কুমিল্লা কারাগারে কয়েদি নির্যাতন

কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে কেস টেবিলের সামনে শাহজাহান বিলাস (৪৮) নামে সাজাপ্রাপ্ত এক কয়েদিকে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। নির্যাতনের এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ায় ভিডিও ফাঁসের অভিযোগে ৩ কারারক্ষীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। নির্যাতনের শিকার কয়েদি শাহজাহান বিলাস (কয়েদি নম্বর ৭১৫১/এ) ভারতের পশ্চিম ত্রিপুরা রাজ্যের দুর্গাপুর গ্রামের আবদু মিয়ার ছেলে। বিষয়টি তদন্তে কারা অধিদপ্তরের নির্দেশে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার শফিকুল ইসলাম খানকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

কমিটির অন্য ২ সদস্য হচ্ছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারের জেল সুপার ইকবাল হোসেন ও ফেনী জেলা কারাগারের জেলার শাহাদত হোসেন মিঠু। কমিটিকে আগামী ৭ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এদিকে আজ তদন্ত কমিটি কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে এসে তদন্ত শুরু করবে বলে জানিয়েছেন কমিটির প্রধান সিনিয়র সুপার শফিকুল ইসলাম খান।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কয়েদি শাহজাহান বিলাস ডাকাতি ও হত্যা মামলার ৫৮ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি। গত ২৬ বছর ধরে তিনি কুমিল্লা কারাগারে বন্দী রয়েছেন। গত ১৫ এপ্রিল তার ওয়ার্ডে তল্লাশি চালায় কারারক্ষীরা। এ সময় ১২ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, এক পুড়িয়া গাঁজা, নগদ ৬শ’ টাকাসহ কারারক্ষীদের হাতে তিনি ধরা পড়েন। পরে ১২ মে তাকে কারাভ্যন্তরে কেস টেবিলের সামনে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেন সিনিয়র জেল সুপার শাহজাহান আহমেদ। ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি কারাগারের সিসিটিভি ফুটেজ থেকে ৫ মিনিট ৫ সেকেন্ডের ভিডিওটি ধারণ করা হয়। এতে দেখা যায়, জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে বন্দী বিলাসের দুই হাত পিঠমোড়া করে বেঁধে মাটিতে ফেলা হয়। এ সময় সিনিয়র জেল সুপার শাহজাহান আহমেদ সেখানে পৌঁছার পর ওই বন্দীকে বেধড়ক পেটান কয়েকজন কারারক্ষী। পরে সেখানে উপস্থিত হন জেলার আসাদুর রহমানও। এ সময় সেখানে বেশ কয়েকজন কারারক্ষী ও সাজাপ্রাপ্ত বন্দীও উপস্থিত ছিল। এছাড়া ফ্লোরে বসা ছিলেন বিচারের অপেক্ষায় থাকা আরও দুই বন্দী। এদিকে কারাগার সূত্র জানায়, কারাগারের অভ্যন্তর সার্বক্ষণিকভাবে সিসিটিভি ফুটেজে নিরাপত্তা ব্যবস্থা মনিটরিং করা হয়। সেখানকার সিসিটিভি ফুটেজ থেকে পুনরায় ভিডিও ধারণ করে কারাগার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের হাত ছাড়া বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। বন্দী বিলাসকে নির্যাতনের সময় ধারণ করা সিসিটিভি ফুটেজ নিয়েও এমন ঘটনা ঘটেছে। সিলেটের একটি ফেইসবুক আইডিতে প্রথমে ভিডিওটি পোস্ট করা হয়।

এছাড়া বিভিন্ন সময়ে মাদকসহ কারাগারে আটক হওয়া কারারক্ষীদের একটি চক্র কৌশলে এ ভিডিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের সুরক্ষাসেবা বিভাগ ও কারা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের নজরে নিয়ে আসেন বলে ধারণা করছেন কারা কর্মকর্তারা। এদিকে বন্দী নির্যাতনের বিষয়টি তদন্তে গত ১ জুলাই কারা অধিদপ্তরের নির্দেশে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র সুপার শফিকুল ইসলাম খানকে প্রধান করে বিষয়টি তদন্তে ৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য ২ সদস্য হচ্ছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারের জেল সুপার ইকবাল হোসেন ও ফেনী জেলা কারাগারের জেলার শাহাদত হোসেন মিঠু। এদিকে নির্যাতনের ভিডিওটি ভাইরাল করার অভিযোগে গত বৃহস্পতিবার কুমিল্লা কারাগারের প্রধান কারারক্ষী মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম, কারারক্ষী অনন্ত চন্দ্র দাস ও চয়ন চন্দ্র পালকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বরখাস্ত হওয়ার পরদিন শুক্রবার কারারক্ষী অনন্ত চন্দ্র দাস কারাগারের ব্যারাকে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন বলে কারাগার সূত্রে জানা গেছে। তবে বর্তমানে তিনি সুস্থ আছেন।

বরখাস্তকৃতদের মধ্যে দুই কারারক্ষী চরন চন্দ্র পাল ও অনন্ত চন্দ্র দাসের ১ মিনিট ১২ সেকেন্ডের একটি ফোনের অডিওতে ভিডিও ফাঁসের বিষয়টি অবগত হয় কারা কর্তৃপক্ষ। এর আগে বন্দী শাহজাহান বিলাসকে পেটানোর অভিযোগে ঘটনার দিন গত ১২ মে কারাগারের কারারক্ষী দিদারুল আলম ও শাহ নেয়াজের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রেকর্ড করা হয়েছে, যা বর্তমানে তদন্তাধীন রয়েছে বলে কারাগার সূত্রে জানা গেছে।

এদিকে বন্দী নির্যাতনের বিষয়ে গতকাল বিকেলে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার শাহজাহান আহমেদ বলেন, এ কারাগারে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে মাদকসহ কারারক্ষী তরিকুল ইসলাম শাহীন ও রোমানকে আটক করে পুলিশে হস্তান্তর করি। এছাড়া অনেকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়। এতে একটি চক্র আমার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ফলে ওই চক্রটি এ ভিডিও ধারণ করে ইউটিউব এবং ফেইসবুকে আপলোড করে। ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বন্দী বিলাসের ওয়ার্ডে তল্লাশি চালিয়ে ইয়াবা, গাঁজা, সিগারেট ও নগদ টাকা জব্দ করা হয়। পরে তাকে কেস টেবিলে ডেকে এনে মাদক ধ্বংস ও জব্দ করা টাকা সরকারের কোষাগারে জমা দেয়া হয়। এ নিয়ে সে ক্ষুব্ধ ছিল আমাদের ওপর। একদিন সেল পরিদর্শনকালে তাকে কারাগার থেকে বের করে দিতে কিংবা মেরে ফেলতে বলে। এ নিয়ে সে উচ্ছৃঙ্খল আচরণও করে। এজন্য তাকে কেস টেবিলে এনে লঘু শাস্তি দেয়া হয়। কিন্তু এ সময় তাকে পেটানোর ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে দুইজন কারারক্ষীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রেকর্ড করা হয়।

তিনি আরও বলেন, সিসিটিভির সার্ভার রুম থেকে ৫ মিনিটের ভিডিও ধারণ করে পরে তা বাইরে প্রকাশ করার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করেছি। বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় ৩ কারারক্ষীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এই চক্রের সঙ্গে ইতিপূর্বে মাদকসহ কারাগারে গ্রেপ্তার হওয়া একাধিক কারারক্ষী জড়িত থাকার বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ সংক্রান্তে একটি অডিও রেকর্ড আমাদের হাতে এসেছে। তদন্ত কমিটির প্রধান চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার শফিকুল ইসলাম খান বলেন, কারা অধিদপ্তরের নির্দেশে এ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। রোববার বিষয়টি তদন্ত করতে আমরা কুমিল্লা কারাগারে গিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলব। আগামী ৭ কার্যদিবসের মধ্যে ঘটনার বিষয়ে আমাদের প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এদিকে নির্যাতনের ঘটনার জেলকোড বিধি জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জেল কোড বিধির ৪৬৩ ধারার ৩ উপ-ধারায় উল্লেখ রয়েছে ‘কোন কারা কর্মকর্তা-কর্মচারী কোন বন্দীর বিরুদ্ধে তরবারি, বেয়নেট, আগ্নেয়াস্ত্র বা অন্য যে কোন অস্ত্র ব্যবহার করিতে পারবেন যদি বন্দী কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী বা অন্য কোন ব্যক্তিকে আক্রমণ করে, তবে শর্ত থাকে যে, তাকে বিশ্বাস করতে হবে যে আক্রান্ত কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী বা অন্য কোন ব্যক্তির জীবনহানি বা অঙ্গহানি বা মারাত্মক জখম হওয়ার কারণ বিদ্যমান।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কারা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক (অতিঃ আইজি প্রিজন্স) কর্নেল মো. আবরার হোসেন টেলিফোনে সংবাদকে বলেন, যে বন্দীকে নির্যাতনের বিষয় নিয়ে কথা উঠছে ওই বন্দী খুবই বেপরোয়া। সে দীর্ঘদিন ধরে ওই কারাগারে থাকার কারণে কারাগারের অভ্যন্তরে মাদকের একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলে মাদক ব্যবসা শুরু করে। বিষয়টি জানার পর তাকে সেলে পাঠানো হয়। সেখানে সে জেলারের সামনেই সেলের লোহার শিকের সঙ্গে নিজের মাথা নিজে ফাঁটিয়ে বলে তাকে সেল থেকে বের করা না হলে নিজে নিজের মাথা ফাঁটিয়ে মারা হবে। এমন পরিস্থিতিতে তাকে কেস টেবিলে আনা হয়। সেখানে তাকে মারধর করতে হয়েছে। তবে বিষয়টি যেহেতু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ গণমাধ্যমে এসেছে তাই কারা অধিদপ্তর থেকে বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর নেয়া হবে। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে তদন্ত চলছে।

কারা অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানায়, কারাগারের সিসি ক্যামেরা সেলের দায়িত্বে কর্মরত কারা রক্ষীর এক আত্মীয় সেখানে কর্মরত আছে। নানা অনিয়মের কারণে তাকে বদলি করা হয়। এ নিয়ে সে জেল সুপারের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। ঘটনার সময় সে বিষয়টি মোবাইলে ধারণ করে রাখে। পরে জেল সুপারকে তার বদলি বন্ধ না করলে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। জেল সুপার তার কথায় কর্ণপাত করেননি। এরপর সে কারাগারের বাইরে গিয়ে ভিডিওটি একটি ফেইসবুক একাউন্ট থেকে ছড়িয়ে দেয়।

কারা অধিদপ্তর জানিয়েছে, বন্দীদের মধ্যে অনেকেই বেপরোয়া। এসব বন্দীদের সামাল দেয়া অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। নানা ধরনের দুর্ঘটনাও তারা ঘটায়। এ কারণে বিপজ্জনক বন্দীদের অনেক সময় শান্ত রাখতে কারা রক্ষীদের হার্ডলাইনে যেতে হয়। কুমিল্লা কারাগারের বন্দীর ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে। ওই বন্দী মানসিকভাবে উগ্র আচরণ করত। ঘটনার দিনও সে উগ্র আচরণ শুরু করেছিল। আর সে কারণেই তার ওপর বল প্রয়োগ করতে হয়েছে।

রবিবার, ০৪ জুলাই ২০২১ , ২০ আষাঢ় ১৪২৮ ২২ জিলক্বদ ১৪৪২

কুমিল্লা কারাগারে কয়েদি নির্যাতন

জেলা বার্তা পরিবেশক, কুমিল্লা

কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে কেস টেবিলের সামনে শাহজাহান বিলাস (৪৮) নামে সাজাপ্রাপ্ত এক কয়েদিকে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। নির্যাতনের এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ায় ভিডিও ফাঁসের অভিযোগে ৩ কারারক্ষীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। নির্যাতনের শিকার কয়েদি শাহজাহান বিলাস (কয়েদি নম্বর ৭১৫১/এ) ভারতের পশ্চিম ত্রিপুরা রাজ্যের দুর্গাপুর গ্রামের আবদু মিয়ার ছেলে। বিষয়টি তদন্তে কারা অধিদপ্তরের নির্দেশে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার শফিকুল ইসলাম খানকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

কমিটির অন্য ২ সদস্য হচ্ছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারের জেল সুপার ইকবাল হোসেন ও ফেনী জেলা কারাগারের জেলার শাহাদত হোসেন মিঠু। কমিটিকে আগামী ৭ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এদিকে আজ তদন্ত কমিটি কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে এসে তদন্ত শুরু করবে বলে জানিয়েছেন কমিটির প্রধান সিনিয়র সুপার শফিকুল ইসলাম খান।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কয়েদি শাহজাহান বিলাস ডাকাতি ও হত্যা মামলার ৫৮ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি। গত ২৬ বছর ধরে তিনি কুমিল্লা কারাগারে বন্দী রয়েছেন। গত ১৫ এপ্রিল তার ওয়ার্ডে তল্লাশি চালায় কারারক্ষীরা। এ সময় ১২ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, এক পুড়িয়া গাঁজা, নগদ ৬শ’ টাকাসহ কারারক্ষীদের হাতে তিনি ধরা পড়েন। পরে ১২ মে তাকে কারাভ্যন্তরে কেস টেবিলের সামনে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেন সিনিয়র জেল সুপার শাহজাহান আহমেদ। ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি কারাগারের সিসিটিভি ফুটেজ থেকে ৫ মিনিট ৫ সেকেন্ডের ভিডিওটি ধারণ করা হয়। এতে দেখা যায়, জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে বন্দী বিলাসের দুই হাত পিঠমোড়া করে বেঁধে মাটিতে ফেলা হয়। এ সময় সিনিয়র জেল সুপার শাহজাহান আহমেদ সেখানে পৌঁছার পর ওই বন্দীকে বেধড়ক পেটান কয়েকজন কারারক্ষী। পরে সেখানে উপস্থিত হন জেলার আসাদুর রহমানও। এ সময় সেখানে বেশ কয়েকজন কারারক্ষী ও সাজাপ্রাপ্ত বন্দীও উপস্থিত ছিল। এছাড়া ফ্লোরে বসা ছিলেন বিচারের অপেক্ষায় থাকা আরও দুই বন্দী। এদিকে কারাগার সূত্র জানায়, কারাগারের অভ্যন্তর সার্বক্ষণিকভাবে সিসিটিভি ফুটেজে নিরাপত্তা ব্যবস্থা মনিটরিং করা হয়। সেখানকার সিসিটিভি ফুটেজ থেকে পুনরায় ভিডিও ধারণ করে কারাগার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের হাত ছাড়া বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। বন্দী বিলাসকে নির্যাতনের সময় ধারণ করা সিসিটিভি ফুটেজ নিয়েও এমন ঘটনা ঘটেছে। সিলেটের একটি ফেইসবুক আইডিতে প্রথমে ভিডিওটি পোস্ট করা হয়।

এছাড়া বিভিন্ন সময়ে মাদকসহ কারাগারে আটক হওয়া কারারক্ষীদের একটি চক্র কৌশলে এ ভিডিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের সুরক্ষাসেবা বিভাগ ও কারা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের নজরে নিয়ে আসেন বলে ধারণা করছেন কারা কর্মকর্তারা। এদিকে বন্দী নির্যাতনের বিষয়টি তদন্তে গত ১ জুলাই কারা অধিদপ্তরের নির্দেশে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র সুপার শফিকুল ইসলাম খানকে প্রধান করে বিষয়টি তদন্তে ৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য ২ সদস্য হচ্ছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারের জেল সুপার ইকবাল হোসেন ও ফেনী জেলা কারাগারের জেলার শাহাদত হোসেন মিঠু। এদিকে নির্যাতনের ভিডিওটি ভাইরাল করার অভিযোগে গত বৃহস্পতিবার কুমিল্লা কারাগারের প্রধান কারারক্ষী মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম, কারারক্ষী অনন্ত চন্দ্র দাস ও চয়ন চন্দ্র পালকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বরখাস্ত হওয়ার পরদিন শুক্রবার কারারক্ষী অনন্ত চন্দ্র দাস কারাগারের ব্যারাকে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন বলে কারাগার সূত্রে জানা গেছে। তবে বর্তমানে তিনি সুস্থ আছেন।

বরখাস্তকৃতদের মধ্যে দুই কারারক্ষী চরন চন্দ্র পাল ও অনন্ত চন্দ্র দাসের ১ মিনিট ১২ সেকেন্ডের একটি ফোনের অডিওতে ভিডিও ফাঁসের বিষয়টি অবগত হয় কারা কর্তৃপক্ষ। এর আগে বন্দী শাহজাহান বিলাসকে পেটানোর অভিযোগে ঘটনার দিন গত ১২ মে কারাগারের কারারক্ষী দিদারুল আলম ও শাহ নেয়াজের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রেকর্ড করা হয়েছে, যা বর্তমানে তদন্তাধীন রয়েছে বলে কারাগার সূত্রে জানা গেছে।

এদিকে বন্দী নির্যাতনের বিষয়ে গতকাল বিকেলে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার শাহজাহান আহমেদ বলেন, এ কারাগারে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে মাদকসহ কারারক্ষী তরিকুল ইসলাম শাহীন ও রোমানকে আটক করে পুলিশে হস্তান্তর করি। এছাড়া অনেকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়। এতে একটি চক্র আমার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ফলে ওই চক্রটি এ ভিডিও ধারণ করে ইউটিউব এবং ফেইসবুকে আপলোড করে। ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বন্দী বিলাসের ওয়ার্ডে তল্লাশি চালিয়ে ইয়াবা, গাঁজা, সিগারেট ও নগদ টাকা জব্দ করা হয়। পরে তাকে কেস টেবিলে ডেকে এনে মাদক ধ্বংস ও জব্দ করা টাকা সরকারের কোষাগারে জমা দেয়া হয়। এ নিয়ে সে ক্ষুব্ধ ছিল আমাদের ওপর। একদিন সেল পরিদর্শনকালে তাকে কারাগার থেকে বের করে দিতে কিংবা মেরে ফেলতে বলে। এ নিয়ে সে উচ্ছৃঙ্খল আচরণও করে। এজন্য তাকে কেস টেবিলে এনে লঘু শাস্তি দেয়া হয়। কিন্তু এ সময় তাকে পেটানোর ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে দুইজন কারারক্ষীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রেকর্ড করা হয়।

তিনি আরও বলেন, সিসিটিভির সার্ভার রুম থেকে ৫ মিনিটের ভিডিও ধারণ করে পরে তা বাইরে প্রকাশ করার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করেছি। বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় ৩ কারারক্ষীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এই চক্রের সঙ্গে ইতিপূর্বে মাদকসহ কারাগারে গ্রেপ্তার হওয়া একাধিক কারারক্ষী জড়িত থাকার বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ সংক্রান্তে একটি অডিও রেকর্ড আমাদের হাতে এসেছে। তদন্ত কমিটির প্রধান চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার শফিকুল ইসলাম খান বলেন, কারা অধিদপ্তরের নির্দেশে এ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। রোববার বিষয়টি তদন্ত করতে আমরা কুমিল্লা কারাগারে গিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলব। আগামী ৭ কার্যদিবসের মধ্যে ঘটনার বিষয়ে আমাদের প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এদিকে নির্যাতনের ঘটনার জেলকোড বিধি জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জেল কোড বিধির ৪৬৩ ধারার ৩ উপ-ধারায় উল্লেখ রয়েছে ‘কোন কারা কর্মকর্তা-কর্মচারী কোন বন্দীর বিরুদ্ধে তরবারি, বেয়নেট, আগ্নেয়াস্ত্র বা অন্য যে কোন অস্ত্র ব্যবহার করিতে পারবেন যদি বন্দী কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী বা অন্য কোন ব্যক্তিকে আক্রমণ করে, তবে শর্ত থাকে যে, তাকে বিশ্বাস করতে হবে যে আক্রান্ত কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী বা অন্য কোন ব্যক্তির জীবনহানি বা অঙ্গহানি বা মারাত্মক জখম হওয়ার কারণ বিদ্যমান।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কারা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক (অতিঃ আইজি প্রিজন্স) কর্নেল মো. আবরার হোসেন টেলিফোনে সংবাদকে বলেন, যে বন্দীকে নির্যাতনের বিষয় নিয়ে কথা উঠছে ওই বন্দী খুবই বেপরোয়া। সে দীর্ঘদিন ধরে ওই কারাগারে থাকার কারণে কারাগারের অভ্যন্তরে মাদকের একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলে মাদক ব্যবসা শুরু করে। বিষয়টি জানার পর তাকে সেলে পাঠানো হয়। সেখানে সে জেলারের সামনেই সেলের লোহার শিকের সঙ্গে নিজের মাথা নিজে ফাঁটিয়ে বলে তাকে সেল থেকে বের করা না হলে নিজে নিজের মাথা ফাঁটিয়ে মারা হবে। এমন পরিস্থিতিতে তাকে কেস টেবিলে আনা হয়। সেখানে তাকে মারধর করতে হয়েছে। তবে বিষয়টি যেহেতু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ গণমাধ্যমে এসেছে তাই কারা অধিদপ্তর থেকে বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর নেয়া হবে। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে তদন্ত চলছে।

কারা অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানায়, কারাগারের সিসি ক্যামেরা সেলের দায়িত্বে কর্মরত কারা রক্ষীর এক আত্মীয় সেখানে কর্মরত আছে। নানা অনিয়মের কারণে তাকে বদলি করা হয়। এ নিয়ে সে জেল সুপারের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। ঘটনার সময় সে বিষয়টি মোবাইলে ধারণ করে রাখে। পরে জেল সুপারকে তার বদলি বন্ধ না করলে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। জেল সুপার তার কথায় কর্ণপাত করেননি। এরপর সে কারাগারের বাইরে গিয়ে ভিডিওটি একটি ফেইসবুক একাউন্ট থেকে ছড়িয়ে দেয়।

কারা অধিদপ্তর জানিয়েছে, বন্দীদের মধ্যে অনেকেই বেপরোয়া। এসব বন্দীদের সামাল দেয়া অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। নানা ধরনের দুর্ঘটনাও তারা ঘটায়। এ কারণে বিপজ্জনক বন্দীদের অনেক সময় শান্ত রাখতে কারা রক্ষীদের হার্ডলাইনে যেতে হয়। কুমিল্লা কারাগারের বন্দীর ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে। ওই বন্দী মানসিকভাবে উগ্র আচরণ করত। ঘটনার দিনও সে উগ্র আচরণ শুরু করেছিল। আর সে কারণেই তার ওপর বল প্রয়োগ করতে হয়েছে।