সংসদে তোপের মুখে স্বাস্থ্যমন্ত্রী, পদত্যাগ দাবি

করোনা মহামারীকালে অক্সিজেন সংকটসহ স্বাস্থ্য খাতের নানা অব্যবস্থাপনা, অনিয়মের কারণে জাতীয় সংসদে আবারও বিরোধী দলের সদস্যদের তোপের মুখে পড়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক, উঠেছে তার পদত্যাগের দাবিও। গতকাল বৃহস্পতিবার বাজেট অধিবেশনের সমাপনী দিনে ‘পয়েন্ট অব অর্ডারে (অনির্ধারিত আলোচনায়)’ দাঁড়িয়ে সংসদ সদস্যরা স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের সমালোচনা করেন।

স্পিকার ড. শিরীন শারমীন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এ সময় সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন। তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে অধিবেশনকক্ষে দেখা যায়নি।

অক্সিজেনের অভাবে নিজ জেলা বগুড়ায় দুই দিনে ২৪ জন মারা যাওয়ার প্রসঙ্গ তুলে আলোচনার সূত্রাপাত করেন বিএনপির সংসদ সদস্য (এমপি) জিএম সিরাজ। পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘বগুড়া কোভিডের হটস্পট। গত তিনদিনে বগুড়ায় মৃতের সংখ্যা ২৪ জন। মৃত্যুর কারণ হলো উচ্চমাত্রার অক্সিজেন সরবরাহের জন্য হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলার সংকট। আজকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী নেই। থাকলে ভালো হতো।’

কোভিডের জন্য নির্ধারিত ২৫০ বেডের মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল আটটি আইসিইউ বেড থাকলেও হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা আছে মাত্র দুটি, এমন তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ফলে বাকি আইসিইউ বেড কোন কাজেই লাগছে না। বগুড়ায় ৩টি হাসপাতালের ৪৫০টি বেড রোগীতে ঠাসা। নতুন রোগী ভর্তি হতে পারছেন না।’

প্রতিটি হাসপাতালে ২০টি করে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা সরবরাহ এবং সার্বক্ষণিক অক্সিজেন সরবরাহের দাবি জানান তিনি।

বিরোধী দলের উপনেতা ও জাতীয় পার্টির (জাপা) জিএম কাদের বক্তব্যের শুরুতেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অব্যবস্থাপনার কথা তুলে ধরে বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক বছর আগে যে অবস্থায় ছিল, এখনও সেখানেই আছে। কোন উন্নতি হয়নি।’

নিজ এলাকার হাসপাতালের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে যেসব চিঠি দিয়েছেন, সংসদে বক্তব্য দিয়েছেন, সেগুলো পুনরুল্লেখ করে জিএম কাদের বলেন, ‘এগুলোর বাস্তবায়ন হয়নি। স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে ছয়-সাতবার ফোন দিলেও ধরেননি। মন্ত্রীর সহকারীদের ফোন করার পর মন্ত্রীকে জানানোর কথা বলি। কিন্তু মন্ত্রী ফোন করেন না। ’

গত ৩০ জুন সংসদে বাজেট পাসের সময় বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের সমালোচনার মুখে স্বাস্থ্য খাতের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। জেলা হাসপাতালের সভাপতি সংসদ সদস্যরা উল্লেখ করে ওই দিন আইনপ্রণেতাদের ওপর দায় চাপান মন্ত্রী।

বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ বলেন, ‘গত বুধবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী সংসদে যে বক্তব্য দিয়েছেন, এর মাধ্যমে গোটা হাউজকে অপমান করা হয়েছে। মন্ত্রী বলেছিলেন, সংসদ সদস্যরা জেলা হাসপাতালের চেয়ারম্যান। তারা দায়িত্ব পালন করেন না। মন্ত্রীর এই বক্তব্য ঠিক নয়। এই বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করা দরকার।’

তিনি আরও বলেন, ‘সংসদে ৯০ ভাগ সদস্য সরকারি দলের। তাহলে কি সরকারি দলের সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন না? তিনি বলেন, আগামী ১০-১৫ দিনের মধ্যে করোনা পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। অক্সিজেন সংকট দেখা দিয়েছে। এটা দেখতে হবে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে খাদ্যসহায়তা দিতে হবে।’

জাপার সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে বলেন, ‘তিনি এক দিনও কোন হাসপাতালের ভেতরে গিয়ে দেখেননি কী হচ্ছে? তিনি শুধু জুম মিটিং করেন। তিনি (স্বাস্থ্যমন্ত্রী) আমেরিকার সঙ্গে তুলনা করেছেন। আমাদের দেশে আমেরিকার চেয়ে কম লোক মারা যায়। এটা কি তার কৃতিত্ব? এক বছর মন্ত্রী কী করলেন? ৩৭টি জেলায় অক্সিজেন নেই। মানুষ মারা যাচ্ছে।’

নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের প্রসঙ্গ তুলে সাবেক প্রতিমন্ত্রী চুন্নু বলেন, ‘ইংল্যান্ডের স্বাস্থ্যমন্ত্রী আনন্দে আত্মহারা হয়ে একটি কিস করার কারণে তাকে রিজাইন দিতে হয়েছে। আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী কী মানুষ? বুঝলাম না। উনার লজ্জা-শরম কিছু নেই। চরিত্র নেই। ওনার রিজাইন দেয়া উচিত।’

জাপার সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘সাতক্ষীরায় অক্সিজেনের অভাবে এক ঘণ্টায় ৭ জন ছটফট করে মারা গেলেন। নার্স, ওয়ার্ড বয় ও চিকিৎসকেরা কী করলেন?’ তিনি বলেন, ‘আইসিইউ, এসডিইউতে রোগী গেলে কোন চিকিৎসা হয় না। সেখানে কী হয়, কেউ জানে না। মানুষের মৃত্যুর কি কোন দাম নেই? একটা তদন্ত কমিটি করুন। এর প্রতিবেদন প্রকাশ করুন।’

জাপার সংসদ সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, ‘বুধবার মাস্কের দুর্নীতির কথা বলার পর স্বাস্থ্যমন্ত্রী মাস্ক কেনা হয়নি বলে দাবি করেন। অথচ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি প্রকল্পের পরিচালক নিজে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে বলেছেন, একটি সার্জিক্যাল মাস্ক কেনা হয়েছে ৩৫৬ টাকায়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী এই সত্য জিনিসটা এড়িয়ে গেলেন কেন? তিনি সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরার বিষয়টি নিশ্চিত করার দাবি জানান।’

রবিবার, ০৪ জুলাই ২০২১ , ২০ আষাঢ় ১৪২৮ ২২ জিলক্বদ ১৪৪২

সংসদে তোপের মুখে স্বাস্থ্যমন্ত্রী, পদত্যাগ দাবি

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

করোনা মহামারীকালে অক্সিজেন সংকটসহ স্বাস্থ্য খাতের নানা অব্যবস্থাপনা, অনিয়মের কারণে জাতীয় সংসদে আবারও বিরোধী দলের সদস্যদের তোপের মুখে পড়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক, উঠেছে তার পদত্যাগের দাবিও। গতকাল বৃহস্পতিবার বাজেট অধিবেশনের সমাপনী দিনে ‘পয়েন্ট অব অর্ডারে (অনির্ধারিত আলোচনায়)’ দাঁড়িয়ে সংসদ সদস্যরা স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের সমালোচনা করেন।

স্পিকার ড. শিরীন শারমীন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এ সময় সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন। তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে অধিবেশনকক্ষে দেখা যায়নি।

অক্সিজেনের অভাবে নিজ জেলা বগুড়ায় দুই দিনে ২৪ জন মারা যাওয়ার প্রসঙ্গ তুলে আলোচনার সূত্রাপাত করেন বিএনপির সংসদ সদস্য (এমপি) জিএম সিরাজ। পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘বগুড়া কোভিডের হটস্পট। গত তিনদিনে বগুড়ায় মৃতের সংখ্যা ২৪ জন। মৃত্যুর কারণ হলো উচ্চমাত্রার অক্সিজেন সরবরাহের জন্য হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলার সংকট। আজকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী নেই। থাকলে ভালো হতো।’

কোভিডের জন্য নির্ধারিত ২৫০ বেডের মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল আটটি আইসিইউ বেড থাকলেও হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা আছে মাত্র দুটি, এমন তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ফলে বাকি আইসিইউ বেড কোন কাজেই লাগছে না। বগুড়ায় ৩টি হাসপাতালের ৪৫০টি বেড রোগীতে ঠাসা। নতুন রোগী ভর্তি হতে পারছেন না।’

প্রতিটি হাসপাতালে ২০টি করে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা সরবরাহ এবং সার্বক্ষণিক অক্সিজেন সরবরাহের দাবি জানান তিনি।

বিরোধী দলের উপনেতা ও জাতীয় পার্টির (জাপা) জিএম কাদের বক্তব্যের শুরুতেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অব্যবস্থাপনার কথা তুলে ধরে বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক বছর আগে যে অবস্থায় ছিল, এখনও সেখানেই আছে। কোন উন্নতি হয়নি।’

নিজ এলাকার হাসপাতালের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে যেসব চিঠি দিয়েছেন, সংসদে বক্তব্য দিয়েছেন, সেগুলো পুনরুল্লেখ করে জিএম কাদের বলেন, ‘এগুলোর বাস্তবায়ন হয়নি। স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে ছয়-সাতবার ফোন দিলেও ধরেননি। মন্ত্রীর সহকারীদের ফোন করার পর মন্ত্রীকে জানানোর কথা বলি। কিন্তু মন্ত্রী ফোন করেন না। ’

গত ৩০ জুন সংসদে বাজেট পাসের সময় বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের সমালোচনার মুখে স্বাস্থ্য খাতের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। জেলা হাসপাতালের সভাপতি সংসদ সদস্যরা উল্লেখ করে ওই দিন আইনপ্রণেতাদের ওপর দায় চাপান মন্ত্রী।

বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ বলেন, ‘গত বুধবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী সংসদে যে বক্তব্য দিয়েছেন, এর মাধ্যমে গোটা হাউজকে অপমান করা হয়েছে। মন্ত্রী বলেছিলেন, সংসদ সদস্যরা জেলা হাসপাতালের চেয়ারম্যান। তারা দায়িত্ব পালন করেন না। মন্ত্রীর এই বক্তব্য ঠিক নয়। এই বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করা দরকার।’

তিনি আরও বলেন, ‘সংসদে ৯০ ভাগ সদস্য সরকারি দলের। তাহলে কি সরকারি দলের সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন না? তিনি বলেন, আগামী ১০-১৫ দিনের মধ্যে করোনা পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। অক্সিজেন সংকট দেখা দিয়েছে। এটা দেখতে হবে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে খাদ্যসহায়তা দিতে হবে।’

জাপার সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে বলেন, ‘তিনি এক দিনও কোন হাসপাতালের ভেতরে গিয়ে দেখেননি কী হচ্ছে? তিনি শুধু জুম মিটিং করেন। তিনি (স্বাস্থ্যমন্ত্রী) আমেরিকার সঙ্গে তুলনা করেছেন। আমাদের দেশে আমেরিকার চেয়ে কম লোক মারা যায়। এটা কি তার কৃতিত্ব? এক বছর মন্ত্রী কী করলেন? ৩৭টি জেলায় অক্সিজেন নেই। মানুষ মারা যাচ্ছে।’

নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের প্রসঙ্গ তুলে সাবেক প্রতিমন্ত্রী চুন্নু বলেন, ‘ইংল্যান্ডের স্বাস্থ্যমন্ত্রী আনন্দে আত্মহারা হয়ে একটি কিস করার কারণে তাকে রিজাইন দিতে হয়েছে। আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী কী মানুষ? বুঝলাম না। উনার লজ্জা-শরম কিছু নেই। চরিত্র নেই। ওনার রিজাইন দেয়া উচিত।’

জাপার সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘সাতক্ষীরায় অক্সিজেনের অভাবে এক ঘণ্টায় ৭ জন ছটফট করে মারা গেলেন। নার্স, ওয়ার্ড বয় ও চিকিৎসকেরা কী করলেন?’ তিনি বলেন, ‘আইসিইউ, এসডিইউতে রোগী গেলে কোন চিকিৎসা হয় না। সেখানে কী হয়, কেউ জানে না। মানুষের মৃত্যুর কি কোন দাম নেই? একটা তদন্ত কমিটি করুন। এর প্রতিবেদন প্রকাশ করুন।’

জাপার সংসদ সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, ‘বুধবার মাস্কের দুর্নীতির কথা বলার পর স্বাস্থ্যমন্ত্রী মাস্ক কেনা হয়নি বলে দাবি করেন। অথচ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি প্রকল্পের পরিচালক নিজে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে বলেছেন, একটি সার্জিক্যাল মাস্ক কেনা হয়েছে ৩৫৬ টাকায়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী এই সত্য জিনিসটা এড়িয়ে গেলেন কেন? তিনি সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরার বিষয়টি নিশ্চিত করার দাবি জানান।’