লকডাউনে আটক অধিকাংশই নিম্নআয়ের মানুষ, আদালতে স্বজনদের ভিড়

গতকাল কঠোর লকডাউনে পঞ্চম দিন ঢাকা মেট্রোপলিটন কোর্ট (সিএমএম) ও হাজতখানার সামনে বহু মহিলা, পুরুষের ভিড়। রোদের তাপের মধ্যে কেউ ছোটাছুটি করছেন, কেউ বা কোর্টের আশপাশে রাস্তার ধারে বসে অপেক্ষা করছেন। লকডাউনে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের আদালতে হাজির করার জন্যই স্বজনদের এই অপেক্ষা দুশ্চিন্তা নিয়ে। কখন আসবে তাদের স্বজনদের নিয়ে পুলিশের গাড়ি।

দুপুর পৌনে একটার পর থেকে লকডাউনে গ্রেপ্তারকৃতদের নিয়ে সিএমএম কোটের্র হাজতখানার সামনে আসা শুরু করল পুলিশের গাড়ি। পুলিশের গাড়ি বা প্রিজনভ্যান সিএমএম আদালত প্রাঙ্গণে ঢোকা মাত্রই অপেক্ষায় থাকা স্বজনরা দৌড়ে যান পুলিশের গাড়ির পিছনে। খুঁজতে থাকেন তাদের আটককৃত স্বজনরা গাড়ির ভেতরে আছে কিনা!

সেখানেই কথা হলো লকডাউনে গ্রেপ্তার হওয়া চা দোকানদার বাতেনের স্ত্রীর সঙ্গে। তিনি জানান, গতকাল সকাল দশটার সময় পল্টনের কালভার্ট রোড এলাকা থেকে আমার স্বামীকে পল্টন থানার ওসি আটক করে দুপুরে কোর্টে চালান দিয়েছে। তিনি জানান, আমার স্বামী চা দোকান খুলে মাত্র ৫০ টাকার চা না বেচতেই পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গেছে। পল্টন থানার ওসি সাহেবের ড্রাইভারের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে চা দোকান চালাত আমার স্বামী। আমরা গরিব মানুষ। কোথায় যাব। আমাদের আয় রোজগারের পথ নেই। কোন রকম চা দোকানের বেচাকেনা দিয়ে আমাদের সংসার চলে। তিনি আরও জানান, কোর্টে আসার পর আমিনুল নামে এক উকিল আমার কাছ থেকে পাঁচশ’ টাকা নিয়েছে স্বামীকে জামিন করিয়ে দিবে বলে। ওই উকিল নিজেকে বার সমিতির ক্রীড়া সম্পাদক বলে পরিচয় দিয়েছে আমাকে।

মোহাম্মদপুর মোড় থেকে সবুজ নামে এক সিএনজিচালককে পুলিশ গ্রেপ্তার করে গত রোববার। সিএমএম কোর্টের সামনে অপেক্ষায় থাকা আটক হওয়া সবুজের বোন জানান, লকডাউনে কেন সিএনজি নিয়ে বের হলো সেজন্য পুলিশ আমার ভাইকে আটক করে। ভাই ছয়মাস হয়েছে বিয়ে করেছে। ভোলার লালমোহনে গ্রামের বাড়িতে থাকা আমার মা, ভাইয়ের স্ত্রী, বিপদের কথা শোনার পর খুবই হতাশায় আছে। কারণ, ছোট ভাই সবুজই সংসারে উপার্জন করত।

সালাউদ্দিন সুমন (২৭) নামে এক কারখানা শ্রমিককে বাড্ডা লিংক রোডের তালতলা রোড থেকে রোববার দুপুরে পুলিশ আটক করে। তার স্বজনরা জানান, লকডাউনে মুখে মাস্ক না থাকার কারণে পুলিশ তাকে আটক করে। সালাউদ্দিন দুপুরে ভাত খেতে বাসায় যাচ্ছিল। ভুলে কারখানায় মাস্ক রেখে এসেছিল।

মাস্ক না পরার কারণে কামরাঙ্গীচর পুলিশ মাসুম নামে দোকানের এক সেলসম্যানকে গত ৪ জুলাই আটক করে। মাসুমের মা জানান, আমরা অসহায় মানুষ। একদিন ছেলে কাজ না করলে সংসার চলে না। কোর্টে এসেছি ছেলেকে মুক্ত করার আশায়। জানি না জজ স্যার কতদিন জেল দেয়। জরিমানা কত টাকা লাগে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।

গতকাল প্রখর রোদের মধ্যে লকডাউনে পুলিশের হাতে আটককৃতদের অনেকের স্ত্রী, বোনদের, নবজাতক শিশুদের কোলে নিয়ে এবং তাদের বৃদ্ধ মা-বাবাদের সিএমএম কোর্টের সামনে স্বজনদের মুক্তির জন্য অপেক্ষা করতে দেখে গেছে।

হাজতখানার ও সিএমএম কোর্টের সামনে এক পুলিশ সদস্যকে হ্যান্ড মাইকে ঘোষণায় বলতে শোনা গেছে, তিনি বলেছিলেন, লকডাউনে আটক হওয়া স্বজনরা যারা কোর্ট প্রাঙ্গণে এসেছেন তাদের বিজ্ঞ মেট্রোপলিটন হাকিম মহোদয় সতর্ক করে বলেছেন, আপনারা কারও দ্বারা প্রতারিত হবেন না। মাত্র একশ’ টাকা জরিমানা আদায় করে লকডাউনে আটককৃতদের ছেড়ে দেয়া হচ্ছে।

ভুক্তভোগীদের অনেককে পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে দেখা গেছে, ঘোষণার আগে ও পরে কোর্টের সামনে অপেক্ষায় থাকা ভুক্তভোগী স্বজনদের ভয়ভীতি দেখিয়ে ও আটককৃতদের মুক্ত করার আশা দিয়ে কিছু আইনজীবী তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। যাদের গলায় ঝুলানো ছিল ঢাকা বার সমিতির লোগোসম্বলিত পরিচয়পত্র।

সিএমএম কোর্টের হাজতখানার দায়িত্বে থাকা ওসি মো. শহিদুল জানান, গতকাল রাজধানীর উত্তর- দক্ষিণ মহানগর থেকে ৫৮৯ জনকে সিএমএম কোর্টে আনা হয়েছে। এরা প্রত্যেকেই লকডাউনে বিধিনিষেধ না মেনে রাস্তায় বের হওয়ার কারণে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে পুলিশ তাদের আটক করে।

মঙ্গলবার, ০৬ জুলাই ২০২১ , ২২ আষাঢ় ১৪২৮ ২৪ জিলক্বদ ১৪৪২

লকডাউনে আটক অধিকাংশই নিম্নআয়ের মানুষ, আদালতে স্বজনদের ভিড়

খন্দকার জাফর আহমদ

image

গতকাল আদালতের হাজতখানার সামনে ধরে আনা নিম্নআয়ের মানুষের স্বজনদের ভিড় -সংবাদ

গতকাল কঠোর লকডাউনে পঞ্চম দিন ঢাকা মেট্রোপলিটন কোর্ট (সিএমএম) ও হাজতখানার সামনে বহু মহিলা, পুরুষের ভিড়। রোদের তাপের মধ্যে কেউ ছোটাছুটি করছেন, কেউ বা কোর্টের আশপাশে রাস্তার ধারে বসে অপেক্ষা করছেন। লকডাউনে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের আদালতে হাজির করার জন্যই স্বজনদের এই অপেক্ষা দুশ্চিন্তা নিয়ে। কখন আসবে তাদের স্বজনদের নিয়ে পুলিশের গাড়ি।

দুপুর পৌনে একটার পর থেকে লকডাউনে গ্রেপ্তারকৃতদের নিয়ে সিএমএম কোটের্র হাজতখানার সামনে আসা শুরু করল পুলিশের গাড়ি। পুলিশের গাড়ি বা প্রিজনভ্যান সিএমএম আদালত প্রাঙ্গণে ঢোকা মাত্রই অপেক্ষায় থাকা স্বজনরা দৌড়ে যান পুলিশের গাড়ির পিছনে। খুঁজতে থাকেন তাদের আটককৃত স্বজনরা গাড়ির ভেতরে আছে কিনা!

সেখানেই কথা হলো লকডাউনে গ্রেপ্তার হওয়া চা দোকানদার বাতেনের স্ত্রীর সঙ্গে। তিনি জানান, গতকাল সকাল দশটার সময় পল্টনের কালভার্ট রোড এলাকা থেকে আমার স্বামীকে পল্টন থানার ওসি আটক করে দুপুরে কোর্টে চালান দিয়েছে। তিনি জানান, আমার স্বামী চা দোকান খুলে মাত্র ৫০ টাকার চা না বেচতেই পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গেছে। পল্টন থানার ওসি সাহেবের ড্রাইভারের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে চা দোকান চালাত আমার স্বামী। আমরা গরিব মানুষ। কোথায় যাব। আমাদের আয় রোজগারের পথ নেই। কোন রকম চা দোকানের বেচাকেনা দিয়ে আমাদের সংসার চলে। তিনি আরও জানান, কোর্টে আসার পর আমিনুল নামে এক উকিল আমার কাছ থেকে পাঁচশ’ টাকা নিয়েছে স্বামীকে জামিন করিয়ে দিবে বলে। ওই উকিল নিজেকে বার সমিতির ক্রীড়া সম্পাদক বলে পরিচয় দিয়েছে আমাকে।

মোহাম্মদপুর মোড় থেকে সবুজ নামে এক সিএনজিচালককে পুলিশ গ্রেপ্তার করে গত রোববার। সিএমএম কোর্টের সামনে অপেক্ষায় থাকা আটক হওয়া সবুজের বোন জানান, লকডাউনে কেন সিএনজি নিয়ে বের হলো সেজন্য পুলিশ আমার ভাইকে আটক করে। ভাই ছয়মাস হয়েছে বিয়ে করেছে। ভোলার লালমোহনে গ্রামের বাড়িতে থাকা আমার মা, ভাইয়ের স্ত্রী, বিপদের কথা শোনার পর খুবই হতাশায় আছে। কারণ, ছোট ভাই সবুজই সংসারে উপার্জন করত।

সালাউদ্দিন সুমন (২৭) নামে এক কারখানা শ্রমিককে বাড্ডা লিংক রোডের তালতলা রোড থেকে রোববার দুপুরে পুলিশ আটক করে। তার স্বজনরা জানান, লকডাউনে মুখে মাস্ক না থাকার কারণে পুলিশ তাকে আটক করে। সালাউদ্দিন দুপুরে ভাত খেতে বাসায় যাচ্ছিল। ভুলে কারখানায় মাস্ক রেখে এসেছিল।

মাস্ক না পরার কারণে কামরাঙ্গীচর পুলিশ মাসুম নামে দোকানের এক সেলসম্যানকে গত ৪ জুলাই আটক করে। মাসুমের মা জানান, আমরা অসহায় মানুষ। একদিন ছেলে কাজ না করলে সংসার চলে না। কোর্টে এসেছি ছেলেকে মুক্ত করার আশায়। জানি না জজ স্যার কতদিন জেল দেয়। জরিমানা কত টাকা লাগে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।

গতকাল প্রখর রোদের মধ্যে লকডাউনে পুলিশের হাতে আটককৃতদের অনেকের স্ত্রী, বোনদের, নবজাতক শিশুদের কোলে নিয়ে এবং তাদের বৃদ্ধ মা-বাবাদের সিএমএম কোর্টের সামনে স্বজনদের মুক্তির জন্য অপেক্ষা করতে দেখে গেছে।

হাজতখানার ও সিএমএম কোর্টের সামনে এক পুলিশ সদস্যকে হ্যান্ড মাইকে ঘোষণায় বলতে শোনা গেছে, তিনি বলেছিলেন, লকডাউনে আটক হওয়া স্বজনরা যারা কোর্ট প্রাঙ্গণে এসেছেন তাদের বিজ্ঞ মেট্রোপলিটন হাকিম মহোদয় সতর্ক করে বলেছেন, আপনারা কারও দ্বারা প্রতারিত হবেন না। মাত্র একশ’ টাকা জরিমানা আদায় করে লকডাউনে আটককৃতদের ছেড়ে দেয়া হচ্ছে।

ভুক্তভোগীদের অনেককে পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে দেখা গেছে, ঘোষণার আগে ও পরে কোর্টের সামনে অপেক্ষায় থাকা ভুক্তভোগী স্বজনদের ভয়ভীতি দেখিয়ে ও আটককৃতদের মুক্ত করার আশা দিয়ে কিছু আইনজীবী তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। যাদের গলায় ঝুলানো ছিল ঢাকা বার সমিতির লোগোসম্বলিত পরিচয়পত্র।

সিএমএম কোর্টের হাজতখানার দায়িত্বে থাকা ওসি মো. শহিদুল জানান, গতকাল রাজধানীর উত্তর- দক্ষিণ মহানগর থেকে ৫৮৯ জনকে সিএমএম কোর্টে আনা হয়েছে। এরা প্রত্যেকেই লকডাউনে বিধিনিষেধ না মেনে রাস্তায় বের হওয়ার কারণে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে পুলিশ তাদের আটক করে।