লকডাউনে কার্ডের মাধ্যমে লেনদেনে রেকর্ড

করোনা সংক্রমণ রোধে ঘোষিত লকডাউনের মধ্যে কেনাকাটায় কার্ডের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় লেনদেনও বেড়েছে। করোনা আসার আগে যে পরিমাণ লেনদেন হতো, এখন তার চেয়ে দেড় গুণ বেশি লেনদেন হচ্ছে কার্ডে। করোনার এ সময়ে শাখায় না গিয়ে কার্ডের মাধ্যমে লেনদেনে উৎসাহিত করছে বেশিরভাগ ব্যাংক। লাইনে দাঁড়ানোর ঝামেলা এড়াতে গ্রাহকরাও এখন ইন্টারনেট ব্যাংকিং ও কার্ডভিত্তিক লেনদেনে ঝুঁকছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত মে মাসে কার্ডের মাধ্যমে রেকর্ড ২৪ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। এর আগে এক মাসে সর্বোচ্চ ২৪ হাজার ১৬১ কোটি টাকা লেনদেনের রেকর্ড ছিল গত মার্চ মাসে। ২০২০ সালের মে মাসে লেনদেন হয়েছিল ১২ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা। গত মে পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর ইস্যু করা মোট কার্ডের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই কোটি ৫৬ লাখ ৭৪ হাজার। আগের বছরের একই মাসে ইস্যু করা মোট কার্ড ছিল দুই কোটি ১৬ লাখ ২৭ হাজার। অর্থাৎ এক বছরে কার্ড বেড়েছে ৪০ লাখ ৪৭ হাজার।

জানা গেছে, বিপুলসংখ্যক এই কার্ডের বেশিরভাগই ডেবিট তথা নিজের জমানো টাকা উত্তোলনের জন্য ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু এ সময়ে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন কমেছে। এখন কার্ডে যে লেনদেন হচ্ছে, তার প্রায় পুরোটাই হচ্ছে দেশে। করোনা আসার আগে কার্ডের ব্যয়ের একটি বড় অংশ হতো দেশের বাইরে। তবে করোনায় বিদেশে ভ্রমণ কমে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেনও বেশ কমে গেছে।

ব্যাংক খাতের কর্মকর্তারা বলছেন, আগে অনেক গ্রাহক কার্ড নিতে চাইতেন না। এখন অনেকে কার্ডে ঝুঁকছেন। করোনার সময়ে প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিংয়ে গ্রাহকদের উৎসাহিত করেছে ব্যাংকগুলো। রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি খাতের সব ব্যাংকই এখন প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। এসব সেবায় যোগ হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম, অনলাইন সিআইবি রিপোর্ট, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, প্রি-পেইড কার্ড, ভিসা কার্ড এবং বিভিন্ন প্রযুক্তির এটিএম। এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে টাকা উত্তোলন ও জমা, রেমিট্যান্স বিতরণ, ইউটিলিটি বিল পরিশোধ ও বেতন-ভাতা প্রদান সবই সম্ভব।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি বছরের মে মাস শেষে ডেবিট কার্ডের গ্রাহক ২ কোটি ৩০ লাখ ৪১ হাজার ২১৪ জন। ২০২০ সালের মে মাসে যা ছিল এক কোটি ৯৪ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ জন। এক বছরে ডেবিট কার্ডের গ্রাহক বেড়েছে প্রায় ৩৫ লাখ ৬৪ হাজার ৮৪৪ জন। কার্ড ব্যবহারকারী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লেনদেনও বেড়েছে। গত বছরের মে মাসে ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন হয় ১১ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা। চলতি মে মাসে সেটা বেড়ে হয়েছে ২২ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ডেবিট কার্ড গ্রাহক দুই কোটির ঘর অতিক্রম করে। বর্তমানে সেটা দুই কোটি ৩০ লাখের বেশি। সে সময় ডেবিট কার্ডে আগে প্রতি মাসে ১৪ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হতো। বর্তমানে ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে ২২ হাজার কোটি টাকার উপরে লেনদেন হচ্ছে।

এদিকে চলতি বছরের এপ্রিল থেকে করোনা আবার মহামারী আকার ধারণ করে। ফলে দফায় দফায় লকডাউন দেয় সরকার। ফলে ঘরে বসেই সব ধরনের সুবিধা নিতে এপ্রিল ও মে মাসে ডেবিট কার্ডের গ্রাহক ও লেনদেন দুটোই বেড়েছে।

তবে ডেবিট কার্ডের লেনদেন যে হারে বেড়েছে সে হারে ক্রেডিট কার্ডের লেনদেন বাড়েনি। ২০২০ সালের মে মাস পর্যন্ত ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক ছিল ১৫ লাখ ৯৮ হাজার ৪৭১ জন, যা চলতি মে মাসে বেড়ে হয়েছে ১৭ লাখ ৫৮ হাজার ৮৮৪ জন। ফলে এক বছরে ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক বেড়েছে প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার ৪১৩ জন। গত মে মাসে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে ৭১৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এ বছর মে মাসে সেটা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৭০৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা। অথচ মার্চেও ক্রেডিট কার্ডে লেনদেনে হয়েছিল ১ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা।

গত বছর লকডাউনে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীদের বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কিছু সুবিধা দেয়া হলেও এ বছর সেটা দেয়া হয়নি। ১৪ এপ্রিল থেকে কঠোর লকডাউনের আগে যখন ৫ থেকে ১২ এপ্রিল পর্যন্ত প্রথমবারের মতো লকডাউন দেয়া হয়, সে সময় বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রেডিট কার্ডধারীদের বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দেয়ার নীতি গ্রহণ করেছিল। কিন্তু ১২ এপ্রিলের এরপরে সেটা আর কার্যকর হয়নি। ক্রেডিট কার্ডের বিল সময়মতো দিতে না পারলে জরিমানার পাশাপাশি অনেক বেশি হারে সুদ দিতে হয়। ব্যাংকে সুদহার ৯ শতাংশ হলেও কার্ডের সুদ ২০ শতাংশ পর্যন্ত আছে।

এর আগে ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া অন্য সব ঋণে সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মানে ক্রেডিট কার্ডে সর্বোচ্চ সুদ হওয়ার কথা ১৪ শতাংশ। তবে এই নির্দেশনাও অমান্য করে অনেক ব্যাংকই বিভিন্নভাবে এর চেয়ে বেশি টাকা আদায় করত। ফলে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে কোন ব্যাংক ক্রেডিট কার্ডে ২০ শতাংশের বেশি সুদ নিতে পারবে না বলে নতুন নির্দেশনা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এটি ওই বছর ১ অক্টোবর থেকে কার্যকর হয়।

শনিবার, ২৪ জুলাই ২০২১ , ৮ শ্রাবন ১৪২৮ ১২ জিলহজ ১৪৪২

লকডাউনে কার্ডের মাধ্যমে লেনদেনে রেকর্ড

অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক

image

করোনা সংক্রমণ রোধে ঘোষিত লকডাউনের মধ্যে কেনাকাটায় কার্ডের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় লেনদেনও বেড়েছে। করোনা আসার আগে যে পরিমাণ লেনদেন হতো, এখন তার চেয়ে দেড় গুণ বেশি লেনদেন হচ্ছে কার্ডে। করোনার এ সময়ে শাখায় না গিয়ে কার্ডের মাধ্যমে লেনদেনে উৎসাহিত করছে বেশিরভাগ ব্যাংক। লাইনে দাঁড়ানোর ঝামেলা এড়াতে গ্রাহকরাও এখন ইন্টারনেট ব্যাংকিং ও কার্ডভিত্তিক লেনদেনে ঝুঁকছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত মে মাসে কার্ডের মাধ্যমে রেকর্ড ২৪ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। এর আগে এক মাসে সর্বোচ্চ ২৪ হাজার ১৬১ কোটি টাকা লেনদেনের রেকর্ড ছিল গত মার্চ মাসে। ২০২০ সালের মে মাসে লেনদেন হয়েছিল ১২ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা। গত মে পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর ইস্যু করা মোট কার্ডের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই কোটি ৫৬ লাখ ৭৪ হাজার। আগের বছরের একই মাসে ইস্যু করা মোট কার্ড ছিল দুই কোটি ১৬ লাখ ২৭ হাজার। অর্থাৎ এক বছরে কার্ড বেড়েছে ৪০ লাখ ৪৭ হাজার।

জানা গেছে, বিপুলসংখ্যক এই কার্ডের বেশিরভাগই ডেবিট তথা নিজের জমানো টাকা উত্তোলনের জন্য ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু এ সময়ে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন কমেছে। এখন কার্ডে যে লেনদেন হচ্ছে, তার প্রায় পুরোটাই হচ্ছে দেশে। করোনা আসার আগে কার্ডের ব্যয়ের একটি বড় অংশ হতো দেশের বাইরে। তবে করোনায় বিদেশে ভ্রমণ কমে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেনও বেশ কমে গেছে।

ব্যাংক খাতের কর্মকর্তারা বলছেন, আগে অনেক গ্রাহক কার্ড নিতে চাইতেন না। এখন অনেকে কার্ডে ঝুঁকছেন। করোনার সময়ে প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিংয়ে গ্রাহকদের উৎসাহিত করেছে ব্যাংকগুলো। রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি খাতের সব ব্যাংকই এখন প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। এসব সেবায় যোগ হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম, অনলাইন সিআইবি রিপোর্ট, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, প্রি-পেইড কার্ড, ভিসা কার্ড এবং বিভিন্ন প্রযুক্তির এটিএম। এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে টাকা উত্তোলন ও জমা, রেমিট্যান্স বিতরণ, ইউটিলিটি বিল পরিশোধ ও বেতন-ভাতা প্রদান সবই সম্ভব।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি বছরের মে মাস শেষে ডেবিট কার্ডের গ্রাহক ২ কোটি ৩০ লাখ ৪১ হাজার ২১৪ জন। ২০২০ সালের মে মাসে যা ছিল এক কোটি ৯৪ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ জন। এক বছরে ডেবিট কার্ডের গ্রাহক বেড়েছে প্রায় ৩৫ লাখ ৬৪ হাজার ৮৪৪ জন। কার্ড ব্যবহারকারী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লেনদেনও বেড়েছে। গত বছরের মে মাসে ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন হয় ১১ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা। চলতি মে মাসে সেটা বেড়ে হয়েছে ২২ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ডেবিট কার্ড গ্রাহক দুই কোটির ঘর অতিক্রম করে। বর্তমানে সেটা দুই কোটি ৩০ লাখের বেশি। সে সময় ডেবিট কার্ডে আগে প্রতি মাসে ১৪ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হতো। বর্তমানে ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে ২২ হাজার কোটি টাকার উপরে লেনদেন হচ্ছে।

এদিকে চলতি বছরের এপ্রিল থেকে করোনা আবার মহামারী আকার ধারণ করে। ফলে দফায় দফায় লকডাউন দেয় সরকার। ফলে ঘরে বসেই সব ধরনের সুবিধা নিতে এপ্রিল ও মে মাসে ডেবিট কার্ডের গ্রাহক ও লেনদেন দুটোই বেড়েছে।

তবে ডেবিট কার্ডের লেনদেন যে হারে বেড়েছে সে হারে ক্রেডিট কার্ডের লেনদেন বাড়েনি। ২০২০ সালের মে মাস পর্যন্ত ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক ছিল ১৫ লাখ ৯৮ হাজার ৪৭১ জন, যা চলতি মে মাসে বেড়ে হয়েছে ১৭ লাখ ৫৮ হাজার ৮৮৪ জন। ফলে এক বছরে ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক বেড়েছে প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার ৪১৩ জন। গত মে মাসে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে ৭১৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এ বছর মে মাসে সেটা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৭০৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা। অথচ মার্চেও ক্রেডিট কার্ডে লেনদেনে হয়েছিল ১ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা।

গত বছর লকডাউনে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীদের বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কিছু সুবিধা দেয়া হলেও এ বছর সেটা দেয়া হয়নি। ১৪ এপ্রিল থেকে কঠোর লকডাউনের আগে যখন ৫ থেকে ১২ এপ্রিল পর্যন্ত প্রথমবারের মতো লকডাউন দেয়া হয়, সে সময় বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রেডিট কার্ডধারীদের বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দেয়ার নীতি গ্রহণ করেছিল। কিন্তু ১২ এপ্রিলের এরপরে সেটা আর কার্যকর হয়নি। ক্রেডিট কার্ডের বিল সময়মতো দিতে না পারলে জরিমানার পাশাপাশি অনেক বেশি হারে সুদ দিতে হয়। ব্যাংকে সুদহার ৯ শতাংশ হলেও কার্ডের সুদ ২০ শতাংশ পর্যন্ত আছে।

এর আগে ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া অন্য সব ঋণে সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মানে ক্রেডিট কার্ডে সর্বোচ্চ সুদ হওয়ার কথা ১৪ শতাংশ। তবে এই নির্দেশনাও অমান্য করে অনেক ব্যাংকই বিভিন্নভাবে এর চেয়ে বেশি টাকা আদায় করত। ফলে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে কোন ব্যাংক ক্রেডিট কার্ডে ২০ শতাংশের বেশি সুদ নিতে পারবে না বলে নতুন নির্দেশনা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এটি ওই বছর ১ অক্টোবর থেকে কার্যকর হয়।