কাক্সিক্ষত ইলিশ না পেয়ে হতাশা নিয়ে ঘাটে ফিরছেন জেলেরা

২৭ সেপ্টেম্বর সোমবার বিকেল সাড়ে ৪টা। সন্দ্বীপ চ্যানেলের গভীর সমুদ্র থেকে ইঞ্জিনচালিত বোট নিয়ে কুমিরা ঘাটে ফিরেন সুমন জল দাশ। ইলিশের আশায় তিনজন জেলে নিয়ে জীবন বাজি রেখে গভীর সমুদ্রে গিয়েছিলেন তিনি। তবে কাক্সিক্ষত ইলিশ না পেয়ে একরাশ হতাশা নিয়ে ঘাটে ফিরেছেন তিনি। শুধু সুমন জল দাশ নন, ইলিশের ভরা মৌসুমে খালি হাতে ঘরে ফেরেন সবুজ জল দাশ, পাপন জল দাশ, হরেন্দ্র জল দাশ, লক্ষণ জল দাশ, বাঞ্চারাম ও নিমাই জল দাসসহ দশজন জেলে। নৌকাভর্তি ইলিশ মাছ ধরে রাজ্যের সব আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফেরার আশায় তারা সকলে সাগরে গিয়েছিলেন। কিন্তু সাগরে ইলিশের দেখা না পেয়ে একরাশ হতাশা নিয়ে ফিরে এসেছেন তারা। সুমন জল দাশ জানান, দুপুরে তিনজন জেলে নিয়ে ইলিশ ধরতে সাগর গেলেও সামান্য ইলিশ আর হতাশা নিয়ে ফিরেছেন তিনি। সাগর থেকে আনা ইলিশ পাইকারের কাছে এক হাজার আটশ টাকায় বিক্রি করেছেন। তার বিক্রিত ইলিশের দাম দিয়ে পরিশোধ করেছেন তিন জেলের বেতন ও জ্বালানি তেলের দাম। তিনি আরও জানান, ইলিশের মৌসুমে মাসিক ২৫ হাজার টাকা বেতনে চারজন জেলে রাখেন তিনি। জেলেদের খাওয়া-দাওয়া ব্যবস্থা করাসহ ইলিশ মৌসুমে দেড় লাখ টাকা খরচ হয়। এর বাইরে জাল, নৌকা, জ্বালানিসহ আনুষঙ্গিক খরচ হয় আরও দুই লাখ টাকা। সব মিলিয়ে ইলিশ মৌসুমে তার সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ হলেও এখন পর্যন্ত অর্ধলাখ টাকা উপার্জন করতে পারেননি তিনি। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্যনুসারে, সীতাকুণ্ডের জেলেরা সন্দ্বীপ চ্যানেলের সাগর থেকে ২০২০ সালে মৌসুমের শুরু থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ১২৫ দশমিক ৫০ মেট্রিক টন ইলিশ ধরেছেন। কিন্তু চলতি বছরের একই সময়ে মাত্র ৩৭৩ মেট্রিক টন ইলিশ ধরেছেন তারা। উত্তর চট্টলা উপকূলীয় মৎস্যজীবী জলদাস সমবায় কল্যাণ ফেডারেশনের সভাপতি লিটন জল দাশ জানান, চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গা থেকে সীতাকুণ্ডের সৈয়দপুর পর্যন্ত সাগর উপকূলীয় এলাকার বসবাস করা ৫৩ হাজার জেলে পরিবার সাগরে মাছ ধরার সঙ্গে সম্পৃক্ত। ইলিশ কম ধরা পড়ায় বিপাকে পড়েছে এসব জেলে পরিবার।

অনেকে দেনা পরিশোধ করতেও পারেননি। আগামী ‘জো’তে ইলিশ ধরতে পারলে ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে পারতেন। জেলেরা জানান, জেলেদের বাৎসরিক আয়ের উৎস হলো ইলিশ মৌসুম। তবে পুঁজি না থাকায় মহাজন-আড়তদারের কাছ থেকে উপজেলার ৭৫ শতাংশ জেলে বিশেষ শর্তে ঋণ নেন। ঋণের টাকায় ইলিশ ধরার যাবতীয় উপকরণ সংগ্রহ করে সমুদ্রে পাড়ি জমান। সাগরে ইলিশ আহরণের মাধ্যমে ঋণের টাকা পরিশেধের স্বপ্ন দেখলেও ইলিশ শূণ্য হাতে ফিরে হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছেন। এতে ভরা মৌসুমেও জেলে পরিবারগুলোতে নীরব দুর্ভিক্ষ চলছে। উপজেলার ভাটিয়ারী, কুমিরা, জোরামতল, বাড়বকুণ্ড, পৌরসদরের মোহন্তের হাট বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাজারে গুটি কয়েক ব্যবসায়ী ছোট টুকরিতে করে ইলিশ বিক্রি করছে।

ব্যবসায়ীদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের দাম প্রতি কেজি ২৫০ টাকার বেশি। গত বছর এই আকারের ইলিশ খুচরা বাজারে বিক্রি হয়েছিল ৮০-১০০ টাকায়। এ বছর বড় ইলিশ তেমন দেখা যাচ্ছে না। ৪০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৪০০-৫০০ টাকায়, ৭০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৬০০-৮০০ টাকায়। এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৯০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকায়। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা শামীম আহমেদ জানান, সন্দ্বীপ চ্যানেলে এবার ইলিশ কিছুটা কম ধরা পড়েছে। উজান থেকে মিঠাপানির সঙ্কট ও শিল্পকারখানার বর্জ্যরে কারণে এমনটা হয়েছে বলে তার ধারণা করছি। সাগরের পানিতে ভাসমান বর্জ্য ও তেলের কারনে পানিতে সূর্য রশ্মি প্রবেশ করতে পারে না। এতে সামুদ্রিক মাছ ও অন্যান্য জলজ উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। যার ফলে এখানে আগের মতো ইলিশ পাওয়া যায়না।

বৃহস্পতিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১ , ১৫ আশ্বিন ১৪২৮ ২১ সফর ১৪৪৩

কাক্সিক্ষত ইলিশ না পেয়ে হতাশা নিয়ে ঘাটে ফিরছেন জেলেরা

প্রতিনিধি, সীতাকুণ্ড (চট্টগ্রাম)

image

সীতাকুণ্ড (চট্টগ্রাম) : কম ইলিশ নিয়ে ফেরায় ঘাটে স্বজনদের সঙ্গে হতাশ জেলেদের ভিড়, ইনসেট সংগৃহীত ইলিশ -সংবাদ

২৭ সেপ্টেম্বর সোমবার বিকেল সাড়ে ৪টা। সন্দ্বীপ চ্যানেলের গভীর সমুদ্র থেকে ইঞ্জিনচালিত বোট নিয়ে কুমিরা ঘাটে ফিরেন সুমন জল দাশ। ইলিশের আশায় তিনজন জেলে নিয়ে জীবন বাজি রেখে গভীর সমুদ্রে গিয়েছিলেন তিনি। তবে কাক্সিক্ষত ইলিশ না পেয়ে একরাশ হতাশা নিয়ে ঘাটে ফিরেছেন তিনি। শুধু সুমন জল দাশ নন, ইলিশের ভরা মৌসুমে খালি হাতে ঘরে ফেরেন সবুজ জল দাশ, পাপন জল দাশ, হরেন্দ্র জল দাশ, লক্ষণ জল দাশ, বাঞ্চারাম ও নিমাই জল দাসসহ দশজন জেলে। নৌকাভর্তি ইলিশ মাছ ধরে রাজ্যের সব আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফেরার আশায় তারা সকলে সাগরে গিয়েছিলেন। কিন্তু সাগরে ইলিশের দেখা না পেয়ে একরাশ হতাশা নিয়ে ফিরে এসেছেন তারা। সুমন জল দাশ জানান, দুপুরে তিনজন জেলে নিয়ে ইলিশ ধরতে সাগর গেলেও সামান্য ইলিশ আর হতাশা নিয়ে ফিরেছেন তিনি। সাগর থেকে আনা ইলিশ পাইকারের কাছে এক হাজার আটশ টাকায় বিক্রি করেছেন। তার বিক্রিত ইলিশের দাম দিয়ে পরিশোধ করেছেন তিন জেলের বেতন ও জ্বালানি তেলের দাম। তিনি আরও জানান, ইলিশের মৌসুমে মাসিক ২৫ হাজার টাকা বেতনে চারজন জেলে রাখেন তিনি। জেলেদের খাওয়া-দাওয়া ব্যবস্থা করাসহ ইলিশ মৌসুমে দেড় লাখ টাকা খরচ হয়। এর বাইরে জাল, নৌকা, জ্বালানিসহ আনুষঙ্গিক খরচ হয় আরও দুই লাখ টাকা। সব মিলিয়ে ইলিশ মৌসুমে তার সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ হলেও এখন পর্যন্ত অর্ধলাখ টাকা উপার্জন করতে পারেননি তিনি। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্যনুসারে, সীতাকুণ্ডের জেলেরা সন্দ্বীপ চ্যানেলের সাগর থেকে ২০২০ সালে মৌসুমের শুরু থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ১২৫ দশমিক ৫০ মেট্রিক টন ইলিশ ধরেছেন। কিন্তু চলতি বছরের একই সময়ে মাত্র ৩৭৩ মেট্রিক টন ইলিশ ধরেছেন তারা। উত্তর চট্টলা উপকূলীয় মৎস্যজীবী জলদাস সমবায় কল্যাণ ফেডারেশনের সভাপতি লিটন জল দাশ জানান, চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গা থেকে সীতাকুণ্ডের সৈয়দপুর পর্যন্ত সাগর উপকূলীয় এলাকার বসবাস করা ৫৩ হাজার জেলে পরিবার সাগরে মাছ ধরার সঙ্গে সম্পৃক্ত। ইলিশ কম ধরা পড়ায় বিপাকে পড়েছে এসব জেলে পরিবার।

অনেকে দেনা পরিশোধ করতেও পারেননি। আগামী ‘জো’তে ইলিশ ধরতে পারলে ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে পারতেন। জেলেরা জানান, জেলেদের বাৎসরিক আয়ের উৎস হলো ইলিশ মৌসুম। তবে পুঁজি না থাকায় মহাজন-আড়তদারের কাছ থেকে উপজেলার ৭৫ শতাংশ জেলে বিশেষ শর্তে ঋণ নেন। ঋণের টাকায় ইলিশ ধরার যাবতীয় উপকরণ সংগ্রহ করে সমুদ্রে পাড়ি জমান। সাগরে ইলিশ আহরণের মাধ্যমে ঋণের টাকা পরিশেধের স্বপ্ন দেখলেও ইলিশ শূণ্য হাতে ফিরে হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছেন। এতে ভরা মৌসুমেও জেলে পরিবারগুলোতে নীরব দুর্ভিক্ষ চলছে। উপজেলার ভাটিয়ারী, কুমিরা, জোরামতল, বাড়বকুণ্ড, পৌরসদরের মোহন্তের হাট বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাজারে গুটি কয়েক ব্যবসায়ী ছোট টুকরিতে করে ইলিশ বিক্রি করছে।

ব্যবসায়ীদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের দাম প্রতি কেজি ২৫০ টাকার বেশি। গত বছর এই আকারের ইলিশ খুচরা বাজারে বিক্রি হয়েছিল ৮০-১০০ টাকায়। এ বছর বড় ইলিশ তেমন দেখা যাচ্ছে না। ৪০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৪০০-৫০০ টাকায়, ৭০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৬০০-৮০০ টাকায়। এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৯০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকায়। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা শামীম আহমেদ জানান, সন্দ্বীপ চ্যানেলে এবার ইলিশ কিছুটা কম ধরা পড়েছে। উজান থেকে মিঠাপানির সঙ্কট ও শিল্পকারখানার বর্জ্যরে কারণে এমনটা হয়েছে বলে তার ধারণা করছি। সাগরের পানিতে ভাসমান বর্জ্য ও তেলের কারনে পানিতে সূর্য রশ্মি প্রবেশ করতে পারে না। এতে সামুদ্রিক মাছ ও অন্যান্য জলজ উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। যার ফলে এখানে আগের মতো ইলিশ পাওয়া যায়না।