অগ্নিনির্বাপণ, বহির্গমনের বিকল্প পথ ছিল না

নারায়ণগঞ্জ দীর্ঘ প্রায় ৪৮ ঘণ্টা পর গতকাল বিকেল ৫টা ২০ মিনিটে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুড কারখানার অগ্নিনির্বাপণ ও মরদেহ উদ্ধারের কাজ শেষ করে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স। গত শুক্রবার কারখানার ছয়তলা ভবনের চতুর্থ তলা থেকে ৪৯টি মরদেহ উদ্ধার করেন তারা। এর আগে অগ্নিদগ্ধ হয়ে কারখানা ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে তিনজনের মৃত্যু হয়। এরপর পুরো ভবনে আর কোন মরদেহ তারা খুঁজে পাননি বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা।

গত বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে উপজেলার ভুলতা কর্ণগোপ এলাকায় অবস্থিত ফুড কারখানাটিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কাজ করছিল ফায়ার সার্ভিস। দীর্ঘ এই সময়ে তারা ভবনের আগুন নিয়ন্ত্রণ, ডাম্পিং ও মরদেহ উদ্ধার করেছেন। মরদেহের খোঁজে ছয়তলা ভবনের সবকটি তলার প্রতিটি কোনায় বিচরণ ছিল ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের। তবে পুরো ৩৪ হাজার বর্গফুট আয়তনের সুবিশাল এই ছয়তলা ভবনের কোন তলায় একটি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রও চোখে পড়েনি বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের ঢাকা বিভাগের উপ পরিচালক দিনমনি শর্মা।

গতকাল দুপুরে এক প্রশ্নের জবাবে সাংবাদিকদের তিনি জানান, ‘গেট বন্ধ পেয়ে তারা হয়তো দক্ষিণ-পূর্ব কোনায় চলে গিয়েছিল। জানালার পাশে গিয়ে হয়তো তারা শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করেছিল। পরে হয়তো আগুনের ধোঁয়ায় তারা অজ্ঞান হয়ে যায়। ৬ তলাবিশিষ্ট এই ভবনে ফায়ার প্রিভেন্টের যে সিস্টেমগুলো থাকার কথা তার কিছুই আমরা দেখতে পাইনি।

তিনি আরও বলেন, ‘কী কী ধরনের ক্যামিকেল ভবনে ছিল তা এখনও শনাক্ত করা যায়নি। কারণ আগুন নেভানোর কাজে ব্যবহার করা পানির সঙ্গে সেগুলো মিশে গেছে। তদন্ত কমিটি ক্যামিকেলের ধরন শনাক্ত করবে।’

সরেজমিন দেখা যায়, আগুনে পুড়ে পুরো ভবনটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ভবনের চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলার চারদিকে লোহার সরু তার দিয়ে জালের মতো বেষ্টনি দেয়া দেখা যায়। এই বেষ্টনির একটি পকেট গেট দিয়ে সিঁড়ির দিকে যেতে হয়। তবে সেই পকেট গেটে তালা দেখা গেছে। এই বেষ্টনিগুলো ভাঙতে তাদের ৩০ মিনিটেরও বেশি সময় লেগেছে। বেষ্টনির পকেট গেটে তালা ঝোলানো ছিল বলে ভবনে কর্মরত ফায়ার সার্ভিসের একাধিক সদস্য জানিয়েছেন।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন ইলেকট্রনিক সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইসাব) একটি প্রতিনিধি দল। ইসাব এর ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রকৌশলী মঞ্জুর আলম সংবাদকে বলেন, পুরো ভবন তারা পরিদর্শন করেছেন। সুবিশাল এই ভবনে যে পরিমাণ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা দরকার ছিল তার কিছুই তাদের নজরে পড়েনি। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে বহির্গমনের বিকল্প পথও ছিল না ভবনে। এমনকি আগুন লাগলে দ্রুত পানি দিয়ে নেভানোর জন্য কোন যন্ত্র তারা দেখতে পাননি বলে জানান। ছাদে উঠার ক্ষেত্রে গেটে তালা ঝুলতে দেখেছেন তারা।

তিনি বলেন, ‘এই ভবনে অন্তত চারটি সিঁড়ির প্রয়োজন ছিল। সিঁড়িগুলোর অবস্থান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তবে এখনও ভবনের নকশা না পাওয়াতে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারছি না। তবে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা জোরদার থাকলে এতগুলো প্রাণ যেত না।’

আগুন নিয়ে উদাসীনতা ছিল কারখানা কর্তৃপক্ষের

কারখানার পার্শ্ববর্তী দোকানি, বস্তিবাসী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যেই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। শুরুতে দ্বিতীয় তলায় আগুন লাগে। তবে বিষয়টিকে পাত্তা দেননি কারখানা কর্তৃপক্ষ। শ্রমিকদের অনেকে বেরিয়ে আসতে চাইলেও তাদের বের হতে দেয়া হয়নি। এরও ঘণ্টাখানেক পর খবর দেয়া হয় ফায়ার সার্ভিসে। ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, ৫টা ৪২ মিনিটে তারা খবর পান। ৩০ মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছান। ততক্ষণে আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভবনজুড়ে। আগুনের লেলিহান শিখার কারণে আটকে পড়া শ্রমিকরা ভবন থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। বাইরে থেকে তাদের স্বজনরা ও স্থানীয় লোকজনও ভেতরে প্রবেশ করতে চেয়েছিলেন। তবে তাদের কাউকেই ভেতরে ঢুকতে কিংবা ভেতর থেকে বের হতে দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন স্থানীয়রা ও শ্রমিকের স্বজনরা।

মোমরাজ মল্লিক থাকেন পুড়ে যাওয়া ভবনটির পার্শ্ববর্তী একটি বস্তিতে। তিনিও এই কারখানারই শ্রমিক। তবে তার নাইট ডিউটি থাকায় ঘটনার সময় তিনি ছিলেন ঘরে। ঘটনার সময় তার ভাগ্নি ঝুমা কর্মরত ছিলেন আগুন লাগা ভবন লাগোয়া আরেকটি ভবনে। বিকেল চারটা বাজার কিছুক্ষণ পরপরই তারা আগুনের কথা শোনেন। ঝুমাকে বাঁচাতে ছুটে যান মামা মোমরাজ। তার সঙ্গে স্থানীয় এলাকাবাসী ও শ্রমিকদের স্বজনরাও ছুটে আসেন। তবে তাদের তখন ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি। পরে কারখানার বেষ্টনি টপকে ভেতরে ঢোকেন তারা। পরে স্থানীয়রা ওই বেষ্টনি ভেঙে ফেলেন।

মোমরাজ সংবাদকে বলেন, কারখানার সামনের বেষ্টনি টপকে ভাগ্নিকে উদ্ধার করেন তিনি। সে সময় আগুন লাগা ভবন থেকে শ্রমিকদের লাফিয়ে পড়তে দেখেন। কারখানার মূল গেট ছিল বন্ধ। তিনি বলেন, ‘প্রথমে আমরা অনেকেই ভেতরে ঢুকতে চাইছি। ঢুকতে দেয় নাই। কইছে আগুন নিইভা যাইব। পরে দেয়াল টপকাইয়া ভেতরে ঢুকে ভাগ্নিরে বাঁচাই। আর মানুষরে দেখি লাফায়ে পড়তে।’ তার ভাগ্নি ঝুমা বলেন, ‘আমাগো পাশের বিল্ডিংয়ে আগুন লাগে। দুই বিল্ডিং একসঙ্গে লাগাইন্না। ভয়ে আমি বের হইতে পারি নাই। মামায় আমারে বাঁচাইছে।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, বিকেল পাঁচটারও আগে আগুন লাগে। তবে তাদের খবর দেয়া হয় সাড়ে পাঁচটারও পর। কারখানার এক উপসহকারী প্রকৌশলীর বরাতে ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আগুন লাগার পর থেকে সেকশন ইনচার্জ মাহবুব আলম কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। এক পর্যায়ে নিচের তলাগুলোতে আগুন বেড়ে গেলে তিনি শ্রমিকদের চারতলায় তার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের ভেতর নিয়ে যান। তার কক্ষেই পাওয়া যায় ৪৯ শ্রমিকের লাশ।’ এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক দিনমনি শর্মা বলেন, ‘আমরা ২০-২৫ জনকে ছাদ থেকে উদ্ধার করেছিলাম। যারা মারা গেছেন তারা যদি ছাদে চলে যেতে পারতেন তাহলে হয়তো আমরা তাদের বাঁচাতে পারতাম।’

স্থানীয়রা জানান, এই কারখানায় এর আগেও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। তবে সেই আগুন তেমন ব্যাপকতা পায়নি। জানানো হয়নি ফায়ার সার্ভিসকেও। গত শুক্রবার কথা বলে সংবাদকে কয়েক সপ্তাহ পূর্বে কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন হাসেম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহান শাহ্ আজাদ। এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের দিনমনি শর্মা বলেন, অনেক সময়ই ফায়ার সার্ভিসকে আগুনের কথা জানানো হয় না। আগুনের ব্যাপকতা নিজেদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলেই পরে কর্তৃপক্ষ তাদের জানান।

কারখানার বিভিন্ন তলায় লাচ্ছা সেমাই, টোস্ট, জুস, নসিলা, নুডুলস, ক্যান্ডিসহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য তৈরি করা হতো। নিচতলা ও ষষ্ঠতলায় ছিল খাদ্য প্রস্তুতের কাচামালের গুদামঘর (স্টোর রুম)। কাচামালের অধিকাংশই তেল, ঘি, রেজিনসহ দাহ্য বস্তু। যদিও পুরো ভবনটিই গুদাম হিসেবে ব্যবহারের কথা ছিল। ভবনের মূল গেটে বড় করে ‘সেন্ট্রাল স্টোর’ লেখা দেখা গেছে। দাহ্যবস্তু বা ক্যামিকেলের গুদামঘর হিসেবে ব্যবহারের ভবনে উৎপাদন কারখানা রাখার বিষয়টিও তদন্ত করে দেখবেন বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।

সজীব গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মালিকানাধীন হাসেম ফুড লিমিটেডের ওই কারখানার কোন ভবনে কী আছে তা জানতে চিঠি দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন কারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের উপ-মহাপরিদর্শক সৌমেন বড়ুয়া। তিনি বলেন, আবেদন করেও পরিদর্শনের অনুমতি তারা পাননি। ফলে কোন ভবনের কোন তলায় কী রয়েছে সেই তথ্য তাদের কাছে নেই। তবে ২০০০ সালে তাদের প্রধান কার্যালয় থেকে এই কারখানার অনুমোদন নেয়া হয়েছিল বলে জানান সৌমেন বড়ুয়া।

কোন নিখোঁজ নেই, জানালো পুলিশ

জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলম সংবাদকে বলেন, আগুনে পুড়ে যাওয়ায় চেহারা বোঝার উপায় না থাকায় মরদেহগুলো উদ্ধার করে সরাসরি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরে সেখানে সিআইডির ফরেনসিক ডিপার্টমেন্ট ডিএনএ স্যাম্পল সংগ্রহ করা শুরু করে। সর্বশেষ ৪০ জনের ডিএনএ সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানান।

গত শুক্রবার ৪৯ জনের মরদেহ উদ্ধারের কথা জানায় ফায়ার সার্ভিস। সর্বশেষ গতকাল সব কার্যক্রম শেষ করার সময়ও একই সংখ্যা জানান তারা। তবে পুলিশ মামলার এজাহারে উল্লেখ করেছে ৪৮ জনের মরদেহের কথা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এসপি বলেন, ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা একসঙ্গে দুটো লাশ ভেবেছিলেন। সে অনুযায়ী তারা বলেছেন ৪৯ মরদেহ। পরে সিআইডি জানায়, মোট মরদেহ ৪৮টি।

এসপি আরও বলেন, ঘটনার পর থেকে তাদের কাছে ৫১ জন নিখোঁজের তালিকা ছিল। তাদের মধ্যে তিনজনের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে। এখন বাকি রয়েছে ৪৮ জনের মরদেহ। ডিএনডি পরীক্ষার পর তাদের মরদেহগুলো স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।

রবিবার, ১১ জুলাই ২০২১ , ২৭ আষাঢ় ১৪২৮ ২৯ জিলক্বদ ১৪৪২

অগ্নিনির্বাপণ, বহির্গমনের বিকল্প পথ ছিল না

সৌরভ হোসেন সিয়াম, (নারায়ণগঞ্জ)

নারায়ণগঞ্জ দীর্ঘ প্রায় ৪৮ ঘণ্টা পর গতকাল বিকেল ৫টা ২০ মিনিটে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুড কারখানার অগ্নিনির্বাপণ ও মরদেহ উদ্ধারের কাজ শেষ করে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স। গত শুক্রবার কারখানার ছয়তলা ভবনের চতুর্থ তলা থেকে ৪৯টি মরদেহ উদ্ধার করেন তারা। এর আগে অগ্নিদগ্ধ হয়ে কারখানা ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে তিনজনের মৃত্যু হয়। এরপর পুরো ভবনে আর কোন মরদেহ তারা খুঁজে পাননি বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা।

গত বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে উপজেলার ভুলতা কর্ণগোপ এলাকায় অবস্থিত ফুড কারখানাটিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কাজ করছিল ফায়ার সার্ভিস। দীর্ঘ এই সময়ে তারা ভবনের আগুন নিয়ন্ত্রণ, ডাম্পিং ও মরদেহ উদ্ধার করেছেন। মরদেহের খোঁজে ছয়তলা ভবনের সবকটি তলার প্রতিটি কোনায় বিচরণ ছিল ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের। তবে পুরো ৩৪ হাজার বর্গফুট আয়তনের সুবিশাল এই ছয়তলা ভবনের কোন তলায় একটি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রও চোখে পড়েনি বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের ঢাকা বিভাগের উপ পরিচালক দিনমনি শর্মা।

গতকাল দুপুরে এক প্রশ্নের জবাবে সাংবাদিকদের তিনি জানান, ‘গেট বন্ধ পেয়ে তারা হয়তো দক্ষিণ-পূর্ব কোনায় চলে গিয়েছিল। জানালার পাশে গিয়ে হয়তো তারা শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করেছিল। পরে হয়তো আগুনের ধোঁয়ায় তারা অজ্ঞান হয়ে যায়। ৬ তলাবিশিষ্ট এই ভবনে ফায়ার প্রিভেন্টের যে সিস্টেমগুলো থাকার কথা তার কিছুই আমরা দেখতে পাইনি।

তিনি আরও বলেন, ‘কী কী ধরনের ক্যামিকেল ভবনে ছিল তা এখনও শনাক্ত করা যায়নি। কারণ আগুন নেভানোর কাজে ব্যবহার করা পানির সঙ্গে সেগুলো মিশে গেছে। তদন্ত কমিটি ক্যামিকেলের ধরন শনাক্ত করবে।’

সরেজমিন দেখা যায়, আগুনে পুড়ে পুরো ভবনটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ভবনের চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলার চারদিকে লোহার সরু তার দিয়ে জালের মতো বেষ্টনি দেয়া দেখা যায়। এই বেষ্টনির একটি পকেট গেট দিয়ে সিঁড়ির দিকে যেতে হয়। তবে সেই পকেট গেটে তালা দেখা গেছে। এই বেষ্টনিগুলো ভাঙতে তাদের ৩০ মিনিটেরও বেশি সময় লেগেছে। বেষ্টনির পকেট গেটে তালা ঝোলানো ছিল বলে ভবনে কর্মরত ফায়ার সার্ভিসের একাধিক সদস্য জানিয়েছেন।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন ইলেকট্রনিক সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইসাব) একটি প্রতিনিধি দল। ইসাব এর ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রকৌশলী মঞ্জুর আলম সংবাদকে বলেন, পুরো ভবন তারা পরিদর্শন করেছেন। সুবিশাল এই ভবনে যে পরিমাণ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা দরকার ছিল তার কিছুই তাদের নজরে পড়েনি। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে বহির্গমনের বিকল্প পথও ছিল না ভবনে। এমনকি আগুন লাগলে দ্রুত পানি দিয়ে নেভানোর জন্য কোন যন্ত্র তারা দেখতে পাননি বলে জানান। ছাদে উঠার ক্ষেত্রে গেটে তালা ঝুলতে দেখেছেন তারা।

তিনি বলেন, ‘এই ভবনে অন্তত চারটি সিঁড়ির প্রয়োজন ছিল। সিঁড়িগুলোর অবস্থান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তবে এখনও ভবনের নকশা না পাওয়াতে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারছি না। তবে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা জোরদার থাকলে এতগুলো প্রাণ যেত না।’

আগুন নিয়ে উদাসীনতা ছিল কারখানা কর্তৃপক্ষের

কারখানার পার্শ্ববর্তী দোকানি, বস্তিবাসী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যেই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। শুরুতে দ্বিতীয় তলায় আগুন লাগে। তবে বিষয়টিকে পাত্তা দেননি কারখানা কর্তৃপক্ষ। শ্রমিকদের অনেকে বেরিয়ে আসতে চাইলেও তাদের বের হতে দেয়া হয়নি। এরও ঘণ্টাখানেক পর খবর দেয়া হয় ফায়ার সার্ভিসে। ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, ৫টা ৪২ মিনিটে তারা খবর পান। ৩০ মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছান। ততক্ষণে আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভবনজুড়ে। আগুনের লেলিহান শিখার কারণে আটকে পড়া শ্রমিকরা ভবন থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। বাইরে থেকে তাদের স্বজনরা ও স্থানীয় লোকজনও ভেতরে প্রবেশ করতে চেয়েছিলেন। তবে তাদের কাউকেই ভেতরে ঢুকতে কিংবা ভেতর থেকে বের হতে দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন স্থানীয়রা ও শ্রমিকের স্বজনরা।

মোমরাজ মল্লিক থাকেন পুড়ে যাওয়া ভবনটির পার্শ্ববর্তী একটি বস্তিতে। তিনিও এই কারখানারই শ্রমিক। তবে তার নাইট ডিউটি থাকায় ঘটনার সময় তিনি ছিলেন ঘরে। ঘটনার সময় তার ভাগ্নি ঝুমা কর্মরত ছিলেন আগুন লাগা ভবন লাগোয়া আরেকটি ভবনে। বিকেল চারটা বাজার কিছুক্ষণ পরপরই তারা আগুনের কথা শোনেন। ঝুমাকে বাঁচাতে ছুটে যান মামা মোমরাজ। তার সঙ্গে স্থানীয় এলাকাবাসী ও শ্রমিকদের স্বজনরাও ছুটে আসেন। তবে তাদের তখন ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি। পরে কারখানার বেষ্টনি টপকে ভেতরে ঢোকেন তারা। পরে স্থানীয়রা ওই বেষ্টনি ভেঙে ফেলেন।

মোমরাজ সংবাদকে বলেন, কারখানার সামনের বেষ্টনি টপকে ভাগ্নিকে উদ্ধার করেন তিনি। সে সময় আগুন লাগা ভবন থেকে শ্রমিকদের লাফিয়ে পড়তে দেখেন। কারখানার মূল গেট ছিল বন্ধ। তিনি বলেন, ‘প্রথমে আমরা অনেকেই ভেতরে ঢুকতে চাইছি। ঢুকতে দেয় নাই। কইছে আগুন নিইভা যাইব। পরে দেয়াল টপকাইয়া ভেতরে ঢুকে ভাগ্নিরে বাঁচাই। আর মানুষরে দেখি লাফায়ে পড়তে।’ তার ভাগ্নি ঝুমা বলেন, ‘আমাগো পাশের বিল্ডিংয়ে আগুন লাগে। দুই বিল্ডিং একসঙ্গে লাগাইন্না। ভয়ে আমি বের হইতে পারি নাই। মামায় আমারে বাঁচাইছে।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, বিকেল পাঁচটারও আগে আগুন লাগে। তবে তাদের খবর দেয়া হয় সাড়ে পাঁচটারও পর। কারখানার এক উপসহকারী প্রকৌশলীর বরাতে ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আগুন লাগার পর থেকে সেকশন ইনচার্জ মাহবুব আলম কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। এক পর্যায়ে নিচের তলাগুলোতে আগুন বেড়ে গেলে তিনি শ্রমিকদের চারতলায় তার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের ভেতর নিয়ে যান। তার কক্ষেই পাওয়া যায় ৪৯ শ্রমিকের লাশ।’ এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক দিনমনি শর্মা বলেন, ‘আমরা ২০-২৫ জনকে ছাদ থেকে উদ্ধার করেছিলাম। যারা মারা গেছেন তারা যদি ছাদে চলে যেতে পারতেন তাহলে হয়তো আমরা তাদের বাঁচাতে পারতাম।’

স্থানীয়রা জানান, এই কারখানায় এর আগেও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। তবে সেই আগুন তেমন ব্যাপকতা পায়নি। জানানো হয়নি ফায়ার সার্ভিসকেও। গত শুক্রবার কথা বলে সংবাদকে কয়েক সপ্তাহ পূর্বে কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন হাসেম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহান শাহ্ আজাদ। এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের দিনমনি শর্মা বলেন, অনেক সময়ই ফায়ার সার্ভিসকে আগুনের কথা জানানো হয় না। আগুনের ব্যাপকতা নিজেদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলেই পরে কর্তৃপক্ষ তাদের জানান।

কারখানার বিভিন্ন তলায় লাচ্ছা সেমাই, টোস্ট, জুস, নসিলা, নুডুলস, ক্যান্ডিসহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য তৈরি করা হতো। নিচতলা ও ষষ্ঠতলায় ছিল খাদ্য প্রস্তুতের কাচামালের গুদামঘর (স্টোর রুম)। কাচামালের অধিকাংশই তেল, ঘি, রেজিনসহ দাহ্য বস্তু। যদিও পুরো ভবনটিই গুদাম হিসেবে ব্যবহারের কথা ছিল। ভবনের মূল গেটে বড় করে ‘সেন্ট্রাল স্টোর’ লেখা দেখা গেছে। দাহ্যবস্তু বা ক্যামিকেলের গুদামঘর হিসেবে ব্যবহারের ভবনে উৎপাদন কারখানা রাখার বিষয়টিও তদন্ত করে দেখবেন বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।

সজীব গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মালিকানাধীন হাসেম ফুড লিমিটেডের ওই কারখানার কোন ভবনে কী আছে তা জানতে চিঠি দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন কারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের উপ-মহাপরিদর্শক সৌমেন বড়ুয়া। তিনি বলেন, আবেদন করেও পরিদর্শনের অনুমতি তারা পাননি। ফলে কোন ভবনের কোন তলায় কী রয়েছে সেই তথ্য তাদের কাছে নেই। তবে ২০০০ সালে তাদের প্রধান কার্যালয় থেকে এই কারখানার অনুমোদন নেয়া হয়েছিল বলে জানান সৌমেন বড়ুয়া।

কোন নিখোঁজ নেই, জানালো পুলিশ

জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলম সংবাদকে বলেন, আগুনে পুড়ে যাওয়ায় চেহারা বোঝার উপায় না থাকায় মরদেহগুলো উদ্ধার করে সরাসরি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরে সেখানে সিআইডির ফরেনসিক ডিপার্টমেন্ট ডিএনএ স্যাম্পল সংগ্রহ করা শুরু করে। সর্বশেষ ৪০ জনের ডিএনএ সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানান।

গত শুক্রবার ৪৯ জনের মরদেহ উদ্ধারের কথা জানায় ফায়ার সার্ভিস। সর্বশেষ গতকাল সব কার্যক্রম শেষ করার সময়ও একই সংখ্যা জানান তারা। তবে পুলিশ মামলার এজাহারে উল্লেখ করেছে ৪৮ জনের মরদেহের কথা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এসপি বলেন, ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা একসঙ্গে দুটো লাশ ভেবেছিলেন। সে অনুযায়ী তারা বলেছেন ৪৯ মরদেহ। পরে সিআইডি জানায়, মোট মরদেহ ৪৮টি।

এসপি আরও বলেন, ঘটনার পর থেকে তাদের কাছে ৫১ জন নিখোঁজের তালিকা ছিল। তাদের মধ্যে তিনজনের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে। এখন বাকি রয়েছে ৪৮ জনের মরদেহ। ডিএনডি পরীক্ষার পর তাদের মরদেহগুলো স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।