রূপগঞ্জ ট্র্যাজেডি

ওদের সস্তা শ্রমের জীবন

আজমিনা বেগম। বাড়ি নেত্রকোনা জেলার মদন থানা এলাকায়। বড় ছেলে রবিন মদন থানার একটি ডিগ্রি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র। ছোট ছেলে মাদ্রাসায় পড়ে। গ্রামে যেটুকু জমিজমা ছিল তাতে স্বামী মো. রোকন মিয়া কাজ কর্ম করে ছেলেদের পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ২ ছেলের জননী আজমিনা বেগমের দিন ভালোই ছিল। কিন্তু সেই ভালো আর ভালো থাকেনি।

স্বামী রোকন মিয়া আকস্মিক ৫ বছর আগে দূরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। স্বামীর চিকিৎসায় সব হারিয়ে জীবন ও জীবিকার তাগিদে ২০২০ সালে ঢাকায় আসেন কাজের সন্ধানে। কাজ নেন হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কারখানায়। ৫ হাজার ৩শ’ টাকা বেতনে ১২ ঘণ্টা ডিউটির মধ্যে ৪ ঘণ্টা ওভার টাইম করে অস্বচ্ছল সংসারের হাল ধরেন। বেতন কম হলেও মাস শেষে ওই টাকাটাই হলো আরজিনা বেগমের বেঁচে থাকার সম্বল।

আজমিনা বেগমের মতো এমন শত শত নারী-পুরুষের কষ্টের জীবন রয়েছে। যারা বেঁচে থাকার লড়াইয়ে দু-বেলা দু’মুঠো খাবারের জন্যই চাকরি নিয়েছেন সজীব গ্রুপের হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কারখানায়। চাকরিতে যখন তারা ঢুকেছেন তখন তারা কত সময় ডিউটি করতে হবে, কত টাকা বেতন হবে সেটি তাদের কাছে মুখ্য ছিল না। শুধু চাকরিটাই দরকার ছিল। আর সল্প বেতনে ৮ ঘণ্টা ডিউটি তো তাদের কাছে অত কঠিন কিছুই ছিল না।

কথা হয় আরজিনা বেগমের সঙ্গে। ৪০ বছরের বেশি বয়সী আরজিনা বেগম বলেন, অভাবের কারণে ঢাকায় আসি। কারখানার সামনে যাই কোন শ্রমিক নিবে কিনা। যেকোন একটি কাজ তখন দরকার ছিল। স্বামী গত ৫ বছর ধরে ক্যান্সার আক্রান্ত। কলেজ ও মাদ্রাসা পড়–য়া দুই ছেলের পড়াশোনা- স্বামীর চিকিৎসা টাকা জোগার করতে চাকরিতে ঢুকি। এ মাসেই বেতন বাড়ানোর কথা ছিল। কিন্তু আগুনের কারণে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। এখন নতুন করে বাঁচতে হবে।

এ কারখানায় কাজ করতো ইয়াছিন রিপন নামে এক কলেজ শিক্ষার্থী। ঘটনার পর থেকে ইয়াছিন রিপনের কোন খোঁজ নেই। কারখানায় পুড়ে মারা যাওয়া ৪৯ শ্রমিকদের মধ্যে ইয়াছিন রিপনেরও মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে কিনা তা না জানলেও ধারণা থেকে ডিএনএ নমুনা দিয়েছেন মা লিলি বেগম।

ইয়াছিন রিপনের ভাই ইব্রাহিম বলেন, তাদের ৩ ভাইকে নিয়ে তাদের মায়ের সব আশা ভরসা। ছোট বেলায় বাবা সেলিম মিয়ার মৃত্যুর পর মা লিলি বেগম কারখানায় কাজ করে তাদের দুই ভাইকে পড়াশোনা করাচ্ছিলেন। ২ বছর আগে তার মা অসুস্থ হয়ে কর্মহীন হয়ে পড়ে। শারীরিকভাবে চলাফেরারও ক্ষমতা হারান। মায়ের চিকিৎসা, আর সংসার চালানোর দায়িত্ব পড়ে ভাইয়ের ওপর। তার ছোট ভাই ইয়াছিন রিপন অত্যন্ত মেধাবী। ভালো কবিতাও লিখেন। রূপগঞ্জের কাঞ্চন এলাকায় সালেম উদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজে একাদশ শ্রেণীর ছাত্র ইয়াছিন নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি হাসেম ফুডে চাকরি নেন। চাকরি করে বেতনের টাকায় সংসার ও নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

ইব্রাহিম জানান, সেও আদমজি কলেজের ছাত্র। ছোট ভাইকে নিয়ে তাদের অনেক আশা ছিল। এখন সব আশাই শেষ হয়ে গেছে। সংসারের স্বচ্ছলতা আর নিজের পড়াশুনার খরচ চালাতে কম টাকা বেতনে চাকরি নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল ইয়াছিন। এখন তারই কোন খোজ নেই। তার মা ডিএনএ নতুনা দিয়েছেন। এখনও ভাইয়ের কোন খোঁজ নেই। হয়তো মারা গেছে। যদি লাশটাও পান তাহলে মাটি দিতে পারবেন।

কারখানায় চাকরি নিতে বাধ্য হয় অনেক শিক্ষার্থী

এ কারখানায় চাকরি নেন কিশোরগঞ্জের মো. তামছু মিয়ার মেয়ে ইমা আক্তার। ২ ভাই ৩ বোনের মধ্যে ইমা তৃতীয়। ৯ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। গত বছর করোনা মহামারী শুরু হওয়ায় স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। পড়াশুনা ছেড়ে সংসারের রোজগারে ভাগিদার হতে ৫ হাজার ৩শ’ টাকায় চাকরি নেয় হাসেম ফুডে।

ইমার মা রুমা আক্তার বলেন, তার স্বামী দর্জির কাজ করে। তিনি দুই ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় থাকতেন। মেয়ের স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মেয়েকে অভাবের কারণেই চাকরিতে ঢোকান। দুই ছেলের মধ্যে এক ছেলে কারেন্ট মিস্ত্রি আর এক ছেলে একটি কারখানায় অ্যাম্বটারির কাজ করেন। বাসা ভাড়া ২২শ’ টাকা। ছেলে মেয়ে ও নিজে চাকরি করে সংসারে যে টাকা আসে তাতে তাদের কোনভাবে চলে যায়। এ টাকায় তারা সংসারের স্বচ্ছলতা ফেরাতে লড়াই করে যাচ্ছেন।

ইমার মতো কুড়িগ্রামের নাগেশ্বর পশ্চিমপাড়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণীর ছাত্র রমজান। দেড় মাস আগে হাসেম ফুডে চাকরি নেয়। ঘটনার দিন লাফিয়ে পড়ে প্রাণ বাঁচান।

রমজান জানান, করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় সে ঢাকায় আসে। এ সময় কোন কাজ না থাকায় সংসারের স্বচ্ছলতা ফেরাতে সেও কিছু একটি কাজ করার চিন্তা করে। মামার মাধ্যমে দেড় মাস আগে হাসেম ফুডে চাকরি নেয় অল্প বেতনে। বেতন কম হওয়ায় ওভারটাইম করতো। প্রতি ঘণ্টা ওভারটাইমের জন্য ২০ থেকে ২৫ টাকা পেতেন। ৪ ঘণ্টা ওভারটাইমে প্রতিদিন ১শ’ টাকা হলে মাসে ৩ হাজার টাকা আসতো। তবে ৩ মাস পর পর ১ মাসের ওভার টাইমের টাকা পেতেন। তার ভাবনা ছিল, যতদিন স্কুল না খোলে ততদিন এখানে কাজ করে যে টাকা জমাবে সে টাকায় তার পড়াশোনার খরচ হবে। এ কারণে সে চাকরিটা নিয়েছে।

রমজানের মতোই আরেক শিশু শিক্ষার্থী সজিব। ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়াশোনা করে। করোনার কারণে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কারখানায় চাকরি নেয়। সকাল ৮ থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ডিউটি করতো।

ওই কারখানার একাধিক শ্রমিক বলেন, গত ৮ জুলাই রূপগঞ্জের কর্ণগোপ এলাকায় অবস্থিত সজীব গ্রুপের এ কারখানায় আগুনে সবকিছু ছাই হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ৫২ জনের মৃত্যু এবং অর্ধশত শ্রমিক আহত হওয়ার পর থেকে কারখানাটি এখন বন্ধ। শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান আবুল হাসেম এখন জেলে। আগুনের ঘটনায় গঠিত হয়েছে একাধিক তদন্ত কমিটি। এরপর থেকে কার্যত এখন এ কারখানার শ্রমিকদের কোন কাজ নেই। আগুনের ঘটনায় যেসব শ্রমিক নিখোঁজ আছেন তাদের স্বজনরা এখন প্রিয়জনের সন্ধান পেতে দৌড়ঝাঁপ করছেন। আহত হয়ে যারা হাত-পা ভেঙেছেন তারা চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হওয়ার জন্য ছুটাছুটি করছেন।

বেতন না পোষালেও ওভাইটাইম করতো সবাই

শ্রমিকরা জানান, সকাল ৮টা থেকে ডিউটি শুরু হয় তাদের। টানা ডিউটি চলে রাত ৮টা পর্যন্ত। এর মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী মূল ডিউটি বিকেল ৪টা পর্যন্ত হলেও বাকি ৪ ঘণ্টা ওভারটাইম করেন শ্রমিকরা। ৮ ঘণ্টা ডিউটির জন্য নারীদের বেতন ৫ হাজার ৩শ’ টাকা আর পুরুষের বেতন ৫ হাজার ৭শ’ টাকা। এভাবে সস্তা শ্রমে সজীব গ্রুপের হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডে শ্রমিকরা কাজ করতো। কর্মরত শ্রমিকদের অধিকাংশ ছিল শিশু- কিশোর। এদের মধ্যে অনেকেই স্কুল-কলেজে পড়তো আবার কেউ পড়াশোনা থেকে ছিটকে পড়া। বয়স্কদের মধ্যে স্বামী কর্তৃক ছেড়ে যাওয়া নারীদের সংখ্যাই বেশি।

শ্রমিকদের ভাষ্য সস্তা শ্রম হলেও শ্রমিকরা কখনও মুখ ফুটে বেতন কম হওয়ার বিষয়টি জানতে চাইতো না। ওভারটাইমের টাকা কয়েক মাস পর দিলেও কোন প্রতিবাদ ছিল না। কারণ কর্মরত শ্রমিকরা সস্তা শ্রমে মাস শেষে যে টাকা পেতেন তাতেই তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হতো। ঘরভাড়া, সংসার খরচ, গ্রামে থাকা বাবা-মায়ের চিকিৎসা খরচ, নিজের খরচ সবই যেন তাদের কম বেতনের ওপর নির্ভরশীল ছিল।

শ্রমিকদের ভাষ্য, যে টাকা বেতন পেতেন তাতে তাদের কিছুই হতো না। এ কারণে প্রত্যেক শ্রমিক ওভারটাইম করতেন। প্রতিদিন ৪ ঘণ্টা ওভারটাইম করে ১শ’ টাকা পাওয়ার আশায়। এ টাকা মাস হিসেব করলে ৩ হাজার টাকা হতো। মূল বেতনের সঙ্গে ৩ হাজার টাকা যোগ হলে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা বেতন হতো। তাতে কোনভাবে তাদের জীবন চলে যেতো। আবার অনেকেই ছিলেন, যাদের পুরো পরিবার এ কারখানায় কাজ করতেন। মা-ছেলে, ছেলে-বাবা, ভাই-বোন মিলেও এ কারখানায় কাজ করেছেন এমন নজির রয়েছে।

অনেক শ্রমিক চিকিৎসার খরচ পাননি

সজীব গ্রুপের কারখানায় আগুনের ঘটনায় আহত হওয়া অনেক শ্রমিক চিকিৎসার খরচ পাননি। ঘটনার পর অনেক শ্রমিক বাড়িতে চলে গেছেন। তারা ফেরত এলেও তালিকায় নাম না উঠায় পরিবারের খরচে চিকিৎসা চালাচ্ছেন। এমন এক শ্রমিক ১৫ বছর বয়সী সোহাগ। গত মে মাসের ২৭ তারিখে হাসেম ফুডে টোস্ট তৈরির কাজ নেয়।

সোহাগ বলেন, ৩ ভাই ৩ বোনের মধ্যে সে ৩ নম্বর। তার বড় দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। বড় ভাই রড মিস্ত্রির কাজ করে। আরেক বড় বোনের এখনও বিয়ে হয়নি। আর তার ছোট এক ভাই আছে। বাবা কালু মিয়া বর্ষা মৌসুমে কৃষি কাজ করলেও অন্য সময় হাতে কোন কাজ থাকে না। কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি থানার শিমুলতলা গ্রামের তাদের বাড়ি। অভাবের সংসার। সে কারণেই হাসেম ফুডে ৫ হাজার ৭শ’ টাকা বেতনে চাকরি নিয়েছে।

ঘটনার দিন সোহাগ কারখানার দোতলায় টোস্ট তৈরির কাজ করছিলেন। আকস্মিক আগুন লাগার পর সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় ধোয়া দেখতে পান। এরপর আগুনের কাড়নে সিড়ি নিয়ে নামতে না পেড়ে উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে। এতে তার পা ভেঙে যায়। ঘটনার পর বাড়ি চলে যান। পরিবার তার চিকিৎসায় এ পর্যন্ত ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা ব্যয় করেছে। কিন্তু সে হাসপাতালে ভর্তি না থাকায় সরকারিভাবে বা কোম্পানি থেকে চিকিৎসার জন্য এক টাকাও পায়নি। বর্তমানে রূপগঞ্জের গোলাকান্দায় নতুন বাজার এলাকায় চাচাতো বোন রুকসানার বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

গত ৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কর্ণগোপ এলাকায় সজীব গ্রুপের হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কারখানায় আগুন লাগে। ভয়াবহ এ আগুন নিভাতে ৪৮ ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। আগুন লাগার একদিন পর একটি ফ্লোর থেকে ৪৯ জনের পোড়া লাশ উদ্ধার হয়। যাদের কাউকে চেনা যাচ্ছিল না। সবমিলিয়ে এ ঘটনায় ৫২ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে অর্ধশত শ্রমিক। ঘটনায় মামলা হলে পুলিশ সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল হাসেমসহ ৮ জনকে গ্রেপ্তার করে। এর মধ্যে আবুল হাসেমের দুই ছেলে জামিনে মুক্ত হলেও অন্যরা এখনও জেলে আছে। গতকাল মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে তদন্তের জন্য।

শনিবার, ১৭ জুলাই ২০২১ , ২ শ্রাবন ১৪২৮ ৬ জিলহজ ১৪৪২

রূপগঞ্জ ট্র্যাজেডি

ওদের সস্তা শ্রমের জীবন

সাইফ বাবলু, রূপগঞ্জ (নারায়াণগঞ্জ) থেকে ফিরে

image

আজমিনা বেগম। বাড়ি নেত্রকোনা জেলার মদন থানা এলাকায়। বড় ছেলে রবিন মদন থানার একটি ডিগ্রি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র। ছোট ছেলে মাদ্রাসায় পড়ে। গ্রামে যেটুকু জমিজমা ছিল তাতে স্বামী মো. রোকন মিয়া কাজ কর্ম করে ছেলেদের পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ২ ছেলের জননী আজমিনা বেগমের দিন ভালোই ছিল। কিন্তু সেই ভালো আর ভালো থাকেনি।

স্বামী রোকন মিয়া আকস্মিক ৫ বছর আগে দূরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। স্বামীর চিকিৎসায় সব হারিয়ে জীবন ও জীবিকার তাগিদে ২০২০ সালে ঢাকায় আসেন কাজের সন্ধানে। কাজ নেন হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কারখানায়। ৫ হাজার ৩শ’ টাকা বেতনে ১২ ঘণ্টা ডিউটির মধ্যে ৪ ঘণ্টা ওভার টাইম করে অস্বচ্ছল সংসারের হাল ধরেন। বেতন কম হলেও মাস শেষে ওই টাকাটাই হলো আরজিনা বেগমের বেঁচে থাকার সম্বল।

আজমিনা বেগমের মতো এমন শত শত নারী-পুরুষের কষ্টের জীবন রয়েছে। যারা বেঁচে থাকার লড়াইয়ে দু-বেলা দু’মুঠো খাবারের জন্যই চাকরি নিয়েছেন সজীব গ্রুপের হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কারখানায়। চাকরিতে যখন তারা ঢুকেছেন তখন তারা কত সময় ডিউটি করতে হবে, কত টাকা বেতন হবে সেটি তাদের কাছে মুখ্য ছিল না। শুধু চাকরিটাই দরকার ছিল। আর সল্প বেতনে ৮ ঘণ্টা ডিউটি তো তাদের কাছে অত কঠিন কিছুই ছিল না।

কথা হয় আরজিনা বেগমের সঙ্গে। ৪০ বছরের বেশি বয়সী আরজিনা বেগম বলেন, অভাবের কারণে ঢাকায় আসি। কারখানার সামনে যাই কোন শ্রমিক নিবে কিনা। যেকোন একটি কাজ তখন দরকার ছিল। স্বামী গত ৫ বছর ধরে ক্যান্সার আক্রান্ত। কলেজ ও মাদ্রাসা পড়–য়া দুই ছেলের পড়াশোনা- স্বামীর চিকিৎসা টাকা জোগার করতে চাকরিতে ঢুকি। এ মাসেই বেতন বাড়ানোর কথা ছিল। কিন্তু আগুনের কারণে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। এখন নতুন করে বাঁচতে হবে।

এ কারখানায় কাজ করতো ইয়াছিন রিপন নামে এক কলেজ শিক্ষার্থী। ঘটনার পর থেকে ইয়াছিন রিপনের কোন খোঁজ নেই। কারখানায় পুড়ে মারা যাওয়া ৪৯ শ্রমিকদের মধ্যে ইয়াছিন রিপনেরও মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে কিনা তা না জানলেও ধারণা থেকে ডিএনএ নমুনা দিয়েছেন মা লিলি বেগম।

ইয়াছিন রিপনের ভাই ইব্রাহিম বলেন, তাদের ৩ ভাইকে নিয়ে তাদের মায়ের সব আশা ভরসা। ছোট বেলায় বাবা সেলিম মিয়ার মৃত্যুর পর মা লিলি বেগম কারখানায় কাজ করে তাদের দুই ভাইকে পড়াশোনা করাচ্ছিলেন। ২ বছর আগে তার মা অসুস্থ হয়ে কর্মহীন হয়ে পড়ে। শারীরিকভাবে চলাফেরারও ক্ষমতা হারান। মায়ের চিকিৎসা, আর সংসার চালানোর দায়িত্ব পড়ে ভাইয়ের ওপর। তার ছোট ভাই ইয়াছিন রিপন অত্যন্ত মেধাবী। ভালো কবিতাও লিখেন। রূপগঞ্জের কাঞ্চন এলাকায় সালেম উদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজে একাদশ শ্রেণীর ছাত্র ইয়াছিন নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি হাসেম ফুডে চাকরি নেন। চাকরি করে বেতনের টাকায় সংসার ও নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

ইব্রাহিম জানান, সেও আদমজি কলেজের ছাত্র। ছোট ভাইকে নিয়ে তাদের অনেক আশা ছিল। এখন সব আশাই শেষ হয়ে গেছে। সংসারের স্বচ্ছলতা আর নিজের পড়াশুনার খরচ চালাতে কম টাকা বেতনে চাকরি নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল ইয়াছিন। এখন তারই কোন খোজ নেই। তার মা ডিএনএ নতুনা দিয়েছেন। এখনও ভাইয়ের কোন খোঁজ নেই। হয়তো মারা গেছে। যদি লাশটাও পান তাহলে মাটি দিতে পারবেন।

কারখানায় চাকরি নিতে বাধ্য হয় অনেক শিক্ষার্থী

এ কারখানায় চাকরি নেন কিশোরগঞ্জের মো. তামছু মিয়ার মেয়ে ইমা আক্তার। ২ ভাই ৩ বোনের মধ্যে ইমা তৃতীয়। ৯ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। গত বছর করোনা মহামারী শুরু হওয়ায় স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। পড়াশুনা ছেড়ে সংসারের রোজগারে ভাগিদার হতে ৫ হাজার ৩শ’ টাকায় চাকরি নেয় হাসেম ফুডে।

ইমার মা রুমা আক্তার বলেন, তার স্বামী দর্জির কাজ করে। তিনি দুই ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় থাকতেন। মেয়ের স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মেয়েকে অভাবের কারণেই চাকরিতে ঢোকান। দুই ছেলের মধ্যে এক ছেলে কারেন্ট মিস্ত্রি আর এক ছেলে একটি কারখানায় অ্যাম্বটারির কাজ করেন। বাসা ভাড়া ২২শ’ টাকা। ছেলে মেয়ে ও নিজে চাকরি করে সংসারে যে টাকা আসে তাতে তাদের কোনভাবে চলে যায়। এ টাকায় তারা সংসারের স্বচ্ছলতা ফেরাতে লড়াই করে যাচ্ছেন।

ইমার মতো কুড়িগ্রামের নাগেশ্বর পশ্চিমপাড়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণীর ছাত্র রমজান। দেড় মাস আগে হাসেম ফুডে চাকরি নেয়। ঘটনার দিন লাফিয়ে পড়ে প্রাণ বাঁচান।

রমজান জানান, করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় সে ঢাকায় আসে। এ সময় কোন কাজ না থাকায় সংসারের স্বচ্ছলতা ফেরাতে সেও কিছু একটি কাজ করার চিন্তা করে। মামার মাধ্যমে দেড় মাস আগে হাসেম ফুডে চাকরি নেয় অল্প বেতনে। বেতন কম হওয়ায় ওভারটাইম করতো। প্রতি ঘণ্টা ওভারটাইমের জন্য ২০ থেকে ২৫ টাকা পেতেন। ৪ ঘণ্টা ওভারটাইমে প্রতিদিন ১শ’ টাকা হলে মাসে ৩ হাজার টাকা আসতো। তবে ৩ মাস পর পর ১ মাসের ওভার টাইমের টাকা পেতেন। তার ভাবনা ছিল, যতদিন স্কুল না খোলে ততদিন এখানে কাজ করে যে টাকা জমাবে সে টাকায় তার পড়াশোনার খরচ হবে। এ কারণে সে চাকরিটা নিয়েছে।

রমজানের মতোই আরেক শিশু শিক্ষার্থী সজিব। ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়াশোনা করে। করোনার কারণে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কারখানায় চাকরি নেয়। সকাল ৮ থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ডিউটি করতো।

ওই কারখানার একাধিক শ্রমিক বলেন, গত ৮ জুলাই রূপগঞ্জের কর্ণগোপ এলাকায় অবস্থিত সজীব গ্রুপের এ কারখানায় আগুনে সবকিছু ছাই হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ৫২ জনের মৃত্যু এবং অর্ধশত শ্রমিক আহত হওয়ার পর থেকে কারখানাটি এখন বন্ধ। শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান আবুল হাসেম এখন জেলে। আগুনের ঘটনায় গঠিত হয়েছে একাধিক তদন্ত কমিটি। এরপর থেকে কার্যত এখন এ কারখানার শ্রমিকদের কোন কাজ নেই। আগুনের ঘটনায় যেসব শ্রমিক নিখোঁজ আছেন তাদের স্বজনরা এখন প্রিয়জনের সন্ধান পেতে দৌড়ঝাঁপ করছেন। আহত হয়ে যারা হাত-পা ভেঙেছেন তারা চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হওয়ার জন্য ছুটাছুটি করছেন।

বেতন না পোষালেও ওভাইটাইম করতো সবাই

শ্রমিকরা জানান, সকাল ৮টা থেকে ডিউটি শুরু হয় তাদের। টানা ডিউটি চলে রাত ৮টা পর্যন্ত। এর মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী মূল ডিউটি বিকেল ৪টা পর্যন্ত হলেও বাকি ৪ ঘণ্টা ওভারটাইম করেন শ্রমিকরা। ৮ ঘণ্টা ডিউটির জন্য নারীদের বেতন ৫ হাজার ৩শ’ টাকা আর পুরুষের বেতন ৫ হাজার ৭শ’ টাকা। এভাবে সস্তা শ্রমে সজীব গ্রুপের হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডে শ্রমিকরা কাজ করতো। কর্মরত শ্রমিকদের অধিকাংশ ছিল শিশু- কিশোর। এদের মধ্যে অনেকেই স্কুল-কলেজে পড়তো আবার কেউ পড়াশোনা থেকে ছিটকে পড়া। বয়স্কদের মধ্যে স্বামী কর্তৃক ছেড়ে যাওয়া নারীদের সংখ্যাই বেশি।

শ্রমিকদের ভাষ্য সস্তা শ্রম হলেও শ্রমিকরা কখনও মুখ ফুটে বেতন কম হওয়ার বিষয়টি জানতে চাইতো না। ওভারটাইমের টাকা কয়েক মাস পর দিলেও কোন প্রতিবাদ ছিল না। কারণ কর্মরত শ্রমিকরা সস্তা শ্রমে মাস শেষে যে টাকা পেতেন তাতেই তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হতো। ঘরভাড়া, সংসার খরচ, গ্রামে থাকা বাবা-মায়ের চিকিৎসা খরচ, নিজের খরচ সবই যেন তাদের কম বেতনের ওপর নির্ভরশীল ছিল।

শ্রমিকদের ভাষ্য, যে টাকা বেতন পেতেন তাতে তাদের কিছুই হতো না। এ কারণে প্রত্যেক শ্রমিক ওভারটাইম করতেন। প্রতিদিন ৪ ঘণ্টা ওভারটাইম করে ১শ’ টাকা পাওয়ার আশায়। এ টাকা মাস হিসেব করলে ৩ হাজার টাকা হতো। মূল বেতনের সঙ্গে ৩ হাজার টাকা যোগ হলে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা বেতন হতো। তাতে কোনভাবে তাদের জীবন চলে যেতো। আবার অনেকেই ছিলেন, যাদের পুরো পরিবার এ কারখানায় কাজ করতেন। মা-ছেলে, ছেলে-বাবা, ভাই-বোন মিলেও এ কারখানায় কাজ করেছেন এমন নজির রয়েছে।

অনেক শ্রমিক চিকিৎসার খরচ পাননি

সজীব গ্রুপের কারখানায় আগুনের ঘটনায় আহত হওয়া অনেক শ্রমিক চিকিৎসার খরচ পাননি। ঘটনার পর অনেক শ্রমিক বাড়িতে চলে গেছেন। তারা ফেরত এলেও তালিকায় নাম না উঠায় পরিবারের খরচে চিকিৎসা চালাচ্ছেন। এমন এক শ্রমিক ১৫ বছর বয়সী সোহাগ। গত মে মাসের ২৭ তারিখে হাসেম ফুডে টোস্ট তৈরির কাজ নেয়।

সোহাগ বলেন, ৩ ভাই ৩ বোনের মধ্যে সে ৩ নম্বর। তার বড় দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। বড় ভাই রড মিস্ত্রির কাজ করে। আরেক বড় বোনের এখনও বিয়ে হয়নি। আর তার ছোট এক ভাই আছে। বাবা কালু মিয়া বর্ষা মৌসুমে কৃষি কাজ করলেও অন্য সময় হাতে কোন কাজ থাকে না। কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি থানার শিমুলতলা গ্রামের তাদের বাড়ি। অভাবের সংসার। সে কারণেই হাসেম ফুডে ৫ হাজার ৭শ’ টাকা বেতনে চাকরি নিয়েছে।

ঘটনার দিন সোহাগ কারখানার দোতলায় টোস্ট তৈরির কাজ করছিলেন। আকস্মিক আগুন লাগার পর সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় ধোয়া দেখতে পান। এরপর আগুনের কাড়নে সিড়ি নিয়ে নামতে না পেড়ে উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে। এতে তার পা ভেঙে যায়। ঘটনার পর বাড়ি চলে যান। পরিবার তার চিকিৎসায় এ পর্যন্ত ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা ব্যয় করেছে। কিন্তু সে হাসপাতালে ভর্তি না থাকায় সরকারিভাবে বা কোম্পানি থেকে চিকিৎসার জন্য এক টাকাও পায়নি। বর্তমানে রূপগঞ্জের গোলাকান্দায় নতুন বাজার এলাকায় চাচাতো বোন রুকসানার বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

গত ৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কর্ণগোপ এলাকায় সজীব গ্রুপের হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কারখানায় আগুন লাগে। ভয়াবহ এ আগুন নিভাতে ৪৮ ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। আগুন লাগার একদিন পর একটি ফ্লোর থেকে ৪৯ জনের পোড়া লাশ উদ্ধার হয়। যাদের কাউকে চেনা যাচ্ছিল না। সবমিলিয়ে এ ঘটনায় ৫২ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে অর্ধশত শ্রমিক। ঘটনায় মামলা হলে পুলিশ সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল হাসেমসহ ৮ জনকে গ্রেপ্তার করে। এর মধ্যে আবুল হাসেমের দুই ছেলে জামিনে মুক্ত হলেও অন্যরা এখনও জেলে আছে। গতকাল মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে তদন্তের জন্য।