পশুর হাটে উপচেপড়া ভিড়

স্বাস্থ্যবিধির কোন শর্তই মানছেন না ক্রেতা-বিক্রেতা

ওহেদুল ইসলাম, কোরবানির গরু কিনতে এসেছেন লালমনিরহাটের কালিগঞ্জ উপজেলার চাপারহাটে। কিন্তু হাটে এসেই জনসমাগম দেখে চক্ষু চড়কগাছ। তিনি বলেন, ঈদে কোরবানির জন্য গরু কিনতে এসেছি। কিন্তু হাটে তো কোন স্বাস্থ্যবিধি নেই। এতো মানুষ দেখে ভয়ও লাগছে। ক্রেতা-বিক্রেতা অধিকাংশের মুখেই মাস্ক নাই।

একই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন রাজধানীর দক্ষিণ বনশ্রীর বাসিন্দা ফরিদ আহমেদ। তিনি বলেন, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী আবাসিক এলাকায় গরুর হাট বসানো যাবে না। কিন্তু মেরাদিয়া হাটটি মূলত দক্ষিণ বনশ্রীর আবাসিক এলাকার বিভিন্ন সড়ককেন্দ্রীক। আফতাব নগর হাটটিও আফতাব নগর আবাসিক এলাকার বিভিন্ন সড়ককেন্দ্রীক। হাটকে ঘিরে এরই মধ্যে জনসমাগম বেড়েছে। করোনা সংক্রমণ ঝুঁকির শঙ্কায় রয়েছে সবাই।

পহেলা জুলাই থেকে টানা ১৪ দিনের কঠোর বিধিনিষেধ শেষে ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে লকডাউন শিথিল করেছে সরকার। ৪৬টি শর্তে ১৭ জুলাই থেকে ঢাকাসহ সারাদেশে কোরবানির গরুর হাট বসানোর অনুমোদন দেয় সরকার। গরুর হাট শুরুর আগে বিধি ভাঙার খেলা শুরু।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঈদুল ফিতরে লকডাউনের মধ্যেও স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে অনেকেই বাড়ি ফিরে ছিল। যার প্রভাবে জুনের শেষ সপ্তাহ ও জুলাই মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর রেকর্ড হয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে কোরবানির হাট শুরু হওয়ায় ঈদের পরে দেশে আক্রান্ত ও মৃত্যুর নতুন রেকর্ড হতে পারে এবং কোরবানির ঈদ পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে বিশেষজ্ঞ জনদের মাঝে।

কোরবানির পশুর হাটে বিক্রেতা ও ক্রেতাদের জন্য যে ৪৬টি শর্ত দেয়া হয়েছে তার বড় একটি অংশ করোনায় স্বাস্থ্যবিধি, সামাজিক দূরত্ব ও মাস্ক সংক্রান্ত। বলা হচ্ছে, হাটে প্রবেশের পথে শরীরের তাপমাত্রা মাপা ও সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা থাকবে। হাটের ভিতরেও হাত ধোয়ার ব্যবস্থা। হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা রাখতে হবে। হাটে গরুগুলোকে এমনভাবে রাখতে হবে যাতে ক্রেতারা নিজেদের মধ্যে তিন ফুট দূরত্ব বজায় রেখে হাটে অবস্থান করতে পারেন। সেভাবেই হাটে গবাদি পশু তুলতে হবে। এর বেশি পশু রাখা যাবে না।

শর্তে বলা হয়েছে, হাটে ক্রেতা-বিক্রেতা সবাইকে মাস্ক পরতে হবে। আর গরু কিনতে দুজনের বেশি হাটে যেতে পারবেন না। হাটের আয়তন অনুযায়ী সামাজিক দূরত্ব রেখে যত জন ক্রেতা এক সঙ্গে প্রবেশ করতে পারেন, ততজন প্রবেশ করবেন। বাকিরা বাইরে অপেক্ষা করে পর্যায়ক্রমে প্রবেশ করবেন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।

কোরবানির পশুর হাটে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে যেভাবে লোকসমাগম হচ্ছে তাতে করোনা সংক্রমণে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে বলে অভিমত দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. সহীদুল্লাহ। তিনি সংবাদকে বলেন, আমরা করোনাবিষয়ক পরামর্শক কমিটি কোরবানি পশুর হাটের জন্য একটি গাইড লাইন দিয়েছি। তা মানার ক্ষেত্রে সবাইকে কঠোর হওয়া দরকার। যদি স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি এবং প্রভাবশালীদের নিয়ে কমিটি করে পুরো বিষয়টি মনিটর করা হয় তবে সাধারণ মানুষকে সরকারের জারি করা স্বাস্থ্যবিধি মানানো সম্ভব হতে পারে।

সারাদেশের ৮টি জেলা থেকে সংবাদের প্রতিনিধির পাঠানো প্রতিবেদন অনুযায়ী হাটগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা যায়নি। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরÑ

কুমিল্লা : কোরবানির পশু কেনাবেচায় কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এলাকাসহ জেলায় ৩৬৩টি স্থানে হাট বসছে। হাটের বেশিরভাগ ক্রেতা-বিক্রেতা স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। অনেকেরই মুখে মাস্ক নেই। হাতে গোনা দু/একজনের মুখে মাস্ক থাকলেও অনেকেই তা নামিয়ে রেখেছেন গলায়। হাট কমিটির পক্ষ থেকে সচেতনতামূলক তেমন কোন প্রচারণা নেই।

এ বিষয়ে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, হাট-বাজারগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে প্রশাসন তৎপর রয়েছে। করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ মাঠে কাজ করছে। ইজারাদেরও স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাজার পরিচালনার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে জনগণকেও সচেতন হতে হবে।

রংপুর : রংপুরসহ আশপাশের জেলাগুলোর বিভিন্ন স্থানে শুক্রবার কোরবানির পশুর হাট বসলেও কোথাও ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি, সামাজিক দূরত্ব মানা হয়নি। বেশিরভাগ গরুর পাইকার এবং খদ্দেরদের মুখে মাস্ক ছিল না। গরু কিনতে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা লোকজনও ঠাসাঠাসি আর গাদাগাদির মধ্যেই ঘুরে বেড়াচ্ছে গরুর হাটে। বেশিভাগ মানুষের মুখে মাস্ক নেই।

রংপুরের সিভিল সার্জন ডা. হিরম্ব কুমার জানিয়েছেন, গরুর হাটগুলোতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক না পরলে সংক্রমণ আরও বাড়তে পারে।

রাজশাহী : রাজশাহী মহানগরের ‘সিটিহাট’ পশুর হাটে ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে গতকাল। তবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে স্থানীয় প্রশাসন স্বাস্থ্যবিধি মেনে পশুর হাটে কেনাবেচার নির্দেশনা দিলেও কোন হাটেই তা মানা হচ্ছে না। সংক্রমণের শঙ্কা থাকলেও ক্রেতা-বিক্রেতাদের কেউই মানছেন না স্বাস্থ্যবিধি।

স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতের বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তরাঞ্চলের সর্ববৃহৎ রাজশাহী সিটি হাটের ইজারাদার আতিকুর রহমান কালু বলেন, ক্রেতা-বিক্রেতাদের সচেতন করতে আমরা বারবার মাইকিং করছি। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলছি। মাস্ক ও স্যানিটাইজার আছে। যে কেউ চাইলেই নিতে পারবে। কিন্তু মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব লক্ষ্য করছি।

সিলেট : ক্রেতার তুলনায় দর্শকই বেশি ছিল সিলেট নগরীর স্থায়ী পশুর হাট কাজিরবাজারে। হাটে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ছোট-বড় বাহারি রংয়ের গরু নিয়ে বসে আছেন পাইকাররা। এছাড়া ভারত ও নেপালি গরুরও সমাগম রয়েছে বাজারে। নির্দেশনা থাকলেও কাজিরবাজারে নেই হাত ধোয়ার কোন ব্যবস্থা। ইজারাদারের পক্ষ থেকেও ছিল না কোন প্রচারণা। এতে হতাশা ব্যক্ত করেছেন সচেতন অনেকেই।

লালমনিরহাট : লালমনিরহাটে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের বিস্তার থেমে নেই। প্রতিদিন লম্বা হচ্ছে আক্রান্তের সঙ্গে মৃত্যুর সারি। এ পরিস্থিতিতে সরকারি বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ায় শহর-গ্রাম সবখানেই স্বাভাবিক চিত্র। অবাধ চলাফেরার সঙ্গে গাদাগাদি করে বসছে পশুর হাট। নির্দেশনা অনুযায়ী হাটে-বাজারে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। কিন্তু লালমনিরহাটে পশুর হাটগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি। মাস্ক ছাড়াই ঘুরে বেড়াচ্ছেন বহু মানুষ। অনেকেই জানেন না সামাজিক দূরত্বের বিষয়টিও। পশুর হাটে হাজারও মানুষের ভিড়ে অসহায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

ইজারাদারের পক্ষ থেকেও নেই কোন সুরক্ষা ব্যবস্থা, প্রবেশপথে রাখা হয়নি হাত ধোয়ার জন্য পানি ও সাবান। নেই শরীরের তাপমাত্রা মাপার যন্ত্রও। স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন করে দিনভর ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগমে তিলঠাঁই ছিল না। হাটজুড়ে শিশু থেকে বৃদ্ধ, সব বয়সী মানুষের ছিল অবাধ সমাগম।

নারায়ণগঞ্জ : নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলায় এবার ১৪টি অস্থায়ী পশুর হাটের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ১৩টি হাটের ইজারা সম্পন্ন হয়েছে। কাক্সিক্ষত দর না পাওয়াতে বাকি আছে একটি। ঈদের তিনদিন আগ থেকে হাট বসানোর অনুমতি দেয়ার কথা থাকলেও উপজেলার বেশ কয়েকটি হাট ইতোমধ্যে বসতে শুরু করেছে। হাটে ক্রেতা-বিক্রেতাদের অনেকেই মানছেন না স্বাস্থ্যবিধি। কোভিড পরিস্থিতিতে হাটে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি রয়েছে উপেক্ষিত। অধিকাংশ হাটের সামনেই নেই জীবাণুনাশক ট্যানেল ব্যবস্থা। হাটে আসা ক্রেতা ও দর্শনার্থীদের অনেকেই মানছেন না স্বাস্থ্যবিধি।

জানতে চাইলে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফা জহুরা সংবাদকে বলেন, ঈদের তিনদিন আগে থেকে হাটের কেনাবেচার অনুমতি দেয়া হয়েছে। সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে হাট পরিচালনার কথা বলা হয়েছে। সবাই সহযোগিতা করলে করোনা পরিস্থিতির মধ্যে সুন্দরভাবে হাট পরিচালনা করা যাবে। তবে কোভিড পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে সরকারি বিধিনিষেধের ব্যত্যয় ঘটলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিয়মিত অভিযান পরিচালনার কথাও জানান তিনি।

বরিশাল : কোরবানিকে সামনে রেখে বরিশাল নগরীতে স্থায়ী একটিসহ তিনটি এবং বরিশাল জেলায় স্থায়ী, অস্থায়ী মিলিয়ে মোট ৬৮টি পশুর হাট বসছে। অবশ্য বরিশাল সদর উপজেলায় আরও চারটি অস্থায়ী পশুর হাট বসানোর অনুমতি দেয়া হয়েছে। গতকাল হাট ঘুরে দেখা গেছে, এখন পর্যন্ত পশুর ক্রেতা-বিক্রেতাদের সংখ্যা কম হলেও তাদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিশেষ কোন আগ্রহ নেই। সবাই ‘আল্লার উপর ভরসা রেখে’ চলছেন। এমনকি ইজারাদারদের যেসব নির্দেশনা পালন করতে বলা হয়েছে তাও তাদের পালন করার আগ্রহ নেই।

জেলা প্রশাসক জসিমউদ্দিন হায়দার বলেন, যারা স্বাস্থ্যবিধি মানবেন না তাদের বিরুদ্ধে মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারে বাধ্য করার জন্য সব উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে বিশেষ টিম কাজ করবে।

সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরায় গরুর হাটে সামাজিক দূরত্ব মানছেন না অধিকাংশ ক্রেতা-বিক্রেতা। এছাড়া গরুহাটে মাস্কবিহীন অবাধে চলাফেরা করায় করোনা সংক্রমণের হার আবারও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এদিকে কোন গরুর হাটে প্রশাসনিক তৎপরতার দেখা মেলেনি।

এ বিষয়ে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. সহিদুল ইসলাম জানান, হাট তদারকির কমিটি রয়েছে। কমিটির লোকজন সরেজমিনে যাচ্ছেনও। কিন্তু কোনভাবেই মানতে বাধ্য করা যাচ্ছে না শারীরিক দূরত্বসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য বিধি।

image

সারাদেশে কোরবানির পশুর হাটগুলোতে কোন স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না, তোয়াক্কা করছে না কেউ কোন নিয়মনীতি। উত্তরাঞ্চলের লালমনিরহাটের পশুর বাজার চিত্র -সংবাদ

আরও খবর
করোনা পরীক্ষার ভুল রিপোর্ট, তদন্ত শুরু প্রাভা হেলথের বিরুদ্ধে
লিটন-সাকিবের যুগলবন্দীতে বড় জয় টাইগারদের
শনাক্তের হার ২৮.৯৬ শতাংশ
ডেঙ্গু আক্রান্ত হাজার ছাড়ালো
ওদের সস্তা শ্রমের জীবন
মুচলেকা রেখে নিহতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ

শনিবার, ১৭ জুলাই ২০২১ , ২ শ্রাবন ১৪২৮ ৬ জিলহজ ১৪৪২

পশুর হাটে উপচেপড়া ভিড়

স্বাস্থ্যবিধির কোন শর্তই মানছেন না ক্রেতা-বিক্রেতা

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

image

সারাদেশে কোরবানির পশুর হাটগুলোতে কোন স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না, তোয়াক্কা করছে না কেউ কোন নিয়মনীতি। উত্তরাঞ্চলের লালমনিরহাটের পশুর বাজার চিত্র -সংবাদ

ওহেদুল ইসলাম, কোরবানির গরু কিনতে এসেছেন লালমনিরহাটের কালিগঞ্জ উপজেলার চাপারহাটে। কিন্তু হাটে এসেই জনসমাগম দেখে চক্ষু চড়কগাছ। তিনি বলেন, ঈদে কোরবানির জন্য গরু কিনতে এসেছি। কিন্তু হাটে তো কোন স্বাস্থ্যবিধি নেই। এতো মানুষ দেখে ভয়ও লাগছে। ক্রেতা-বিক্রেতা অধিকাংশের মুখেই মাস্ক নাই।

একই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন রাজধানীর দক্ষিণ বনশ্রীর বাসিন্দা ফরিদ আহমেদ। তিনি বলেন, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী আবাসিক এলাকায় গরুর হাট বসানো যাবে না। কিন্তু মেরাদিয়া হাটটি মূলত দক্ষিণ বনশ্রীর আবাসিক এলাকার বিভিন্ন সড়ককেন্দ্রীক। আফতাব নগর হাটটিও আফতাব নগর আবাসিক এলাকার বিভিন্ন সড়ককেন্দ্রীক। হাটকে ঘিরে এরই মধ্যে জনসমাগম বেড়েছে। করোনা সংক্রমণ ঝুঁকির শঙ্কায় রয়েছে সবাই।

পহেলা জুলাই থেকে টানা ১৪ দিনের কঠোর বিধিনিষেধ শেষে ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে লকডাউন শিথিল করেছে সরকার। ৪৬টি শর্তে ১৭ জুলাই থেকে ঢাকাসহ সারাদেশে কোরবানির গরুর হাট বসানোর অনুমোদন দেয় সরকার। গরুর হাট শুরুর আগে বিধি ভাঙার খেলা শুরু।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঈদুল ফিতরে লকডাউনের মধ্যেও স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে অনেকেই বাড়ি ফিরে ছিল। যার প্রভাবে জুনের শেষ সপ্তাহ ও জুলাই মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর রেকর্ড হয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে কোরবানির হাট শুরু হওয়ায় ঈদের পরে দেশে আক্রান্ত ও মৃত্যুর নতুন রেকর্ড হতে পারে এবং কোরবানির ঈদ পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে বিশেষজ্ঞ জনদের মাঝে।

কোরবানির পশুর হাটে বিক্রেতা ও ক্রেতাদের জন্য যে ৪৬টি শর্ত দেয়া হয়েছে তার বড় একটি অংশ করোনায় স্বাস্থ্যবিধি, সামাজিক দূরত্ব ও মাস্ক সংক্রান্ত। বলা হচ্ছে, হাটে প্রবেশের পথে শরীরের তাপমাত্রা মাপা ও সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা থাকবে। হাটের ভিতরেও হাত ধোয়ার ব্যবস্থা। হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা রাখতে হবে। হাটে গরুগুলোকে এমনভাবে রাখতে হবে যাতে ক্রেতারা নিজেদের মধ্যে তিন ফুট দূরত্ব বজায় রেখে হাটে অবস্থান করতে পারেন। সেভাবেই হাটে গবাদি পশু তুলতে হবে। এর বেশি পশু রাখা যাবে না।

শর্তে বলা হয়েছে, হাটে ক্রেতা-বিক্রেতা সবাইকে মাস্ক পরতে হবে। আর গরু কিনতে দুজনের বেশি হাটে যেতে পারবেন না। হাটের আয়তন অনুযায়ী সামাজিক দূরত্ব রেখে যত জন ক্রেতা এক সঙ্গে প্রবেশ করতে পারেন, ততজন প্রবেশ করবেন। বাকিরা বাইরে অপেক্ষা করে পর্যায়ক্রমে প্রবেশ করবেন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।

কোরবানির পশুর হাটে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে যেভাবে লোকসমাগম হচ্ছে তাতে করোনা সংক্রমণে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে বলে অভিমত দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. সহীদুল্লাহ। তিনি সংবাদকে বলেন, আমরা করোনাবিষয়ক পরামর্শক কমিটি কোরবানি পশুর হাটের জন্য একটি গাইড লাইন দিয়েছি। তা মানার ক্ষেত্রে সবাইকে কঠোর হওয়া দরকার। যদি স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি এবং প্রভাবশালীদের নিয়ে কমিটি করে পুরো বিষয়টি মনিটর করা হয় তবে সাধারণ মানুষকে সরকারের জারি করা স্বাস্থ্যবিধি মানানো সম্ভব হতে পারে।

সারাদেশের ৮টি জেলা থেকে সংবাদের প্রতিনিধির পাঠানো প্রতিবেদন অনুযায়ী হাটগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা যায়নি। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরÑ

কুমিল্লা : কোরবানির পশু কেনাবেচায় কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এলাকাসহ জেলায় ৩৬৩টি স্থানে হাট বসছে। হাটের বেশিরভাগ ক্রেতা-বিক্রেতা স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। অনেকেরই মুখে মাস্ক নেই। হাতে গোনা দু/একজনের মুখে মাস্ক থাকলেও অনেকেই তা নামিয়ে রেখেছেন গলায়। হাট কমিটির পক্ষ থেকে সচেতনতামূলক তেমন কোন প্রচারণা নেই।

এ বিষয়ে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, হাট-বাজারগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে প্রশাসন তৎপর রয়েছে। করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ মাঠে কাজ করছে। ইজারাদেরও স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাজার পরিচালনার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে জনগণকেও সচেতন হতে হবে।

রংপুর : রংপুরসহ আশপাশের জেলাগুলোর বিভিন্ন স্থানে শুক্রবার কোরবানির পশুর হাট বসলেও কোথাও ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি, সামাজিক দূরত্ব মানা হয়নি। বেশিরভাগ গরুর পাইকার এবং খদ্দেরদের মুখে মাস্ক ছিল না। গরু কিনতে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা লোকজনও ঠাসাঠাসি আর গাদাগাদির মধ্যেই ঘুরে বেড়াচ্ছে গরুর হাটে। বেশিভাগ মানুষের মুখে মাস্ক নেই।

রংপুরের সিভিল সার্জন ডা. হিরম্ব কুমার জানিয়েছেন, গরুর হাটগুলোতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক না পরলে সংক্রমণ আরও বাড়তে পারে।

রাজশাহী : রাজশাহী মহানগরের ‘সিটিহাট’ পশুর হাটে ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে গতকাল। তবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে স্থানীয় প্রশাসন স্বাস্থ্যবিধি মেনে পশুর হাটে কেনাবেচার নির্দেশনা দিলেও কোন হাটেই তা মানা হচ্ছে না। সংক্রমণের শঙ্কা থাকলেও ক্রেতা-বিক্রেতাদের কেউই মানছেন না স্বাস্থ্যবিধি।

স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতের বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তরাঞ্চলের সর্ববৃহৎ রাজশাহী সিটি হাটের ইজারাদার আতিকুর রহমান কালু বলেন, ক্রেতা-বিক্রেতাদের সচেতন করতে আমরা বারবার মাইকিং করছি। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলছি। মাস্ক ও স্যানিটাইজার আছে। যে কেউ চাইলেই নিতে পারবে। কিন্তু মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব লক্ষ্য করছি।

সিলেট : ক্রেতার তুলনায় দর্শকই বেশি ছিল সিলেট নগরীর স্থায়ী পশুর হাট কাজিরবাজারে। হাটে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ছোট-বড় বাহারি রংয়ের গরু নিয়ে বসে আছেন পাইকাররা। এছাড়া ভারত ও নেপালি গরুরও সমাগম রয়েছে বাজারে। নির্দেশনা থাকলেও কাজিরবাজারে নেই হাত ধোয়ার কোন ব্যবস্থা। ইজারাদারের পক্ষ থেকেও ছিল না কোন প্রচারণা। এতে হতাশা ব্যক্ত করেছেন সচেতন অনেকেই।

লালমনিরহাট : লালমনিরহাটে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের বিস্তার থেমে নেই। প্রতিদিন লম্বা হচ্ছে আক্রান্তের সঙ্গে মৃত্যুর সারি। এ পরিস্থিতিতে সরকারি বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ায় শহর-গ্রাম সবখানেই স্বাভাবিক চিত্র। অবাধ চলাফেরার সঙ্গে গাদাগাদি করে বসছে পশুর হাট। নির্দেশনা অনুযায়ী হাটে-বাজারে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। কিন্তু লালমনিরহাটে পশুর হাটগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি। মাস্ক ছাড়াই ঘুরে বেড়াচ্ছেন বহু মানুষ। অনেকেই জানেন না সামাজিক দূরত্বের বিষয়টিও। পশুর হাটে হাজারও মানুষের ভিড়ে অসহায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

ইজারাদারের পক্ষ থেকেও নেই কোন সুরক্ষা ব্যবস্থা, প্রবেশপথে রাখা হয়নি হাত ধোয়ার জন্য পানি ও সাবান। নেই শরীরের তাপমাত্রা মাপার যন্ত্রও। স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন করে দিনভর ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগমে তিলঠাঁই ছিল না। হাটজুড়ে শিশু থেকে বৃদ্ধ, সব বয়সী মানুষের ছিল অবাধ সমাগম।

নারায়ণগঞ্জ : নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলায় এবার ১৪টি অস্থায়ী পশুর হাটের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ১৩টি হাটের ইজারা সম্পন্ন হয়েছে। কাক্সিক্ষত দর না পাওয়াতে বাকি আছে একটি। ঈদের তিনদিন আগ থেকে হাট বসানোর অনুমতি দেয়ার কথা থাকলেও উপজেলার বেশ কয়েকটি হাট ইতোমধ্যে বসতে শুরু করেছে। হাটে ক্রেতা-বিক্রেতাদের অনেকেই মানছেন না স্বাস্থ্যবিধি। কোভিড পরিস্থিতিতে হাটে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি রয়েছে উপেক্ষিত। অধিকাংশ হাটের সামনেই নেই জীবাণুনাশক ট্যানেল ব্যবস্থা। হাটে আসা ক্রেতা ও দর্শনার্থীদের অনেকেই মানছেন না স্বাস্থ্যবিধি।

জানতে চাইলে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফা জহুরা সংবাদকে বলেন, ঈদের তিনদিন আগে থেকে হাটের কেনাবেচার অনুমতি দেয়া হয়েছে। সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে হাট পরিচালনার কথা বলা হয়েছে। সবাই সহযোগিতা করলে করোনা পরিস্থিতির মধ্যে সুন্দরভাবে হাট পরিচালনা করা যাবে। তবে কোভিড পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে সরকারি বিধিনিষেধের ব্যত্যয় ঘটলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিয়মিত অভিযান পরিচালনার কথাও জানান তিনি।

বরিশাল : কোরবানিকে সামনে রেখে বরিশাল নগরীতে স্থায়ী একটিসহ তিনটি এবং বরিশাল জেলায় স্থায়ী, অস্থায়ী মিলিয়ে মোট ৬৮টি পশুর হাট বসছে। অবশ্য বরিশাল সদর উপজেলায় আরও চারটি অস্থায়ী পশুর হাট বসানোর অনুমতি দেয়া হয়েছে। গতকাল হাট ঘুরে দেখা গেছে, এখন পর্যন্ত পশুর ক্রেতা-বিক্রেতাদের সংখ্যা কম হলেও তাদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিশেষ কোন আগ্রহ নেই। সবাই ‘আল্লার উপর ভরসা রেখে’ চলছেন। এমনকি ইজারাদারদের যেসব নির্দেশনা পালন করতে বলা হয়েছে তাও তাদের পালন করার আগ্রহ নেই।

জেলা প্রশাসক জসিমউদ্দিন হায়দার বলেন, যারা স্বাস্থ্যবিধি মানবেন না তাদের বিরুদ্ধে মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারে বাধ্য করার জন্য সব উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে বিশেষ টিম কাজ করবে।

সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরায় গরুর হাটে সামাজিক দূরত্ব মানছেন না অধিকাংশ ক্রেতা-বিক্রেতা। এছাড়া গরুহাটে মাস্কবিহীন অবাধে চলাফেরা করায় করোনা সংক্রমণের হার আবারও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এদিকে কোন গরুর হাটে প্রশাসনিক তৎপরতার দেখা মেলেনি।

এ বিষয়ে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. সহিদুল ইসলাম জানান, হাট তদারকির কমিটি রয়েছে। কমিটির লোকজন সরেজমিনে যাচ্ছেনও। কিন্তু কোনভাবেই মানতে বাধ্য করা যাচ্ছে না শারীরিক দূরত্বসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য বিধি।