামক জীবাণু হিসেবে ভাইরাস অন্যান্য জীবাণু থেকে ভিন্নধর্মী। মূলত ভাইরাস জীবদেহের বাইরে একটি প্রাণহীন জড় বস্তু। শুধু পোশাকের দেহে প্রবেশ করলেই এরা প্রাণ পায় এবং দ্রুত বংশবিস্তার করে। এক জীব থেকে অন্যজীবে প্রবেশের কথাটিই সংক্রমণ। এখানে অতি নিকট (৩ ফুট দূরত্বে) অবস্থানেই এই অনুপ্রবেশের ঘটনাটি ঘটে। এই তিন ফুট দূরত্ব অতিক্রমকালের সময়টুকুতে কভিডের প্রাণ থাকে। এই সময়কাল মাত্র ৯ সেকেন্ড।

করোনা ভাইরাস তার দেহ কাঠামো মুহূর্তেই পরিবর্তন করে ফেলে। ফলে এর এন্টি সিরাম বা ভেকসিন তৈরির কাজটি ছিল কঠিন। ইদানীং বিজ্ঞানীদের ধারণা চিকিৎসা কোন স্থায়ী সমাধান নয়। যে কোনো রোগের প্রতিষেধকের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। আর এই প্রতিরোধের কাজটির একমাত্র প্ল্যাটফরম শরীরের ‘ইমিউনিটি সিস্টেম’। এই ইমিউনিটি বা প্রতিরোধের শক্তিটি গড়ে উঠে কিছু খাদ্য ও পুষ্টি গ্রহণের মাধ্যমে। পুষ্টি হলো- খাদ্যের সেই সব উপাদান যা দ্বারা শরীরের গঠন, বৃদ্ধিসাধন, ক্ষয়পূরণ, আত্তীকরণসহ প্রয়োজানীয় শক্তি উৎপাদন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি হয়। মূলত: শরীরের শ্বেত রক্তকণিকা এবং দেহ কোষের লিম্ফেটিক সিস্টেম দেহের ভেতরে সব জীবাণুর বিরুদ্ধে মোকাবিলায় অংশ নেয় এবং জীবাণুকে প্রায়শ; ঘায়েল করে। এই মোকাবিলাটি শারীর বৃত্তীয় কার্যাবলির সঙ্গে যুক্ত যেখানে খাদ্যের ভিটামিন ও খনিজ সরাসরি জড়িত এবং এর সঙ্গে খাদ্যের প্রধান উপাদান প্রোটিন বা এমাইনো এসিড ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

মোটের ওপর শরীরের রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে যে সব পুষ্টি উপাদান ক্রিয়াশীল সে গুলো হলো -

এক : প্রোটিন বা এ্যামাইনো এসিড : দেহের সকল শারীরবৃত্তীয় কার্যাবলি হরমোনাল সিগন্যালে ক্রিয়াশীল হয়। অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধের জৈবিক ক্রিয়ায় হরমোন মুখ্য ভূমিকা পালন করে। আর এই হরমোন খাদ্যের প্রোটিন দিয়ে গঠিত। রক্তের হিমোগ্লোবিন যা অক্সিজেন পরিবহন করে সেই হিমোগ্লোবিন প্রোটিন দিয়ে তৈরি। মাছ, মাংস, দুধ, ডিম প্রাণিজ প্রোটিনের এই খাদ্য উপাদান হরমোনাল সিগন্যালে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে এবং রোগ প্রতিরোধকে বেগবান করে।

দুই : ভিটামিন এ : ফুসফুস, শ্বাসনালী, ত্বকের আবরণী কলা, ঝোজক কলার রক্ষাকবজ হলো ভিটামন-এ। করোনা যেখানে শ্বাসনালীর আবরণী কলা বা কোষে আক্রমণ করে সেখানে ভিটামিন-এ প্রতিরোধক। রঙ্গিন শাকসবজি, সামুদ্রিক মাছের তেল, যকৃত, দুধ, ডিম ভিটামিন-এ এর প্রধান খাদ্য উৎস্য।

তিন : ভিটামিন ডি : বোন মেরু বা অস্থিমজ্জার প্রধান উপাদান হলো ভিটামিন ডি যা রক্তের লোহিত কণিকা তৈরির স্থান। দেহের কোষে অক্সিজেনের একমাত্র বাহক রক্তের লোহিত কণিকা। তৈলাক্ত মাছ, দুধ, সূর্য়ের আলো ভিটামিন ডি এর প্রধান উৎস্য।

চার : ভিটামিন সি : বলা হয়ে থাকে রোগ প্রতিরোধের প্রধান হাতিয়ার ভিটামিন সি। ফুসফুস, শ্বাসনালীসহ দেহের সব ব্লাড ভেসেলের সুরক্ষার প্রধান নিয়ামক ভিটামিন সি। রক্তের হিমোগ্লোবিনে আয়রন সংঝোজন ও অন্ত্রের আয়রন পরিশোষণ দেহে বিভিন্ন কোষে অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করে ভিটামিন সি। জীবাণুকে গ্রাস করার কাজে শ্বেত রক্ত কণিকা ও লিম্ফনোটকে সরাসরি সহায়তা করে ভিটামিন সি। লেবু, পেয়ার, কমলা, আমলকি, টমেটো, কাঁচামরিচ ইত্যাদিতে ভরপুর ভিটামিন সি রয়েছে।

পাঁচ: ভিটামিন-ই : প্রধান এন্টি অক্সিডেন্ট। করোনার আক্রমণে রক্তের রোহিত কণিকা জারিত হয়ে ধ্বংস হয়। লোহিত রক্ত কণিকাকে জারণের হাত থেকে রক্ষা করে এই ভিটামিন-ই। হরমোনের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জীবাণুর বিরুদ্ধে দ্রুত সাড়া প্রদান করে। বীজ তেল ভিটামিন-ই এর উৎকৃষ্ট উৎস্য। বাদাম, ডিম, শাকেও ভিটামিন-ই পাওয়া যায়।

আয়রন বা লৌহ : ফুসফুস হতে বিভিন্ন কোষে অক্সিজেন পরিবহন করে হিমোগ্লোবিন। আর এই হিমোগ্লোবিন (হিম +গ্লোবিন) এর প্রধান একটি অংশ-হিম বা লৌহ। কলিজা, ডিমের কুসুম, মুরগির মাংস, ডাল, শাকপাতা লৌহের বিশেষ খাদ্য উৎস্য।

কপার : দেহের বিভিন্ন জারণ বিজারণে কো-এনজাইম হিসেবে কপার কাজ করে। আয়রন বিপাক ও পরিবহনে কপার সরাসরি জড়িত। কলিজা, ডিম, বাদাম, শামুকের মাংসে কপার পাওয়া যায়।

জিংক : শরীরের বিভিন্ন গ্রন্থিও গঠন, বৃদ্ধি, অন্ত্রের সুরক্ষায় জিংক আবশ্যক। করোনার আক্রমণে ফুসফুসের সঙ্গে পরিপাকতন্ত্রের শোষণ অঞ্চল ক্ষুদ্রান্ত ও বৃহাদ্রান্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জিংক অন্ত্রের সুরক্ষার প্রধান হাতিয়ার। জিংক বিভিন্ন হরমোনের বার্তাবাহনেও সহায়তা করে। মাছ, মাংস, কলিজা, ডিম জিংকের প্রধান খাদ্য উৎস্য।

শরীরের রোগ প্রতিরোধের এইসব খাদ্য ও পুষ্টি গ্রহণের পাশাপাশি বয়স ও ওজন অনুযায়ী অবশ্যই দৈনিক নির্ধারিত ক্যালরি গ্রহণ করতে হবে। পরিমিত হাঁটাচলা ও ব্যায়াম শরীরের রক্ত সঞ্চালনকে স্বাভাবিক রাখে। পর্যাপ্ত ঘুম এন্ডোক্রাইন গ্লান্ডগুলোকে চাপমুক্ত রাখে। ফলে শরীরের ইমিউন সিস্টেম হয় গতিশীল। সর্বোপরি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ইতিবাচক মন-মানসিকতা ও বিজ্ঞানভিত্তিক জীবনযাপন করোনাকে প্রতিহত করে দেহমনকে আরও চাঙ্গা করতে পারে।

[লেখক : পুষ্টিবিদ, বেসরকারি সংস্থা

আরআরএফে কর্মরত]

শনিবার, ০৩ জুলাই ২০২১ , ১৯ আষাঢ় ১৪২৮ ২১ জিলক্বদ ১৪৪২

পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা

মোহাম্মদ আতিকুজ্জামান

কথায় আছে- স্বাস্থ্যই সম্পদ। বলা হয়- স্বাস্থ্যই সুখ। ২০২০-এর বিশ্ব বিষময় হয়ে একুশে এসে হলো হুশময়। আদিকাল থেকেই মানুষ প্রকৃতির বিরূপ আচরণের মোকাবিলায় বিজ্ঞানের সব কলাকৌশলে বিচরণ করে আসছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আবিষ্কার করছে বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক টিকা বা ভ্যাকসিন।

রোগ মূলত দু ধরনের। সংক্রামক রোগ এবং অসংক্রামক রোগ। সংক্রামক রোগ জীবাণু ঘটিত অর্থাৎ জীবাণু দ্বারা সৃষ্ট এবং এক জীব থেকে অন্য জীবে সংক্রমিত হয়। সংক্রামক রোগ বায়ুবাহিত, পানিবাহিত এবং তা একদেহ আরেক দেহে সংক্রমিত হতে পারে। বায়ুবাহিত সংক্রামক রোগসমূহ সাধারণভাবে ‘ফ্লো’ হিসেবে পরিচিত। এগুলো সবই ভাইরাসের মাধ্যমে ঘটে। পানিবাহিত সংক্রামক রোগ বেশিরভাগই ব্যাকটেরিয়া দ্বারা হয়ে থাকে। তবে এসব ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া জলেস্থলে সর্বত্রই বিরাজ করে থাকে। এ ছাড়া ফাঙ্গাস, বিভিন্ন পরজীবীর মাধ্যমেও সংক্রামক রোগ ঘটে খাকে। এ সব ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস, পরজীবী পরিবেশের এক উপাদান খেকে অন্য উপাদানে, এক জীব থেকে অন্য জীবে সংক্রামিত হয় এবং দ্রত বংশবিস্তার করে জীবদেহকে অসার করে ফেলে। অপরদিকে অসংক্রামক রোগ হলো শরীরের বিভিন্ন ব্যাধি, যা বংশগত বা ব্যক্তিগত খাদ্যাভ্যাস বা নিয়মশৃঙ্খলার ত্রুটির কারণে ঘটে খাকে। যেমন ডায়েবেটিকস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি।

সংক্রামক রোগের চিকিৎসায় জীবাণুকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে ওষুধ সেবন করা হয় এবং প্রতিরোধের জন্য টিকা বা ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়। আর অন্যদিকে অসংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে কিছু ওষুধের পাশাপাশি ব্যক্তির খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মশৃঙ্খলাকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। তবে দুই ক্ষেত্রেই শরীর তার নিজস্ব ইমিউনিটি বা প্রতিরোধ ক্ষমতা দিয়ে রোগ মোকাবিলা করে খাকে। আর এই ইমিউনিটির প্রধান ভিত্তি হচ্ছে- খাদ্য ও পুষ্টি। অর্থাৎ প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পুষ্টি উপাদান শরীরের বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কার্যাবালির মাধ্যমে শরীরকে কর্মক্ষম করে তোলে এবং শরীরে ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে।

বর্তমান বিশ্বের মহামারি করোনাভাইরাস একটি সংক্রামক রোগ। অর্থাৎ এটি পরিবেশের এক জীব থেকে অন্য জীবে সংক্রামিত হয়। সংক্রামক জীবাণু হিসেবে ভাইরাস অন্যান্য জীবাণু থেকে ভিন্নধর্মী। মূলত ভাইরাস জীবদেহের বাইরে একটি প্রাণহীন জড় বস্তু। শুধু পোশাকের দেহে প্রবেশ করলেই এরা প্রাণ পায় এবং দ্রুত বংশবিস্তার করে। এক জীব থেকে অন্যজীবে প্রবেশের কথাটিই সংক্রমণ। এখানে অতি নিকট (৩ ফুট দূরত্বে) অবস্থানেই এই অনুপ্রবেশের ঘটনাটি ঘটে। এই তিন ফুট দূরত্ব অতিক্রমকালের সময়টুকুতে কভিডের প্রাণ থাকে। এই সময়কাল মাত্র ৯ সেকেন্ড।

করোনা ভাইরাস তার দেহ কাঠামো মুহূর্তেই পরিবর্তন করে ফেলে। ফলে এর এন্টি সিরাম বা ভেকসিন তৈরির কাজটি ছিল কঠিন। ইদানীং বিজ্ঞানীদের ধারণা চিকিৎসা কোন স্থায়ী সমাধান নয়। যে কোনো রোগের প্রতিষেধকের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। আর এই প্রতিরোধের কাজটির একমাত্র প্ল্যাটফরম শরীরের ‘ইমিউনিটি সিস্টেম’। এই ইমিউনিটি বা প্রতিরোধের শক্তিটি গড়ে উঠে কিছু খাদ্য ও পুষ্টি গ্রহণের মাধ্যমে। পুষ্টি হলো- খাদ্যের সেই সব উপাদান যা দ্বারা শরীরের গঠন, বৃদ্ধিসাধন, ক্ষয়পূরণ, আত্তীকরণসহ প্রয়োজানীয় শক্তি উৎপাদন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি হয়। মূলত: শরীরের শ্বেত রক্তকণিকা এবং দেহ কোষের লিম্ফেটিক সিস্টেম দেহের ভেতরে সব জীবাণুর বিরুদ্ধে মোকাবিলায় অংশ নেয় এবং জীবাণুকে প্রায়শ; ঘায়েল করে। এই মোকাবিলাটি শারীর বৃত্তীয় কার্যাবলির সঙ্গে যুক্ত যেখানে খাদ্যের ভিটামিন ও খনিজ সরাসরি জড়িত এবং এর সঙ্গে খাদ্যের প্রধান উপাদান প্রোটিন বা এমাইনো এসিড ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

মোটের ওপর শরীরের রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে যে সব পুষ্টি উপাদান ক্রিয়াশীল সে গুলো হলো -

এক : প্রোটিন বা এ্যামাইনো এসিড : দেহের সকল শারীরবৃত্তীয় কার্যাবলি হরমোনাল সিগন্যালে ক্রিয়াশীল হয়। অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধের জৈবিক ক্রিয়ায় হরমোন মুখ্য ভূমিকা পালন করে। আর এই হরমোন খাদ্যের প্রোটিন দিয়ে গঠিত। রক্তের হিমোগ্লোবিন যা অক্সিজেন পরিবহন করে সেই হিমোগ্লোবিন প্রোটিন দিয়ে তৈরি। মাছ, মাংস, দুধ, ডিম প্রাণিজ প্রোটিনের এই খাদ্য উপাদান হরমোনাল সিগন্যালে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে এবং রোগ প্রতিরোধকে বেগবান করে।

দুই : ভিটামিন এ : ফুসফুস, শ্বাসনালী, ত্বকের আবরণী কলা, ঝোজক কলার রক্ষাকবজ হলো ভিটামন-এ। করোনা যেখানে শ্বাসনালীর আবরণী কলা বা কোষে আক্রমণ করে সেখানে ভিটামিন-এ প্রতিরোধক। রঙ্গিন শাকসবজি, সামুদ্রিক মাছের তেল, যকৃত, দুধ, ডিম ভিটামিন-এ এর প্রধান খাদ্য উৎস্য।

তিন : ভিটামিন ডি : বোন মেরু বা অস্থিমজ্জার প্রধান উপাদান হলো ভিটামিন ডি যা রক্তের লোহিত কণিকা তৈরির স্থান। দেহের কোষে অক্সিজেনের একমাত্র বাহক রক্তের লোহিত কণিকা। তৈলাক্ত মাছ, দুধ, সূর্য়ের আলো ভিটামিন ডি এর প্রধান উৎস্য।

চার : ভিটামিন সি : বলা হয়ে থাকে রোগ প্রতিরোধের প্রধান হাতিয়ার ভিটামিন সি। ফুসফুস, শ্বাসনালীসহ দেহের সব ব্লাড ভেসেলের সুরক্ষার প্রধান নিয়ামক ভিটামিন সি। রক্তের হিমোগ্লোবিনে আয়রন সংঝোজন ও অন্ত্রের আয়রন পরিশোষণ দেহে বিভিন্ন কোষে অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করে ভিটামিন সি। জীবাণুকে গ্রাস করার কাজে শ্বেত রক্ত কণিকা ও লিম্ফনোটকে সরাসরি সহায়তা করে ভিটামিন সি। লেবু, পেয়ার, কমলা, আমলকি, টমেটো, কাঁচামরিচ ইত্যাদিতে ভরপুর ভিটামিন সি রয়েছে।

পাঁচ: ভিটামিন-ই : প্রধান এন্টি অক্সিডেন্ট। করোনার আক্রমণে রক্তের রোহিত কণিকা জারিত হয়ে ধ্বংস হয়। লোহিত রক্ত কণিকাকে জারণের হাত থেকে রক্ষা করে এই ভিটামিন-ই। হরমোনের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জীবাণুর বিরুদ্ধে দ্রুত সাড়া প্রদান করে। বীজ তেল ভিটামিন-ই এর উৎকৃষ্ট উৎস্য। বাদাম, ডিম, শাকেও ভিটামিন-ই পাওয়া যায়।

আয়রন বা লৌহ : ফুসফুস হতে বিভিন্ন কোষে অক্সিজেন পরিবহন করে হিমোগ্লোবিন। আর এই হিমোগ্লোবিন (হিম +গ্লোবিন) এর প্রধান একটি অংশ-হিম বা লৌহ। কলিজা, ডিমের কুসুম, মুরগির মাংস, ডাল, শাকপাতা লৌহের বিশেষ খাদ্য উৎস্য।

কপার : দেহের বিভিন্ন জারণ বিজারণে কো-এনজাইম হিসেবে কপার কাজ করে। আয়রন বিপাক ও পরিবহনে কপার সরাসরি জড়িত। কলিজা, ডিম, বাদাম, শামুকের মাংসে কপার পাওয়া যায়।

জিংক : শরীরের বিভিন্ন গ্রন্থিও গঠন, বৃদ্ধি, অন্ত্রের সুরক্ষায় জিংক আবশ্যক। করোনার আক্রমণে ফুসফুসের সঙ্গে পরিপাকতন্ত্রের শোষণ অঞ্চল ক্ষুদ্রান্ত ও বৃহাদ্রান্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জিংক অন্ত্রের সুরক্ষার প্রধান হাতিয়ার। জিংক বিভিন্ন হরমোনের বার্তাবাহনেও সহায়তা করে। মাছ, মাংস, কলিজা, ডিম জিংকের প্রধান খাদ্য উৎস্য।

শরীরের রোগ প্রতিরোধের এইসব খাদ্য ও পুষ্টি গ্রহণের পাশাপাশি বয়স ও ওজন অনুযায়ী অবশ্যই দৈনিক নির্ধারিত ক্যালরি গ্রহণ করতে হবে। পরিমিত হাঁটাচলা ও ব্যায়াম শরীরের রক্ত সঞ্চালনকে স্বাভাবিক রাখে। পর্যাপ্ত ঘুম এন্ডোক্রাইন গ্লান্ডগুলোকে চাপমুক্ত রাখে। ফলে শরীরের ইমিউন সিস্টেম হয় গতিশীল। সর্বোপরি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ইতিবাচক মন-মানসিকতা ও বিজ্ঞানভিত্তিক জীবনযাপন করোনাকে প্রতিহত করে দেহমনকে আরও চাঙ্গা করতে পারে।

[লেখক : পুষ্টিবিদ, বেসরকারি সংস্থা

আরআরএফে কর্মরত]