হাসপাতালে অর্ধেক রোগীই গ্রামের

গ্রামাঞ্চলে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে করোনা সংক্রমণ। দেশের প্রায় সর্বস্তরেই সামাজিক বিস্তার ঘটাচ্ছে করোনার ডেল্টা ধরন। এতদিন জেলা-উপজেলা সদর ও শহরকেন্দ্রিক সংক্রমণ ঘটলেও বর্তমানে অর্ধেক রোগীই শনাক্ত হচ্ছে তৃণমূল পর্যায় বা গ্রামাঞ্চলে।

চিকিৎসকরা বলছেন, গ্রামাঞ্চলের লোকজন করোনা সংক্রমিত হয়েও প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হচ্ছেন না। অনেকেই করোনাকে ‘সাধারণ জ¦র, সর্দি-কাশি’ ভেবে গাফিলতি করছেন। এতে সময় ক্ষেপণ হওয়ায় অনেকের শ^াসকষ্ট বেড়ে যায়, অক্সিজেন লেভেল নিচে নেমে যায়। শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকলে তখনই হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে রোগীকে। এ কারণে সারাদেশেই করোনায় মৃত্যু দ্রুত বাড়ছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।

করোনায় গত একদিনে দেশে রেকর্ড ১৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদিন শনাক্তেরও রেকর্ড গড়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় দেশে সর্বোচ্চ ৯ হাজার ৯৬৪ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ পেয়েছে স্বাস্থ্যকর্মীরা। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে শনাক্তের হার ছিল ২৯ শতাংশের উপরে।

দেশে এখন যে সংক্রমণ হচ্ছে তা ‘কমিউনিটি’তে ছড়িয়ে গেছে জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘সংক্রমণ গ্রামের লোকজনের মধ্যে বেশি হচ্ছে। আমাদের কাছে যে হিসাব আছে, তাতে আমরা দেখতে পাচ্ছি ৫০ শতাংশের বেশি রোগী গ্রাম থেকে আসছে।’

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ৪ জুলাই এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, জুন মাসে দেশে ‘কোভিড-১৯’ রোগীদের নমুনা থেকে ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স করে দেখা গেছে, ৭৮ শতাংশই ডেল্টা ধরনে আক্রান্ত।

গত মার্চের প্রথমদিকে দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়। এপ্রিলে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন অর্থাৎ ‘ডেল্টা’র উপস্থিতি শনাক্ত হয়। এপ্রিলের পর থেকেই করোনা প্রাদুর্ভাব দ্রুত বাড়তে থাকে।

ঢাকা জেলা ছাড়া ঢাকা বিভাগের ১৩ জেলার মধ্যে গত বেশ কিছুদিন ধরেই সবচেয়ে বেশি করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হচ্ছে টাঙ্গাইলে। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় এই জেলায় ২২৭ জনের করোনা শনাক্ত হয় এবং ছয়জন মারা যান। আগের দিনও টাঙ্গাইলে ১৯৫ জনের করোনা শনাক্ত এবং মৃত্যু হয় পাঁচজনের।

টাঙ্গাইলে করোনা পরিস্থিতির অবনতির বিষয়ে জানতে চাইলে জেলার সিভিল সার্জন ডা. আবুল ফজল মো. শাহাবুদ্দীন খান সংবাদকে বলেন, ‘দেশের উত্তরাঞ্চলের ২২টি জেলার গেটওয়ে টাঙ্গাইল। এগুলোর মধ্যে সীমান্তবর্তী জেলাই বেশি। ২২টি জেলার মানুষ টাঙ্গাইল দিয়ে সারাদেশের যাতায়াত করেন, এখানে থামেন, বিভিন্ন হোটেলে রাত্রীযাপন করেন।’

সীমান্তবর্তী জেলায় সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার পর টাঙ্গাইলের ‘গেটওয়ে’গুলো নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাব করা হয়েছিল জানিয়ে সিভিল সার্জন বলেন, ‘কিন্তু তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এখন দেশের ৫০টি উচ্চ সংক্রমিত জেলার মধ্যে টাঙ্গাইল অন্যতম। অন্যান্য জেলার মতো এখানেও গ্রামাঞ্চলে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। তবে আক্রান্ত হয়েও মানুষজন হাসপাতালে আসছেন না, দেরিতে আসছেন। অক্সিজেনের লেভেল নিচে নেমে গেলে কিংবা শ^াসকষ্ট বেড়ে গেলেই হাসপাতালে আসছেন। এতে দ্রুত রোগী মারা যাচ্ছেন। চিকিৎসকদের কিছু করার থাকছে না।’

দেরিতে হাসপাতালে নেয়ায়

মৃত্যু বেশি

বর্ষা মৌসুম চলায় করোনা সংক্রমিত হয়েও মানুষ একে জ্বর, সর্দি-কাশি ভাবছেন জানিয়ে ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বলেন, সে কারণে হাসপাতালে আসছে কম। সময়মতো চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু বেশি হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘আমরা সবগুলো উপজেলায় কথা বলেছি। সবার পর্যবেক্ষণ একটাই, রোগীদের অনেকেই অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে ৪০-৫০ এ নেমে গেলে হাসপাতালে আসছেন।’

অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গেলে ‘ব্রেইন ড্যামেজ’ আগেই হয়ে যায়, মন্তব্য করে ডা. খুরশীদ আলম বলেন, ‘এ ধরনের রোগীদের বাঁচানো খুব কঠিন হয়। গ্রামের রোগীরা অসতর্ক, গ্রামের বয়স্ক মানুষ হাসপাতালে আসেন অনেক পরে, এ কারণে মৃত্যুর হার বেশি হচ্ছে।’

একদিনে শনাক্ত প্রায় ১০ হাজার

গতকাল সকাল আটটা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে রেকর্ড নয় হাজার ৯৬৪ জনের দেহে করোনাভাইরাসের জীবাণু শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়ালো ৯ লাখ ৫৪ হাজার ৮৮১ জনে।

গতকাল বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

২৪ ঘণ্টায় মৃত্যুর রেকর্ড

সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় করোনায় দেশে ১৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে করোনায় মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ালো ১৫ হাজার ২২৯ জনে।

গত একদিনে মৃত্যু হওয়া লোকজনের মধ্যে পুরুষ ১০৯ জন ও নারী ৫৫ জন। তাদের মধ্যে সরকারি হাসপাতালে ১২৩ জন, বেসরকারি হাসপাতালে ২৫ জন ও বাসায় মারা গেছেন ১৫ জন, আর হাসপাতালে মৃত অবস্থায় একজনকে আনা হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে সরকারি ও বেসরকারি ৬০৫টি ল্যাবরেটরিতে ৩৪ হাজার দুটি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এ নিয়ে মোট নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা দাঁড়ালো ৬৭ লাখ ৫৭ হাজার ৫৬২টি।

সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে করোনা সংক্রমণ শনাক্তের হার ২৯ দশমিক ৩০ শতাংশ। আর এ পর্যন্ত শনাক্তের মোট হার ১৪ দশমিক ১৩ শতাংশ।

গত একদিনে সুস্থ হয়েছেন পাঁচ হাজার ১৮৫ জন। এ নিয়ে মোট সুস্থ রোগীর সংখ্যা দাঁড়ালো আট লাখ ৩৯ হাজার ৮২ জনে। মোট সুস্থতার হার ৮৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ।

একদিনে মৃত্যু হওয়া ১৬৪ জনের মধ্যে ৮৩ জনের বয়স ছিল ৬০ বছরের বেশি, অন্যদের মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে ৪৭ জন, ৪০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ১৮ জন, ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সী ১২ জন ও ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সী চারজনের মৃত্যু হয়েছে।

বিভাগভিত্তিক হিসাবে দেখা গেছে, গত একদিনে সবচেয়ে বেশি ৫৫ জনের মৃত্যু হয়েছে খুলনা বিভাগে। এছাড়া ঢাকা বিভাগে ৪০ জন, চট্টগ্রামে ১৮ জন, রাজশাহীতে ১৬ জন, খুলনায় ৫৫ জন, বরিশালে ৯ জন, সিলেটে আটজন, রংপুরে ১৬ জন ও ময়মনসিংহ বিভাগে দুইজনের মৃত্যু হয়।

শনাক্ত বেড়েছে সব বিভাগেই

সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় সবকটি বিভাগেই করোনা রোগী শনাক্ত বেড়েছে। ঢাকা বিভাগে গত একদিনে ১৬ হাজার ২৬৪টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। এই পরীক্ষায় চার হাজার ২৫০ জনের দেহে করোনাভাইরাসের জীবাণু শনাক্ত হয়েছে। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে জীবাণু শনাক্তের হার ২৬ দশমিক ১৩ শতাংশ। আগের দিন ঢাকা বিভাগে চার হাজার ২০৭ জন রোগী শনাক্ত হয়।

আর ঢাকা মহানগরসহ জেলায় গত একদিনে ১৩ হাজার ২৯৬টি নমুনা পরীক্ষায় তিন হাজার ১৯৫ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে সংক্রমণ শনাক্তের হার ২৪ দশমিক ০২ শতাংশ। আগের দিন ঢাকা দুই হাজার ৯৪৩ জনের করোনা শনাক্ত হয়।

ময়মনসিংহ বিভাগে একদিনে এক হাজার ২২৩টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। এই পরীক্ষায় ৩৮৯ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ পাওয়া গেছে। পরীক্ষা বিবেচনায় সংক্রমণের হার ৩১ দশমিক ৮০ শতাংশ। আগের দিন এই বিভাগে ৩৫৮ জনের দেহে সংক্রমণ শনাক্ত হয়।

চট্টগ্রাম বিভাগে ২৪ ঘণ্টায় চার হাজার ৪৮৮টি নমুনা পরীক্ষায় এক হাজার ৩৬৭ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। চট্টগ্রামে শনাক্তের হার ৩০ দশমিক ৪৫ শতাংশ। আগের দিন চট্টগ্রাম বিভাগে ৬৭৩ জনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়।

রাজশাহী বিভাগে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় চার হাজার ২৩৩টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। এই পরীক্ষায় এক হাজার ১২৩ জনের দেহে করোনার জীবাণু শনাক্ত হয়েছে। পরীক্ষা অনুপাতে শনাক্তের হার ২৬ দশমিক ৫২ শতাংশ। রাজশাহী বিভাগে আগের দিন ৯৯২ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছিল।

রংপুর বিভাগে গত একদিনে এক হাজার ৯৭৫টি নমুনা পরীক্ষায় ৬৭৬ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া গেছে। সংক্রমণের হার ৩৪ দশমিক ২২ শতাংশ। আগের দিন রংপুরে ৫৫৬ জনের ‘কোভিড-১৯’ শনাক্ত হয়েছিল।

খুলনা বিভাগে ২৪ ঘণ্টায় চার হাজার ১২১টি নমুনা পরীক্ষায় হয়েছে। এই পরীক্ষায় এক হাজার ৪৭০ জনের দেহে করোনার জীবাণু পাওয়া গেছে। পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ৩৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ। আগের দিন এই বিভাগে এক হাজার ৩০৪ জনের করোনা ধরা পড়েছিল।

বরিশাল বিভাগে গত একদিনে ৯৫৩টি নমুনা পরীক্ষায় ৪৩৬ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ পাওয়া গেছে। পরীক্ষা অনুপাতে জীবাণু শনাক্তের হার ৪৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ। আগের দিন বরিশাল বিভাগে ৩৪৩ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছিল।

সিলেট বিভাগে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ৭৪৫টি নমুনা পরীক্ষায় ২৫৩ জনের দেহে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। সিলেটে সংক্রমণের হার ৩৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ। আগের দিন এই বিভাগে ২২৮ জনের শরীরে করোনার জীবাণু পাওয়া যায়।

গ্রামের রোগী

রাজশাহী মির্জাপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি জানান, রাজশাহীর বাগমারায় হাসপাতালে ভর্তির কিছুক্ষণ পর করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান রহিমা বেগম (৭০) নামের এক নারী। অন্যদিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় করোনা আক্রান্ত হয়ে বাড়িতে মারা যান এক এনজিও কর্মকর্তা। গতকাল সকালে করোনায় ওই দুজন মারা যান।

মৃতরা হলেন উপজেলার শ্রীপুর গ্রামের হাবিবুর রহমানের স্ত্রী রহিমা বেগম এবং ভবানীগঞ্জ পৌরসভার সাদোপাড়া গ্রামের মুকুল হোসেন (৫৬)। জানা গেছে, গতকাল সকালে ৯টার কিছুক্ষণ আগে করোনার উপসর্গ নিয়ে রহিমা বেগমকে বাগমারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। করোনা পরীক্ষার আগে চিকিৎসা করা যাবে না জানিয়ে হাসপাতালের বারান্দায় রাখা হয় তাকে। সকাল ৯টায় ল্যাব টেকনিশিয়ান হাসপাতালে এলে বৃদ্ধার অ্যান্টিজেন পরীক্ষার জন্য নমুনা নেয়া হয়। এরপরই চিকিৎসকদের সামনে ছটফট করে মারা যান ওই বৃদ্ধা। মারা যাওয়ার পরে তার করোনা পজেটিভ রিপোর্ট আসে।

স্বজনরা অভিযোগ করেন, রহিমার শ্বাসকষ্ট ছিল। অক্সিজেনের প্রয়োজন থাকার পরও হাসপাতাল থেকে এর ব্যবস্থা করা হয়নি এবং চিকিৎসায় চিকিৎসকদের চরম অবহেলা ছিল।

অন্যদিকে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে করোনা আক্রান্ত হয়ে ভবানীগঞ্জ পৌরসভার সাদোপাড়া গ্রামে এনজিও কর্মকর্তা মুকুল হোসেন (৫৬) মারা যান। তিনি রংপুরে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন।

স্থানীয়রা জানান, লকডাউন ঘোষণার পর মুকুল বাড়িতে চলে আসেন। করোনার উপসর্গ দেখা দেয়ায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে নমুনা পরীক্ষা করেন তিনি। এরপর পজিটিভ প্রতিবেদন আসে তার। পরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকদের পরামর্শে বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন মুকুল।

উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। এ নিয়ে উপজেলায় করোনায় ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া উপসর্গ নিয়ে আরও তিনজন মারা গেছেন। বর্তমানে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আইসোলেশনে তিনজন চিকিৎসাধীন আছেন। এদের মধ্যে দু’জন পুরুষ এবং একজন নারী।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা গোলাম রাব্বানী বলেন, মৃত্যুর পরই রহিমা বেগমের করোনা পজেটিভ প্রতিবেদন আসে। কিন্তু চিকিৎসকদের অবহেলার বিষয়ে কিছু বলেননি তিনি।

এদিকে হাসপাতালে করোনা সংক্রমিত অনেক রোগীই আসছেন শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়ার পর। এ কারণে মৃত্যু বেশি আবার অনেকে পথেই মারা যাচ্ছে।

কিছুদিন আগেও গ্রামের মানুষের মুখে মুখে একটাই কথা ছিল, ‘আমাদের গ্রামে করোনা নেই, আমাদের করোনাভাইরাস হবে না’। এজন্য তারা মুখে মাস্ক পরা বা অন্য কোন স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কাই করতেন না। কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছে পরিস্থিতি ততই ভয়াবহ হয়ে উঠছে। বিশেষ করে করোনার প্রকোপ এখন বিভাগীয় শহর রাজশাহীর পাশাপাশি গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ছে।

প্রতিদিনই গ্রাম থেকে আসা করোনা রোগীর চাপ বাড়ছে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (রামেক) ভর্তি করোনা আক্রান্ত রোগীর ৪০ শতাংশই গ্রামাঞ্চলের। আর করোনায় মৃতদের মধ্যে অধিকাংশাই ভারতের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত ছিলেন, বলছেন চিকিৎসকরা।

চিকিৎসকরা বলছেন, হঠাৎ করেই করোনা আক্রান্ত রোগীর অবস্থা বেশিমাত্রায় খারাপ হয়ে যাচ্ছে। হাসপাতালে আসা রোগীদের অক্সিজেন স্যাচুরেশন কম থাকছে। শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা হঠাৎ করে বাড়ছে। শারীরিক অবস্থার নানা ধরনগুলো দ্রুতই পরিবর্তন হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসা করার সময়ও দিচ্ছে না এই ধরনগুলো। শহরে যেমনভাবে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানা হচ্ছে গ্রামে তা হচ্ছে না। ফলে গ্রামাঞ্চল থেকে এখন বেশি রোগী আসছে।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডা. পার্থ মণি ভট্টাচার্য বলেন, এবার রোগী ভর্তির পর থেকেই শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়া এবং অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমতে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। লিভার, কিডনি ও ডায়াবেটিস রোগীদের সমস্যা আরও বেশি।

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জানান, কুষ্টিয়ায় কিছুতেই কমছে না করোনার ভয়াবহতা। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা আক্রান্ত হয়ে ১৭ জন ও উপসর্গ নিয়ে ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সকালে এ তথ্য নিশ্চিত করেন কুষ্টিয়া করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আবদুল মোমিন।

এদিকে কুষ্টিয়ায় করোনার সংক্রমণের হার উর্ধ্বগতির বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আমিনুল হক রতন বলেন, ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এমনই, দ্রুত আক্রমণ করে, বেশি মৃত্যুর কারণ হয়। অধিকাংশ রোগীকে অক্সিজেন দেয়ার দরকার হচ্ছে। রোগীর সংখ্যা বাড়ায় অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে কাড়াকাড়ি লেগে যাচ্ছে। গ্রামে ঘরে ঘরে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। সচেতনার অভাবে রোগী মৃত্যুর হার বাড়ছে।

তিনি আরও জানান, মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অধিকাংশই গ্রামের বাসিন্দা। তাদের বয়স ৫০-এর বেশি। গ্রামের মানুষ এ সময় জ¦র-ঠা-া নিয়ে বেশ উদাসীন। পরিবারের কেউ জ¦র, ঠা-া বা কাশিতে আক্রান্ত হলে কেউ প্রকাশ করছেন না। এরা করোনা পরীক্ষায় আগ্রহী হচ্ছে না, গ্রামের বাসিন্দারা মনে করেন করোনা পরীক্ষায় শনাক্ত হলে বাড়ি লকডাউন হয়ে যাচ্ছে, এই ভয়ে কেউ জ¦র, কাশি বা ঠা-া আক্রান্ত হলেও প্রকাশ করছে না। সাধারণ জ¦র মনে করে সতর্ক না হয়ে সাধারণভাবেই পরিবারের সদস্যদের মাঝে চলাফেরা করছেন। এতে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে।

জেলার একমাত্র করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল ২৫০ শয্যার কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে রোগীর ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে এ হাসপাতালে ২৫০টি শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তি আছেন প্রায় ৩০০ জন।

মঙ্গলবার, ০৬ জুলাই ২০২১ , ২২ আষাঢ় ১৪২৮ ২৪ জিলক্বদ ১৪৪২

বেড়েই চলেছে সংক্রমণ-মৃত্যু

হাসপাতালে অর্ধেক রোগীই গ্রামের

রাকিব উদ্দিন

গ্রামাঞ্চলে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে করোনা সংক্রমণ। দেশের প্রায় সর্বস্তরেই সামাজিক বিস্তার ঘটাচ্ছে করোনার ডেল্টা ধরন। এতদিন জেলা-উপজেলা সদর ও শহরকেন্দ্রিক সংক্রমণ ঘটলেও বর্তমানে অর্ধেক রোগীই শনাক্ত হচ্ছে তৃণমূল পর্যায় বা গ্রামাঞ্চলে।

চিকিৎসকরা বলছেন, গ্রামাঞ্চলের লোকজন করোনা সংক্রমিত হয়েও প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হচ্ছেন না। অনেকেই করোনাকে ‘সাধারণ জ¦র, সর্দি-কাশি’ ভেবে গাফিলতি করছেন। এতে সময় ক্ষেপণ হওয়ায় অনেকের শ^াসকষ্ট বেড়ে যায়, অক্সিজেন লেভেল নিচে নেমে যায়। শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকলে তখনই হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে রোগীকে। এ কারণে সারাদেশেই করোনায় মৃত্যু দ্রুত বাড়ছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।

করোনায় গত একদিনে দেশে রেকর্ড ১৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদিন শনাক্তেরও রেকর্ড গড়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় দেশে সর্বোচ্চ ৯ হাজার ৯৬৪ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ পেয়েছে স্বাস্থ্যকর্মীরা। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে শনাক্তের হার ছিল ২৯ শতাংশের উপরে।

দেশে এখন যে সংক্রমণ হচ্ছে তা ‘কমিউনিটি’তে ছড়িয়ে গেছে জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘সংক্রমণ গ্রামের লোকজনের মধ্যে বেশি হচ্ছে। আমাদের কাছে যে হিসাব আছে, তাতে আমরা দেখতে পাচ্ছি ৫০ শতাংশের বেশি রোগী গ্রাম থেকে আসছে।’

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ৪ জুলাই এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, জুন মাসে দেশে ‘কোভিড-১৯’ রোগীদের নমুনা থেকে ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স করে দেখা গেছে, ৭৮ শতাংশই ডেল্টা ধরনে আক্রান্ত।

গত মার্চের প্রথমদিকে দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়। এপ্রিলে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন অর্থাৎ ‘ডেল্টা’র উপস্থিতি শনাক্ত হয়। এপ্রিলের পর থেকেই করোনা প্রাদুর্ভাব দ্রুত বাড়তে থাকে।

ঢাকা জেলা ছাড়া ঢাকা বিভাগের ১৩ জেলার মধ্যে গত বেশ কিছুদিন ধরেই সবচেয়ে বেশি করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হচ্ছে টাঙ্গাইলে। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় এই জেলায় ২২৭ জনের করোনা শনাক্ত হয় এবং ছয়জন মারা যান। আগের দিনও টাঙ্গাইলে ১৯৫ জনের করোনা শনাক্ত এবং মৃত্যু হয় পাঁচজনের।

টাঙ্গাইলে করোনা পরিস্থিতির অবনতির বিষয়ে জানতে চাইলে জেলার সিভিল সার্জন ডা. আবুল ফজল মো. শাহাবুদ্দীন খান সংবাদকে বলেন, ‘দেশের উত্তরাঞ্চলের ২২টি জেলার গেটওয়ে টাঙ্গাইল। এগুলোর মধ্যে সীমান্তবর্তী জেলাই বেশি। ২২টি জেলার মানুষ টাঙ্গাইল দিয়ে সারাদেশের যাতায়াত করেন, এখানে থামেন, বিভিন্ন হোটেলে রাত্রীযাপন করেন।’

সীমান্তবর্তী জেলায় সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার পর টাঙ্গাইলের ‘গেটওয়ে’গুলো নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাব করা হয়েছিল জানিয়ে সিভিল সার্জন বলেন, ‘কিন্তু তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এখন দেশের ৫০টি উচ্চ সংক্রমিত জেলার মধ্যে টাঙ্গাইল অন্যতম। অন্যান্য জেলার মতো এখানেও গ্রামাঞ্চলে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। তবে আক্রান্ত হয়েও মানুষজন হাসপাতালে আসছেন না, দেরিতে আসছেন। অক্সিজেনের লেভেল নিচে নেমে গেলে কিংবা শ^াসকষ্ট বেড়ে গেলেই হাসপাতালে আসছেন। এতে দ্রুত রোগী মারা যাচ্ছেন। চিকিৎসকদের কিছু করার থাকছে না।’

দেরিতে হাসপাতালে নেয়ায়

মৃত্যু বেশি

বর্ষা মৌসুম চলায় করোনা সংক্রমিত হয়েও মানুষ একে জ্বর, সর্দি-কাশি ভাবছেন জানিয়ে ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বলেন, সে কারণে হাসপাতালে আসছে কম। সময়মতো চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু বেশি হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘আমরা সবগুলো উপজেলায় কথা বলেছি। সবার পর্যবেক্ষণ একটাই, রোগীদের অনেকেই অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে ৪০-৫০ এ নেমে গেলে হাসপাতালে আসছেন।’

অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গেলে ‘ব্রেইন ড্যামেজ’ আগেই হয়ে যায়, মন্তব্য করে ডা. খুরশীদ আলম বলেন, ‘এ ধরনের রোগীদের বাঁচানো খুব কঠিন হয়। গ্রামের রোগীরা অসতর্ক, গ্রামের বয়স্ক মানুষ হাসপাতালে আসেন অনেক পরে, এ কারণে মৃত্যুর হার বেশি হচ্ছে।’

একদিনে শনাক্ত প্রায় ১০ হাজার

গতকাল সকাল আটটা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে রেকর্ড নয় হাজার ৯৬৪ জনের দেহে করোনাভাইরাসের জীবাণু শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়ালো ৯ লাখ ৫৪ হাজার ৮৮১ জনে।

গতকাল বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

২৪ ঘণ্টায় মৃত্যুর রেকর্ড

সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় করোনায় দেশে ১৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে করোনায় মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ালো ১৫ হাজার ২২৯ জনে।

গত একদিনে মৃত্যু হওয়া লোকজনের মধ্যে পুরুষ ১০৯ জন ও নারী ৫৫ জন। তাদের মধ্যে সরকারি হাসপাতালে ১২৩ জন, বেসরকারি হাসপাতালে ২৫ জন ও বাসায় মারা গেছেন ১৫ জন, আর হাসপাতালে মৃত অবস্থায় একজনকে আনা হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে সরকারি ও বেসরকারি ৬০৫টি ল্যাবরেটরিতে ৩৪ হাজার দুটি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এ নিয়ে মোট নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা দাঁড়ালো ৬৭ লাখ ৫৭ হাজার ৫৬২টি।

সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে করোনা সংক্রমণ শনাক্তের হার ২৯ দশমিক ৩০ শতাংশ। আর এ পর্যন্ত শনাক্তের মোট হার ১৪ দশমিক ১৩ শতাংশ।

গত একদিনে সুস্থ হয়েছেন পাঁচ হাজার ১৮৫ জন। এ নিয়ে মোট সুস্থ রোগীর সংখ্যা দাঁড়ালো আট লাখ ৩৯ হাজার ৮২ জনে। মোট সুস্থতার হার ৮৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ।

একদিনে মৃত্যু হওয়া ১৬৪ জনের মধ্যে ৮৩ জনের বয়স ছিল ৬০ বছরের বেশি, অন্যদের মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে ৪৭ জন, ৪০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ১৮ জন, ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সী ১২ জন ও ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সী চারজনের মৃত্যু হয়েছে।

বিভাগভিত্তিক হিসাবে দেখা গেছে, গত একদিনে সবচেয়ে বেশি ৫৫ জনের মৃত্যু হয়েছে খুলনা বিভাগে। এছাড়া ঢাকা বিভাগে ৪০ জন, চট্টগ্রামে ১৮ জন, রাজশাহীতে ১৬ জন, খুলনায় ৫৫ জন, বরিশালে ৯ জন, সিলেটে আটজন, রংপুরে ১৬ জন ও ময়মনসিংহ বিভাগে দুইজনের মৃত্যু হয়।

শনাক্ত বেড়েছে সব বিভাগেই

সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় সবকটি বিভাগেই করোনা রোগী শনাক্ত বেড়েছে। ঢাকা বিভাগে গত একদিনে ১৬ হাজার ২৬৪টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। এই পরীক্ষায় চার হাজার ২৫০ জনের দেহে করোনাভাইরাসের জীবাণু শনাক্ত হয়েছে। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে জীবাণু শনাক্তের হার ২৬ দশমিক ১৩ শতাংশ। আগের দিন ঢাকা বিভাগে চার হাজার ২০৭ জন রোগী শনাক্ত হয়।

আর ঢাকা মহানগরসহ জেলায় গত একদিনে ১৩ হাজার ২৯৬টি নমুনা পরীক্ষায় তিন হাজার ১৯৫ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে সংক্রমণ শনাক্তের হার ২৪ দশমিক ০২ শতাংশ। আগের দিন ঢাকা দুই হাজার ৯৪৩ জনের করোনা শনাক্ত হয়।

ময়মনসিংহ বিভাগে একদিনে এক হাজার ২২৩টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। এই পরীক্ষায় ৩৮৯ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ পাওয়া গেছে। পরীক্ষা বিবেচনায় সংক্রমণের হার ৩১ দশমিক ৮০ শতাংশ। আগের দিন এই বিভাগে ৩৫৮ জনের দেহে সংক্রমণ শনাক্ত হয়।

চট্টগ্রাম বিভাগে ২৪ ঘণ্টায় চার হাজার ৪৮৮টি নমুনা পরীক্ষায় এক হাজার ৩৬৭ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। চট্টগ্রামে শনাক্তের হার ৩০ দশমিক ৪৫ শতাংশ। আগের দিন চট্টগ্রাম বিভাগে ৬৭৩ জনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়।

রাজশাহী বিভাগে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় চার হাজার ২৩৩টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। এই পরীক্ষায় এক হাজার ১২৩ জনের দেহে করোনার জীবাণু শনাক্ত হয়েছে। পরীক্ষা অনুপাতে শনাক্তের হার ২৬ দশমিক ৫২ শতাংশ। রাজশাহী বিভাগে আগের দিন ৯৯২ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছিল।

রংপুর বিভাগে গত একদিনে এক হাজার ৯৭৫টি নমুনা পরীক্ষায় ৬৭৬ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া গেছে। সংক্রমণের হার ৩৪ দশমিক ২২ শতাংশ। আগের দিন রংপুরে ৫৫৬ জনের ‘কোভিড-১৯’ শনাক্ত হয়েছিল।

খুলনা বিভাগে ২৪ ঘণ্টায় চার হাজার ১২১টি নমুনা পরীক্ষায় হয়েছে। এই পরীক্ষায় এক হাজার ৪৭০ জনের দেহে করোনার জীবাণু পাওয়া গেছে। পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ৩৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ। আগের দিন এই বিভাগে এক হাজার ৩০৪ জনের করোনা ধরা পড়েছিল।

বরিশাল বিভাগে গত একদিনে ৯৫৩টি নমুনা পরীক্ষায় ৪৩৬ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ পাওয়া গেছে। পরীক্ষা অনুপাতে জীবাণু শনাক্তের হার ৪৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ। আগের দিন বরিশাল বিভাগে ৩৪৩ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছিল।

সিলেট বিভাগে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ৭৪৫টি নমুনা পরীক্ষায় ২৫৩ জনের দেহে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। সিলেটে সংক্রমণের হার ৩৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ। আগের দিন এই বিভাগে ২২৮ জনের শরীরে করোনার জীবাণু পাওয়া যায়।

গ্রামের রোগী

রাজশাহী মির্জাপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি জানান, রাজশাহীর বাগমারায় হাসপাতালে ভর্তির কিছুক্ষণ পর করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান রহিমা বেগম (৭০) নামের এক নারী। অন্যদিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় করোনা আক্রান্ত হয়ে বাড়িতে মারা যান এক এনজিও কর্মকর্তা। গতকাল সকালে করোনায় ওই দুজন মারা যান।

মৃতরা হলেন উপজেলার শ্রীপুর গ্রামের হাবিবুর রহমানের স্ত্রী রহিমা বেগম এবং ভবানীগঞ্জ পৌরসভার সাদোপাড়া গ্রামের মুকুল হোসেন (৫৬)। জানা গেছে, গতকাল সকালে ৯টার কিছুক্ষণ আগে করোনার উপসর্গ নিয়ে রহিমা বেগমকে বাগমারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। করোনা পরীক্ষার আগে চিকিৎসা করা যাবে না জানিয়ে হাসপাতালের বারান্দায় রাখা হয় তাকে। সকাল ৯টায় ল্যাব টেকনিশিয়ান হাসপাতালে এলে বৃদ্ধার অ্যান্টিজেন পরীক্ষার জন্য নমুনা নেয়া হয়। এরপরই চিকিৎসকদের সামনে ছটফট করে মারা যান ওই বৃদ্ধা। মারা যাওয়ার পরে তার করোনা পজেটিভ রিপোর্ট আসে।

স্বজনরা অভিযোগ করেন, রহিমার শ্বাসকষ্ট ছিল। অক্সিজেনের প্রয়োজন থাকার পরও হাসপাতাল থেকে এর ব্যবস্থা করা হয়নি এবং চিকিৎসায় চিকিৎসকদের চরম অবহেলা ছিল।

অন্যদিকে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে করোনা আক্রান্ত হয়ে ভবানীগঞ্জ পৌরসভার সাদোপাড়া গ্রামে এনজিও কর্মকর্তা মুকুল হোসেন (৫৬) মারা যান। তিনি রংপুরে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন।

স্থানীয়রা জানান, লকডাউন ঘোষণার পর মুকুল বাড়িতে চলে আসেন। করোনার উপসর্গ দেখা দেয়ায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে নমুনা পরীক্ষা করেন তিনি। এরপর পজিটিভ প্রতিবেদন আসে তার। পরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকদের পরামর্শে বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন মুকুল।

উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। এ নিয়ে উপজেলায় করোনায় ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া উপসর্গ নিয়ে আরও তিনজন মারা গেছেন। বর্তমানে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আইসোলেশনে তিনজন চিকিৎসাধীন আছেন। এদের মধ্যে দু’জন পুরুষ এবং একজন নারী।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা গোলাম রাব্বানী বলেন, মৃত্যুর পরই রহিমা বেগমের করোনা পজেটিভ প্রতিবেদন আসে। কিন্তু চিকিৎসকদের অবহেলার বিষয়ে কিছু বলেননি তিনি।

এদিকে হাসপাতালে করোনা সংক্রমিত অনেক রোগীই আসছেন শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়ার পর। এ কারণে মৃত্যু বেশি আবার অনেকে পথেই মারা যাচ্ছে।

কিছুদিন আগেও গ্রামের মানুষের মুখে মুখে একটাই কথা ছিল, ‘আমাদের গ্রামে করোনা নেই, আমাদের করোনাভাইরাস হবে না’। এজন্য তারা মুখে মাস্ক পরা বা অন্য কোন স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কাই করতেন না। কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছে পরিস্থিতি ততই ভয়াবহ হয়ে উঠছে। বিশেষ করে করোনার প্রকোপ এখন বিভাগীয় শহর রাজশাহীর পাশাপাশি গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ছে।

প্রতিদিনই গ্রাম থেকে আসা করোনা রোগীর চাপ বাড়ছে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (রামেক) ভর্তি করোনা আক্রান্ত রোগীর ৪০ শতাংশই গ্রামাঞ্চলের। আর করোনায় মৃতদের মধ্যে অধিকাংশাই ভারতের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত ছিলেন, বলছেন চিকিৎসকরা।

চিকিৎসকরা বলছেন, হঠাৎ করেই করোনা আক্রান্ত রোগীর অবস্থা বেশিমাত্রায় খারাপ হয়ে যাচ্ছে। হাসপাতালে আসা রোগীদের অক্সিজেন স্যাচুরেশন কম থাকছে। শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা হঠাৎ করে বাড়ছে। শারীরিক অবস্থার নানা ধরনগুলো দ্রুতই পরিবর্তন হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসা করার সময়ও দিচ্ছে না এই ধরনগুলো। শহরে যেমনভাবে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানা হচ্ছে গ্রামে তা হচ্ছে না। ফলে গ্রামাঞ্চল থেকে এখন বেশি রোগী আসছে।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডা. পার্থ মণি ভট্টাচার্য বলেন, এবার রোগী ভর্তির পর থেকেই শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়া এবং অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমতে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। লিভার, কিডনি ও ডায়াবেটিস রোগীদের সমস্যা আরও বেশি।

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জানান, কুষ্টিয়ায় কিছুতেই কমছে না করোনার ভয়াবহতা। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা আক্রান্ত হয়ে ১৭ জন ও উপসর্গ নিয়ে ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সকালে এ তথ্য নিশ্চিত করেন কুষ্টিয়া করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আবদুল মোমিন।

এদিকে কুষ্টিয়ায় করোনার সংক্রমণের হার উর্ধ্বগতির বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আমিনুল হক রতন বলেন, ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এমনই, দ্রুত আক্রমণ করে, বেশি মৃত্যুর কারণ হয়। অধিকাংশ রোগীকে অক্সিজেন দেয়ার দরকার হচ্ছে। রোগীর সংখ্যা বাড়ায় অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে কাড়াকাড়ি লেগে যাচ্ছে। গ্রামে ঘরে ঘরে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। সচেতনার অভাবে রোগী মৃত্যুর হার বাড়ছে।

তিনি আরও জানান, মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অধিকাংশই গ্রামের বাসিন্দা। তাদের বয়স ৫০-এর বেশি। গ্রামের মানুষ এ সময় জ¦র-ঠা-া নিয়ে বেশ উদাসীন। পরিবারের কেউ জ¦র, ঠা-া বা কাশিতে আক্রান্ত হলে কেউ প্রকাশ করছেন না। এরা করোনা পরীক্ষায় আগ্রহী হচ্ছে না, গ্রামের বাসিন্দারা মনে করেন করোনা পরীক্ষায় শনাক্ত হলে বাড়ি লকডাউন হয়ে যাচ্ছে, এই ভয়ে কেউ জ¦র, কাশি বা ঠা-া আক্রান্ত হলেও প্রকাশ করছে না। সাধারণ জ¦র মনে করে সতর্ক না হয়ে সাধারণভাবেই পরিবারের সদস্যদের মাঝে চলাফেরা করছেন। এতে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে।

জেলার একমাত্র করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল ২৫০ শয্যার কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে রোগীর ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে এ হাসপাতালে ২৫০টি শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তি আছেন প্রায় ৩০০ জন।