টাঙ্গাইলের মধুপুরে কাওচি পাথরের অপরিকল্পিত আহরণ

লালমাটির কাদাময় বাইদ পাড়ি দিলে উঁচু চালা। সেই চালার শীর্ষে উঁইপোকার ঢিবির মতো এক খণ্ড উঁচু ভূমি। তাতে ধুপধাপ শব্দে চলছে কোদাল। কোদালের আগায় বেরিয়ে আসছে ক্ষুদ্রকায় কালো পাথর। ঝটপট রিকশা ভ্যানে তুলে সেসব ফেলা হচ্ছে কর্দমাক্ত লালমাটির রাস্তায়। টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার পাহাড়ি কাকড়াগুণী গ্রামে এমন দৃশ্য দেখা যায়।

কোদাল চালাতে চালাতে দিনমজুর রহমত আলী বলতে থাকেন, এই যে দেখছেন এটির নাম কাওচি পাথর। রং কয়লার মতো কুচকুচে কালো। নুড়ি পাথরের মতোই শক্ত। পাশেই দাঁড়ানো কাওচি ব্যবসায়ী উসমান আলী জানান, মধুপুরের পাহাড়ি এলাকায় বাণিজ্যিক খামারে আবাদ হয় কলা, কাঁঠাল, আনারস, লেবু, আদা হলুদসহ দেশি-বিদেশি ফলমূল ও কৃষিপণ্য। কিন্তু কাগজে-কলমে এসব জমির অনেকটাই বন বিভাগের। তাদের জমিতে রাস্তা পাকা করার নিয়ম নেই। তাই পাহাড়ের ফলের উদ্যানে যেতে কাঁচা রাস্তাই ভরসা। বর্ষাকালে এসব রাস্তায় রিকশাভ্যান তো দূর থাক হাঁটার জোঁ থাকে না। এ সময় বাগানের হাজার হাজার টন ফল নিয়ে বিপাকে পড়েন উৎপাদনকারীরা। সে কারণে প্রতিবছর প্রায় দেড়শ’ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তায় নিজ খরচে কাওচি পাথর ফেলেন বাগান মালিকরা। একবার কাওচি ফেললে পুরো বছর ট্রাকসহ যানবাহন সচল থাকে। কিন্তু কাওচি পাথর উত্তোলনে বিধিনিষেধ আছে। তাই চুরি করে কাওচি সংগ্রহ করছেন বলে জানান উসমান আলী।

মধুপুর উপজেলার কুড়াগাছা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল হক জানান, সরকার এলজিএসপি কর্মসূচির মাধ্যমে কাওচি পাথরে পাহাড়ি কাঁচা রাস্তা সংস্কারে বরাদ্দ দেন। কিন্তু বন উজাড় হওয়ায় এবং অপরিকল্পিত আহরণে কাওচির ভা-ার নিঃশেষ হচ্ছে। শোলাকুড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আখতার হোসেন জানান, পাহাড়ি এলাকার কয়েকশ’ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তায় বর্ষাকালে চলাচল ও ফল পরিবহনে ভোগান্তি হয়। বন বিভাগ এসব রাস্তা পাকাকরণে বাধা দেয়। এমন অবস্থায় প্রতিবছর শত শত টন কাওচি ফেলে রাস্তা সংস্কার করায় কালো সোনার ভা-ার শেষ হচ্ছে।

অরণখোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুর রহিম জানান, এলজিইডি টাকা বরাদ্দ দিলেও ভূমি বিরোধের জের ধরে বন বিভাগ সড়ক পাকা করতে দেয় না। তাছাড়া কাওচি সংগ্রহেও দাবি করা হয়। মনের দুঃখে তিনি এবার কাওচিতে রাস্তা সংস্কার বন্ধ রেখেছেন।

বেড়িবাইদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জুলহাস উদ্দীন জানান, দেশের ফলের বড় সরবরাহকারী এলাকা হলো মধুপুর। কিন্তু সেই ফল পরিবহনের কাঁচা রাস্তা পাকাকরণ এমনকি কাওচি দিয়ে সংস্কারেও বাধা দিচ্ছে বন বিভাগ।

মধুপুর উপজেলা এলজিইডির উপসহকারী প্রকৌশলী আলমগীর হোসেন জানান, কাওচি পাথর লালমাটির অমূল্য সম্পদ। নুড়ি পাথরের বিকল্প বলা যায়। এটির ভা-ার কমে যাওয়ায় এলজিইডি কাওচি দিয়ে রাস্তা নির্মাণ আপাতত বন্ধ রেখেছে।

বন বিভাগের দোখলা রেঞ্জ অফিসার আবদুল আহাদ জানান, নির্বিচারে বন উজাড় হওয়ায় কাওচির ভা-ার নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। লালমাটির কনা ও বৃষ্টির পানি ছায়াযুক্ত স্থানে দীর্ঘ সময় থাকার পর ক্রমান্বয়ে কাওচি পাথরে রূপান্তরিত হতে থাকে। এই রূপান্তরে কয়েক দশকও লাগতে পারে। বনভূমি জবরদখলে নেয়ার পর সেখানে কৃষি ফসল করা হলে সেখানে কাওচি জন্ম নেবে না বলে জানান তিনি।

মধুপুর বনাঞ্চলের সহকারী বন সংরক্ষক জামাল হোসেন তালুকদার জানান, কাওচি প্রাকৃতিক সম্পদ। এটি নিঃশেষ হওয়ার পথে। অপরিকল্পিত আহরণে ভূমি ক্ষয়ের দরুণ গাছপালার ক্ষতি হয়। তাই কাউকে বাধা দিলে তারা নানাভাবে দোষারোপ ও অভিযোগ তোলেন।

বুধবার, ০৭ জুলাই ২০২১ , ২৩ আষাঢ় ১৪২৮ ২৫ জিলক্বদ ১৪৪২

টাঙ্গাইলের মধুপুরে কাওচি পাথরের অপরিকল্পিত আহরণ

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক, টাঙ্গাইল

image

লালমাটির কাদাময় বাইদ পাড়ি দিলে উঁচু চালা। সেই চালার শীর্ষে উঁইপোকার ঢিবির মতো এক খণ্ড উঁচু ভূমি। তাতে ধুপধাপ শব্দে চলছে কোদাল। কোদালের আগায় বেরিয়ে আসছে ক্ষুদ্রকায় কালো পাথর। ঝটপট রিকশা ভ্যানে তুলে সেসব ফেলা হচ্ছে কর্দমাক্ত লালমাটির রাস্তায়। টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার পাহাড়ি কাকড়াগুণী গ্রামে এমন দৃশ্য দেখা যায়।

কোদাল চালাতে চালাতে দিনমজুর রহমত আলী বলতে থাকেন, এই যে দেখছেন এটির নাম কাওচি পাথর। রং কয়লার মতো কুচকুচে কালো। নুড়ি পাথরের মতোই শক্ত। পাশেই দাঁড়ানো কাওচি ব্যবসায়ী উসমান আলী জানান, মধুপুরের পাহাড়ি এলাকায় বাণিজ্যিক খামারে আবাদ হয় কলা, কাঁঠাল, আনারস, লেবু, আদা হলুদসহ দেশি-বিদেশি ফলমূল ও কৃষিপণ্য। কিন্তু কাগজে-কলমে এসব জমির অনেকটাই বন বিভাগের। তাদের জমিতে রাস্তা পাকা করার নিয়ম নেই। তাই পাহাড়ের ফলের উদ্যানে যেতে কাঁচা রাস্তাই ভরসা। বর্ষাকালে এসব রাস্তায় রিকশাভ্যান তো দূর থাক হাঁটার জোঁ থাকে না। এ সময় বাগানের হাজার হাজার টন ফল নিয়ে বিপাকে পড়েন উৎপাদনকারীরা। সে কারণে প্রতিবছর প্রায় দেড়শ’ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তায় নিজ খরচে কাওচি পাথর ফেলেন বাগান মালিকরা। একবার কাওচি ফেললে পুরো বছর ট্রাকসহ যানবাহন সচল থাকে। কিন্তু কাওচি পাথর উত্তোলনে বিধিনিষেধ আছে। তাই চুরি করে কাওচি সংগ্রহ করছেন বলে জানান উসমান আলী।

মধুপুর উপজেলার কুড়াগাছা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল হক জানান, সরকার এলজিএসপি কর্মসূচির মাধ্যমে কাওচি পাথরে পাহাড়ি কাঁচা রাস্তা সংস্কারে বরাদ্দ দেন। কিন্তু বন উজাড় হওয়ায় এবং অপরিকল্পিত আহরণে কাওচির ভা-ার নিঃশেষ হচ্ছে। শোলাকুড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আখতার হোসেন জানান, পাহাড়ি এলাকার কয়েকশ’ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তায় বর্ষাকালে চলাচল ও ফল পরিবহনে ভোগান্তি হয়। বন বিভাগ এসব রাস্তা পাকাকরণে বাধা দেয়। এমন অবস্থায় প্রতিবছর শত শত টন কাওচি ফেলে রাস্তা সংস্কার করায় কালো সোনার ভা-ার শেষ হচ্ছে।

অরণখোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুর রহিম জানান, এলজিইডি টাকা বরাদ্দ দিলেও ভূমি বিরোধের জের ধরে বন বিভাগ সড়ক পাকা করতে দেয় না। তাছাড়া কাওচি সংগ্রহেও দাবি করা হয়। মনের দুঃখে তিনি এবার কাওচিতে রাস্তা সংস্কার বন্ধ রেখেছেন।

বেড়িবাইদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জুলহাস উদ্দীন জানান, দেশের ফলের বড় সরবরাহকারী এলাকা হলো মধুপুর। কিন্তু সেই ফল পরিবহনের কাঁচা রাস্তা পাকাকরণ এমনকি কাওচি দিয়ে সংস্কারেও বাধা দিচ্ছে বন বিভাগ।

মধুপুর উপজেলা এলজিইডির উপসহকারী প্রকৌশলী আলমগীর হোসেন জানান, কাওচি পাথর লালমাটির অমূল্য সম্পদ। নুড়ি পাথরের বিকল্প বলা যায়। এটির ভা-ার কমে যাওয়ায় এলজিইডি কাওচি দিয়ে রাস্তা নির্মাণ আপাতত বন্ধ রেখেছে।

বন বিভাগের দোখলা রেঞ্জ অফিসার আবদুল আহাদ জানান, নির্বিচারে বন উজাড় হওয়ায় কাওচির ভা-ার নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। লালমাটির কনা ও বৃষ্টির পানি ছায়াযুক্ত স্থানে দীর্ঘ সময় থাকার পর ক্রমান্বয়ে কাওচি পাথরে রূপান্তরিত হতে থাকে। এই রূপান্তরে কয়েক দশকও লাগতে পারে। বনভূমি জবরদখলে নেয়ার পর সেখানে কৃষি ফসল করা হলে সেখানে কাওচি জন্ম নেবে না বলে জানান তিনি।

মধুপুর বনাঞ্চলের সহকারী বন সংরক্ষক জামাল হোসেন তালুকদার জানান, কাওচি প্রাকৃতিক সম্পদ। এটি নিঃশেষ হওয়ার পথে। অপরিকল্পিত আহরণে ভূমি ক্ষয়ের দরুণ গাছপালার ক্ষতি হয়। তাই কাউকে বাধা দিলে তারা নানাভাবে দোষারোপ ও অভিযোগ তোলেন।