নাজমুল বেঁচে গেছে, খুঁজে পাচ্ছে না মাকে

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ১৩ বছরের শিশু নাজমুল, তার ৬ বছরের ছোট বোন পাখি, দুই খালা এবং মামা একে অপরকে জড়িয়ে বিলাপ করছেন। তোমরা আমার বোনের লাশ ফিরিয়ে দেও। আমরা আর কিছু চাই না, এখন দুই সন্তানের কি হবে। নাজমার দুই বোনের এমন বুকফাটা আর্তনাতে মর্গের পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। আগের দিন মা নাজমা বেগমের লাশের সন্ধানে ডিএনএ নমুনা দিয়ে গেলেও গতকাল ফের নাজমুল তার ছোট বোন এবং খালা মামাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন মর্গে। নাজমুলের মা আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়েছেন বলে ধারণা তাদের। নাজমার মতো ওই কারখানায় যারা অগুনে পুড়েছে তাদের প্রত্যেকই এমণভাবে অঙ্গার হয়েছেন যে কারোরই লাশ চেনার কোন উপায় নেই বলেছেন পুলিশ এবং হাসপতাল কর্তৃপক্ষ।

নাজমুলের মামা ফারুক জানান, সজীব গ্রুপের পুড়ে যাওয়া কারখানায় দোতালায় ৬ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতো ১৩ বছর বয়সী নাজমুল। ৪র্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করলেও অভাবের তোড়ে পড়া আর নিয়মিত হয়নি। সংসারের হাল ধরতে মা নাজমা বেগমের সঙ্গে ১ বছর আগে শ্রমিক হিসেবে কাজ নেয়া নাজমুল।

বৃহস্পতিবার রোজকার নিয়ম মেনে সকাল ৮টায় কারখানায় কাজ শুরু করে নাজমুল। কাজ শেষ করে বিকেল ৪টায় বাসায় চলে যায়। ৫টায় যখন আগুন লাগে নাজমুলের মনে পড়ে যায় মা নাজমার কথা। ১০ মিনিটের মধ্যে দৌড়ে এসে দেখে কারখানার ফটকে তালা মারা ভেতরে আগুন জ্বলছে। এর পর থেকে মায়ের খোঁজ পাচ্ছে না নাজমুল।

মামা ফারুক বলেন, আগের দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসে ডিএনএ নমুনা দিয়ে গেলেও গতকাল ফের ৬ বছরের ছোট বোনকে নিয়ে মায়ের মরদেহ নিতে আসে। নাজমুল জানে না শেষ পর্যন্ত তার মায়ের মরদেহটিও মিলবে কিনা?

ফারুক বলেন, নাজমা তাদের বড় বোন। ১৭ বছর আগে আফজাল নামে একজনের সঙ্গে বিয়ে হয়। আফজাল তখন একটি মুরগির দোকানে কাজ করতেন। নাজমা এক মেয়ে এক ছেলেকে নিয়ে যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় থাকতেন। আকস্মিক বেকার হয়ে পড়ে আফজাল। ঘরভাড়া সংসার এবং ছেলের পড়াশুনার খরচ চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। নাজমা তখন একটি হোটেলে কাজ নেয়। তাতেও ঘরভাড়া ঠিকমতো দিতো পারতো না। সংসারে অভাব অনটন লেগেই থাকতো।

‘বোনের সংসারের এমন টানাপড়েনে বোন নাজমাকে হাসেম ফুড কারখানায় চাকরি পাইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। বোনকে যাত্রাবাড়ীর ভাড়া বাসা ছেড়ে দিয়ে নিজেদের বাড়ির পাশে বাসা ভাড়া নিতে বলেন। নাজমা বাপের বাড়ির পাশে ৩ হাজার টাকা মাসিক ভাড়ায় একটি বাসাও ভাড়া নেন। নাজমার একক রোজগারে সংসার ঠিকমতো না চলায় ১৩ বছরের সন্তান নাজমুলকেও একই ফ্যাক্টরিতে কাজে দেন। ১ বছর আগে নাজমুল ওই কারখানায় দোতালায় কাজ নেয়। নাজমার বেতন ৫ হাজার ৭০০ টাকা হলেও ছেলের বেতন ছিল ৬ হাজার টাকা। মা ছেলের রোজগারে সংসার কোনভাবে চলছিল। এখন সবকিছুই শেষ হয়ে গেছে’।

নাজমার দুই বোন জানায়, নাজমার স্বামী গত ২ বছর ধরে কাজ করতো না। শ্বাসকষ্টের রোগ থাকায় প্রায় অসুস্থ থাকতো। ঘুরে ফিরে তার দিন কাটে। বেকার স্বামীর চিকিৎসার পাশাপাশি সংসারের খরচ নাজমার বেতনের ওপর নির্ভর করতো। এখন তার ছেলে মেয়েকে কি জবাব দিব। ৬ বছরের পাখি বৃহস্পতিবার থেকেই তার মাকে খুঁজছে। বলছে, আম্মু তো বিকেলেই আসার কথা এখনও আসছে না কেন?।

শিশু শ্রমিক নাজমুল জানায়, বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় সে কারখানায় যায়। বিকেল ৪টায় ডিউটি শেষ করে সে বাসায় ফিরে। প্রতিদিন মাকে ফোন করে বাসায় ফিরলেও বৃহস্পতিবার ফোন করতে পারেনি। বিকেলে তার মায়ের কথা মনে পড়লেও ফোন করে কথা বলার জন্য। মাকে বলবে আমি চলে এসেছি তুমি রাত ৮টায় বাসায় চলে আসো। কিন্তু সেই কথা বলা হয়নি। ফোন করলেও ফোন ধরেননি তার মা। এর মধ্যে আগুন লাগার খবর পেয়ে ছুটে যান কারখানার সামনে। গিয়ে দেখেন আগুন আর আগুন। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার পর আর ফোন বাজেনি। এর পর থেকে অপেক্ষা। ছোট বোন তাকে জিজ্ঞেস করে ভাই মা তো ফিরলো না। মায়ের কি ছুটি হয়নি।

নাজমুলের ছোট বোন এখনও জানে না তার মায়ের চিরদিনের মতো হয়তো ছুটি হয়ে গেছে। নিখোঁজ নাজমার খোঁজে কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরেও কোথায় তার আহত হয়ে চিকিৎসাধীন থাকার তথ্য নেই স্বজনদের কাছে।

নাজমুল জানান, অভাবের সংসারে মা ছিল তাদের সবকিছ্।ু বাবা থেকেও নেই। এখন ছোট বোনকে কোন কিছুতেই বুঝ দিতে পারছেন না। ছোট বোনকে খালারা বলেছে, তার মা ঢাকা মেডিকেলে আছে। হাত কেটে গেছে। এমন খবরে ছোট বোন বলেছে সে তার মাকে দেখতে যাবে। তাই ছোট বোনকে নিয়ে আসে।

গত বৃহস্পতিবার রূপগঞ্জের কর্ণগোপ এলাকায় হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কারখানায় আগুন লাগে। সেখানে ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত ৫২ জনের মৃত্যু হয়েছে। তারা উদ্ধার করেছে ২৫ জনকে। এর মধ্যে ৪৯ জনের লাশ ৪ তলার একটি ফ্লোর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। লাশগুলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন জায়গায় রাখা হয়েছে। স্বজনরা যারা আসছেন তাদের ডিএনএ নমুনা নিয়ে লাশের ডিএনএ নমুনার সঙ্গে মিলিয়ে লাশ শনাক্তের কাজ করছে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ।

রবিবার, ১১ জুলাই ২০২১ , ২৭ আষাঢ় ১৪২৮ ২৯ জিলক্বদ ১৪৪২

নাজমুল বেঁচে গেছে, খুঁজে পাচ্ছে না মাকে

সাইফ বাবলু

image

গতকাল ঢাকা মেডিকেল মর্গের সামনে নিখোঁজ মায়ের সন্ধানে নাজমুল ও তার স্বজনরা -সংবাদ

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ১৩ বছরের শিশু নাজমুল, তার ৬ বছরের ছোট বোন পাখি, দুই খালা এবং মামা একে অপরকে জড়িয়ে বিলাপ করছেন। তোমরা আমার বোনের লাশ ফিরিয়ে দেও। আমরা আর কিছু চাই না, এখন দুই সন্তানের কি হবে। নাজমার দুই বোনের এমন বুকফাটা আর্তনাতে মর্গের পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। আগের দিন মা নাজমা বেগমের লাশের সন্ধানে ডিএনএ নমুনা দিয়ে গেলেও গতকাল ফের নাজমুল তার ছোট বোন এবং খালা মামাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন মর্গে। নাজমুলের মা আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়েছেন বলে ধারণা তাদের। নাজমার মতো ওই কারখানায় যারা অগুনে পুড়েছে তাদের প্রত্যেকই এমণভাবে অঙ্গার হয়েছেন যে কারোরই লাশ চেনার কোন উপায় নেই বলেছেন পুলিশ এবং হাসপতাল কর্তৃপক্ষ।

নাজমুলের মামা ফারুক জানান, সজীব গ্রুপের পুড়ে যাওয়া কারখানায় দোতালায় ৬ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতো ১৩ বছর বয়সী নাজমুল। ৪র্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করলেও অভাবের তোড়ে পড়া আর নিয়মিত হয়নি। সংসারের হাল ধরতে মা নাজমা বেগমের সঙ্গে ১ বছর আগে শ্রমিক হিসেবে কাজ নেয়া নাজমুল।

বৃহস্পতিবার রোজকার নিয়ম মেনে সকাল ৮টায় কারখানায় কাজ শুরু করে নাজমুল। কাজ শেষ করে বিকেল ৪টায় বাসায় চলে যায়। ৫টায় যখন আগুন লাগে নাজমুলের মনে পড়ে যায় মা নাজমার কথা। ১০ মিনিটের মধ্যে দৌড়ে এসে দেখে কারখানার ফটকে তালা মারা ভেতরে আগুন জ্বলছে। এর পর থেকে মায়ের খোঁজ পাচ্ছে না নাজমুল।

মামা ফারুক বলেন, আগের দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসে ডিএনএ নমুনা দিয়ে গেলেও গতকাল ফের ৬ বছরের ছোট বোনকে নিয়ে মায়ের মরদেহ নিতে আসে। নাজমুল জানে না শেষ পর্যন্ত তার মায়ের মরদেহটিও মিলবে কিনা?

ফারুক বলেন, নাজমা তাদের বড় বোন। ১৭ বছর আগে আফজাল নামে একজনের সঙ্গে বিয়ে হয়। আফজাল তখন একটি মুরগির দোকানে কাজ করতেন। নাজমা এক মেয়ে এক ছেলেকে নিয়ে যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় থাকতেন। আকস্মিক বেকার হয়ে পড়ে আফজাল। ঘরভাড়া সংসার এবং ছেলের পড়াশুনার খরচ চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। নাজমা তখন একটি হোটেলে কাজ নেয়। তাতেও ঘরভাড়া ঠিকমতো দিতো পারতো না। সংসারে অভাব অনটন লেগেই থাকতো।

‘বোনের সংসারের এমন টানাপড়েনে বোন নাজমাকে হাসেম ফুড কারখানায় চাকরি পাইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। বোনকে যাত্রাবাড়ীর ভাড়া বাসা ছেড়ে দিয়ে নিজেদের বাড়ির পাশে বাসা ভাড়া নিতে বলেন। নাজমা বাপের বাড়ির পাশে ৩ হাজার টাকা মাসিক ভাড়ায় একটি বাসাও ভাড়া নেন। নাজমার একক রোজগারে সংসার ঠিকমতো না চলায় ১৩ বছরের সন্তান নাজমুলকেও একই ফ্যাক্টরিতে কাজে দেন। ১ বছর আগে নাজমুল ওই কারখানায় দোতালায় কাজ নেয়। নাজমার বেতন ৫ হাজার ৭০০ টাকা হলেও ছেলের বেতন ছিল ৬ হাজার টাকা। মা ছেলের রোজগারে সংসার কোনভাবে চলছিল। এখন সবকিছুই শেষ হয়ে গেছে’।

নাজমার দুই বোন জানায়, নাজমার স্বামী গত ২ বছর ধরে কাজ করতো না। শ্বাসকষ্টের রোগ থাকায় প্রায় অসুস্থ থাকতো। ঘুরে ফিরে তার দিন কাটে। বেকার স্বামীর চিকিৎসার পাশাপাশি সংসারের খরচ নাজমার বেতনের ওপর নির্ভর করতো। এখন তার ছেলে মেয়েকে কি জবাব দিব। ৬ বছরের পাখি বৃহস্পতিবার থেকেই তার মাকে খুঁজছে। বলছে, আম্মু তো বিকেলেই আসার কথা এখনও আসছে না কেন?।

শিশু শ্রমিক নাজমুল জানায়, বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় সে কারখানায় যায়। বিকেল ৪টায় ডিউটি শেষ করে সে বাসায় ফিরে। প্রতিদিন মাকে ফোন করে বাসায় ফিরলেও বৃহস্পতিবার ফোন করতে পারেনি। বিকেলে তার মায়ের কথা মনে পড়লেও ফোন করে কথা বলার জন্য। মাকে বলবে আমি চলে এসেছি তুমি রাত ৮টায় বাসায় চলে আসো। কিন্তু সেই কথা বলা হয়নি। ফোন করলেও ফোন ধরেননি তার মা। এর মধ্যে আগুন লাগার খবর পেয়ে ছুটে যান কারখানার সামনে। গিয়ে দেখেন আগুন আর আগুন। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার পর আর ফোন বাজেনি। এর পর থেকে অপেক্ষা। ছোট বোন তাকে জিজ্ঞেস করে ভাই মা তো ফিরলো না। মায়ের কি ছুটি হয়নি।

নাজমুলের ছোট বোন এখনও জানে না তার মায়ের চিরদিনের মতো হয়তো ছুটি হয়ে গেছে। নিখোঁজ নাজমার খোঁজে কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরেও কোথায় তার আহত হয়ে চিকিৎসাধীন থাকার তথ্য নেই স্বজনদের কাছে।

নাজমুল জানান, অভাবের সংসারে মা ছিল তাদের সবকিছ্।ু বাবা থেকেও নেই। এখন ছোট বোনকে কোন কিছুতেই বুঝ দিতে পারছেন না। ছোট বোনকে খালারা বলেছে, তার মা ঢাকা মেডিকেলে আছে। হাত কেটে গেছে। এমন খবরে ছোট বোন বলেছে সে তার মাকে দেখতে যাবে। তাই ছোট বোনকে নিয়ে আসে।

গত বৃহস্পতিবার রূপগঞ্জের কর্ণগোপ এলাকায় হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কারখানায় আগুন লাগে। সেখানে ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত ৫২ জনের মৃত্যু হয়েছে। তারা উদ্ধার করেছে ২৫ জনকে। এর মধ্যে ৪৯ জনের লাশ ৪ তলার একটি ফ্লোর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। লাশগুলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন জায়গায় রাখা হয়েছে। স্বজনরা যারা আসছেন তাদের ডিএনএ নমুনা নিয়ে লাশের ডিএনএ নমুনার সঙ্গে মিলিয়ে লাশ শনাক্তের কাজ করছে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ।