কুমিল্লায় ভুয়া মেডিকেল সনদ দিয়ে আদালতে বিচারাধীন মামলা প্রভাবিত করার চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এক শ্রেণীর দালালদের মাধ্যমে এসব সনদ তৈরি করে বাদীপক্ষ আদালতে সরবরাহ করছেন। এর ফলে অপরাধ না করেও হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে বিবাদীদের। মিথ্যা এসব মামলায় হয়রানি থেকে বাঁচতে কেউ কেউ আত্মগোপনে আছেন। আবার কেউ কেউ এসব মামলায় আটক হয়ে জেল খাটছেন। দৈনিক সংবাদ-এর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে কুমিল্লার আদালতে বিচারাধীন বিভিন্ন মামলায় দাখিলকৃত এসব ভুয়া মেডিকেল সনদের তথ্য। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধে সংশ্লিষ্টদের সর্তকসহ দালাল ও প্রতারকচক্রদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন সচেতনমহল। এছাড়া অনিয়ম বন্ধে সরকারি হাসপাতালগুলোর জরুরি বিভাগগুলোতে সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে থানা ও পুলিশ সুপার কার্যালয় থেকে সরাসরি মনিটরিং শেষে সনদ দেয়ারও দাবি জানান তারা।
জানা যায়, কুমিল্লার ১৮টি থানার চলমান মামলাগুলোর বিচারিক কার্যক্রম পরিচালিত হয় জেলা দায়রা জজ আদালত এবং চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। কেউ কেউ রাজনৈতিক বা প্রভাবশালীদের কারণে থানায় মামলা করতে না পেরে আদালতে মামলা দায়ের করছেন। পারিবারিক ও সামাজিক বিভিন্ন ঘটনায় ফৌজদারি অপরাধে দায়েরকৃত এসব মামলার নথির সঙ্গে দেয়া হচ্ছে মেডিকেল সনদ। আদালতে দায়েরকৃত বিভিন্ন মামলার সঙ্গে বাদীপক্ষ ভুয়া মেডিকেল সনদ দাখিল করছেন। এসব ঘটনায় পুলিশি হয়রানির ভয়ে অনেকে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইছেন। আদালতে জামিন নামঞ্জুর হলে অনেকে আবার কারাবরণও করছেন। কয়েকটি মামলার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য।
জানা যায়, কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামের শহিদুল ইসলামের ছেলে রাসেল (২৪) গত বছর ৬ ডিসেম্বর সদর দক্ষিণ মডেল থানায় দায়েরকৃত একটি মামলায় কুমিল্লার আদালতে আত্মসমর্পণ করেন একই বছরের ২১ ডিসেম্বর। আদালত তাকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এ মামলায় প্রমাণাদি হিসেবে বাদীর পক্ষে তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতে দুটি মেডিকেল সনদ দাখিল করেন। অনুসন্ধানে দেখা যায়, দাখিলকৃত দুটি সনদই ভুয়া। আদালতে দাখিলকৃত মেডিকেল সনদে স্বাক্ষর ও সিল থাকলেও এসব সনদ তাদের নয় বলে জানান চিকিৎসকরা। পরবর্তীতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চিকিৎসকদের দেয়া প্রতিবেদনে ভুয়া মেডিকেল সনদের বিষয়টি নিশ্চিত হয় পুলিশ। বিষয়টি আদালতের নজরে আসলে রাসেল জামিনে মুক্ত হন। ভুক্তভোগী রাসেলের মা মাসুমা আক্তার জানান, ‘আমরা মোহাম্মদপুর গ্রামে একটি বাড়ি ক্রয় করি। এরপর স্থানীয় শাহ আলম নামে এক ব্যক্তি আমাদের কাছে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। কিন্তু চাঁদা না দেয়ায় আমাদের নামে থানায় মিথ্যা মামলা দায়ের করে। এ মামলার সঙ্গে কিভাবে মিথ্যা সনদ আদালতে দাখিল করেছে, তা আমরা কিছুই জানি না। অথচ হয়রানির শিকার হয়েছি। ওই সময়ে আত্মসমর্পণ করে আমার ছেলেকে জেলহাজতে যেতে হয়। মামলার অন্য আসামিরা ভয়ে বাড়ি ছেড়ে আত্মগোপনে ছিল।’
গলিয়ারা দক্ষিণ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন প্রধান জানান, ‘বিষয়টি ধরা পরার পর সে আর আমাদের কাছে আসে না।’ তিনি আরও বলেন, এর আগেও শাহ আলম আমাদের মেম্বার-চেয়ারম্যানের কাগজ জালিয়াতি করেছে। ‘এ ধরনের কর্মকা- যদি সমাজে চলতে থাকে তাহলে মানুষ ন্যায়বিচার পাবে না।’
একই রকম ঘটনা আরও ঘটেছে। নগরীর চর্থা এলাকায় আরশে নূর এমি নামে এক নারীকে জখম করা হয়েছে এমন অভিযোগ এনে কুমিল্লার আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলার সঙ্গে কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালের একটি মেডিকেল সনদ আদালতে দাখিল করা হয়। পরবর্তীতে আদালতের নির্দেশে মেডিকেল সনদের সত্যতা যাচাইয়ে গত বছরের ১২ ডিসেম্বর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক বরাবরে আবেদন করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। কিন্তু হাসপাতালের রেজিস্টারের সঙ্গে দাখিলকৃত ওই সনদের সত্যতা না পাওয়ায় ওই বছরের ২৪ ডিসেম্বর ভুয়া সনদ উল্লেখ করে জেলা গোয়েন্দা শাখার ওসি বরাবরে পত্র প্রেরণ করেন হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মো. আবদুল করিম খন্দকার।
জেলার তিতাস উপজেলার বন্দরামপুর গ্রামের আক্তার হোসেনের স্ত্রী শেফালী বেগম নামে এক নারীর জখমি সনদ যাচাইয়েও চলতি বছরের গত ২ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বরাবরে আবেদন করা হয়। যা পরবর্তীতে ভুয়া প্রমাণিত হয়। একের পর এক এসব মিথ্যা সনদের কারণে হয়রানির শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। অনুসন্ধানকালে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় এসব সনদে যেসব চিকিৎসকদের নাম, সিল ও স্বাক্ষর ব্যবহার করা হয়েছে তাদের সঙ্গেও।
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার ডা. মোহাম্মদ শাওন শিকদার জানান, ‘আমি দীর্ঘদিন ধরে বাংলা সিল ব্যবহার করে আসছি। অথচ যেসব সনদ যাচাইয়ের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে, ভুয়া এ সনদগুলোতে ইংরেজি সিল ব্যবহার করা হয়েছে। যা আমার নয়। এসব ঘটনার সঙ্গে নিঃসন্দেহে কোন দালাল অথবা প্রতারকচক্র জড়িত রয়েছে। যারা দীর্ঘদিন ধরে এমন কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এটা আমাদের জানা কাম্য যে, এ চক্রের সঙ্গে কারা জড়িত। এটা জানা গেলে মানুষ সুবিচার পাবে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে।’
একই হাসপাতালের ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার ডা. মো. আবুল হাসেম মজুমদার জানান, ‘সাম্প্রতিক সময়ে এমন ঘটনা বেড়েই চলেছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যাচাই শেষে ভুয়া প্রমাণিত হচ্ছে। এসব ভুয়া সনদে আমাদের নাম ব্যবহার করায় আমরা বিব্রত হচ্ছি। তাই এ প্রতারকচক্রের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি। যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজ করার জন্য কেউ সাহস না পায় এবং আর কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এক্ষেত্রে মাঝেমাঝে আমাদেরও আদালতে গিয়ে হয়রানির শিকার হতে হয়।’
এ বিষয়ে কুমিল্লার জননিরাপত্তা বিঘœকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের সাবেক স্পেশাল পিপি অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান মিঠু জানান, ‘এ ধরনের অনিয়ম বন্ধে রাষ্ট্রের দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে একটি ক্যামেরা থাকা উচিত। যা থানা বা পুলিশ সুপার কার্যালয় থেকে সরাসরি দেখা যাবে। কোন লোকটা আহত হয়েছে, হাসপাতালে এসেছে, তার কী অবস্থা। পুলিশ সেটা তাৎক্ষণিক রেকর্ড করবে। পরবর্তীতে চিকিৎসকরা তার সনদ প্রদান করবেন। এ ব্যবস্থা প্রণয়ন করা না গেলে যা চলছে দীর্ঘদিন যাবত সেটাই চলতে থাকবে।’
এ বিষয়ে কুমিল্লা পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ জানান, ‘ভুয়া মেডিকেল সনদের বিষয়টি নজরে আসায় সব তদন্তকারী কর্মকর্তাকে সতর্ক করা হয়েছে এবং যাচাই-বাছাই শেষে আদালতে মেডিকেল সনদ প্রেরণের জন্য তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া ভুয়া মেডিকেল সনদ তৈরিতে যেসব প্রতারক চক্র জড়িত রয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে আমাদের তৎপরতা অব্যাহত আছে। কোন অবস্থাতেই এসব প্রতারক চক্রকে ছাড় দেয়া হবে না।’
এ বিষয়ে কুমিল্লার আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম সেলিম জানান, ‘যদি কোন ব্যক্তি কোন নির্দোষ মানুষকে জড়ানোর জন্য কিংবা অপমানিত করার জন্য অথবা যে কোন কারণেই হোক মিথ্যার আশ্রয় নেয় এবং মামলার সঙ্গে ভুয়া কাগজ বা ভুয়া সনদ দাখিল করে। পরবর্তীতে তা যদি ভুয়া প্রমাণিত হয়, তাহলে আদালত বিধিমোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ওই মামলায় প্রতিকার পাবেন। সিআরপিসি মোতাবেক এবং বাংলাদেশে প্রযোজ্য আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিধিমোতাবেক ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি সর্বোচ্চ শাস্তিও নিশ্চিত করা হবে।’
সোমবার, ০৫ জুলাই ২০২১ , ২১ আষাঢ় ১৪২৮ ২৩ জিলক্বদ ১৪৪২
জেলা বার্তা পরিবেশক, কুমিল্লা
কুমিল্লায় ভুয়া মেডিকেল সনদ দিয়ে আদালতে বিচারাধীন মামলা প্রভাবিত করার চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এক শ্রেণীর দালালদের মাধ্যমে এসব সনদ তৈরি করে বাদীপক্ষ আদালতে সরবরাহ করছেন। এর ফলে অপরাধ না করেও হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে বিবাদীদের। মিথ্যা এসব মামলায় হয়রানি থেকে বাঁচতে কেউ কেউ আত্মগোপনে আছেন। আবার কেউ কেউ এসব মামলায় আটক হয়ে জেল খাটছেন। দৈনিক সংবাদ-এর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে কুমিল্লার আদালতে বিচারাধীন বিভিন্ন মামলায় দাখিলকৃত এসব ভুয়া মেডিকেল সনদের তথ্য। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধে সংশ্লিষ্টদের সর্তকসহ দালাল ও প্রতারকচক্রদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন সচেতনমহল। এছাড়া অনিয়ম বন্ধে সরকারি হাসপাতালগুলোর জরুরি বিভাগগুলোতে সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে থানা ও পুলিশ সুপার কার্যালয় থেকে সরাসরি মনিটরিং শেষে সনদ দেয়ারও দাবি জানান তারা।
জানা যায়, কুমিল্লার ১৮টি থানার চলমান মামলাগুলোর বিচারিক কার্যক্রম পরিচালিত হয় জেলা দায়রা জজ আদালত এবং চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। কেউ কেউ রাজনৈতিক বা প্রভাবশালীদের কারণে থানায় মামলা করতে না পেরে আদালতে মামলা দায়ের করছেন। পারিবারিক ও সামাজিক বিভিন্ন ঘটনায় ফৌজদারি অপরাধে দায়েরকৃত এসব মামলার নথির সঙ্গে দেয়া হচ্ছে মেডিকেল সনদ। আদালতে দায়েরকৃত বিভিন্ন মামলার সঙ্গে বাদীপক্ষ ভুয়া মেডিকেল সনদ দাখিল করছেন। এসব ঘটনায় পুলিশি হয়রানির ভয়ে অনেকে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইছেন। আদালতে জামিন নামঞ্জুর হলে অনেকে আবার কারাবরণও করছেন। কয়েকটি মামলার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য।
জানা যায়, কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামের শহিদুল ইসলামের ছেলে রাসেল (২৪) গত বছর ৬ ডিসেম্বর সদর দক্ষিণ মডেল থানায় দায়েরকৃত একটি মামলায় কুমিল্লার আদালতে আত্মসমর্পণ করেন একই বছরের ২১ ডিসেম্বর। আদালত তাকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এ মামলায় প্রমাণাদি হিসেবে বাদীর পক্ষে তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতে দুটি মেডিকেল সনদ দাখিল করেন। অনুসন্ধানে দেখা যায়, দাখিলকৃত দুটি সনদই ভুয়া। আদালতে দাখিলকৃত মেডিকেল সনদে স্বাক্ষর ও সিল থাকলেও এসব সনদ তাদের নয় বলে জানান চিকিৎসকরা। পরবর্তীতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চিকিৎসকদের দেয়া প্রতিবেদনে ভুয়া মেডিকেল সনদের বিষয়টি নিশ্চিত হয় পুলিশ। বিষয়টি আদালতের নজরে আসলে রাসেল জামিনে মুক্ত হন। ভুক্তভোগী রাসেলের মা মাসুমা আক্তার জানান, ‘আমরা মোহাম্মদপুর গ্রামে একটি বাড়ি ক্রয় করি। এরপর স্থানীয় শাহ আলম নামে এক ব্যক্তি আমাদের কাছে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। কিন্তু চাঁদা না দেয়ায় আমাদের নামে থানায় মিথ্যা মামলা দায়ের করে। এ মামলার সঙ্গে কিভাবে মিথ্যা সনদ আদালতে দাখিল করেছে, তা আমরা কিছুই জানি না। অথচ হয়রানির শিকার হয়েছি। ওই সময়ে আত্মসমর্পণ করে আমার ছেলেকে জেলহাজতে যেতে হয়। মামলার অন্য আসামিরা ভয়ে বাড়ি ছেড়ে আত্মগোপনে ছিল।’
গলিয়ারা দক্ষিণ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন প্রধান জানান, ‘বিষয়টি ধরা পরার পর সে আর আমাদের কাছে আসে না।’ তিনি আরও বলেন, এর আগেও শাহ আলম আমাদের মেম্বার-চেয়ারম্যানের কাগজ জালিয়াতি করেছে। ‘এ ধরনের কর্মকা- যদি সমাজে চলতে থাকে তাহলে মানুষ ন্যায়বিচার পাবে না।’
একই রকম ঘটনা আরও ঘটেছে। নগরীর চর্থা এলাকায় আরশে নূর এমি নামে এক নারীকে জখম করা হয়েছে এমন অভিযোগ এনে কুমিল্লার আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলার সঙ্গে কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালের একটি মেডিকেল সনদ আদালতে দাখিল করা হয়। পরবর্তীতে আদালতের নির্দেশে মেডিকেল সনদের সত্যতা যাচাইয়ে গত বছরের ১২ ডিসেম্বর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক বরাবরে আবেদন করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। কিন্তু হাসপাতালের রেজিস্টারের সঙ্গে দাখিলকৃত ওই সনদের সত্যতা না পাওয়ায় ওই বছরের ২৪ ডিসেম্বর ভুয়া সনদ উল্লেখ করে জেলা গোয়েন্দা শাখার ওসি বরাবরে পত্র প্রেরণ করেন হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মো. আবদুল করিম খন্দকার।
জেলার তিতাস উপজেলার বন্দরামপুর গ্রামের আক্তার হোসেনের স্ত্রী শেফালী বেগম নামে এক নারীর জখমি সনদ যাচাইয়েও চলতি বছরের গত ২ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বরাবরে আবেদন করা হয়। যা পরবর্তীতে ভুয়া প্রমাণিত হয়। একের পর এক এসব মিথ্যা সনদের কারণে হয়রানির শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। অনুসন্ধানকালে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় এসব সনদে যেসব চিকিৎসকদের নাম, সিল ও স্বাক্ষর ব্যবহার করা হয়েছে তাদের সঙ্গেও।
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার ডা. মোহাম্মদ শাওন শিকদার জানান, ‘আমি দীর্ঘদিন ধরে বাংলা সিল ব্যবহার করে আসছি। অথচ যেসব সনদ যাচাইয়ের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে, ভুয়া এ সনদগুলোতে ইংরেজি সিল ব্যবহার করা হয়েছে। যা আমার নয়। এসব ঘটনার সঙ্গে নিঃসন্দেহে কোন দালাল অথবা প্রতারকচক্র জড়িত রয়েছে। যারা দীর্ঘদিন ধরে এমন কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এটা আমাদের জানা কাম্য যে, এ চক্রের সঙ্গে কারা জড়িত। এটা জানা গেলে মানুষ সুবিচার পাবে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে।’
একই হাসপাতালের ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার ডা. মো. আবুল হাসেম মজুমদার জানান, ‘সাম্প্রতিক সময়ে এমন ঘটনা বেড়েই চলেছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যাচাই শেষে ভুয়া প্রমাণিত হচ্ছে। এসব ভুয়া সনদে আমাদের নাম ব্যবহার করায় আমরা বিব্রত হচ্ছি। তাই এ প্রতারকচক্রের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি। যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজ করার জন্য কেউ সাহস না পায় এবং আর কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এক্ষেত্রে মাঝেমাঝে আমাদেরও আদালতে গিয়ে হয়রানির শিকার হতে হয়।’
এ বিষয়ে কুমিল্লার জননিরাপত্তা বিঘœকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের সাবেক স্পেশাল পিপি অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান মিঠু জানান, ‘এ ধরনের অনিয়ম বন্ধে রাষ্ট্রের দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে একটি ক্যামেরা থাকা উচিত। যা থানা বা পুলিশ সুপার কার্যালয় থেকে সরাসরি দেখা যাবে। কোন লোকটা আহত হয়েছে, হাসপাতালে এসেছে, তার কী অবস্থা। পুলিশ সেটা তাৎক্ষণিক রেকর্ড করবে। পরবর্তীতে চিকিৎসকরা তার সনদ প্রদান করবেন। এ ব্যবস্থা প্রণয়ন করা না গেলে যা চলছে দীর্ঘদিন যাবত সেটাই চলতে থাকবে।’
এ বিষয়ে কুমিল্লা পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ জানান, ‘ভুয়া মেডিকেল সনদের বিষয়টি নজরে আসায় সব তদন্তকারী কর্মকর্তাকে সতর্ক করা হয়েছে এবং যাচাই-বাছাই শেষে আদালতে মেডিকেল সনদ প্রেরণের জন্য তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া ভুয়া মেডিকেল সনদ তৈরিতে যেসব প্রতারক চক্র জড়িত রয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে আমাদের তৎপরতা অব্যাহত আছে। কোন অবস্থাতেই এসব প্রতারক চক্রকে ছাড় দেয়া হবে না।’
এ বিষয়ে কুমিল্লার আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম সেলিম জানান, ‘যদি কোন ব্যক্তি কোন নির্দোষ মানুষকে জড়ানোর জন্য কিংবা অপমানিত করার জন্য অথবা যে কোন কারণেই হোক মিথ্যার আশ্রয় নেয় এবং মামলার সঙ্গে ভুয়া কাগজ বা ভুয়া সনদ দাখিল করে। পরবর্তীতে তা যদি ভুয়া প্রমাণিত হয়, তাহলে আদালত বিধিমোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ওই মামলায় প্রতিকার পাবেন। সিআরপিসি মোতাবেক এবং বাংলাদেশে প্রযোজ্য আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিধিমোতাবেক ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি সর্বোচ্চ শাস্তিও নিশ্চিত করা হবে।’