শহীদ জননী জাহানারা ইমাম

মিথুশিলাক মুরমু

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম কয়েকটি শব্দকে- ‘পবিত্র মুক্তিযুদ্ধ’, ‘গণআদালত’ ‘গণতদন্ত’ নতুন করে পরিচিত করেছেন। পবিত্র সংবিধানের সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকলেও ‘পবিত্র মুক্তিযুদ্ধ’ সম্পর্কে আমার চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে। অনুরূপভাবে আদালত সম্পর্কে ওয়াকিবহাল রয়েছি কিন্তু তাঁর ও সহযোগীদের আন্দোলনের ফসল গণআদালত কিংবা গণতদন্ত কমিশনও।

জাহানারা ইমাম দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েই যুক্ত হয়েছিলেন ‘সাম্প্রদায়িকতা ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী নাগরিক কমিটির’ সঙ্গে। অত্যন্ত বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘একটি অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী শক্তির পুনর্বাসন প্রক্রিয়া বহাল রেখে একটি জাতির গণতান্ত্রিক অর্থনৈতিক মুক্তির ভবিষ্যৎ নির্মাণ করা কখনও সম্ভব নয়। ঘরের মধ্যে সাপ এবং মানুষ একসঙ্গে বাস করতে পারে না। এই অবস্থা জেনে-শুনে, কেউ যদি শান্তিতে ঘুমানোর উপদেশ দেয় তাকে মূর্খ-অর্বাচীন বলা যাবে না- সে আসলে ধূর্ত শয়তান। শান্তিপ্রিয় মানুষের সে বিনাশ চায় আসলে। এদেশের প্রকৃত কল্যাণকামী বিভিন্ন পথ ও মতের দল ও সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক লক্ষ্যের কর্মসূচি ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। কিন্ত আমরা আমাদের অভিন্ন শত্রু সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী মানবতাবিরোধী দাগী অপরাধীদের রাজনৈতিক সামাজিকভাবে নির্মূলের ব্যবস্থা করার জন্যে এক কেন্দ্রে আজ সমবেত হয়েছি। এই অভিন্ন প্রতিপক্ষকে চূড়ান্তভাবে পরাস্ত করতে হলে আজকের গণদাবি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যকর করতেই হবে। এ কর্তব্য পালনের আগে দেশের কোন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্মসূচিই নির্বিঘে্ন সম্পন্ন করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়।’ ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে ২৫ মে প্রথম জনসমুদ্রের সম্মুখে উপস্থিত হলে আবেগঘন মুহূর্তের সৃষ্টি হয়েছিল। সাপ্তাহিক নয়া পদধ্বনি ৭ জুন, ১৯৮১-এর এক প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল- ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধার মাতা জাহানারা ইমাম যখন বক্তৃতা করতে ওঠেন, তখন সমাবেশে আগত মুক্তিযোদ্ধারা সমস্বরে সেøাগান দিতে থাকেন, ‘মাগো তোমায় কথা দিলাম, অস্ত্র আবার হাতে নেব; মুক্তিযোদ্ধার হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার।’ পবিত্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের জন্য স্বাধীনতার শত্রু সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট জামায়াত-শিবির চক্রের বিরুদ্ধে তিনি যে বিশাল আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন তার সূচনা এভাবেই হয়েছিল।

‘বিদায় দে মা ঘুরে আসি, একাত্তরের দিনগুলির বইয়ের কিশোর ভাষ্য’-এর ভূমিকায় ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে জাহানারা ইমাম লিখেছেন, ‘এখন যারা শিশু-কিশোর, তারা কেউই ১৯৭১ সালে জন্মগ্রহণ করেনি। ১৯৭১ সালে যে একটি মহান, পবিত্র মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, সে সম্বন্ধে তারা বিস্তারিত কিছু জানে না বললেই হয়। ... তারা মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা আরও অনেক বই পড়বে এবং তাদের দেশের সবচেয়ে গৌরবময়, সবচেয়ে পবিত্র, সবচেয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সঠিক ধারণা ও জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হবে।’ কেন তিনি ‘পবিত্র মুক্তিযুদ্ধ’ শব্দটি ব্যবহার করলেন, ব্যক্তিগতভাবেই মেলানোর চেষ্টা করেছি। অশূচি মানুষকে শূচি করতে ধর্মবেত্তাগণ মন্ত্র, প্রার্থনা বা মোনাজাতপূর্বক জল ছিটিয়ে থাকেন। ওল্ড টেস্টামেন্টে দেখা যায়- অপরাধী, দাগি ও আইন লঙ্ঘনকারীদের স্রষ্টার উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত পশুবলির রক্ত ও জল ছিটিয়ে পবিত্রকরণ করা হতো। একদিকে যেমন- আধ্যাত্মিক ও চেতনাগত পরিবর্তনের প্রত্যাশা থাকত; অপরদিকে বাহ্যিক ও আদর্শগত বিষয়টি গুরুত্বারোপ করা হতো। যিনি বা যারা রক্ত ও জল মিশ্রিত ছিটানো ফোটায় সিক্ত হতেন, বিশ্বাস করা হতো শুদ্ধতায় চলাচল করবে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নভাবে জীবন যাপনে অভ্যস্ত হবে। অর্থাৎ রক্ত ও জল জীবন প্রতীক। আমাদের দৈনিক ওজনের ৬০-৭৫ ভাগ জল। আমাদের রক্ত, মাংস, স্নায়ু, দাঁত, হাড় ইত্যাদি প্রতিটি অঙ্গের গঠনের জন্য জলের আবশ্যিকতা রয়েছে। স্রষ্টার দৃষ্টিতে গ্রাহ্যণীয় করতে মানুষ, জীবজন্তু এবং বস্তুর ওপরও রক্ত-জল ছিটিয়ে দেয়া হতো। আমার বাংলাদেশ যুগ-যুগান্ত থেকে অসংখ্য শাসকের নির্যাতন-নিপীড়ন, অত্যাচার-অবিচার, অন্যায়-অবহেলার স্তুপে বির্বণ হয়ে পড়েছিলো। রাজা-প্রজা, শাসক-শোষিত, মনিব-দাস সম্পর্কের সীমানা রেখা প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠেছিলো ’৭১-এর পূর্বে। শোষকদের বিতাড়িত করতে পদ্মা-মেঘনা, যমুনা-ব্রহ্মপুত্রে রক্তের স্রোতে প্রবাহিত হয়েছে। পাকিস্তানী হায়েনারা মা-বোনের সম্ভ্রম লুট করেছে, নারী-পুরুষ-শিশু, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতাদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে; ৩০ লক্ষাধিক শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে পুরো দেশের মাটি। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-মুসলমানসহ দেশের অভ্যন্তরে প্রতিটি ধর্মের, প্রতিটি জনগোষ্ঠীর মানুষের রক্ত স্রোতে প্রবাহিত হয়েছে। দেশের জন্যে উৎসর্গীকৃত শহীদের রক্ত ছিটায় পুণ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে ‘সোনার বাংলা’। মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে অংশগ্রহণ, ত্যাগ ও ধর্মীয় রীতি রেওয়াজে দেশের জন্য ¯্রষ্টার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা উৎসর্গ পবিত্রতার দিকগুলোকে আরও উজ্জ্বল করেছে। আত্মিক ও আধ্যাত্মিক দিক বিবেচনা করেই মহান মুক্তিযুদ্ধকে অবশ্যই ‘পবিত্র মুক্তিযুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি।

মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তিতে বাংলাদেশের পতাকা, স্বাধীন-সার্বভৌমত্ব এবং সরকার গঠিত হলে পরবর্তীকালে পবিত্র সংবিধান প্রণীত হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে বাংলাদেশ দৃঢ় প্রত্যয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ৪ নভেম্বর সংবিধান মহান সংসদে গৃহীত হয়। আমার দেশের সংবিধানে দেশের নামকরণ করা হলো- ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। সহজেই অনুমতি হয় যে, ৫৬ হাজার ৯৮০ বর্গ কিলোমিটার বাংলাদেশে বসবাসরত জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেকের উপস্থিতিকে সাংবিধানিকভাবে সম্মান জানানো হয়েছে। পবিত্র মুক্তিযুদ্ধের অপরাধীদের বিচার নিস্পত্তি হয়েছে ‘গণআদালত’-এ। গণআদালত-এর প্রতি আপামর মানুষের সম্মতি, সমর্থন এবং আস্থা জন্মেছিল। আমরা সত্যিই অবলোকন করেছি, গণআদালত কর্তৃক ঘোষিত রায়ের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে মাননীয় আদালত কর্তৃক রায়েও। অজস্র মানুষের সাক্ষ্য, তথ্যাদি, সময় ও পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে মাননীয় আদালত দোষী স্যবস্ত করে সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। যা ইতিপূর্বে গণআদালত কর্তৃকও প্রমাণিত হয়েছিল এবং প্রতীকী হলেও অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ঘোষণা করেছিল। গণমানুষের অভিযুক্ত কোন ব্যক্তিকে বোধকরি স্রষ্টাও নির্দোষ করেন না! শাস্ত্রানুযায়ী- যার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সে যদি ওই অপরাধীকে ক্ষমা না করে; তাহলে তার বিষয়ে স্রষ্টা নীরবতা পালন করেন।

১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ৩ মে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২৬ জুন, ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে ইহজগত ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুর পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি ২৮ জুন থেকে ৪ জুলাই পর্যন্ত শোক সপ্তাহ এবং ৬ জুলাই জাতীয় শোক দিবস পালন করে। মাত্র ৬৫ বছরের জীবনীকালে তিনি যে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন, সেটি এখন দাবানলে পরিণত হয়েছে। তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা ও বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছিলেন- ‘জাহানারা ইমাম আর আমাদের মাঝে নেই। ২৬ জুন (১৯৯৪) তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু যাওয়ার আগে মানুষের চেতনার এক অগ্নিশিখা জ্বালিয়ে দিয়ে গেছেন। মনে হচ্ছে, কি এক জাদুমন্ত্র স্প্তু মানুষকে জাগ্রত করে গেছেন। যারা বড়ো প্রয়োজন ছিল এই দেশ ও জাতির জন্য। আমাকে মাঝে মাঝে বলতেন, ‘তুমি আমার মনকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছো। আমি ঘরে বসে লেখালেখির কাজ করতাম। এর মধ্যে দিয়েই যা বলে যেতাম। কিন্তু যেদিন তুমি আমার বাড়ি গেলে, কথা বললে কী যেন হয়ে গেল আমার মধ্যে। আমি নতুন করে ভাবতে চেষ্টা করলাম। বোধহয় এ আন্দোলনই আমাকে টেনেছিল তখন। মা, মাটি, দেশকে সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, শত্রুমুক্ত করতেই ভূমিকা গ্রহণে অগ্রগণ্য হয়েছেন। জাহানারা ইমাম অমর হয়ে থাকবেন নিখাত দেশপ্রেম ও ভালোবাসার জন্যে। তিনি মহাপ্রয়াণে গিয়েছেন কিন্তু আমাদের মাঝে যে সুরের আগুন তিনি জ্বালিয়ে গেছেন, তা আমরা সরবে এবং নীরবে অনুসরণ ও অনুকরণ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

রবিবার, ০৪ জুলাই ২০২১ , ২০ আষাঢ় ১৪২৮ ২২ জিলক্বদ ১৪৪২

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম

মিথুশিলাক মুরমু

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম কয়েকটি শব্দকে- ‘পবিত্র মুক্তিযুদ্ধ’, ‘গণআদালত’ ‘গণতদন্ত’ নতুন করে পরিচিত করেছেন। পবিত্র সংবিধানের সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকলেও ‘পবিত্র মুক্তিযুদ্ধ’ সম্পর্কে আমার চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে। অনুরূপভাবে আদালত সম্পর্কে ওয়াকিবহাল রয়েছি কিন্তু তাঁর ও সহযোগীদের আন্দোলনের ফসল গণআদালত কিংবা গণতদন্ত কমিশনও।

জাহানারা ইমাম দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েই যুক্ত হয়েছিলেন ‘সাম্প্রদায়িকতা ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী নাগরিক কমিটির’ সঙ্গে। অত্যন্ত বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘একটি অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী শক্তির পুনর্বাসন প্রক্রিয়া বহাল রেখে একটি জাতির গণতান্ত্রিক অর্থনৈতিক মুক্তির ভবিষ্যৎ নির্মাণ করা কখনও সম্ভব নয়। ঘরের মধ্যে সাপ এবং মানুষ একসঙ্গে বাস করতে পারে না। এই অবস্থা জেনে-শুনে, কেউ যদি শান্তিতে ঘুমানোর উপদেশ দেয় তাকে মূর্খ-অর্বাচীন বলা যাবে না- সে আসলে ধূর্ত শয়তান। শান্তিপ্রিয় মানুষের সে বিনাশ চায় আসলে। এদেশের প্রকৃত কল্যাণকামী বিভিন্ন পথ ও মতের দল ও সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক লক্ষ্যের কর্মসূচি ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। কিন্ত আমরা আমাদের অভিন্ন শত্রু সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী মানবতাবিরোধী দাগী অপরাধীদের রাজনৈতিক সামাজিকভাবে নির্মূলের ব্যবস্থা করার জন্যে এক কেন্দ্রে আজ সমবেত হয়েছি। এই অভিন্ন প্রতিপক্ষকে চূড়ান্তভাবে পরাস্ত করতে হলে আজকের গণদাবি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যকর করতেই হবে। এ কর্তব্য পালনের আগে দেশের কোন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্মসূচিই নির্বিঘে্ন সম্পন্ন করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়।’ ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে ২৫ মে প্রথম জনসমুদ্রের সম্মুখে উপস্থিত হলে আবেগঘন মুহূর্তের সৃষ্টি হয়েছিল। সাপ্তাহিক নয়া পদধ্বনি ৭ জুন, ১৯৮১-এর এক প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল- ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধার মাতা জাহানারা ইমাম যখন বক্তৃতা করতে ওঠেন, তখন সমাবেশে আগত মুক্তিযোদ্ধারা সমস্বরে সেøাগান দিতে থাকেন, ‘মাগো তোমায় কথা দিলাম, অস্ত্র আবার হাতে নেব; মুক্তিযোদ্ধার হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার।’ পবিত্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের জন্য স্বাধীনতার শত্রু সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট জামায়াত-শিবির চক্রের বিরুদ্ধে তিনি যে বিশাল আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন তার সূচনা এভাবেই হয়েছিল।

‘বিদায় দে মা ঘুরে আসি, একাত্তরের দিনগুলির বইয়ের কিশোর ভাষ্য’-এর ভূমিকায় ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে জাহানারা ইমাম লিখেছেন, ‘এখন যারা শিশু-কিশোর, তারা কেউই ১৯৭১ সালে জন্মগ্রহণ করেনি। ১৯৭১ সালে যে একটি মহান, পবিত্র মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, সে সম্বন্ধে তারা বিস্তারিত কিছু জানে না বললেই হয়। ... তারা মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা আরও অনেক বই পড়বে এবং তাদের দেশের সবচেয়ে গৌরবময়, সবচেয়ে পবিত্র, সবচেয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সঠিক ধারণা ও জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হবে।’ কেন তিনি ‘পবিত্র মুক্তিযুদ্ধ’ শব্দটি ব্যবহার করলেন, ব্যক্তিগতভাবেই মেলানোর চেষ্টা করেছি। অশূচি মানুষকে শূচি করতে ধর্মবেত্তাগণ মন্ত্র, প্রার্থনা বা মোনাজাতপূর্বক জল ছিটিয়ে থাকেন। ওল্ড টেস্টামেন্টে দেখা যায়- অপরাধী, দাগি ও আইন লঙ্ঘনকারীদের স্রষ্টার উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত পশুবলির রক্ত ও জল ছিটিয়ে পবিত্রকরণ করা হতো। একদিকে যেমন- আধ্যাত্মিক ও চেতনাগত পরিবর্তনের প্রত্যাশা থাকত; অপরদিকে বাহ্যিক ও আদর্শগত বিষয়টি গুরুত্বারোপ করা হতো। যিনি বা যারা রক্ত ও জল মিশ্রিত ছিটানো ফোটায় সিক্ত হতেন, বিশ্বাস করা হতো শুদ্ধতায় চলাচল করবে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নভাবে জীবন যাপনে অভ্যস্ত হবে। অর্থাৎ রক্ত ও জল জীবন প্রতীক। আমাদের দৈনিক ওজনের ৬০-৭৫ ভাগ জল। আমাদের রক্ত, মাংস, স্নায়ু, দাঁত, হাড় ইত্যাদি প্রতিটি অঙ্গের গঠনের জন্য জলের আবশ্যিকতা রয়েছে। স্রষ্টার দৃষ্টিতে গ্রাহ্যণীয় করতে মানুষ, জীবজন্তু এবং বস্তুর ওপরও রক্ত-জল ছিটিয়ে দেয়া হতো। আমার বাংলাদেশ যুগ-যুগান্ত থেকে অসংখ্য শাসকের নির্যাতন-নিপীড়ন, অত্যাচার-অবিচার, অন্যায়-অবহেলার স্তুপে বির্বণ হয়ে পড়েছিলো। রাজা-প্রজা, শাসক-শোষিত, মনিব-দাস সম্পর্কের সীমানা রেখা প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠেছিলো ’৭১-এর পূর্বে। শোষকদের বিতাড়িত করতে পদ্মা-মেঘনা, যমুনা-ব্রহ্মপুত্রে রক্তের স্রোতে প্রবাহিত হয়েছে। পাকিস্তানী হায়েনারা মা-বোনের সম্ভ্রম লুট করেছে, নারী-পুরুষ-শিশু, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতাদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে; ৩০ লক্ষাধিক শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে পুরো দেশের মাটি। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-মুসলমানসহ দেশের অভ্যন্তরে প্রতিটি ধর্মের, প্রতিটি জনগোষ্ঠীর মানুষের রক্ত স্রোতে প্রবাহিত হয়েছে। দেশের জন্যে উৎসর্গীকৃত শহীদের রক্ত ছিটায় পুণ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে ‘সোনার বাংলা’। মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে অংশগ্রহণ, ত্যাগ ও ধর্মীয় রীতি রেওয়াজে দেশের জন্য ¯্রষ্টার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা উৎসর্গ পবিত্রতার দিকগুলোকে আরও উজ্জ্বল করেছে। আত্মিক ও আধ্যাত্মিক দিক বিবেচনা করেই মহান মুক্তিযুদ্ধকে অবশ্যই ‘পবিত্র মুক্তিযুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি।

মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তিতে বাংলাদেশের পতাকা, স্বাধীন-সার্বভৌমত্ব এবং সরকার গঠিত হলে পরবর্তীকালে পবিত্র সংবিধান প্রণীত হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে বাংলাদেশ দৃঢ় প্রত্যয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ৪ নভেম্বর সংবিধান মহান সংসদে গৃহীত হয়। আমার দেশের সংবিধানে দেশের নামকরণ করা হলো- ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। সহজেই অনুমতি হয় যে, ৫৬ হাজার ৯৮০ বর্গ কিলোমিটার বাংলাদেশে বসবাসরত জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেকের উপস্থিতিকে সাংবিধানিকভাবে সম্মান জানানো হয়েছে। পবিত্র মুক্তিযুদ্ধের অপরাধীদের বিচার নিস্পত্তি হয়েছে ‘গণআদালত’-এ। গণআদালত-এর প্রতি আপামর মানুষের সম্মতি, সমর্থন এবং আস্থা জন্মেছিল। আমরা সত্যিই অবলোকন করেছি, গণআদালত কর্তৃক ঘোষিত রায়ের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে মাননীয় আদালত কর্তৃক রায়েও। অজস্র মানুষের সাক্ষ্য, তথ্যাদি, সময় ও পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে মাননীয় আদালত দোষী স্যবস্ত করে সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। যা ইতিপূর্বে গণআদালত কর্তৃকও প্রমাণিত হয়েছিল এবং প্রতীকী হলেও অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ঘোষণা করেছিল। গণমানুষের অভিযুক্ত কোন ব্যক্তিকে বোধকরি স্রষ্টাও নির্দোষ করেন না! শাস্ত্রানুযায়ী- যার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সে যদি ওই অপরাধীকে ক্ষমা না করে; তাহলে তার বিষয়ে স্রষ্টা নীরবতা পালন করেন।

১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ৩ মে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২৬ জুন, ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে ইহজগত ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুর পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি ২৮ জুন থেকে ৪ জুলাই পর্যন্ত শোক সপ্তাহ এবং ৬ জুলাই জাতীয় শোক দিবস পালন করে। মাত্র ৬৫ বছরের জীবনীকালে তিনি যে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন, সেটি এখন দাবানলে পরিণত হয়েছে। তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা ও বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছিলেন- ‘জাহানারা ইমাম আর আমাদের মাঝে নেই। ২৬ জুন (১৯৯৪) তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু যাওয়ার আগে মানুষের চেতনার এক অগ্নিশিখা জ্বালিয়ে দিয়ে গেছেন। মনে হচ্ছে, কি এক জাদুমন্ত্র স্প্তু মানুষকে জাগ্রত করে গেছেন। যারা বড়ো প্রয়োজন ছিল এই দেশ ও জাতির জন্য। আমাকে মাঝে মাঝে বলতেন, ‘তুমি আমার মনকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছো। আমি ঘরে বসে লেখালেখির কাজ করতাম। এর মধ্যে দিয়েই যা বলে যেতাম। কিন্তু যেদিন তুমি আমার বাড়ি গেলে, কথা বললে কী যেন হয়ে গেল আমার মধ্যে। আমি নতুন করে ভাবতে চেষ্টা করলাম। বোধহয় এ আন্দোলনই আমাকে টেনেছিল তখন। মা, মাটি, দেশকে সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, শত্রুমুক্ত করতেই ভূমিকা গ্রহণে অগ্রগণ্য হয়েছেন। জাহানারা ইমাম অমর হয়ে থাকবেন নিখাত দেশপ্রেম ও ভালোবাসার জন্যে। তিনি মহাপ্রয়াণে গিয়েছেন কিন্তু আমাদের মাঝে যে সুরের আগুন তিনি জ্বালিয়ে গেছেন, তা আমরা সরবে এবং নীরবে অনুসরণ ও অনুকরণ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।